প্রকল্পের নামে পাহাড়ে-সমতলে চলছে জমি দখল: আদিবাসী ফোরাম

“নানামুখী আগ্রাসনে আদিবাসী জীবন আজ প্রান্তিকতার শেষ কিনারায় উপনীত হয়েছে,” বলা হয়েছে লিখিত বক্তব্যে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2023, 12:10 PM
Updated : 28 April 2023, 12:10 PM

উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পাহাড় ও সমতলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জমি দখল চলছে অভিযোগ করে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বসবাসকারী নৃ গোষ্ঠীগুলোর মোর্চা ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’। 

একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার অনুরোধ ছাড়াও বাঙালিদের সঙ্গে ‘সেতুবন্ধন রচনার’ প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেছে সংগঠনটি। 

শুক্রবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ফোরামের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন শুরু হয়। গণসংগীত ও জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরুর পর মাদলের ধ্বনীতে হয় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। 

দুই দিনের এই সম্মেলনে মোট ১২ দফা দাবি তুলে ধরেছে আদিবাসী ফোরাম। আদিবাসী অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামকে নবউদ্যমে উজ্জীবিত করার প্রত্যয়ের কথাও বলা হয়। 

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বান্দরবানের লামা উপেজলায় ম্রো এবং ত্রিপুরাদের ভূমি দখল, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের আক্রমণ, মধুপুরে বনায়ন ও কৃত্রিম লেক খনন প্রকল্পের নামে আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের অপচেষ্টা চলছে। 

বরগুনা ও পটুয়াখালী অঞ্চলের রাখাইনদের মন্দিরসহ শ্মশানভূমি দখল, সিলেটে ভূমি থেকে খাসিয়াদের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র চলছে বলেও অভিযোগ করা হয়। 

‘আগ্রাসনে আদিবাসী জীবন এখন প্রান্তিকতায়’ 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত ৪০ লাখের বেশি আদিবাসী জনগণ নানা শোষণ ও বৈষম্যের শিকার অভিযোগ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “এই দীর্ঘ সময়ে আদিবাসী জনগণ তাদের ভূমির অধিকার হারিয়েছে। 

“বনায়ন, পর্যটন, রাবার বাগান ও উন্নয়নের নামে অব্যাহতভাবে আদিবাসীদের ভূমি দখল চলছে। সব মিলিয়ে নানামুখী আগ্রাসনে আদিবাসী জীবন আজ প্রান্তিকতার শেষ কিনারায় উপনীত হয়েছে।” 

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, সে কথা তুলে ধরে বলা হয়, “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন এখনও অকার্যকর। অন্যদিকে দেশের সমতল অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনগণের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনে প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার বাস্তবায়ন করেনি।” 

সংবিধানে ‘আদিবাসী’র স্বীকৃতির দাবিও উঠে আসে লিখিত বক্তব্যে। বলা হয়, বাঙালি জাতি ছাড়াও স্মরণাতীত কাল থেকে এদেশে আদিবাসী জাতিগুলো তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রথা ও রীতি-নীতি, স্বতন্ত্র মূল্যবোধ নিয়ে বসবাস করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধেও তাদের ছিল গৌরবোজ্জ্বল অবদান। 

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের সময় তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও সেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। 

বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ছাড়াও গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজকে এই ‘ন্যায়ভিত্তিক সংগ্রামে’ একাত্ম হওয়ার আহ্বানও জানানো হয় সম্মেলনে। 

‘আমরা চাই সেতুবন্ধন’ 

শুভেচ্ছা বক্তব্যে ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “আদিবাসীদের সঙ্গে বাঙালির সেতুবন্ধন রচিত হোক। আমরা একসঙ্গে পথ চলতে চাই। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আমরাও একসঙ্গে পথ হাঁটতে চাই। 

“বাঙালিদের সঙ্গে হাত ধরে একসঙ্গে পথ চলার অঙ্গীকার। থাকবে পরস্পরকে শ্রদ্ধা।” 

‘মানবিকতা, ভালোবাসা’ দিয়ে নৃ গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি নীতিমালা করারও দাবি জানান তিনি। 

সভাপতির বক্তব্যে ফোরামের সভাপতি জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, “বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইকে এগিয়ে নিতে হবে। পাহাড়ে কিংবা সমতলে বসবাসরত আদিবাসীদের নানা রকম সংকট উঠে এসেছে সবার আলোচনায়। সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সবাইকেই ভূমিকা রাখতে হবে।” 

প্রয়াত রাজনীতিক পঙ্গজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সন্তু লারমা। তিনি বলেন, “আরও কিছুদিন তার বেঁচে থাকাটা খুব দরকার ছিল আমাদের জন্য। জন্ম হলে মরতে হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবুও তাকে আজ ভীষণ মনে পড়ছে।”

সংবিধানে আদিবাসী না থাকা লজ্জার: মেনন  

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “সংবিধানে আদিবাসীদেরকে আমাদের অংশ করে নিতে পারিনি। এটা আমাদের জাতীয় জীবনের লজ্জা। যখনই সংবিধান সংশোধনের প্রশ্ন আসে তখনই আমরা হোঁচট খেয়েছি। আদিবাসীদের আমরা এখনও জাতীয় গণতান্ত্রিক চর্চার অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি।” 

বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি ছাড়াও বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ‘উপজাতি’ ও ‘ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী’ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। যদিও এসব জাতিগোষ্ঠী নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের দাবি জানিয়ে আসছিল। 

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, “আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে ভাগ করাও এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে বাংলাদেশকে গড়েছি, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার স্থান হবে না।” 

সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সুরক্ষায় আইন করার দাবিও জানান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট শরিক এই নেতা। 

তিনি বলেন, “এই আইনের বলে রাষ্ট্রের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে, যে সেতু দিয়ে সংখ্যালঘুরা তার অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রের কাছে যেতে পারে।” 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, “৭২ এর সংবিধানের অনেক প্রশংসা করি। কিন্তু সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সংবিধানকে প্রশ্ন করে আমাদের অধিকারের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে।” 

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অভাব আমাদের মূলধারার রাজনীবিদদেরও গ্রাস করেছে। আদিবাসীদের অনেক কবি আছেন। বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চা হয়। আমাদের রাজনীতিবিদের কজন সেই কবিতা পড়েন? এখন লুটপাটের এক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আদিবাসীদের উপর নিপীড়নের পেছনেও কিন্তু লুটপাট।” 

নারী নেত্রী খুশি কবির বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত এই দেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই দেশের মুক্তি হবে না।” 

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিবিবির সভাপতি রুহিন হোসেন প্রিন্স, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, পরিবেশ আইনজীবী সমিতি বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আদিবাসী ফোরামের নারী বিষয়ক সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং, ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক চাইথোয়াই মারমা, সংগঠনের সহসভাপতি অজয় এ মৃ, রবীন্দ্রনাথ সরেন, জাতীয় কমিটির সদস্য কৃষ্ণপদ মুণ্ডাও এ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। 

১২ দাবি 

এই সম্মেলনে আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে যেসব দাবি তুলে ধরা হয় সেগুলো হলো– 

# আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। 

# আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। 

# আদিবাসীদের প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত ভূমির অধিকারের আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে।  

# সময়সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা পূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। 

# পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। 

# সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। 

# আদিবাসী নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। 

# আদিবাসীদের ভূমিতে তাদের পূর্ব সম্মতি ছাড়া ইকোপার্ক, সামাজিক বনায়ন, ট্যুরিজম, ইপিজেড বা অন্য কোন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যাবে না। 

# আদিবাসীদের উপর সব নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধসহ সকল মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।  

# জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহিত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুসমর্থন এবং আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন করতে হবে। 

# জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকার পরিষদে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ করতে হবে।

এবং 

# প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে আদিবাসী কোটা পুনর্বহাল করতে হবে এবং অন্যান্য চাকরিতে কোটা নিশ্চিত করতে হবে।