হে ফেস্টিভেল নিয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত

rashed_shaon
Published : 16 Nov 2013, 03:20 PM
Updated : 16 Nov 2013, 03:20 PM

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে যে হে ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেলো (১৪-১৬ নভেম্বর) তা গতবারের চেয়েও তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে আমাদের কয়েকজন বিশিষ্ট সৃষ্টিশীল ব্যক্তির মতামত প্রদান করা হলো।

মনিরুজ্জামান : ভাষাবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, কবি
…………………………
আগ্রাসন থেকে আমাদের
সতর্ক থাকতে হবে।

…………………………
বাংলা একাডেমি 'নবান্ন' ভুলে হে ফেস্টিভ্যাল করছে। এই উৎসবে বিপুল অর্থব্যয়ে বিদেশি সংস্কৃতি লালন ও বাংলায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের কবিসাহিত্যিকরা প্রত্যাশিত পর্যায়ে তাতে অংশগ্রহণ করেনি। এতে বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের সঙ্গে বাংলা একাডেমির একটি দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা বিদেশি সংস্কৃতির অপ-চাপে দু'শ বছরের অধিককাল নিজেদের তুলে ধরতে পারিনি । তার অবসান ঘটিয়ে যখন আমাদের বুদ্ধিজীবী ও কবিসাহিত্যিকদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময় এসেছে, তখন ভিন্ন নাম নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনুপ্রবেশের সুযোগ নিচ্ছে ভিন্নভাষাভাষী আগ্রাসী সংস্কৃতি। এটাকে প্রশ্রয় দিলে আমরা ভুল করবো। এ-ধরনের প্রশ্রয় নতুন সাংস্কৃকি সঙ্কট সৃষ্টি করবে। আমরা বিদেশি সংস্কৃতির বিরোধী নই, তবে তার আগ্রাসন থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ: অধ্যাপক, সাবেক মহাপরিচালক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
…………………………
এটাকে অত্যন্ত নিন্দার
দৃষ্টিতে দেখছি এবং একটা জাতীয়
অবমাননা হিসেবে গণ্য করছি

…………………………
বাংলা একাডেমি সাধারণ প্রতিষ্ঠান নয়। এর সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের উদ্ভব হওয়ার যে আন্দোলন সে আন্দোলনের ফসল হিসেবে। ৫৪'র যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার মধ্যে ১৬ নম্বর দফা ছিল বাংলা একাডেমি স্থাপন ও ভাষার উন্নয়ন। এরপর কন্সটিটিউশনেও বলা হয়েছে এদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এই ভাষার উন্নয়নের দায়িত্বটা বাংলা একাডেমির। বাংলা একাডেমি কোন প্রাইভেট পাবলিশারের ফোরাম হতে পারে না । একটা অখ্যাত গ্রামের একটা পাবলিশিং হাউসের আয়োজনে একটা ফেস্টিভাল হল এই হে ফেস্টিভেল। তার হোস্ট হয়েছে বাংলা একাডেমি। একবার 'আনন্দ পাবলিশার্স' বাংলা একাডেমিকে পুরস্কার দিয়েছিল। এই ঘটনা ঘটেছিল আমি যখন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলাম। আমি সেই পুরস্কার গ্রহণ করিনি। কারণ একটা পাবলিশিং হাউসের কোন অধিকার নাই যে বাংলা একাডেমির মতো একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেয়ার । এটা ছিল অপমানজনক। আমি সেই অপমান হতে দেইনি। এর জন্যে আমার ওপর অনেকে অসন্তুষ্ট হয়েছে এবং আমাকে মৌলবাদী বলেছে। এখন কথা হচ্ছে আমি এটাকে অত্যন্ত নিন্দার দৃষ্টিতে দেখছি এবং একটা জাতীয় অবমাননা হিসেবে গণ্য করছি। এটা একধরনের হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছু নয়।

মনসুর মুসা: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
…………………………
বাংলা একাডেমি তো
প্রচারের অনুষ্ঠানের জন্যে নয়

…………………………
আমি আসলে কিছুই জানি না । হে ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নাই। যে বিষয়ে কিছুই জানি না সে বিষয়ে কিভাবে মন্তব্য করব? আমি এখনো পর্যন্ত কোন চিঠি পাই নাই। আমি আগে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এখন তো আজীবন সদস্যও। সে হিসেবেও কোন চিঠি পাই নাই। সুতরাং আমার জানা নেই তারা আসলে কিভাবে কী করছে। এখন তো শুনতে পাই বাংলা একাডেমির স্বাভাবিক যে কাজ তার চেয়ে অন্য কাজ বেড়ে গেছে। বাংলা একাডেমির জন্য এটা খুব একটা উপকারী বা সম্মানজনক কিনা সেটাতো আমি বলতে পারবো না। তবে এতে করে বাংলা একাডেমির কোন উপকার হবে বলে আমি আশা করতে পারছি না । হয়তো একটা প্রচার পাবে, কিন্তু বাংলা একাডেমি তো প্রচারের অনুষ্ঠানের জন্যে নয়, এটা একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ সবের চাইতে বাংলা একাডেমিতে নির্বাচন করাটা অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু সে বিষয় একাডেমির কোন মাথা ব্যথাও নেই।

মনজুরে মওলা: কবি, সাবেক সচিব। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
…………………………
আমি এই উৎসব
বিষয়ে কিছুই জানি না

…………………………
আমি এই উৎসব বিষয়ে কিছুই জানি না। তাই আমি কিছু বলতেও চাই না। আমি শুধু একটি চিঠি পেয়েছি যে, এই নামে একটি উৎসব হচ্ছে। এর বাইরে আমার কিছু জানা নেই। তাছাড়া বাংলা একাডেমি বিষয়ে নতুন আইন হয়েছে। সেই আইনটি সম্পর্কেও আমি ওয়াকিবহাল নই। সুতরাং আমি কিছু বলতে চাই না।

বুলবন ওসমান: চিত্রসমালোচক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক
…………………………
নিজস্বতাকে বলি দিয়ে
আন্তর্জাতিকতা নয়

…………………………
পাশ্চাত্যের একটি গ্রামের নাম হে। সেখান থেকেই এর নামকরণ করা হয়েছে 'হে ফেস্টিভ্যাল'। প্রত্যেকেই তার গ্রাম বা শহরকে এগিয়ে নিতে চায়। সেটা দোষের কিছু না। কিন্তু বিষয়টা হলো 'হে উৎসব' যেখানে হচ্ছে সেই বাংলা একাডেমি হলো আমাদের অন্তরের একটি প্রতিষ্ঠান। শহীদের রক্ত দিয়ে আমরা এই প্রতিষ্ঠানকে তৈরি করেছি এবং এই বুকের রক্ত আরও বেশি করে দিয়ে দেশটা পেয়েছি। সেইখানে অন্য দেশের একটি গ্রামের নামে যে উৎসব হচ্ছে সেটা আমার কাছে যথার্থ বলে মনে হয় না। এটা অন্য যে কোন একটা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হল ভাড়া নিয়ে করতে পারে। আর বাংলা একাডেমিতে যদি এ ধরণের অনুষ্ঠান করতে হয় তাহলে তা বড় আকারে সবাইকে নিয়ে বিশেষভাবে করবে।

আমি মনে করি অন্যের উৎসবের জন্য এখানে এভাবে জায়গা না দিয়ে বরং বাংলা একাডেমি যদি আমেরিকার কোন জায়গায় কোন একটা অনুষ্ঠান করে সেটার যৌক্তিকতা অনেক বেশি। তাছাড়া আমরা যদি একটা আন্তর্জাতিক সাহিত্য মেলা করি সেটা হতে পারে। সেখানে হে একটা অংশ হতে পারে মাত্র। রবীন্দ্রনাথ করলেন বিশ্বভারতী। বিশ্বকে নিয়ে আসলেন শান্তি নিকেতনে। তিনি বিশ্বকে ভারতে আনলেন আবার ভারতকে বিশ্বে পৌছে দিলেন।

আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হবে প্রতিটি দেশের কিছু জাতীয় গৌরবের স্থান থাকে। বাংলা একাডেমি আমাদের তেমনি একটি গৌরবের জায়গা। সেই জায়গা কোন কিছু দ্বারা আচ্ছন্ন হবে সেটা আমাদের জন্যে মঙ্গলজনক নয়। প্রত্যেক জাতির একটা নিজস্বতা থাকবে। তার সাথে আন্তর্জাতিকতা । কিন্তু নিজস্বতাকে বলি দিয়ে আন্তর্জাতিকতা নয় কখনোই। তাহলে তো আর পরিচয়ও থাকবে না। এই জন্যেই আমার মনে হয় যে হে ফেস্টিভাল বাংলা একাডেমির করা উচিত নয়।

বাংলা একাডেমি কোনভাবেই এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। এটি আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। এখানে ফোকাস হচ্ছে হে। আমাদের একাডেমি তো ফোকাস হচ্ছে না। হে আমাদেরকে জয় করে নিলো, গোটা বাংলাদেশকে, এটাতো হতে পারে না। হ্যাঁ, ওরা ওদের প্রচার করবে না কেন? বিশ্বে সবারই প্রচার করবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের যা জাতীয় গৌরব আমরা তা কোনভাবেই কলুষিত করতে চাই না। এটাই আমাদের বড় চিন্তা। এই চিন্তাটা আমাদের এ ধরনের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মনে রাখা উচিত। এখানে আমরা ছোটখাট জিনিসগুলোকে প্রাধান্য দিবো না। দশটা প্রতিষ্ঠান যদি হতো, যে বিশ্বের দশটা প্রতিষ্ঠান এসেছে, তখন বাংলা একাডেমি এটা করতে পারতো। বাংলা একাডেমিকে প্রাধান্য দিয়ে ওই দশটিকেও আমরা খোপ খোপ করে প্রচার করলাম। এটাই মূল বক্তব্য।

রফিক আজাদ : কবি ও সাবেক সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ
…………………………
ক্ষয়িষ্ণু নীতির সাম্রাজ্যবাদের
দালালির জাযগা এটা নয়

…………………………
বাংলা একাডেমিতে কোনভাবেই হে উৎসব হওয়া উচিত নয়। বাংলা একাডেমি খুবই পবিত্র স্থান। কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাসত্ব করার জায়গা এটা নয়। বাঙালির মেধা ও মননের জায়গা এই বাংলা একাডেমি। ক্ষয়িষ্ণু নীতির সাম্রাজ্যবাদের দালালীর জাযগা এটা নয়। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাঙালির নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এটি। সেই স্থানে কেউ অন্যের দালালি করবে এটা হতে পারে না।

রবিউল হুসাইন: কবি ও সাবেক সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ
…………………………
হে ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে
বাংলা একাডেমির এই সম্পৃক্ততা
কোনভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়

…………………………
আমার মনে হয়, হে ফেস্টিভ্যাল আয়োজকদের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই ভালো বিষয়। তবে আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লেখক এখানে অংশ নিচ্ছেন না। এ ধরনের একটি আয়োজনের হোস্ট হয়েছে বাংলা একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানটি সেই বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের ফসল। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলা ভাষার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সেই কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা একাডেমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় হে ফেস্টিভেলের সঙ্গে বাংলা একাডেমির এই সম্পৃক্ততা কোনভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এটি নিজেই একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। সে নিজেই এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে পারে। তারা যদি নিজেদের আপন শক্তিতে একটি আর্ন্তজাতিক সাহিত্য উৎসব করতা তাহলে খুবই ভালো লাগত। আর একটি বিষয় আমার মনে হয়, বাংলা একাডেমি একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ বিভাগ করতে পারে। যেখানে এদেশের প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক, যারা নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য, তাদের লেখাকে অনুবাদ করে বিশ্ব দরবারে নিয়ে যাওয়া যায়। এটা করলে বাংলা একাডেমির বিশাল একটা কাজ হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত একাডেমি এধরনের কিছু করে নাই। কাজেই আমার মনে হয় অন্য কারও লেজুড়বৃত্তি না করে একাডেমি নিজের বলে স্বাধীনভাবেই নিজের জন্য এটি করবে, এটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। বাংলা একাডেমি প্রতিবছর যে গ্রন্থমেলা করে সেই মেলাকে উপলক্ষ করে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন করতে পারে।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী: কবি ও সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ
…………………………
হে ফেস্টিভেল…
নিজের যুক্ততার কোন যৌক্তিক
কারণ খুঁজে পাই না

…………………………
এই উৎসবে বাংলা একাডেমির সম্পৃক্ততা কী এটা আমি জানি না। আমাদের কবিতা পরিষদকে এখানে গতবারও কবিতা পাঠের জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। এবারও আমাদের ডাকা হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে এখানে আমার কোন আগ্রহ নাই। হে ফেস্টিভেল যে কারণে যাদের উদ্দেশ্যে করা হয় আমি তার সঙ্গে নিজের যুক্ততার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাই না।

আলতাফ হোসেন: কবি
…………………………
প্রতিবাদ হওয়ার পরেও
কর্তাব্যক্তিরা তা গ্রাহ্য করছে না,
এটাই ভয়ের বিষয়

…………………………
এই উৎসবের আয়োজকরা যেসব কর্মকাণ্ড করছে তা আমার কাছে মোটেই স্বচ্ছ মনে হচ্ছে না। এটা নিয়ে কেউ কেন প্রতিবাদ করছে না, এটাই আমার কাছে অবাক লেগেছে। অনেকেই এই উৎসবে যাচ্ছে কিছু একটা পাওয়ার আশায়। এটা খুবই খারাপ হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। এটা নিয়ে যেভাবে প্রতিবাদ হওয়া দরকার তাও হচ্ছে না। আরও সুসংহত ও জোরালোভাবে বাংলা একাডেমির এই ধরনের আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত। বাংলা একাডেমি আমাদের আশা ভরসার স্থল। সেখানে এ ধরনের আয়োজন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়ার পরেও কর্তাব্যক্তিরা তা গ্রাহ্য করছে না, এটাই ভয়ের বিষয়।

ফরিদ আহমেদ দুলাল: কবি, নাট্যকার, সাহিত্য সংগঠক
…………………………
এটি অবশ্যই আমাদের
জাতির জন্য অপমানজনক

…………………………
বাংলা একাডেমি আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এটা আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে একাডেমি দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে এটা আমরা প্রত্যাশা করি না। বাংলা একাডেমী অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। এটা তো জাতীয় চিন্তা-চেতনার একটি প্রতীক। তাহলে কেন তাদের নামটি একটি পত্রিকার নামের পরে থাকবে। আমরা বাংলা একাডেমির এই দুর্দশা দেখতে চাই না। অন্য যেকোন জায়গায় হে উৎসব হতে পারে। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। এখন যেভাবে একটা পত্রিকার নামের পরে বাংলা একাডেমির নাম ব্যবহার করা হচ্ছে এটা আমাদের পুরো জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের। এই উৎসবের দাওয়াতপত্র দেখলেই আপনি বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। সেখানে আগে একটি ইংরেজি পত্রিকার নাম, পরে বাংলা একাডেমির নাম রাখা হয়েছে। এটি অবশ্যই আমাদের জাতির জন্য অপমানজনক।

শাহাবুদ্দীন নাগরী:কবি, শিশুসাহিত্যিক
…………………………
কারও ব্যানারে গিয়ে
বাংলা একাডেমির এ ধরনের অনুষ্ঠান
করার কোন যৌক্তিকতা আমি দেখি না

…………………………
হে ফেস্টিভ্যালের মত একটি আয়োজন বাংলা একাডেমির মত প্রতিষ্ঠানের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। আমি এ ধরনের আয়োজনের বিরোধিতা করি। কেননা এ ধরনের আয়োজন করতে হলে বাংলা একাডেমি তা নিজেই করতে পারে। আমি যতদূর জানি বা শুনেছি, তাতে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এ ধরনের একটি আয়োজন হয়েছিল। তারপরে দীর্ঘ দিন গত হয়ে গেলেও বাংলা একাডেমি বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তেমন কোন অনুষ্ঠান করেনি বা করতে পারেনি। কিন্তু এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মত ক্ষমতা বাংলা একাডেমির আছে। হে ফেস্টিভেল করা হয়েছে, এটা কেন করা হল, কাদেরকে প্রমোট করা জন্য– এই প্রশ্ন সকলের মধ্যে। এর উদ্দেশ্য যদি এমন হয়, বাংলাদেশে যারা ইংরেজি মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা করেন তাদেরকে প্রমোট করার জন্য, তাহলে বাংলাদেশে ইংরেজিতে অনেকেই লেখালেখি করেন। তাদের সবাইকে কি ডাকা হয়েছে! আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, যারা অসাহিত্যিক, তারা ইংরেজিতে লেখালেখিও করেন না, ইংরেজি সাহিত্য চর্চাও করেন না এমন অনেককেই এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি এটার কোন মানে খুঁজে পাই না। যদি এই অনুষ্ঠানের লক্ষ্যই এমন হয়, বাংলাদেশে যারা ইংরেজি সাহিত্য চর্চা করেন তাদের প্রমোট করা, তাহলে যারা এ ধারার সাহিত্যিক তাদের সকলকেই খুঁজে বের করতে হবে। এবং সকলকে একত্রিত করতে হবে। আর এই কাজটি করবে যারা হে ফেস্টিভেল উদ্যোক্তা, তারা। বাংলা একাডেমি নয়। বাংলা একাডেমি যেটা করবে তা হল দেশের সকল সাহিত্যিকদের নিয়ে উৎসব করতে পারে। একাডেমি কোন ব্যানারে না গিয়ে নিজেরাই এটা করতে পারে। কারও ব্যানারে গিয়ে বাংলা একাডেমির এ ধরনের অনুষ্ঠান করার কোন যৌক্তিকতা আমি দেখি না।

আহমাদ মাযহার: শিশু সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
…………………………
এ ধরণের একটি আয়োজনে
বাংলা একাডেমির সংম্পৃক্ততাকে
চেতনা বিরুদ্ধ মনে করি

…………………………
হে ফেস্টিভ্যাল বাংলাদেশে হতেই পারে। আমাদের দেশে যারা ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের পরিচিতি পাওয়ার আকাঙ্খা থেকে এ ধরনের আরও আয়োজন হতে পারে। এ বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। তবে এর সঙ্গে বাংলা একাডেমির যে ভূমিকা তা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। বাংলা একাডেমিও এ ধরনের আয়োজন করতেই পারে। তবে সেই ধরনটা হবে ভিন্ন। এখানে এই প্রতিষ্ঠানটি যে ধরণের ভূমিকা পালন করছে তা এই প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাংলা একাডেমির কাজের ক্ষেত্রে যেসব দিকে মনোযোগ থাকা প্রয়োজন সেটা নেই।

আমরা গত বছরও এই উৎসব নিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ফলে এবারে তারা কিছুটা সংশোধিতভাবে উৎসব উদযাপন করছেন। তবুও এখানে সাহিত্যিকদেরকে প্রকৃত শ্রদ্ধাবোধ দেখানো হচ্ছে না। এটা দেখানোর কথাও নয়। এ ধরনের একটি আয়োজনে বাংলা একাডেমির সংম্পৃক্ততাকে চেতনা বিরুদ্ধ মনে করি আমি।

শামসেত তাবরেজী: কবি
…………………………
এ-ধরনের আয়োজনের
পিছনে একটা কু-চিন্তা থাকতে পারে

…………………………
এই উৎসবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তবে পারসেপশনের জায়গা থেকে বলতে চাই, বাংলা একাডেমি অনেক ধরনের অনুষ্ঠান করতে পারে। সেইটা করলে আজকে ভালো হত। কিন্তু তা না করে তারা কিছু গণবিচ্ছিন্ন মানুষের লেখাকে প্রোমোশন করছে, সেটা অবশ্যই কাম্য নয়। আমি কয়েকদিন আগে একাডেমির লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি সেখানে নজরুল সমগ্রের পুরোটা নেই। আমার কাছে সারা বছর নজরুল সমগ্র পাওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের অসুবিধা থাকা সত্বেও সেসব দিকে গুরুত্ব না দিয়ে হে ফেস্টিভ্যালের মত একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যাওয়াটা আমার কাছে কাম্য নয়। বিদেশি কোন উৎসবকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য বাংলা একাডেমির সৃষ্টি হয়নি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তুলে ধরার জন্যই এই প্রতিষ্ঠান। বিদেশি ভাষায় কাজ করতেই যদি চায় তাহলে বাংলা একাডেমি আমাদের সেরা সাহিত্যগুলোকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে সেটা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে পারে। আর একটা কাজ তারা করতে পারে। বিদেশি ভাষার সেরা বইগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করে সেসব বই নিয়ে উৎসব করতে পারে। সেসব না করে একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে কেন্দ্র করে এধরনের আয়োজনের পিছনে একটা কু-চিন্তা থাকতে পারে। টেলিভিশন ও সিনেমার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তকে বিপথগামী করার যে প্রয়াস আমরা দেখি সাহিত্যেও সে ধরনের একটি উদ্যোগ হলেও হতে পারে এটা। আমি একবাক্যে এটাই বলব, আমাদের মধ্যবিত্তকে রুষ্ট করে তোলার জন্য যতগুলো কাজ হচ্ছে এটাও সে ধরনেরই একটি কাজ। এটা আমার কাছে খুবই বেদনাদায়ক বলেই মনে হচ্ছে।

কাজল শাহনেওয়াজ : কবি ও গল্পকার
…………………………
বাংলা একাডেমির
ভূমিকা খুবই হতাশাজনক

…………………………
হে ফেস্টিভ্যাল করে এর আয়োজকরা কী করতে চায় এটা কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেনি। এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে গেলে প্রথম যে শর্ত তা হল সবাইকে অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানাতে হবে। আমরা মনে হয় ওরা কী করতে চায় তা আমরা জানি না। আবার এই আয়োজন যারা করছে তারাও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ওভাবে জড়িত নয়। ওদের পরিচয়ও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আসলে তারা কী করতে চায় এটা জানা দরকার। তারা বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করছে না, বরং অন্য উদ্দেশ্যে এই আয়োজন। এটা আমার কাছে খুবই আর্শ্চয্যজনক মনে হয়েছে।

বাংলা একাডেমির ভূমিকা খুবই হতাশাজনক। এর ভূমিকাও আমার কাছে পরিষ্কার না। এর অনেক বড় বড় এজেন্ডা থাকা সত্বেও তারা সেসব দিকে মনোযোগী নয়। আমি বলব যেসব কারণে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তারা করতে পারেনি। এর মধ্যে বাংলা সাহিত্যের অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে তারা প্রয়োজনীয় সম্মান দেখাতে পারেনি। এর চাইতে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে। আমি মনে করি না এরা তেমন কোন মহৎ কাজ করতে পেরেছে। এরা বইমেলা করা ছাড়া আর কোন কাজ করে কিনা আমার সন্দেহ আছে।

মারুফ রায়হান: কবি ও সম্পাদক, সাহিত্য ম্যাগাজিন বাংলামাটি ডটনেট
…………………………
এ উৎসবের নেপথ্যে অল্প
ক'জন বাঙালি/ অবাঙালির ব্যক্তিস্বার্থের
বিষয়টিও উৎকট হয়ে ধরা পড়েছে

…………………………
আমাদের নিস্তরঙ্গ সাহিত্য-সমাজে একটি সাহিত্য উৎসব শিক্ষণীয় ও আনন্দময় অভিজ্ঞতার উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। লেখক-পাঠক সম্পর্ক-সাঁকো তৈরি এবং নানা দেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও তার থাকে। 'হে ফেস্টিভ্যাল, ঢাকা'-রও থাকত সে সম্ভাবনা যদি তা অনুষ্ঠানকেন্দ্র (ভেন্যু) নিয়ে অহেতুক বিতর্কে না জড়াতো। বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যুক্ত। এটিই পারে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক উৎসবের আয়োজন করতে। শুধু পারেই বা বলি কেন, এটির সে-দায়িত্বও রয়েছে। ভিনদেশের জাতীয় একটি উৎসব হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু হে ফেস্টিভ্যাল একটি রাষ্ট্রের একটি রাজ্যের ক্ষুদ্র একটি শহরের নিজস্ব উৎসব। তাছাড়া এ উৎসবের নেপথ্যে অল্প ক'জন বাঙালি/অবাঙালির ব্যক্তিস্বার্থের বিষয়টিও উৎকট হয়ে ধরা পড়েছে। সাহিত্য উৎসব অবিতর্কিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

আহমাদ মোস্তফা কামাল: কথাসাহিত্যিক
…………………………
বাংলা একাডেমি এই
সমস্ত বিষয়ে মোটেই স্বচ্ছ নয়

…………………………
হে ফেস্টিভ্যাল বা যে কোন ধরনের সাহিত্যের উৎসব হতেই পারে। তবে এখানে কথা হচ্ছে বাংলা একাডেমি এ ধরনের উৎসব করবে কিনা। আমার মনে হয় বাংলা একাডেমি নিয়ে এদেশের প্রতিটি মানুষেরই অনেক প্রত্যাশা। এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা অনেক আশাআকাঙ্ক্ষা করি। এটি মূলত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এই কাজের মধ্যেও নানা রকম অস্বচ্ছতা আছে। তারা উৎসব আয়োজনের আগে তার সদস্যদের কাছ থেকে মতামত নিতে পারত যে আদৌ একাডেমি এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে পারে কিনা। এটা যদি করা হত তাহলে আমার মনে হয় অধিকাংশই নেতিবাচক মতামত দিতেন। আর এটি যতটা আইনের প্রশ্ন তার চাইতেও বেশি নৈতিকতার বিষয় জড়িত। আমাদের প্রত্যাশা বাংলা একাডেমি বাংলা সাহিত্য উন্নয়নে তার সব ধরনের কাজ পরিচালনা করবে। আমি মনে করি, আমাদের বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে সেটা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যদি কাজ করত তাহলে সেটা ইতিবাচক একটি কাজ হত। বাংলা একাডেমি এই সমস্ত বিষয়ে মোটেই স্বচ্ছ নয়। আমার মনে হয় বাংলা একাডেমির আগে এই সমস্ত বিষয়কে পরিষ্কার করা উচিত।

নিয়ামত ইমাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয় লেখক। ইংরেজিতে লেখেন ।
…………………………
বাংলাদেশে বসে ইংরেজি ভাষায়
শুধু নিচুমানের বা অ-মানের ইংরেজি
সাহিত্যই রচনা করা সম্ভব

…………………………
বাংলা একাডেমিকে শুধু বাংলা ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রাণের উৎসবগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখুন। হে ফেস্টিভ্যাল কোন সরকারী আয়োজনও নয়। তারা চাইলেই বৃটিশ কাউন্সিল বা আমেরিকান সেন্টার বা কোন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন বা শ্রেণীকক্ষ বা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হোটেল বা মিলনায়তন ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠানটি উদযাপন করতে পারে। তাদের স্পন্সরদের নিশ্চয়ই অর্থশক্তি কম নয়। তারা যদি কৌশলে নির্বাচিত বিদেশী লেখকদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই একটি উপযোগী ভেন্যুও সার্থকভাবে সংগ্রহ করতে পারে। হে ফেস্টিভ্যাল বিদেশি লেখকদের সাথে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশী লেখকদের যোগাযোগ করিয়ে দেবে – বাংলা একাডেমীর বা সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা বা হে ফেস্টিভালের সাথে জড়িত ইংরেজির অধ্যাপক বা বাংলাদেশী ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিক একথা বিশ্বাস করেন তাদের জেগে ওঠা উচিত। লেখকদের মধ্যে যোগাযোগ এভাবে সৃষ্টি হয় না এবং বাংলাদেশে বসে ইংরেজি ভাষায় শুধু নিচুমানের বা অ-মানের ইংরেজি সাহিত্যই রচনা করা সম্ভব। তাছাড়া যে সব বাংলাদেশী শুধু ইংরেজি ভাষায় লিখে সাহিত্যিক হতে চান তাদের প্রথম ভালবাসা তো বাংলা নয়। বাংলা একাডেমির কাছে তারা যে-কোন মানুষ বা বড়জোর স্বদেশী পর্যটক। তাদের জন্য এর বিশেষ কিছু করণীয় নেই। যারা মনে করেন এই ফেস্টিভ্যাল বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা উৎসাহিত করবে, তাদেরও জেগে ওঠা উচিত। হে ফেস্টিভাল তো ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনাকারী বাংলাদেশী লেখককেও কোন না কোন কারণ দেখিয়ে অনুষ্ঠানের বাইরে রেখেছে। তাছাড়া এটি যদি বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা উৎসাহিত করেও, তাহলেও বাংলা একাডেমী বা বাংলাদেশী মানুষদের খুব একটা খুশি হবার কারণ দেখি না; কারণ, সাহিত্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানতে হলে বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমেই জানতে হবে, বাংলাদেশী ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে নয়। বাংলাদেশীদের রচিত ইংরেজি সাহিত্য বাংলাদেশের সংস্কৃতি বা বাংলাদেশী মানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃত রূপ নির্দেশ করে না।

মতিন বৈরাগী: কবি ও প্রাবন্ধিক
…………………………
বাংলা একাডেমির এ
ধরনের কাজ করা উচিত নয়

…………………………
বাংলা একাডেমির কাজ বাংলা সাহিত্য, বাংলা লেখক, বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে। এ ধরণের উৎসব অন্য অনেকেই করতে পারত। তা না করে বাংলা একাডেমির এ ধরনের কাজ করা উচিত নয়। আমরা যদি এ ধরনের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হে নিয়ে মাতামাতি করি তাহলে কি এর স্বকীয়তা নষ্ট হচ্ছে না?

বিনয় বর্মন: কবি, অনুবাদক ও অধ্যাপক
…………………………
হে ফেস্টিভ্যালটা বাংলা
একাডেমিতে হওয়া উচিত নয়

…………………………
না, আমারতো মনে হয় এটা বাংলা একাডেমির করা উচিত নয়। কারণ হলো এর সঙ্গে আমাদের ভাষার সম্পর্ক, আমাদের ভাষা আন্দোলনের সম্পর্ক; আর যেহেতু বাংলা একাডেমি আমাদের একটা জাতীয় চেতনার প্রতীক। এটা আমাদের জাতীয় ভাষার একটা কেন্দ্রীয় গৃহের মতো। এখানে আমার মনে হয় বাংলা ভাষার জন্য বাংলা একাডেমির কাজ করা উচিত, অন্য ভাষার জন্য এটা নয়; বরং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এই কাজ করতে পারে। বাংলা একাডেমির আসলে বাংলা ভাষার জন্যই নিবেদিত থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়। এবং হে ফেস্টিভালটা বাংলা একাডেমিতে হওয়া উচিত নয় বলেই আমার মনে হয়।

মাহবুব মোর্শেদ: কবি ও সাংবাদিক
…………………………
ধনীর সন্তানদের প্রমোট
করার জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান
সাহিত্য উৎসবে সংশ্লিষ্ট

…………………………
বাংলা একাডেমি বিশ্ব সাহিত্যের কিংবা ইংরেজি সাহিত্যের বা বাংলাদেশে বসে যারা ইংরেজি সাহিত্যে লেখালেখি করেন তাদের নিয়ে কোন অনুষ্ঠান যদি করতে চায়, তাহলে বাংলা একাডেমি নিজের নেতৃত্বে সেটা করতে পারে, অন্য কারোর সহযোগী হিসেবে নয়। বড় সাহিত্যিক এখানে যারা আছেন তাদের নিয়ে, বাংলাদেশে বা বাংলাদেশের বাইরে, তাদেরকে নিযে বাংলা একাডেমি একটা নিজস্ব উদ্যোগে একটা আয়োজন করতেই পারে। কিন্তু হে ফেস্টিভ্যাল কেন? এখন তরুণ প্রজন্ম অনেক সচেতন। বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে তা প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা সহজেই জানতে পারি। 'হে ফস্টিভেল' কোন আহামরি স্ট্যাটাসের ফেস্টিভেল নয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল বা শিল্প-সংস্কৃতির দলগুলোও এ ধরনের সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে। সে সব তারা করে নিজেদের নামে। কিন্তু এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ অবসিত হওয়ার বহুকাল পরে ব্রিটেনের ছোট্ট একটি শহরের নামে এদেশে উৎসব করাটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। সেখানে আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি সংশ্লিষ্টতা থাকলেও আমাদের ব্রান্ডিংটা হচ্ছে না কিন্তু। ভারতের যে সকল লেখক ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করেন তাদের লেখায় কিন্তু ভারতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য উঠে আসে। আর এখানে যারা ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করছেন তাদের ক্ষেত্রে সে বিষয়টি অনুপস্থিত। সব মিলিয়ে এটা কোনভাবেই আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না। আর বাংলা একাডেমির মত প্রতিষ্ঠান যদি এভাবে দেউলিয়াপনা করতে থাকে তাহলে আমাদের দেশের ব্রান্ডিংটাও কখনই হবে না। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও হয়ত এমন দেখা যাবে না যেখানে ধনীর সন্তানদের প্রমোট করার জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান সাহিত্য উৎসবে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে।

শাহিদা বেগম: কথাসাহিত্যিক, আইনবিদ (সহকারী এটর্নী জেনারেল), শিশুসাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা
…………………………
বাংলা একাডেমিতে এ
ধরনের অনুষ্ঠান করে আমাদের
উৎসমূলকে কলঙ্কিত করেছে

…………………………
বাংলা একাডেমি শুধু জাতীয় প্রতিষ্ঠান নয়, আমাদের ঐতিহ্যের উৎসমূল। এই প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হয়েছে ভাষা প্রতিষ্ঠার তারিখ থেকেই। সেখানে একটা বিদেশি ভাষার ফেস্টিভাল বাংলা একাডেমির চত্বরে হতেই পারে না। এটা ব্রিটিশ কাউন্সিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা শিল্পকলা একাডেমি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে হতে পারত। আয়োজকরা বাংলা একাডেমিতে এ ধরনের অনুষ্ঠান করে আমাদের উৎসমূলকে কলঙ্কিত করেছে। এটা কোনভাবেই এইখানে করা যাবে না। আমরা তো আমাদের দরজা বন্ধ করে রাখবো না। ভাষা, সাহিত্য – যেকোন ক্ষেত্রেই। আমাদের দরজা খোলাই থাকবে। যেকোন ভাষা, যেকোন সংস্কৃতির জন্য আমাদের দরজা খোলা। তবে আমরা অপসংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেব না। আমি চাই, যে কোন সুস্থ সংস্কৃতির প্রদর্শনী আমাদের এখানে হোক। সব সময়েই চাইব। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিজেদের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে, ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আমরা কখনোই কোন বিদেশির লেজুড়বৃত্তি করবো না ।

আলফ্রেড খোকন: কবি
…………………………
ওরা আসলে কতিপয় মানুষকে প্রমোট করে
…………………………
আদতে হে ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল সাহিত্যের কোন সম্পর্ক নাই। এটা মূলত একটি দৈনিক পত্রিকা ও বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান মিলে করেন। এখানে আমরা কখনও যাই নাই। অনেকেই এর বিরোধিতা করেছেন। প্রতীকী আন্দোলনও হয়েছে। এবার আন্দোলন হচ্ছে কিনা জানি না। বিষয়টা হচ্ছে আমাদের দেশের কিছু পয়সাওয়ালা লোকের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে লেখালেখি করছে। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেই মনে হয় এই আয়োজন। শুরুটা তো তাই। এখন দেখা যাক ভবিষ্যতে কোথায় যায়। আমি কখনও এই আয়োজন দেখতেও যাইনি। ওখানে কি হয় তা-ও জানিনা। তাই এই উৎসব নিয়ে আগ্রহও দেখাই নাই। আমার কাছে এদেশের উৎসব বলতে একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ, পহেলা বৈশাখ।

এখন তো আর একটা বিষয় পরিষ্কার। ওরা আসলে কতিপয় মানুষকে প্রমোট করে। তারা ধন্যাঢ্য পরিবারের সন্তান। আবার তারা মিডিয়ারও আনুকূল্যে পায়।

নাসের মাহমুদ : কবি
…………………………
অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের/
সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় হওয়াই সঙ্গত

…………………………
'হে ফেস্টিভ্যাল' যদি করতেই হয় তো বাংলা একাডেমির বাইরে অন্য কোথাও এবং অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের/সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় হওয়াই সঙ্গত।