হাসান আজিজুল হকের ভেতরের খানিকটা

ফারুক মঈনউদ্দীনফারুক মঈনউদ্দীন
Published : 17 Nov 2021, 07:44 AM
Updated : 17 Nov 2021, 07:44 AM


ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় যখন গল্প লিখতে শুরু করি, তখন আমাদের সাথে কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার চমৎকার সব গল্প লিখছিলেন। তাঁদের গল্প পড়ে ঈর্ষাকাতর হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। তাঁদের কেউ কেউ সেসময় হাসান আজিজুল হককে হাসান ভাই বলতেন, আর আমি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের বন্ধু হওয়ার সুবাদে তাঁকে "হাসান ভাই" বলার সুযোগ পেতাম না। সুতরাং এই সব সম্পর্কের ঝামেলা এড়ানোর জন্য বরারবরই তাঁকে "স্যার" ডাকতাম, আর আমার বন্ধুটি তাঁকে ডাকতেন মেজ চাচা। সেই সুবাদে বন্ধুটি যখন হাসান স্যারের বড় বোন জাহানারা নওশিনকে ফুফু ডাকতেন, আমাকেও সেটাই বলতে হতো। কিন্তু ভাবতাম, তাঁদের পরিবার তো ওপার থেকে এসেছেন, তাঁরা চাচা-ফুফু ডাকবেন কেন? আমার সবচেয়ে বড় ভাই ও বোন অভিবক্ত বাংলায় বড় হয়েছেন বলে, তাঁদের দেখেছি খালাদের বলছেন মাসীমা, কিংবা ফুফুকে ডাকছেন পিসী বলে। যা-ই হোক এই লেখার বিষয়বস্তু মোটেই এটা নয়।

হাসান আজিজুল হকের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইউনিভার্সিটি জীবনে না হলেও পরবর্তী সময়ে যখন তিনি চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির কোনো কাজে আসতেন, তখন তাঁকে আতিথ্য দিতে পেরে সেটা পুষিয়ে নিতে পেরেছিলাম। একবার আমার চট্টগ্রামের বাসায় দুপুরের খাওয়ার পর আমার শেলফ থেকে অম্লান দত্তের একখানা বই খুঁজে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ছিলেন তিনি। আমার তিন বছরের অতিচঞ্চলা কন্যাটি এসময় না ঘুমিয়ে তাঁকে নানানভাবে উৎপাত করতে থাকে। সেদিন বিকেলে চা খেতে খেতে তিনি আমাকে আমার কন্যার কীর্তির বর্ননা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, "তোমার মেয়েটি প্রথমে জানালার গ্রিল বেয়ে ওঠে, তারপর আমার কপালের ওপর পা রেখে নেমে আসে। একসময় আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অম্লান দত্তের সবকিছু ম্লান করে দিয়ে একটানে বইটির মলাট ছিঁড়ে ফেলে। এসনই ছিল তাঁর রসবোধ।

তাঁর সাথে এই সম্পর্কের কয়েক বছর আগে তাঁর রাঢ়বঙ্গের পটভুমিতে লেখা গল্পগুলো নিয়ে প্রথম লেখা লিখি "হাসান আজিজুল হক: তাঁর গল্পের ভূগোল।" লেখাটা ছাপা হয়েছিল ১৯৮৯ কিংবা ৯০ সালের সংবাদ সাময়িকীতে। তখন সংবাদ পত্রিকার সাহিত্যপাতা দেখতেন আবুল হাসনাত এবং সেই পাতায় লেখা প্রকাশিত হওয়াও ছিল তখনকার সময়ে এক বিশাল প্রাপ্তি। লেখাটা তাঁর কাছে নিয়ে গেলে তিনি অতি সংক্ষিপ্ত কথায় বলেছিলেন, "রেখে যান।" সবাই জানেন, তাঁর সামনে কোনো চেয়ার থাকত না, আমাদের মতো অখ্যাত লেখকযশোপ্রার্থীরা যাতে তাঁর সামনে গিয়ে বসে গল্প জমানোর সুযোগ না পান। কিন্তু হাসনাত ভাইয়ের এরকম চরম শুষ্ক আচরণে ব্যথিত হইনি, কারণ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমার লেখাটা কোনো কাটছাঁট না করে হুবহু ছাপাা হয় সংবাদ সাময়িকীতে। এই বিরল সম্মান পাওয়ার পর হাসান আজিজুল হকের সবগুলো গল্প নিয়ে আরো কয়েকটা লেখা লিখি, সেগুলো ছাপা হয়েছিল কোনো দৈনিকের সাহিত্য পাতায়। তাঁর গল্পে অন্ধকারের ব্যবহার নিয়ে সেই সিরিজের আরেকটার নাম ছিল "হাসান আজিজুল হক: তাঁর অদ্ভুত আঁধার ভুবন।" তাঁর গল্পে প্রায়শই থাকত অন্ধকারে একটা আবহ। যেমন "শকুন" গল্পের প্রথম প্যারায় একই বাক্যে দুইবার অন্ধকার শব্দের উপস্থিতি: "ফিকে অন্ধকারের মধ্যে গভীর নিকষ একতাল সজীব অন্ধকারের মতো প্রায় ওদের মাথা ছুঁয়ে সামনের পোড়ো ভিটেয় নামল জিনিসটা।" কিংবা দ্বিতীয় প্যারায় তিনবার এসেছে অন্ধকার, আবারও একই বাক্যে দুবার: "আবছা অন্ধকারে খানিকটা উঁচু মাটি আর অন্ধকার ঝোপ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না তাদের।" দেখতে পাই "আমৃত্যু আজীবন" গল্পের তেইশ পৃষ্ঠার পরিসরে অন্ধকার শব্দের ব্যবহার আছে মোট বত্রিশবার। লেখাটির সাথে জীবনানন্দের কবিতার অন্ধকারের সাথে একটা তুলনামূলক আলোচনার চেষ্টা করেছিলাম।

আরেকটি লেখার বিষয় ছিল হাসান আজিজুল হকের গল্পের নারী চরিত্ররা। লক্ষ্য করি, তাঁর গল্পের নারী চরিত্ররা প্রায়শঃই অন্তরালের গৌন চরিত্র, কিংবা কেউ সামনে এলেও তারা বিমর্ষ, হতাশ ও রূপহীনা। এই সব নারী চরিত্র নিয়ে একটা লেখা তৈরি করেছিলাম, যেটার শিরোনাম ছিল "হাসান আজিজুল হক: তাঁর অরমণীয় রমণীরা।" ধারনা করি লেখাটা পড়ে তিনি চমৎকৃত হয়েছিলেন, রাজশাহী থেকে ফোন করে অনেক কথার ফাঁকে তিনি বলেছিলেন, "নামটা চমৎকার দিয়েছ গো!" তাঁর কেবল এই একটিমাত্র কথায় ছাত্রজীবনে তাঁকে অনেকের মতো "হাসান ভাই" বলতে না পারার দুঃখ আমার একমহূর্তের মধ্যে ঘুচে গিয়েছিল।

হাসান আাজিজুল হকের পুরো পরিবারের মধ্যে আছে গল্পের বীজ ও তার অনন্য কথকতা। আমাদের বন্ধু হাসান আজিজুল হকের অকালপ্রয়াত যে ভ্রাতুষ্পুত্রটি বাঁশঝাড়ে কঞ্চির মতো বেড়ে উঠেছিল, ওর মধ্যেও ছিল এরকম কল্পনাপ্রসূত গল্প বলার অনবদ্য ক্ষমতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা যখন উন্নয়ন অর্থনীতিতে সমাজের দরিদ্র মানুষের জন্য কর্ম সংস্থানের মাধমে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার পাঠ নিচ্ছি, সেসময় তাঁর "খনন" গল্পটি আমাদের চোখ খুলে দেয়। কারণ তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে খাল খননের কাজে শ্রমদানকারী মজুরটির কোনো জমি নেই, সে কেবল সারাদিন মাটি কেটে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কমসূচির অধীনে পাওয়া কয়েক কেজি গম বা চাউল নিয়ে বাড়ি ফিরবে। খালের দুপাশে জমির মালিক ভূস্বামীরা যে বাড়তি ফসল গোলায় তুলতে পারবে, তার ওপর শ্রম দানকারী মজুরটির কোনো দাবি বা অধিকার থাকবে না। তিনি নির্মোহভাবে বলে দেন যে এই খালকাটার মাধ্যমে সরকার নিজের খরচে ভূস্বামীদের জমিতে সেচের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন মাত্র, কিন্তু তার ফলে ভূমিহীন মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে না।

কিংবা তাঁর গল্প "ভেতরের খানিকটা" পড়ার পর মানুষ গলাকাটার রাজনীতির ওপর আরো বেশিমাত্রায় বিরক্ত হতে বাধ্য। গল্পটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে এই রাজনীতির ভুল আদর্শে যে-জোতদারটিকে আজ খুন করা হচ্ছে, কালই তাঁর ছেলে বাবার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে জমির নতুন মালিক বা জোতদার হয়ে পড়বে। সুতরাং সিস্টেম না পাল্টালে গলাকাটার রাজনীতি করে কোনো ফায়দা হবে না।
তাঁর "চালচিত্রের খুঁটিনাটি" বইটির ওপর একটা আলোচনা লিখেছিলাম বলে খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। তখন বলেছিলেন, "মা মেয়ের সংসার" বইটি নিয়ে বেশি আলোচনা কেউ করেনি, সুতরাং আমি যাতে বইটির ওপর একটা লেখা লিখি। পড়তে গিয়ে দেখলাম বইটির এই নামগল্পটা ছাড়া অন্যগুলো নিয়ে লিখতে গেলে তিনি মনে কষ্ট পেতে পারেন। তাই বইটির ওপর আলোচনাটা আর করা হয়নি। আশা করি বিষয়টা নিয়ে তাঁর মনে আর কোনো দুখঃবোধ ছিল না।