মুক্তিযুদ্ধে দুই ‘ভিনদেশী’ বাংলাদেশের বীর

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 Sept 2021, 07:27 PM
Updated : 25 Sept 2021, 07:27 PM

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী দু'জন 'ভিনদেশী' বীরের কথা বলব, যাদের শেকড় বাংলাদেশের গভীরে প্রোথিত– একজন দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, অন্যজন অশোক সেনগুপ্ত। প্রথমজনের জন্ম কুমিল্লা শহরে, তবে আদি নিবাস ছিল মানিকগঞ্জের বেউথা গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় জনের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামে, দাশের বাড়ি সংলগ্ন 'দুহি সেনের বাড়ি'। অন্যদিকে, দিলীপ সেনগুপ্তের সঙ্গে এই গৈলা গ্রামেরই বন্ধন তৈরি হয় বৈবাহিক সূত্রে। তিনি বিয়ে করেন 'গৈলা দাশের বাড়ি', মেধাবী সবিতা দাশগুপ্তকে।

গৈলা গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এ দু'জন পরস্পরকে দেখেননি। তবে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ তাদেরকে 'মাতৃভূমিতে' নিয়ে এসেছিল এবং কাকতালীয়ভাবে দু'জনেরই কাজের সঙ্গেই 'আকাশ' জড়িত। দিলীপকুমার সেনগুপ্ত সে সময় কাজ করতেন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে। ইংল্যান্ডের বিবিসি ও ভারতের দূরদর্শনের সাবেক কর্মকর্তা ও কবি পঙ্কজ সাহা 'দূর দর্শনের স্মৃতি– স্মৃতির মধ্যে তিনি' লেখায় স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে– 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রণবেশ সেন, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় এবং উপেন তরফদার যে অসাধারণভাবে কাজ করতে পেরেছিলেন এবং আজ যা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে আমার মনে হয় তার পেছনে দিলীপকুমার সেনগুপ্তের অভিভাবকত্ব এবং সেই সময়ের আকাশবাণীতে ওরকম যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে।'

১৯৭৩ সালে দিলীপকুমার সেনগুপ্ত বাংলাদেশের এসেছিলেন আকাশবাণীর একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যেসব অনুষ্ঠান হয়েছিল, তার কয়েক ট্রাঙ্ক ভর্তি টেপ তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে।

দিলীপকুমার সেনগুপ্ত যেসব টেপ বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন, ইতিহাসের অমূল্য সেই স্মারক বাংলাদেশের কোথাও কি সংরক্ষিত আছে?

আকাশে ভেসে আসা কথা-সুর ধরা পড়ে বেতার যন্ত্রে, বহু বছর এটা ছিল পরম বিস্ময়ের। দিলীপকুমার সেনগুপ্ত আকাশবাণীতে চাকরির আগে অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর ঢাকা কেন্দ্রে চাকরি করেছেন ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে। পরে যুক্ত হয়েছেন ভারতের নানা বেতার কেন্দ্রে। কিন্তু নিঃসন্দেহে তার কর্মজীবনের সেরা সময় ১৯৭১। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা অভিযান শুরুর পরপরই পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় শরণার্থীর ঢল নামে। ওই রাতে গ্রেফতার হওয়ার ঠিক আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। আকাশবাণী বেতার কেবল খবরের উৎস নয়, হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকমী মানুষের অন্যতম নির্ভরতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা নতুনভাবে সংগঠিত ও সশস্ত্র হতে শুরু করেছে এবং ভারতের ভূখণ্ড এসব কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র– বাংলাদেশের জনগণ এ সব জানতে পারে এ বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। দিলীপকুমার সেনগুপ্ত তখন এ প্রতিষ্ঠানের মধ্যমণি।

'মুজিবনগরকে' কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত হচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কাজ শুরু করেছে। এ কেন্দ্রের প্রতিটি শাখা স্বয়ংসম্পূর্ণ– খবর, নাটক, কথিকা, কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীত, হাস্য-কৌতুক– একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রে যা যা অনুষ্ঠান থাকা উচিত সব রয়েছে এতে। আরও বিস্ময়ের ছিল যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্প-কলা-কুশলী সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী। সময় ছিল ভয়ঙ্কর। যেকোনো সময় হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে মৃত্যু হতে পারে। এ বিপদের মধ্যে শত শত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এ সব শিল্পী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে হাজির হয়েছিল। আকাশবাণী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতি সব ধরনের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী শাহীন সামাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আকাশবাণীতে বাংলাদেশে শিল্পীদের অনুষ্ঠান করার সুযোগ দেওয়া হতো। তিনি প্রথমবার গান গেয়ে পেয়েছিলেন ১০০ টাকা। রথীন রায় স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে– 'যে দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে হাজির হই, আগে যারা সেখানে গিয়েছেন, সবাই স্বাগত জানাতে হাজির। তারা বলছেন– তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।'

১৯৭১ সালের ১৪ অগাস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিন মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডোরা একযোগে চট্টগ্রাম, মোংলা এবং চাঁদপুরসহ কয়েকটি নৌ বন্দরে একযোগে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিপুল সংখ্যক জাহাজ ও লঞ্চ ডুবিয়ে দেবে– এ পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। নৌ কমান্ডোরা এ জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় প্রস্তুত। আক্রমণের সংকেত মিলবে কীভাবে? এগিয়ে এলো আকাশবাণী এবং বিশেষভাবে দিলীপকুমার সেনগুপ্ত। ঠিক হয় আকাশবাণী-খ কেন্দ্র থেকে খ্যাতিমান শিল্পী সন্ধ্যা মুখার্জির দুটি গান পর পর দু'দিন বাজানো হবে– প্রথমটি অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতির এবং দ্বিতীয়টি হামলার সংকেত। বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল।

দিলীপকুমার সেনগুপ্ত ইন্দিরা গান্ধীর পছন্দের লোক ছিলেন। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভায় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার দফতরের দায়িত্বে। বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রের পরিচালকদের সভায় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত প্রদানের আগে তিনি দিলীপকুমার সেনগুপ্তের মতামত জানতে চাইতেন। বেতার কেন্দ্রের কী করতে হবে, এ প্রশ্নে একবার তিনি বলেই ফেললেন– 'Do what Sengupta does.'

বৈবাহিকসূত্রে দিলীপকুমার সেনগুপ্ত আমাদের গৈলা দাশের বাড়ির পরিবারে যুক্ত হয়েছিলেন। আমরা তিন ভাই এবং বড় বোনের স্বামী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। আমার বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমার মা রেনুকা দাশগুপ্তা 'মুক্তিযোদ্ধার মা' হিসেবে সম্মানের আসনে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচারে অগাস্ট মাসের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা আমার মা-বাবা-বোনদের পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দেন। এ সময়ে দিলীপকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তিনি উচ্ছসিত– শ্বশুরবাড়ির চারজন সদস্য রনাঙ্গনের যোদ্ধা। নিজের কথা বলেন এভাবে– 'আমি নিজেকেও মনে করি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে।' তখন কুমিল্লার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনার সময়ে জগন্নাথ হলের মিলনায়তনে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথাও বলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ অবদানের জন্য তাকে পদ্মশ্রী খেতাব দিয়েছিল ভারত সরকার। তবে একটি দুঃখ তাকে আমৃত্যু পীড়া দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করে। ওই অবিস্মরণীয় সময়ে রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর আকাশবাণী কেন্দ্রের হেড অব নিউজ দ্বীপেশ চন্দ্র ভৌমিক। তিনি ঢাকা থেকে দ্রুত হেলিকপ্টারে চেপে আগরতলা গিয়ে কলকাতায় আকাশবাণীর প্রধান দিলীপকুমার সেনগুপ্তকে এ আনন্দের সংবাদ দেন। কিন্তু সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান আকাশবাণী। তাই নিয়ম অনুযায়ী দিলীপকুমার সেনগুপ্ত সঙ্গে সঙ্গে তা প্রচার করতে পারেননি, তিনি অনুমতি চেয়ে পাঠান দিল্লিতে। এ অনুমতি আসতে আসতে বিবিসি খবরটি ব্রেক করে দেয়, স্কুপ নিউজ করে ফেলে।

অশোক সেনগুপ্ত ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর হান্টার যুদ্ধবিমান নিয়ে বার বার হানা দেন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নানা লক্ষ্যবস্তুতে। ভূপৃষ্ঠে বোমা ফেলেছেন, অন্য বিমান লক্ষ্য করে গুলি করেছেন। বর্তমানে পাঞ্জাবে বসবাস করছেন তিনি। টেলিফোনে আমাকে বলেন বাংলাদেশ মুক্ত করার অভিযানে অংশ নিয়ে কী যে আনন্দ পেয়েছি, তা কাউকে বোঝাতে পারব না। মনে হয়েছে– আমার নিজের ভূখণ্ড, আমার স্বজনরা শত্রুকবলিত– তাদের মুক্ত করতে হবে। তার ফেলা বোমায় ঢাকা বিমানবন্দরে বড় পুকুরের মতো গর্ত হয়েছিল– সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন শত্রু বিমান যেন ওড়ার জন্য রানওয়ে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্যই এটা করা হয়। প্রথম দিনের অভিযানেই পাকিস্তানি বিমান বাহিনী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এরপর ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং মাত্র মাস খানেক আগে গঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো অবাধে উড়েছে ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্য শহর ও সবুজ-শ্যামল গ্রামের ওপর দিয়ে। নিচু দিয়ে ওড়ার সময় দেখেছেন ঢাকার বিভিন্ন বাড়ির ছাদের ওপর উঠে নারী-পুরুষ-শিশু উল্লাসধ্বনি করছে, করতালি দিচ্ছে। বিশ্বের আর কোথাও বিমান বাহিনীর অভিযানের সময় এমনটি ঘটেছে কি?

অশোক সেনগুপ্ত ১৯৬১ সালে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোগ দেন, অবসর নেন ১৯৯৭ সালে।

জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে পারা– এভাবেই বললেন বরিশালের গৈলা গ্রামের কৃতী সন্তান।

'Bangladesh Liberation War Honour' and 'Friends of Liberation War Honour'– মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশ এভাবে সম্মানিত করেছে। দিলীপকুমার সেনগুপ্ত ও অশোক সেনগুপ্ত এখন পর্যন্ত এ তালিকায় নেই। এ সম্মানের জন্য তারা যোগ্য, সন্দেহ নেই। তবে কেউ প্রশ্ন করতেই পারে– তারা কি 'ভিনদেশী' হিসেবে বিবেচিত হবেন, নাকি বাংলাদেশের ঘরের ছেলে হিসেবে?