জেমস রেনেল ও তাঁহার রোজনামচা : ১৭৬৪-১৭৬৭

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 6 Dec 2007, 05:34 PM
Updated : 6 Dec 2007, 05:34 PM

(দোসরা কিস্তি)

জেমস রেনেল বৃত্তান্ত : আরো

………
জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৩০)
……….
জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৩০) বিষয়ে আরো তথ্য চাহিয়া যাঁহারা লিখিতে বলিয়াছেন তাঁহাদের – বিশেষ বিধান রিবেরু মহাশয়ের – শুকরিয়া আদায় করিয়া তাঁহার কথা দ্বিতীয় কিস্তি লিখিতেছি। এই কিস্তির উৎসও প্রথম কিস্তির অনুরূপ। নতুন খবর ইহাতে তেমন বিশেষ নাই। (লা টুশ ১৯১০; উয়িকিপিডিয়া ২০০৭)

জেমস রেনেলের জন্ম ১৭৪২ সালের ৩রা ডিসেম্বর ধরিয়া লইলে ১৭৬৪ সালের গোড়ার দিকে তাঁহার বয়স হইতেছে সবে ২১ বছর কয়েক মাস। সেই বয়সেই তিনি বঙ্গদেশে আসিলেন। বঙ্গে তখন সবে ইংরেজাধিকার কায়েম হইয়াছে বটে, মোকাম হয় নাই পুরাদস্তুর – এই কথা আমরা পহিলা কিস্তিযোগেই উল্লেখ করিয়াছি। ততদিনে তাঁহার নৌ-বাহিনীর চাকুরিসহ জাগতিক বা হাতেকলমে অভিজ্ঞতা লাভ হইয়া গিয়াছে ৮ বছর। তাঁহার বাবা জন রেনেলও নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা আমরা আমলে লই নাই।

১৭৫৬ সালে তিনি প্রথম মহাব্রিটেনের রাজার নৌবাহিনীর ব্রিলিয়ান্ট (Brilliant) নামা জাহাজে নাবিকের (midshipman) চাকরি লইয়াছিলেন। সেই জাহাজেই তাঁহার পরিচয় হইয়াছিল সমান পদে চাকরিরত টোপাম নামা অন্য এক নাবিকের সঙ্গে। এই টোপাম সাহেবই বলিয়া কহিয়া কলিকাতার উইলিয়াম নামা দুর্গে শিক্ষানবিশ প্রকৌশলী বা এঞ্জিনিয়ার পদে তাঁহার চাকরি জুটাইয়া দিয়াছিলেন।

অবশ্য ইহার আগের বৎসর অর্থাৎ ১৭৬৩ সালেই রেনেল স্বেচ্ছায় নৌবাহিনী না ছাড়িয়াই পূর্ব ভারত কোম্পানির চাকরি লইয়াছিলেন। চাকরি লইয়া তিনি ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে গমন করেন। সেখানে তাঁহার কাজ ছিল জরিপ পরিচালনা। এই কাজ তিনি নৌবাহিনীতে থাকার সময়ই শিখিয়াছিলেন। সেই জায়গা হইতে মাদ্রাজে (এখনকার চেন্নাই) ফিরিয়া তিনি নৌবাহিনী হইতে ছাড়া পাইয়া গেলেন। সেই জায়গায় তাঁহাকে একটি সদাগরি জাহাজের কাপ্তেন নিয়োগ করা হইয়াছিল। দুর্ভাগ্যের মধ্যে, ১৭৬৩ সালের ২১ অক্টোবর তারিখে জাহাজটি হারিকেনে হারাইয়া যায়। ভাগ্যের মধ্যে, রেনেল সাহেব ঝড়ের রাতে জলে ছিলেন না, স্থলভাগে অবস্থিতি করিতেছিলেন। তাই বাঁচিয়া গেলেন। পরে নেপচুন নামা একটি আন্দাজমতো জাহাজের চাকরি তাঁহার হইয়াছিল। ইহার কাজের মধ্যেও কিছু জরিপ তিনি করিয়াছিলেন।

১৭৬৪ সালেই কলিকাতায় সেই সময়কার ইংরেজ গভর্নর বা দুর্গাধিপতি হেনরি ভ্যানশিটার্ট তাঁহাকে গঙ্গার বদ্বীপ এলাকা জরিপ করিবার নিমিত্ত আমিন নিয়োগ করেন। এই কাজ সফলতার সহিত সম্পাদন করিবার পুরষ্কার হিসাবেই – বোধ হয় – তাঁহার উচ্চতর পদ জোটে। ১৭৬৭ সালের মাহে জানুয়ারি নাগাদ মহা আমিন বা সার্ভেয়ার-জেনারেল পদে রেনেলের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। তাঁহার মাসোহারা ঠিক করা হইয়াছিল তিনশত টাকা। কালের বিচারে এই বেতন অতি উচ্চ ছিল। প্রমাণ: ১৭৬৪ সালে কলিকাতা কৌন্সিলের (Council) সদস্য ওয়ারেন হেস্টিংস মহাশয়ও নাকি ঐ একই পরিমাণ মাসোহারা তুলিতেন। জেমস রেনেলকে এই বড় পদটিতে নিয়োগ দেওয়ার কিছুদিন পর অতি বিখ্যাত লাটসাহেব রবার্ট ক্লাইব মহোদয়ের দ্বিতীয় দফা গভর্নরি শেষ হয়।

১৭৬৭ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখে পূর্ব ভারত কোম্পানির সদর দপ্তর (Court of Directors) বরাবর লেখা কলিকাতা কৌন্সিলের এক চিঠি হইতে এই খবর পাওয়া যাইতেছে। ৩০ মার্চের চিঠিতে উল্লেখ করা হইয়াছে সম্প্রতি তিনি জরিপ অভিযান চালাইবার সময় গুরুতর আহত হইয়াছেন। ইহাতে তাঁহার স্বাস্থ্যহানিও ঘটিল গুরুতর। এই ঘটনার বিবরণ রেনেল নিজেও তাঁহার রোজনামচা লিপিতে আবদ্ধ রাখিয়াছেন।

এতদ্দেশীয় দেশের বিপ্লবী দেশীয় সৈনিকদের পরিচয় তিনি 'সন্ন্যাসী' নামই দিয়াছিলেন। সন্ন্যাসীরা সেইবার তাঁহাকে মারিয়া-কাটিয়া একশেষ করিবার সামান্যই বাকি রাখিয়াছিলেন। ইহা ১৭৬৬ ইংরেজির ২১ ফেব্র"য়ারি তারিখের ঘটনা। জায়গার নাম ধরলা। ইহা ভূটানপথে কুচবিহার সীমান্তের নিকটে বটে।

গঙ্গা হইতে বড় বড় জাহাজযোগে কেমন করিয়া কলিকাতায় আসা যায় তাহার সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজিয়া বাহির করিতে রেনেল সাহেবকে পহিলা চাকুরিটা দেওয়া হইয়াছিল। পরে তাঁহাকে বলা হয় সুন্দরবন আর মেঘনার মধ্য দিয়া কলিকাতা আসিবার পথও বাহির করিতে। রেনেলের রোজনামচায় এই পহিলা অভিযানের বিবরণ ছাড়াও আরও তিন যাত্রার কাহিনী লেখা হইয়াছে।

শেষের তিন যাত্রায় তিনি উত্তর ও পূর্ব বাঙ্গালার অনেক জায়গার নদীপথিক জরিপ শেষ করিয়াছিলেন। ব্রহ্মপুত্র নদীর পথে গোয়ালপাড়া পর্যন্ত পৌঁছিবার পর অহম রাজ্যের সীমানায়ও তিনি ঢুকিয়াছিলেন বলিয়া উল্লেখ পাইতেছি। এই অভিযানের এক প্রহরে তিনি যখন কুচবিহার সীমান্তে তখনই দেশীয় বিপ্লবীদের হাতে পড়েন। মারটা জবর হইয়াছিল বলিয়াই মনে হয়।

সন্ন্যাসী ফকির বাহিনী তাঁহাদের দলকে ঘেরাও করিয়া ফেলে এবং তলোয়ার দিয়া কয়েকটা কোপও মারে তাঁহার গায়ে। শুদ্ধ ভাগ্যের জোরে তিনি এ যাত্রা প্রাণটা রক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন। রোজনামচায় এই হামলার সবিস্তার বিবরণ পাওয়া যাইবে। তাহা ছাড়া ইংরেজি ভাষায় তাঁহার যে জীবনীগ্রন্থ অবলম্বন লা টুশ সাহেব তাঁহার ভূমিকা ফাঁদিয়াছেন সেই জীবনীগ্রন্থও ইহার বিস্তারিত তথ্যসম্বলিত বলিয়া জানাইতে কসুর করেন নাই তিনি । (মার্কাম ১৮৯৫: ৪৭)

রেনেলের রোজনামচার বিস্তার ১৭৬৭ সালের মার্চমাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। তখনও তিনি গাঙ্গেয় বদ্বীপাঞ্চলের নদনদীজরিপ কাজ শেষ করিয়া সারেন নাই। সেই সময় তাহার প্রবলবেগে জ্বর আসিত। সেই রকমই এক জ্বরের প্রকোপে তিনি একদিন কাজ বন্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন । ইহা জানাইতেছেন তাঁহার জীবনী লেখকরা।

যথা মার্কাম সাহেব লিখিত জীবনীগ্রন্থে ভারতবর্ষে রেনেলের বাদবাকি জীবনের কর্মতৎপরতার আরো বিবরণ রহিয়াছে। ১৭৭১ সালে আপনকার পুরানা দুশমন ফকির সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে আবারও তাঁহাকে যুদ্ধে পাঠান হইয়াছিল। জীবনীকার কহিতেছেন এই যাত্রায় তাঁহার ফললাভ ষোল আনাই হইয়াছিল। তদুপরি – এক বৎসর পর – তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিলেন।

তাঁহার কনের নাম ছিল বেগম জেন থ্যাকারে। ইঁহার ভাইয়ের নাম উয়িলিয়াম ম্যাকপিচ থ্যাকারে। এই ভাইয়ের ঘরের নাতির নামও একই ছিল। তিনি আর কেহই নহেন, স্বয়ং পরকালের বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক উয়িলিয়াম ম্যাকপিচ থ্যাকারে। রেনেলের ঢাকাস্থ বন্ধু কার্টিয়ার সাহেব যখন গভর্নর হইলেন সেই সময় এই থ্যাকারে সাহেবই তাঁহার সচিব নিযুক্ত হইলেন। অতয়েব দাঁড়াইল এই: রেনেল সাহেব আপনকার বন্ধুর সচিবের ভগিনির পাণি গ্রহণ করিলেন। করিয়া – যতদূর জানি – সুখিও হইলেন। সেই কাহিনী পরে হইবে।

অথ রেনেলনামা দ্বিতীয় কিস্তি সমাপ্ত। অদ্য ৩ ডিসেম্বর সন ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ অথবা রেনেল মহাশয়ের ২৬৫ নম্বর জন্মদিনে।

দোহাই

১. James Rennell, The Journals of Major James Rennell, First Surveyor-General of India, Written for the information of the Governors of Bengal during his surveys of the Ganges and Brahmaputra rivers 1764 to 1767, edited by T. H. D. La Touche, Geological Survey of India (Calcutta; Asiatic Society, 1910).
২. Wikipedia, 'James Rennell,' (Wikipedia, 2007).
৩. Sir C. Markham, Major James Rennell and the Rise of Modern English Geography, (London: Cassell & Co., 1895).

~~~

আমিন জেমস রেনেল

বিরচিত

শুকনা মৌসুমে গঙ্গানদী হইতে কলিকাতা যাইবার নিকটতম পথ খুঁজিয়া পাইবার লক্ষ্যে জলঙ্গি নদীর মাথা হইতে ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থল পর্যন্ত গঙ্গার; লক্ষীপুর হইতে ঢাকা পর্যন্ত মেঘনা ও অন্যান্য নদীর; এবং দক্ষিণ তীরবর্তী নদীনালার জরিপকার্যের বিবরণী সংযুক্ত

রোজনামচা

সন ১৭৬৪-১৭৬৭

তজর্মা : সলিমুল্লাহ খান

(গত সংখ্যার পর)

২২ তারিখ আসকালদুপুরবেলা দক্ষিণ-পূর্ব দিক হইতে ভারি পরিচ্ছন্ন দমকা হাওয়া বহিতেছিল। ফলে আমরা বিকাল পর্যন্ত (পরিকল্পনা মোতাবেক) জরিপ কাজে আর আগাইতে পারি নাই। মাত্র তখন নাগাদই আমরা জলঙ্গি নদীর মাথা হইতে পূর্বদিক ধরিয়া জরিপকার্য শুরু করিলাম। গতকল্য আমরা ঐ নদীর মাথা আর উহার উজানে গঙ্গাতীরের জরিপ এক মাইল পর্যন্ত শেষ করিয়াছিলাম।

হাল মৌসুমে এই মহানদীর আবহাওয়া সচরাচর যে রকম হইয়া থাকে আজ বিকালবেলা তাহার কিছু নমুনা দেখিলাম। মানে সন্ধ্যার দিকে যখন আমরা কুমারের (Quemaieree) অদূরে নদী পার হইতেছিলাম তখন দক্ষিণ-পূর্ব দিক হইতে একটা দমকা হাওয়া আসিল। আসিয়া সমস্ত নৌকা-সাম্পান একঠেলায় জলঙ্গির বালুচরে তুলিয়া দিল। সারারাত সেখানে থাকিয়া ঝাপটা খাইল। দুই জন নাবিক বাতাসের ঝাপটায় উড়িয়া যায়। তবে ভাগ্যের দয়ায় সাঁতার দিয়া কুলে উঠিতে সক্ষম হয়।

২৩ তারিখ সকালটা চমৎকার। নদীর দক্ষিণতীর জরিপ করিয়া কাটাইলাম। [সংযুক্ত] ১ নং মানচিত্রে ইহার খুঁটিনাটি পাওয়া যাইবে। আজ মহেশকুড়াঁর (Mayescunda) নালা পরখ করিলাম। এই নালা জলঙ্গির ৫ মাইল খানিক দক্ষিণে দক্ষিণ-পূর্বে, আর ইহাই আমাদের হাতে পড়া এক নম্বর নালা বা ক্রিক (Creek)। দেখিলাম ইহার পানি প্রবেশদ্বারে মাত্র ২ হাত আর পোয়া মাইল মতো উজানে গেলে একেবারে শুকনা। এই তল্লাটে বিস্তর ধান আর কার্পাসতুলার চাষ হয়। এই জায়গা হইতে পূর্বমুখি কমপক্ষে ৮ মাইল পর্যন্ত নদীর গতিপথ প্রায় সোজাসুজি পূর্বদিকগামী, আর বিপজ্জনক বালিয়াড়িতে ভরা। নদীও তদুপরি অতিরিক্ত দ্রুতগতিতে বহিতেছে। জলঙ্গির ৮ মাইল পূর্বে দক্ষিণ-পূর্বে পঞ্চিফেরার (Paunchiferra) একটা খাল আসিয়া গঙ্গায় পড়িয়াছে। শুনিয়াছি এই খালটি সারদার (Surda) কাছে একই নদী হইতে বাহির হইয়াছে। আজ সন্ধ্যাবেলা আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ হওয়ায় আমরা বীরসগঞ্জ বালিয়াড়ির একটা খালে নৌকা-সাম্পান ভিড়াইয়া রাখিয়াছিলাম।

২৪ তারিখ সারাদিন আবহাওয়া বেশ ভালো । গতকালের মতন আজও জরিপ চালাইয়াছি। হরিশংকর (Harisongkor) আর কালিগঞ্জ (Callygunge) গ্রাম পার হইলাম। এই স্থলে নদী দুই খাতে ভাগ হইয়া গিয়াছে। মধ্যস্থলের বালির দ্বীপটি লম্বায় পাঁচ মাইল। নদী এখন উত্তর-পূর্ব দিকে মোড় লইয়া বহিতেছে আর ইহার প্রস্থ কোথাও কোথাও বর্ষা মৌসুমে ২ ১/২ মাইল। এইখানটায় দেশগ্রাম দেখিতে চোখ জুড়ায়, বেশির ভাগই মাঠ-ময়দান আর গবাদি পশুর সংখ্যাও বেশ বটে। নদীতীর এখানে ৩০ ফুট উচুঁ, অবিরত ঝরিয়া পড়িতেছে বলিয়া নৌকা সাম্পানের বিপদ ঘটিতে পারে, তাই তীরের তেমন কাছে যাইতে মানা। আজ হাওয়া দিতেছে দক্ষিণদিক হইতে, আসিতেছে হালকা মৃদুমন্দ সমীরণ আকারে।

২৫ তারিখ দুপুরের আগে সাংঘাতিক গরম পড়িয়াছে, বিকালবেলা ঝড়-তুফানে কাটিল আর বৃষ্টিও নামিল ঢের। আজ গঙ্গা নদীর উত্তর মোহনার সীমা বরাবর অবস্থিত চকুলা (Chocula) নামক গ্রামে আসিলাম। এইখান হইতে নদী পূর্বে দক্ষিণ-পূর্বে ঘুরিয়া ৫ বা ৬ মাইল পর্যন্ত চলিয়াছে আর বালির এক বিশালাকার দ্বীপ উঠিয়া ইহার সবটুকু বরাবরই নদীকে দুইভাগে ভাগ করিয়া রাখিয়াছে। উত্তরদিকের খাতটাই সবচেয়ে বেশি গভীর এবং সবচেয়ে বেশি ভালো।

২৬ তারিখ সুন্দর আবহাওয়া। পূর্ব দক্ষিণ-পূর্ব মোহনা জরিপ করিতেছি।

২৭ তারিখ সুন্দর আবহাওয়া। পূর্ব দক্ষিণ-পূর্ব মোহনা শেষ করিলাম আর অন্য একটায় প্রবেশ করিলাম। ইহার দৌড় প্রায় ৫ ১/২ মাইল দক্ষিণমুখি। বর্ষা মৌসুমে ইহার ওসার (চওড়া) দেড় মাইলের বেশি হয় না আর এখন স্থানে স্থানে পোয়া মাইলের বেশি হইবে না। আমাদের আগমন সংবাদে গ্রামের লোকজন ঘরবাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। তাই এইসব জায়গার নাম জানিয়া লইতে কিছুটা দেরি হইল। আজ সন্ধ্যায় মালাকোলা (Malacola) ও সেলাহ (Selah) গ্রামদ্বয়ের মাঝখানটায় (প্রায় ২ ১/২ মাইলের তফাতে) গুনিয়া দেখিলাম নৌকার সংখ্যা ৪০০ শতের কম হইবে না। সন্ধ্যা নাগাদ চুম্বক কাঁটার নড়াচড়া পূর্বমুখি ০´-৩৬º হইয়াছে।

২৮ তারিখ পূর্বাহ্ন সুন্দর, সন্ধ্যা আর্দ্র আর ঝড়বৃষ্টিভরা। গত ৩ দিন ধরিয়া বাতাস দক্ষিণ হইতে বহিতেছে। দক্ষিণ মোহনার জরিপ শেষ করিয়াছি আর দামাদুর (Damadure) গ্রামে আসিয়া পৌঁছিয়াছি, এই গ্রামটি ইহার শেষভাগে আছে। এই জায়গা হইতে নদী দ্রুত উত্তর-পূর্ব দিকে ঘুরিয়া গিয়াছে আর এই পথে ৯ মাইল চলিয়াছে। আজ রাত ভরিয়া বৃষ্টি হইল।

২৯ তারিখ পূর্বাহ্নে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। অপরাহ্ণে কম্পাসের নানান কোণ হইতে বেশ কয়েকবার দমকা হাওয়া বহিল আর বৃষ্টিও হইল বেশ। ফল দাড়াঁইল আজ আমাদের কাজ হইল সামান্যই। আজ রাত্রে অনেক বৃষ্টি।

৩০ তারিখ আবহাওয়া সহনীয়। উত্তর-পূর্ব মোহনার পাঁচ মাইল উপর হইতে বড় একটি দ্বীপের শুরু। ইহা পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে পাঁচ মাইল বিস্তৃত। ফলে স্থানে স্থানে নদীর ওসার ৩ ১/২ মাইল পর্যন্ত হইবে। সর্বদক্ষিণের খাত দিয়া সম্বৎসর নৌ-যানবাহন চলাচল করে না। শ্রীরামপুর (Serampour) ও গড়গড়ি (Gurgoree) গ্রাম ইহার শেষ সীমায়। এখানকার গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদ ভালোমতই হইয়া থাকে আর ফসলের বেশির ভাগই ধান্য (Padda)। অদ্য গভর্নর মহোদয় সমীপে লিখিলাম, আমার কাজকর্মের বিবরাণাদি তাহাকে জানাইয়া দিয়াছি।

৩১ তারিখ সারাদিন দক্ষিণদিক হইতে একেবারে তাজা হাওয়ার ঝাপটা (Gales) বহিল। বড় দ্বীপটির দক্ষিণ-পূর্ব মাথা হইতে নদী প্রায় ৮ মাইল পর্যন্ত দক্ষিণে বহিয়া গিয়াছে। পশ্চিমদিকের তীর বেশির ভাগই জঙ্গলে ঢাকা। তবে পূর্বতীরে চাষাবাদ ভালোমতই হইতেছে আর এই তীরে ১০ কিম্বা ১১ টা গ্রাম বসিয়াছে। এই মোহনার (Reach) শেষ মাথায় কস্তি (Custee) গ্রাম ।

১লা ও ২রা জুন সুন্দর আবহাওয়া, দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব দিক হইতে তাজা হাওয়া বহিতেছে। এই দুই দিন দক্ষিণ মোহনার পশ্চিমতীর জরিপ করিয়া কাটাইলাম আর ২ তারিখ সন্ধ্যাবেলা কস্তি গ্রামে আসিলাম। গ্রামটি মোহনার মোড় হইতে বিপরীতদিকের পশ্চিম তীরে বটে।

৩ তারিখ সুন্দর সকাল। গ্রাম হইতে তিন পোয়ামাইলমতো ভাঁটায় নদী হইতে বাহির হইয়াছে কস্তি খাল। সেই খালের মাথায় আসিলাম। শুনিলাম এই খাল দিয়া সারা বৎসর নৌকা-সাম্পান চলে। আরও শুনিলাম ইহা হইতে রাঙ্গাফুলায় যাওয়া যায়। যদি তাহাই হয় তো বলিতে হইবে আমাদের অভিযান সাফল্যের সহিত সমাপ্ত হইল। খালটি ১৩০ হইতে ২০০ গজ পর্যন্ত চওড়া এবং ১/৪ মাইল উজানে যাওয়ার পর ৪০ হইতে ১০ হাত পর্যন্ত গভীর হয়।