আমার সাধনা

আফসান চৌধুরীআফসান চৌধুরী
Published : 18 May 2022, 08:48 AM
Updated : 18 May 2022, 08:48 AM


চিত্রকর্ম: হুয়ান মিরো

সেই শৈশবে, যখন কারও কথা শুনে ধারণা গ্রহণ করবার মতো সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, তখন আম্মার কাছ থেকে প্রথম শুনি আল্লাহর কথা। তিনি সবকিছু সৃজন করেছেন। তিনি পরম শক্তিমান। তিনি নিরাকার। তাকে দেখা যায় না। তিনি একা। তিনি সাত আসমানের ওপারে থাকেন। এই আল্লাহকে ভাবনায় আনতে কেমন একটা রহস্যময় অনুভূতি হতো। নিরাকারকে তো আর ঠিক-ঠিক কল্পনায় আনা যায় না। আমার চেতনার দূর আসমানে একটি নিঃসঙ্গ ঈগল পাখি উড়ে বেড়াত। গোপনে-গোপনে সেই আল্লাহর সাথে আমার সত্তার যোগ যেন অনুভব করতাম। যেন-বা আমিই সেই পাখিটি। এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারতাম না। ভয় লাগত।

তারপর শুনি নবিজির কথা। তিনি হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান করেছিলেন। তাঁর কাছে জিবরাইল ফেরেশতা ওহি মানে আল্লাহর বাণী নিয়ে আসতেন। নবি মানে মানুষ হয়েও তিনি মানবোত্তর। তাঁর প্রতি বিপুল সম্মানবোধ জাগত। মিলাদ শরিফ ছিল আমার খুব প্রিয়। মিলাদ শেষের মিষ্টির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তো ছিলই। কিন্তু শুধু সেজন্যই নয়। মিলাদে নবির শানে যে সালাম পেশ করা হতো, যে নবিমাহাত্ম্য সুরে ও কাব্যে বর্ণিত হতো তা আমার চেতনাকে আপ্লুত করত।

ইয়া নবি সালাম আলাইকা
ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা
ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা
সালা ওয়া তুল্লা আলাইকা।

এরপরের কাব্যাংশে বিভিন্ন মৌলভি সাহেব বিভিন্ন কালাম গাইতেন। আমাদের সময় বেশি প্রচলিত ছিল কবি গোলাম মোস্তফাকৃত কাব্যটি।

তুমি যে নূরের নবি
নিখিলের ধ্যানের ছবি
তুমি না এলে দুনিয়ায়
আঁধারে ডুবিত সবি…

ইত্যাদি।

এ ছাড়াও আল্লাহ ও রাসুলের বন্দনায় অন্য যেসব কালাম গাওয়া হতো সেগুলোও সুরে ও ছন্দে আমার মনকে লোকোত্তর ভাবে মন্থিত করে তুলত। যেমন :

হাসবি রাব্বি জাল্লাল্লাহ্
মাফি কালবি গায়র উল্লাহ্
নুর-ই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ্
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।

মিলাদের অনুষঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা বলি। আমার নানা ধার্মিক মানুষ ছিলেন। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে তিনি তার নিবাসে আমাকেসহ আমার কাছাকাছি বয়সের মামা-খালা আর সমবয়সী আরও দু-একজন প্রতিবেশী বালক-বালিকা নিয়ে মিলাদ পড়তেন ও শেষে মোনাজাত করতেন যেন আল্লাহ রহমানুর রাহিম সেই দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি থেকে দেশবাসীকে নাজাত দান করেন। তিনি বলতেন, 'তোমরা শিশু। মাসুম। তোমরা হাত তুলে চাইলে আল্লাহ সেটা মঞ্জুর করবেন।'

নবির জীবনের নানা উপাখ্যান শুনতাম বিভিন্ন সূত্রে এবং পড়তাম প্রাথমিক শ্রেণিসমূহের কোনো-কোনো বইয়ে। নবি হেরা পর্বতের গুহায় বসে মোরাকাবা তথা ধ্যানসাধনা করেছেন, সেখানেই তাঁর কাছে প্রথম আল্লাহ তায়ালার বাণী আসে এইসব পড়েছি। তারপর গৌতম বুদ্ধের জীবনীমূলক লেখা পড়েছি। জীবন ও জগতের দুঃখ ও অনিত্যতায় ব্যথিত হয়ে সিদ্ধার্থ মুক্তির উপায় অন্বেষণ করেন এবং নানাবিধ সাধনা করে অবশেষে বৃক্ষতলে সমাসীন হয়ে ধ্যানলিপ্ত অবস্থায় বোধি তথা প্রজ্ঞা তথা উপলব্ধ জ্ঞান লাভ করেন। তাছাড়া মুনি-ঋষিগণ অন্তর্জ্ঞান লাভের জন্য ধ্যান করেন এটাও তো জেনেছিলাম। আদর্শলিপিতে বর্ণপরিচয়ে প্রতিটি বর্ণের সাথে একটি ছন্দিত বাক্য ছিল। ঋ-তে ছিল : ঋষি বসে ধ্যান করে। এইসব সূত্র ধরে ছেলেবেলাতেই ধ্যান বিষয়টার প্রতি একটা গূঢ় অনুরাগ জন্মায়। কাগজের বড় বাক্সের ভিতরে বসে ধ্যান-ধ্যান খেলাও করেছি।

আমার শৈশবে প্রায়শই ঝিম ধরা দুপুরে এক ফকির আসতেন। আমার মা তাকে খেতে দিতেন। তিনি ঠিক সাধারণ ভিখারি ছিলেন না। তখন বুঝতাম না, পরে অনুমান করি, তিনি কোনো সাধক ফকির-দরবেশ ছিলেন। কে জানে কেন আমাকে তিনি পছন্দ করতেন। আর আমিও তার প্রতি কেন যে অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলাম জানি না। তাকে আমি কী বলতাম তার কিছুই মনে নাই, তবে এটা মনে আছে যে তার সাথে আমি খুব অনুচ্চ স্বরে কথা বলতাম। তার সাথে আমার এই ঘনিষ্ঠতা দেখে সম্ভবত কোনো শঙ্কা জেগেছিল আমার অভিভাবকদের মনে। ওনাকে আসতে নিষেধ করা হয়েছিল যতদূর মনে পড়ে। তার জন্য আমার সংগোপন একটা বিরহ তৈরি হয়েছিল। তার একটা কথাই আমার মনে আছে, তিনি বলতেন, 'বড় হলে তুমি দরবেশ হবা।' হয়তো এটা তার আশীর্বাদ ছিল। কিন্তু তার এই কথাটি দেশনার বীজরূপে আমার অন্তরে প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে যায়। পরবর্তীতে আমি দরবেশ না হয়ে গেলেও, দরবেশি ভাবচ্ছায়ায় যে আচ্ছাদিত হয়েছি তা হয়তো ওই ওলির আশীর্বাদেরই বাস্তবায়ন। তিনিই আমার খোয়াজ খিজির।

ওপরের বর্ণনা পড়ে এরকম মনে হতে পারে যে আমার শৈশব ও বাল্যকাল কেবলমাত্র অধ্যাত্মিক ভাবধারাতেই সংলিপ্ত ছিল। আসলে তা নয়। ওটা ছিল একাংশ। এর বাইরে জীবন-ও জগতের বহুরকম ভাব ও আবেগ, ভাবনা ও কল্পনা, বাসনা ও সংকল্প নিশ্চয়ই আমাকে অধিকার করেছিল।

একেবারে শৈশব থেকে আমার গল্পের বই ও তারপর নানা ধরনের বইপত্র পড়বার শখ ও অভ্যাস প্রবল ছিল। বিবিধ বই ও পত্রিকায় পড়া নানারকম তথ্য, চিন্তা, ঘটনা ইত্যাদি আমাকে নানাভাবে ভাবিত ও প্রভাবিত করেছে। আর বাল্যকাল থেকেই সাহিত্য বিশেষত কবিতার প্রতি আমার খুব আকর্ষণ ছিল। আমিও একজন সাহিত্যিক হবো, এমন একটা বাসনাও তৈরি হয়েছিল। আমার সমবয়সী অন্যান্য পরিচিত বালকদের চাইতে আমার একটা ভিন্নতাও হয়তো পরিলক্ষিত হতো। আমাদের পাড়ার অগ্রজ কেউ-কেউ আমাকে 'ভাবুক স্বভাবের' বলেও চিহ্নিত করেছিলেন। আর আমার বিবিধ কর্মকাণ্ড ও আচরণ ভালো-মন্দ, প্রশংসিত-নিন্দিত ইত্যাদি বৈচিত্র্যে তরঙ্গিত ছিল। তবু ঈশ্বরে ও ধর্মে বিশ্বাস এবং সেই সঞ্জাত ভাব ও আবেগ আমার মনোরাজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান হিসেবেই ছিল।

তার বিপরীত ঘটনা ঘটল যখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। থিসিসের পর তো অ্যান্টিথিসিসই আসে। ওইসময় মার্কসীয় ভাবধারার দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ পড়ে আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস ভেঙে যায়। ওই সময়ে আমার বাল্যপ্রেমে বিপর্যয় আমাকে এমনিতেই বেশ বিক্ষত ও আশাহত করেছিল। সেই মানসিক প্রতিবেশে পরমেশ্বরের বিশ্বাস ধ্বসে পড়ার ঘটনা একটু মর্মান্তিকই হয়েছিল। চট করেই যে তা হয়েছিল এমন নয়। বরং কয়েকটা দিন ধরে আমার ভিতরে তুমুল যুদ্ধ হতে থাকে। আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আমার ঈশ্বরকে আমি হত্যা করতে পারলাম বলে মনে হলো। কিন্তু তখন নিহত ঈশ্বরের প্রেতাত্মা নিশ্চয়ই সংগোপনে পরিহাসের হাসি হেসেছিলেন। বালকেরা তো কত কিছুই করে ফেলেছে বলে ভাবে। একটা সময় পার হবার পরেই সব কিছুর রূপ-স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এসএসসি-র পর থেকেই সাহিত্য বিশেষত আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে পড়াশোনা বাড়তে থাকে। ঢাকা কলেজে পড়বার সময় যদিও মার্কসবাদের বেশ একটা দীপ্ত আবহ ছিলো চেতনায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়বার সময় তা পুরোই আধুনিকতাবাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নতা, মৃত্যুবোধ, মাদকাসক্তি, নৈরাশ্য, ব্যর্থতা, সমাজবিমুখতা ইত্যাদি নেতিবাচক উপাদানময় সাহিত্য, সাহিত্যিকদের অবক্ষয়ী জীবনাচারের কাহিনি এবং আমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রকাশ্য ও গোপন নানা উপাদান — যার মধ্যে মাদকাসক্তি একটি এবং বিশ্বাসহীনতাও হয়তো-বা আর একটি — আমাকে ভয়ানকভাবে অধিকার করে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিই না। প্রায়-ভবঘুরে জীবন যাপন করি। কয়েক বার আত্মহত্যার প্রয়াস নিই। এরপর একসময় এমন অবস্থা হয়েছিলো যে তখন আমি শুধু অস্তিত্বশীল আছি — প্রায় জড়বস্তুর মতো, জীবন সম্পর্কে আর কোনো অনুভবের ক্ষমতাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসবার জন্য, নিজেকে পরিচালিত করবার জন্য, একটি পথ খুঁজে পাওয়া তখন আমার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

এইসময় আমরা সবুজবাগ এলাকা ছেড়ে বাড্ডার নিবাসে অধিবাসী হই। তখন বেশ অনেকদিন আমি নিজেকে গৃহে স্বেচ্ছায় অন্তরীণ রাখি। মাদক সংশ্রব পরিত্যাগ করি। বিড়াল-কুকুরের সখ্য উপভোগ আর উদ্ভিদচর্চায় কিছু সময় দিয়েছিলাম তখন। শহরের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রহিত হতে থাকল। নিজেকে ইতিবাচকভাবে সময় দিতে শুরু করলাম।

এইসময় আমি ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের বই ও ধর্মদর্শন সম্পর্কে পড়তে শুরু করি এবং প্রাচ্য ও পশ্চিমা দর্শনের মূল কথাগুলোও বুঝবার চেষ্টা করি। বেশ কিছুকাল এসব বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে আমার এই প্রত্যয় হলো যে 'নিজেকে জানো' — এইটিই সব ধর্ম ও দর্শনের সার কথা। বুদ্ধিগতভাবে বুঝলাম যে আল্লাহ হলেন চেতনার শুদ্ধ ও পূর্ণ রূপ, তিনি জগতেরও সারসত্তা ও এককত্ব। আর, সাধনপদ্ধতি হলো নিজের ভিতরের দিকে তাকানো — সালাত তথা যোগ তথা ধ্যানের সহযোগে।

ওইসময় ধ্যান-সম্পর্কিত বইপত্র সংগ্রহ করতে শুরু করি, যা কিছু নাগালে পাই। ওইসব পড়ে ধ্যানবিষয়ক প্রাথমিক ধারণা হবার পর নিজের শরীর-মনে শিথিলতা এনে, এক বিষয়ে মনকে নিবদ্ধ করে ধ্যানের প্রয়াস নিই। এবং প্রথমবারেরই এটুকু বুঝি যে ধ্যান জিনিসটা কাজ করে। আমাকে এই প্রক্রিয়াতেই সময় দিতে হবে।

এইসময় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে শুরু করি। সেটা হলো নিজের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি ও ভুল সনাক্ত করে তালিকা করতে থাকা। প্রথম অবস্থায় এতে একটু অসুবিধা হতো। সাধারণত আমরা তো পরের ভুল-দোষ দেখতেই অভ্যস্ত থাকি। নিজের ত্রুটি চিহ্নিত করতে ইগো বা অহমিকা তো একটু বাধা দেয়ই। ক্রমে-ক্রমে তালিকা বাড়তে থাকে। আরেকটা তালিকা করি অন্যদের চোখে আমার সীমাবদ্ধতা-দোষ-ভুলের। অন্যেরা আমার এইসব বিষয় কীভাবে দেখে ও ভাবে তার তালিকা। তারপর আমি খুঁজি, যাদের সাথে আমার বিভিন্ন সময় মনোমালিন্য হয়েছে সেইসব ক্ষেত্রে আমার নিজের দায় কোথায়। আমি আরও স্মরণ করবার চেষ্টা করি, বিভিন্ন সময় আমি যে-সব অপকর্ম-অপরাধ ও ভুল আচরণ করেছি সেইগুলো। আমি আরও স্মরণ করবার চেষ্টা করি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় আমার মনে যেসব অপ্রিয় ও দুঃখজনক অনুভূতি হয়েছে, যা আমার ব্যক্তিত্ব ও আচরণকে প্রভাবিত করেছে সেইসব। অর্থাৎ অনাসক্ত ও নিরপেক্ষভাবে আত্নপাঠের বেশ একটা নিবিষ্টতার মধ্যে নিজেকে তখন ব্যস্ত করেছিলাম।

এরপর আমি এই সুফি-বৈষ্ণব-বাউলসহ বিবিধ ভাবদর্শন ও সাধনমার্গ নিয়ে আরও চর্চা করতে শুরু করি, নানা রকম বই পড়ি, অধ্যাত্মবাদের চর্চার সাথে জড়িত নানা জনের সাথে পরিচয় হয়। প্রথম পরিচয় হয় বাতেন সরকার সাহেবের সাথে। তিনি আমাদেরই গৃহের একাংশ ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি সারাদিন ক্যাসেট বাজিয়ে লালনের আর ভক্তিমার্গের নানা রচয়িতার ফকিরি গান শুনতেন। এইসব গানের রূপক-প্রতীক নিয়ে আলাপের সূত্রপাত। তিনি ছিলেন একজন ফকিরি ধারার গুরুবাদী মানুষ। তখনও তো ফকিরি ধারার বিষয়-আশয় ভালো বুঝতাম না। এর আগে, নাস্তিক্যবাদের কালে, পীর-ফকির মানেই ভণ্ড — এমন ধারণাই পোষণ করতাম। বাতেন সাহেবের কাছ থেকে ফকিরির দর্শন ও চর্চা বিষয়ক নানা ধারণা লাভ করি। তার সাথে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে বাবা শরফুদ্দিন চিশতি ও মিরপুরে বাবা শাহ আলি বোগদাদির মাজার শরিফে যাই। মাজারের পরিবেশ, ভক্তকুল, বিবিধ চর্চা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হতে শুরু করে।

এই বাতেন সাহেবের মাধ্যমেই তরিকতপন্থী মাসুদ মেহেদি ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। উনি বেশ ভালো বলিয়ে লোক। সুফিভাবধারার বয়ান অনর্গল বলে যেতে পারেন। উনি একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। মাঝেমাঝেই তার চেম্বারে গিয়ে বসি। তার সাথে কথোপকথনে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হয়। কারণ আমার পূর্বকালের যুক্তিবাদী মানসিক অভ্যাসের কারণে যে-যে বিষয়ে খটকা লাগে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন কিংবা তর্ক তুলি। এসবের মধ্য দিয়ে আমার সুফিভাবধারা বিষয়ক ধ্যান-ধারণা একটু-একটু করে বিকশিত হতে থাকে।

মেহেদি মাসুদের পীর হলেন বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী। তার নাম আমি আগেই জানতাম। আশির দশকের মাঝামাঝি এরশাদ সরকার 'মারেফতের গোপন কথা' নামক একটি বই নিষিদ্ধ করে। তখনই বইটার কথা জেনেছিলাম, রচয়িতার নামও। কিন্তু তখন বইটি পড়া হয়নি। মেহেদি মাসুদের কাছ থেকে বাবা জাহাঙ্গীর রচিত বই নিয়ে পড়লাম। পড়ে বেশ অবাক হলাম। কারণ এতকাল ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে যেরকম ধারণা ছিল সে হিসেবে অনেক কিছুরই এখানে একেবারে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেইসব ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য আমার কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হলো। মেহেদি মাসুদের কাছ থেকে শাহ সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী রচিত কিছু গ্রন্থ পড়েও অবাক হলাম। এখানেও প্রচলিত অনেক ধারণার ভিন্নরকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেলাম। এই পাঠ আমার মনকে সুফি ভাবধারার দিকে আরও এগিয়ে দিল।

কিছুকাল পরে মনে হলো, আমি তো ধ্যানসাধনা, আত্মপাঠ ও আত্মশুদ্ধির পথে একাকী এগিয়ে চলেছি। কিন্তু এদেশে যে সকল পীর-ফকিরের খানকা-আখড়া-দরগা-দরবারে এই ধরনের চর্চা বিদ্যমান আছে তাদের কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা নিলে তো ভালোই হয়। মেহেদি মাসুদ ভাইকে বললাম যে তার পীরের দরবারে দর্শনার্থী হিসাবে যেতে চাই। এরপর একদিন তিনি জানালেন, কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় তার মুরশিদের দরবারে ওরস অনুষ্ঠান আছে, আমি যেতে পারি। সেইমতো একজন সঙ্গী নিয়ে বুড়িগঙ্গার ওপারে চলে গেলাম। এই প্রথম কোনো পীরের দরবারে আমার উপস্থিতি।

চুনকুটিয়ার চৌধুরীপাড়ায় বাবা জাহাঙ্গীরের দরবারে গিয়ে দোতলায় তাঁর আসনঘরের সামনে চলে এলাম। তাঁর কক্ষের সামনে গিয়ে দেখি, সেখানে অনেক মানুষের ভীড়, কিন্তু সবাই বসে আছে স্থির হয়ে। ক্যাসেটে কাওয়ালি গান বাজছে লাউড স্পিকারে জোরে। কাওয়ালিটি শেখ সাদি রচিত বিখ্যাত রুবাই 'বালাগাল উলা বি-কামালিহি'কে ভিত্তি করে মহানবির মেরাজের আবহে রচিত। কাওয়াল দুই ভাই — সাবরি ব্রাদার্স নামে পরিচিত — একজন গোলাম ফরিদ সাবরি ও অন্যজন মকবুল আহমেদ সাবরি যুগলভাবে এই গানটি করেন। বড় অপূর্ব, বড় মনমাতানো এই উপস্থাপনা। কক্ষের মাঝখানটায় বাবা জাহাঙ্গীর সমাসীন। তাঁকে ঘিরে পুরো কক্ষে ভক্ত-আশেকেরা বসে আছেন। তিনি ধ্যানস্থ। তিনি সমাহিত। আর ধ্যানে নিমগ্ন মানুষের মুখে অপূর্ব এক বিভা থাকে। যে যত নিমগ্ন থাকেন, যত চিত্তানন্দে থাকেন, তার মুখমণ্ডল তত স্নিগ্ধ থাকে। তাঁর স্নিগ্ধ ও স্থির মুখ আমি দেখতে থাকলাম। ওই সময়ের বিবরণটা যেন-বা মিলে যায় হজরত আমির খসরুর একটি কালামের সাথে, যেখানে তিনি বলছেন, গতরাতে তিনি এক দিব্য মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে উজ্জ্বলতম প্রদীপ হয়ে বসেছিলেন স্বয়ং মহানবি। 'মুহাম্মদ শাম-ই মেহফিল বুদ সব জায়েকে মান বুদাম।'

এই প্রসঙ্গে এটুকু বলে রাখা যায় যে এই আমার প্রথম উপভোগের সাথে কাওয়ালি শোনা। পরবর্তীতে অসংখ্যবার অনেক-অনেক উত্তম কাওয়ালি গান শুনবার ও তার সাথে ভাবের সংযোগ ঘটবার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। কারণ বাবা জাহাঙ্গীর কাওয়ালি গানের সমঝদার আর তাঁর দরবারে নিত্যনিয়মিত কাওয়ালি গান বাজানো হয় বিখ্যাত শিল্পীদের রেকর্ডকৃত কিংবা সরাসরি শিল্পীর কণ্ঠে। আর দরবারের ওরসে তো ভাবমূলক গান-বাজনার জমজমাট আসর চলতেই থাকে। ভাবসাধনার সাথে সঙ্গীতের নিগূঢ় সংযোগ রয়েছে। চর্যাপদ তো বৌদ্ধ সাধকদের সাধনমূলক সঙ্গীত, বাউল ও লালনগীতি যেরকম। তাছাড়া কাওয়ালি, ভজন, কীর্তন, শ্যামা, মুরশিদি, বিচ্ছেদ, মাইজভাণ্ডারি ইত্যাদি বহুতর ঘরানার গান মরমিধারা ও সাধনমার্গের সাথে সম্পর্কিত। এইসব গানে প্রাসঙ্গিক ভাব জমাট বাঁধে, হাল বা দশা তৈরি হয়, বাদ্যযন্ত্রের তালে জিকির-জপের স্পন্দন তৈরি হয়।

কাওয়ালি শেষ হবার পর তিনি ধ্যান হতে জাগলেন। একটু পর তিনি ওই কক্ষের বাইরে এলেন। ভক্তিমুদ্রায় তাঁকে প্রণতি জানিয়ে বললাম, 'আমি আপনাকে দেখতে এসেছি।' তিনি স্মিতমুখে বললেন, 'আপনি এসেছেন এতে আমি খুশি হয়েছি। নিচে এখন কাওয়ালি গানের আসর বসবে। চলেন যাই।' নিচে শেষ রাত পর্যন্ত কাওয়ালির আসর চলল। সকালে চলে এলাম।

এরপর ভাবলাম, আমি তো গেছি অনুষ্ঠানের দিন, প্রতি সপ্তাহে তিনি তার ভক্তদের নিয়ে যে মাহফিলে বসেন তখন কী বলেন, কী শেখান, তা একবার দেখে এলে হয়। সুতরাং মেহেদি মাসুদ ভাইয়ের সাথে এক বৃহস্পতিবার গেলাম দরবারে। তাঁর দেশনা শুনলাম। তাঁর বই পড়ে আগেই বুঝেছিলাম তিনি শুধু অন্তর্জ্ঞানীই নন, তাঁর বইপত্র পড়াও বেশ ব্যাপক। নিটশে যাঁর প্রিয় দার্শনিক, এমনকি নিজের এক কন্যার নাম যিনি নিটশে রেখেছেন, তাঁর তো পাঠ বিস্তৃতই হবার কথা। পীর বলতে সাধারণত যে ভাবমূর্তি আমাদের সামনে আসে তিনি তেমন নন। আমি যে পটভূমি থেকে এসেছি তার সাথে তাঁর অনেক মিল পাওয়া যায়। তাঁর বয়ানের পর উপস্থিত সবাই মিলে তাঁর সাথে ওজিফা ও সাজরা শরিফ পাঠ, জিকির, মোনাজাত ইত্যাদি কার্যক্রম চলল। এসব আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। কিছুদিন পর আবার এক বৃহস্পতিবারে গেলাম। এভাবে মাঝে-মাঝে যাওয়া শুরু করলাম। তিনি আমাকে প্রথম থেকেই বেশ একটু বিশেষ স্নেহ করতে থাকলেন। ওনার সন্তানেরাও খুব আন্তরিক। তারা আর অন্যান্য ভক্তগণ ক্রমে আমাকে আপন করে নিতে থাকলেন। আমি ওখানকার মুরিদ না হয়েও ওখানকার একজন হয়ে উঠতে লাগলাম। ভক্তদের সাথে বিভিন্ন মাজারের ওরস মাহফিলে যাওয়া হতে লাগল। ফলে আমার অভিজ্ঞতাও বাড়তে লাগল।

এদিকে আমার বসবাসের এলাকা বাড্ডায় বাবা জাহাঙ্গীরের এক মুরিদ মোস্তফা ভাই তার নিবাসে একটি খানকা স্থাপন করলেন। সালাম মাস্তান নামে বাবা জাহাঙ্গীরের এক মুরিদ ও খলিফা সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে যেতাম। আরও কয়েকজন নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে আসতেন। সেখানে ক্যাসেটে ভাবের গান বাজিয়ে আমরা ধ্যান ও জিকিরে মশগুল থাকতাম। এইখানে আমার বেশ একটা ভাবচর্চা হয়েছিল।

এভাবে বেশ কিছুকাল কাটল। বাবা জাহাঙ্গীরের দরবারে যাওয়া-আসা করতে-করতে তাঁর শিক্ষার মূল বিষয়গুলো ততদিনে বুঝে ফেলেছি ও সেগুলো গ্রহণযোগ্যও মনে হয়েছে। তাঁর সাথে শ্রদ্ধা-স্নেহের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বেশ গভীরতায় স্থিতিও পেয়েছে। তখন তাঁর কাছে বায়াত গ্রহণ করাটা কেবল আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার মাত্র। ভাবলাম, এই আনুষ্ঠানিকতাটুকু না হলে অন্য ভক্তদের সাথে আমার কোথাও একটা সীমারেখা থেকে যায়। ওটা দূর করাই ভালো। অতএব তাঁর কাছে প্রথমবার যাওয়ার দশ মাস পরে এক বৃহস্পতিবারে যখন বললাম যে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে মুরিদ হতে চাই, ভোররাত চারটার দিকে তিনি আমাকে বায়াত দিলেন। প্রেম তো প্রতিষ্ঠিত হয়েই ছিল, এখন কলমা পড়ে বিয়ে হলো।

বাবার দরবারে যারা নিয়মিত আসতেন তারা ছাড়াও প্রায়সই বিভিন্ন লোকজন আসতেন। কেউ আসতেন বাবার বই পড়ে বা কারো কাছে শুনে তাঁকে দেখার জন্য, তাঁর কথা শুনবার জন্য, তাঁর কাছে মুরিদ হবার জন্য, তাঁর নির্দেশিত ধ্যানসাধনা করবার জন্য। আবার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, জাগতিক বিবিধ সংকটে পড়েও অনেকে আসতেন। পীর-ফকিরদের কাছে আত্মিক উন্নয়ন বা আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য যত মানুষ যায় তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ যায় জাগতিক চাওয়া-পাওয়া-সংকট মোচনের জন্য। মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে, তার বিপন্নতার কথা বলার মতো কাউকে পায় না, তখন সান্ত্বনা কিংবা দোয়া কিংবা কোনো সমাধানের জন্য পীর-ফকিরদের মাজারে ও দরবারে ছুটে যায় তারা। কারো-কারো মনোবাঞ্ছা পূরণও হয়। বাবার দরবারে সংশ্লিষ্ট হবার ফলে বহু বিচিত্র মানুষের সাথে পরিচয় হলো। পীর, ফকির, মাস্তান, জ্ঞানী, ভক্ত, সাধক, ভাবুক — নানা মাত্রার গুণীজন।

বাবার সাথে ও গুরু ভাইদের সাথে বিভিন্ন মাজারে ও ওরসে যাওয়া হয়েছে। আবার ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেক জায়গায় গিয়েছি। ফলে দেশের বিবিধ বিখ্যাত, কম পরিচিত, প্রায় অপরিচিত বিভিন্ন মাজারে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ওলির স্মৃতিসংসর্গে নানাবিধ অনুষ্ঠান-আচার এবং সাধু ও আশেকদের সমাবেশ থেকে প্রেম-ভক্তি ও ধ্যানময় আবহে আমার চিত্তচেতনা উষ্ণ ও উজ্জ্বল হয়েছে। অচেনা মানুষদের কাছ থেকেও যে ভালোবাসা পেয়েছি তাতে সমৃদ্ধ হয়েছে আমার হৃদয়। বস্তুত কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, ফকিরির আবহে এত বছর সময় কাটিয়ে তুমি কী পেয়েছ? আমি নির্দ্বিধায় বলব : পেয়েছি ভালোবাসা, অহেতুক ভালোবাসা — এইটুকুই আমার পাওয়া। গুরুর কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছি, তাঁর সন্তানদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছি, তাঁর ভক্তদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছি এবং একদম অচেনা-অজানা আশেকজনাদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই আমার ফকিরি জীবনের সম্পদ।

বাবার কাছে বায়াত নেবার পর তিনি আমাকে ধ্যানসাধনায় বসতে বললেন। বাবার বইপত্র ও ওয়াজ-আলোচনায় যে-বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো ধ্যানসাধনা। আত্মজ্ঞান (নিজের নফস তথা প্রাণের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রবৃত্তি ও প্রবণতাসমূহকে জানা) ও আত্মশুদ্ধি (নিজের ভিতরের শয়তান তথা আমিত্ব বা ইগোকে নিয়ন্ত্রণ) হলো এর প্রধান বিষয়। অস্থির-চঞ্চল মনকে ধ্যানের বিষয়ে (গুরুর অবয়ব) নিবদ্ধ রেখে ক্রমে মনের গভীরে ডুবে যাওয়ার সাধনা এটা। কামালিয়াত বা আত্মসিদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবার জন্যই এই ধ্যানসাধনা। বাবা জাহাঙ্গীরের কাছে কেউ মুরিদ হতে এলে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, 'বাবা, তুমি কি ধ্যানসাধনা করবা? করলে আসো, মুরিদ হয়ে সাধনা করো। সাধনা করে সত্যের কোনো নিদর্শন না পেলে আমাকে ফেলে চলে যেও। পীর বড় নয়, সত্যই বড়। সাধনা না করলে শুধু-শুধু "বাবা" ডেকে কোনো লাভ নাই। আসবা-যাবা, গানের সাথে লাফাবা, কিছু কথা শিখে অন্যকে হারায়ে দিবা, এইসবের কোনো মূল্য নাই। পীরের কাছে কোনো আইসক্রিম নাই যে খাওয়ায়ে দিলে তুমি কামেল হয়ে যাবে। তোমার সাধনা তোমাকেই করতে হবে।'

সাধনার জন্য বাবা তার ভক্তদের বিভিন্ন স্থানে পাঠান। নরসিংদীর শিবপুরে নৌকাঘাটা গ্রামে একটি ফলবাগানে তিনি সাধনালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে একজন বসতে পারত। তারপর আরও দুটি ঘর করা হয়। তারপর বারো-তের জন সাধনায় বসবার মতো কক্ষ তৈরি হয়। 'ইসকুল খুইলাছে রে মাওলা ইসকুল খুইলাছে' গানের প্রেরণায় আমরা এই সাধনকেন্দ্রকে বাবার ধ্যানসাধনার ইসকুল বলি। এখানে ছাড়াও বিভিন্ন মাজারের সন্নিহিত নিরিবিলি স্থানে নিভৃত কক্ষে সাধনার জন্য বাবা পাঠান।

বাবার কাছে বায়াত নেবার আগেই আমি নিজেদের বাড়িতে দুবার চল্লিশ দিন করে সাধনার প্রাকটিস করেছিলাম। বাবার দেওয়া সাধনায় কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। সাধনা চলাকালে মাছ-মাংস-ডিম খাওয়া নিষেধ। এইসময় পোশাক হিসেবে পরতে হয় দুই খণ্ড সাদা কাপড়, হজের সময় এহরাম পরিধান করা হয় যেভাবে। এই সময়কালে কথা বলা নিষেধ। বই পড়াও নিষেধ। যৌনাচরণ তো নিষেধই। ধ্যানসাধনা হিসেবে গুরুর অবয়ব একাগ্রভাবে স্মরণ করতে হয়। ওটিই ধ্যানের বিষয়। এইসময় গুরুর শেখানো পদ্ধতিতে জিকির করতে হয়। গুরুর দেওয়া ওজিফা পড়তে হয় নির্দিষ্ট সংখ্যায়। ধ্যান করতে হয় অন্ধকার ঘরে এবং রাতের বেলায়। পরিবেশটা নিরিবিলি হওয়া চাই। কিন্তু ঘরের প্রাকটিস মানে ঘরের প্রাকটিসই। কারণ নিজের বাড়িতে আছি মানে নিজের সবকিছুর মধ্যে আছি। বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেলেই অভ্যস্ত সংযোগ অর্ধেক কেটে যায়। মনের মধ্যে থাকে সবকিছুই, কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করাই তো সাধনার একটি মাত্রা। বাড়ির প্রাকটিসে অন্তত একস্থানে বসে ধ্যানপ্রচেষ্টার এবং জিকির ও ওজিফা পড়ার মকসো করা যায়। চঞ্চল-অস্থির-বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত ও একাগ্র করবার প্রয়াস নেওয়া যায়।

বাবা আমাকে প্রথমবার সাধনায় পাঠালেন বগুড়ায়। প্রথমে মহাস্থানগড়ে গিয়ে বাবা শাহ সুলতান বলখীর মাজার শরিফে ভক্তি দিয়ে, সেখানে কিছু সময় অবস্থান করে গেলাম কাহালুতে কালু শাহ বাবার মাজারের কাছে এক নিভৃত কক্ষে। অগ্রজ গুরুভাই নজিবর শাহ সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেখানে একচল্লিশ দিন অবস্থান করেছিলাম। সাধনা ব্যাপারটা আসলে যে কী তা বুঝতে-বুঝতে আর ধ্যানে মন বসাতে-বসাতেই চল্লিশ দিন কেটে যায়।

প্রথম অবস্থায় সাধককে দুটো প্রবল সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। একটি হলো মনের চঞ্চলতা। মন তো একটা মাতাল বানরের মতো। বিষয় হতে বিষয়ান্তরে লাফিয়ে বেড়ায় সে। প্রথমে গুরুর চেহারা স্মরণ করতে গিয়ে দেখা যায় সেটা ঠিকমতো আসছে না। যদি-বা এসেছে তো কয়েক সেকেন্ড পরেই মন অন্য কোনো বিষয়ে লিপ্ত হয়ে যায়। কতক্ষণ পরে মনে পড়ে, আরে আমাকে তো গুরুর ধ্যান করতে হবে। তখন মনকে আবার নিয়ে আসতে হয় ধ্যানের বিষয়ে। এইভাবে বারবার মন দিগবিদিকে ছুটে যায়, আবার তাকে ধ্যানে ফিরিয়ে আনতে হয়। এটাতেও মনে একরকম অস্থিরতা তৈরি হয়। ধ্যান হচ্ছে নাকি হচ্ছে না, এই নিয়ে মনে সংশয় তৈরি হয়। মনকে শান্ত ও স্থির করবার জন্য ধ্যান শুরুর আগে কয়েকটা কাজ করে নিতে হয়। এর নানাবিধ উপায় আছে। যেমন প্রথমেই নিজের শরীরে মুরশিদের অস্তিত্ব আরোপ করে নিতে হয়। পায়ের আঙুল থেকে মাথার চুল পর্যন্ত একে একে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খেয়াল করে 'এটা আমার নয়, এটা আমার গুরুর' — এরকম ভেবে নিতে হয়। তারপর এখানে আমি বসে নাই, আমার মুরশিদ বসে আছেন — এই ভাবনা ভেবে নিজের দেহবোধের অনুভবকে একটু পরোক্ষ করে দেওয়া যায়। তারপর ধীরে-ধীরে দীর্ঘ করে কয়েকবার দম নিয়ে ও ছেড়ে এরপর নিঃশ্বাসকে স্বাভাবিক হতে দিতে হয়। তারপর দুই নাকের ফুটো দিয়ে যে শ্বাস-প্রশ্বাস ঢুকছে আর বের হচ্ছে এটা মনের চোখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ বা অনুভব করলেই শরীর ও মন বেশ হালকা হয়ে যায়। ধ্যান করবার মনোদৈহিক পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। এইবার দুই ভুরুর মাঝখানে মাকামে মাহমুদা বা আজ্ঞাচক্রে মনেনিবেশ করে গুরুর অবয়বের ধ্যান শুরু করতে হয়। অবশ্য ধ্যানের আরও অজস্র রকম পদ্ধতি আছে। তবে গুরু যে-পদ্ধতি শেখান সেইটা অবলম্বনই ভক্তের জন্য বিধেয়।

সাধককে দ্বিতীয় যে সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় সেটা হলো ভয়। ভয় একটা শক্তিশালী মানসিক বৃত্তি। মন-মস্তিষ্কের অনেক গভীর স্তরে এর অধিষ্ঠান। কিছু ভয় একেবারে জেনেটিক স্তরে আছে। মৃত্যুভয়, অন্ধকারকে ভয়, সাপ ও বিবিধ হিংস্র প্রাণীর ভয়, আকস্মিক শব্দে ভয়, আগুনের ভয়, জলে ডোবার ভয়, ভূমিকম্পের ভয়, অনিশ্চয়তার ভয় ইত্যাদি। তাছাড়া রয়েছে ভূত-প্রেত-জিন ইত্যাদি অশরীরী অতিপ্রাকৃত সত্তার ভয় যা শৈশব থেকে শোনা-জানার ফলে মনের গহন স্তরে জমাট বেধে থাকে। ফলে পরবর্তীতে যুক্তিশীল মন যদি এসবকে না-ও মানে তবু নির্জনে অন্ধকারে ওইসব ভয় নানাভাবে চেতন মনকে প্রকম্পিত করে। তদুপরি সাধনা বিষয়ে নানান ভীতিকর গল্পকাহিনি ও বর্ণনা আছে, যেগুলো তখন মনকে পেছন থেকে নানাভাবে আন্দোলিত করে। আসলে বাইরে থেকে কোনো জিন-ভূত, কালী-চামুণ্ডা, দৈত্য-শাঁকচুন্নি, রাক্ষস-খোক্কস, বাঘ-ভাল্লুক, সাপ-ড্রাগন কিছুই আসবার দরকার নাই, মনের ভেতরে ওইসবের যে ধারণা আছে ওগুলোই তখন মূর্তিমান হতে থাকে। তখন টিনের বেড়ায় টিকটিকির লেজের আঘাতের শব্দে মনে হয় যেন ঘরে ড্রাগন ঢুকে পড়েছে। বাতাসে গাছের ডাল টিনের চালে বাড়ি দিলে মনে হয় উপরে ভূত-প্রেতে উদ্দাম নৃত্য শুরু করেছে। আর গহীন অন্ধকারে কল্পনার প্রেরণায় কতরকম ভয়ানক আকৃতি যে দেখতে পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নাই। এইসব ভয়কে অতিক্রম করে শান্ত মনে ধ্যান করবার জন্য সাধককে অনেকটা সময় পার করতে হয়। এবং অনেকেই প্রথম পর্যায়ে মনের অস্থিরতা অথবা ভয়ের কারণে সাধনায় ক্ষান্ত দিয়ে চলে যায়।

কাহালু থেকে ফেরার পর কিছুকাল কাটল। সাধনার একটা ফল হলো, মুরশিদের সাথে অন্তরের যোগ বাড়ে। আর যারা সাধনা করে ফেরে তাদেরকে বাবা একটু বিশেষ স্নেহ দেন। বাবার বাড়িতে আমি আগের চেয়ে বেশি সময় দিতে লাগলাম। এভাবে কিছুকাল কাটবার পর বাবা আমাকে সাধনায় বসালেন নরসিংদীর সাধনালয়ে।

বিশাল বাগানের মধ্যে নিরিবিলিতে তখন সাধনার জন্য নতুন দুটো টিনের ঘর নির্মিত হয়েছে। আমি আর অন্য একজন বসলাম সাধনায়। কিন্তু তিন চার দিনের মধ্যে তিনি 'ফাপর' লাগার জন্য সাধনা ছেড়ে চলে গেলেন। তার নাকি মনে হতো, তিনি জিকির করতে শুরু করলে ব্যাঙেরা তার সাথে জিকির করত। এতে তার ভয় লাগত। সবকিছু ফেলে এসে নিভৃতে বসে-বসে ধ্যানসাধনা করা একটু কঠিনই বটে। তাছাড়া পরিবেশটা একটু প্রকৃতিময়। দিনের বেলাতেই হঠাৎ কখনো-বা সাধনার ঘরে সাপ ঢুকে পড়ত। বাগানে কতিপয় গুইসাপ বিচরণ করত। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যার পরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেড়া ছিল না। রাত-বেরাতে শিয়াল এসে হুক্কাহুয়া ডাকত। কী একটা পাখি রাতের বেলায় কেমন এক রহস্যময় স্বরে ডাকত। গা ছমছম করে ওঠার মতন। আমার প্রথম দিকে বেশ ভয়-ভয় করত। ধীরে-ধীরে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে ধ্যানে ক্রমে-ক্রমে নিবিষ্ট হতে শুরু করি।

আমার তো কবিতা লিখবার একটা ব্যাপার সেই বাল্যকাল থেকেই ছিল। যৌবনে কবি হতে চাওয়াটাই আমার মুখ্য ব্যাপার ছিল। যখন আমি আত্ম-জিজ্ঞাসার প্রক্রিয়া শুরু করি তখন সাত বছর কবিতা লেখা একেবারে বন্ধ ছিল। সাধনায় থাকা অবস্থাতে আবার কবিতার প্রবাহ এসে আমাকে অধিকার করল। এখন আমার কবিতার বিষয়, ভাব ও প্রকরণ পাল্টে গেল। সাধনাত্মক বিষয়, গুরুমুখী ভাবনা, উপলব্ধির জগৎ ইত্যাদি সরল ধরনের প্রকরণে ছন্দিত হতে লাগল। কবিতা রচনা আমার সাধনার সহযোগী বিষয় হয়ে উঠল যেন।

নরসিংদীর সাধনালয়ে দু বছর সাধনায় ছিলাম। তবে একটানা নয়। চল্লিশ দিন কিংবা চারমাস সাধনা করে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবার বসেছি। এর মধ্যে সাধনার ঘরের সংখ্যা বেড়ে বারোতে দাঁড়ালো। সব ঘর যখন সাধকে ভর্তি থাকত তখন সাধনালয়ে বেশ একটা জমজমাট ব্যাপার হতো। বাবা জাহাঙ্গীর মাসে অন্তত একবার এসে কয়েকদিন থাকতেন সাধনালয়ে। তখন একটা আলাদা মাত্রা পেত। তিনি সাধকদের নানা নির্দেশনা ও উৎসাহ দিতেন।

বাগানের নানা রকম কাজ পরিচালনা করতেন বাবা। বাগানের আগাছা পরিষ্কার করা, নতুন নতুন গাছ লাগানো, গাছে পানি দেওয়া, সার দেওয়া, ফুলবাগান রচনা, সীমানার বেড়া তৈরি, নিচু জায়গা মাটি দিয়ে ভরাট করা — ইত্যাদি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি বসে থেকে কাজগুলো করাতেন। সাধকেরা, বাবার সাথে আসা ভক্তরা ও সংলগ্ন অধিবাসীরা এই কর্মযজ্ঞে অংশ নিতো। এমনিতে সাধকদের জন্য প্রতিদিনের নিয়মিত কাজ ছিল কিছু সময় ধরে বাগানে ঝরে-পড়া পাতা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করা আর আগাছাদি তুলে ফেলা। বাগানের গাছপালার যত্ন নেওয়াও এই কাজের অংশ ছিল।

এরপর আমার সাধনায় বসা হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মুখীতে বাবা মিসকিন শাহের মাজার শরিফ প্রাঙ্গণে। আমরা তিনজন একসাথে গিয়েছিলাম। মাজার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চার মাসের জন্য তিনটি কক্ষ বরাদ্দ পেয়েছিলাম সামান্য নজরানার বিনিময়ে। এইখানে অবস্থানকালে আমার নানারকম অভিজ্ঞতা হয়, যা আমার সুফিভাবের চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে একটা সময়কাল ব্যেপে এটুকুই আমার সামান্য সাধনা। তাই বলে আমার সাধনা এখানেই শেষ হয়ে গেছে, এমন নয় মোটেই। আমি কোনো কামালিয়াত হাসিলের দাবি করছি না। তবে একটা পর্যায় পার হয়েছে। ধরে নেওয়া যাক, বিষয়টা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করবার মতো।

এই সাধনায় কী অর্জন হয়েছে আমার? না, ঘোষণা করার মতো, ডিক্লেয়ার দেবার মতো, দাবি করবার মতো কোনো কিছুই হয় নাই। না আমি পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারি, না আমি আকাশবিহারী হয়ে যথা-ইচ্ছা-তথায় গমন করতে পারি। শূন্য থেকে রসগোল্লাও আনতে পারি না, জিন কোনো মোহর বা ডলার এনেও দেয় না আমাকে। যদিও অনেকের ধারণা, সাধকদের কাছে জিনেরা বশীভূত হয়, পোষ মানে আর জিন দিয়ে সাধকেরা অনেক কেরামতি দেখাতে পারে। এমনকি আমি সাধনায় থাকা কালে কোনো-কোনো লোক এসে আমাকে খুব অনুনয়-বিনয় করত। তাদের আবদার একটা বশীভূত জিন যেন আমি তাকে দান করি।

তাহলে সাধনা করে কতটুকু কী হলো? এই সময়যাপনের ফলাফল কী? হ্যাঁ, ফলাফল অতি উত্তম — অন্তত আমার নিজের জন্য। যেই অবস্থায় আমি আমার আত্ম-অন্বেষণ শুরু করেছিলাম — যেন একটা জড়পাথরের মতো স্থবির অবস্থায় থেকে, যখন আমার মনোদৈহিক উপাদানসমূহ আমাকে প্রবলভাবে বিক্ষিপ্ত ও মূঢ় করে রেখেছিল, যখন অশান্তির আগুনে আমি অনুক্ষণ প্রজ্জ্বলিত হতেছিলাম, যখন নিজের যাপনপথ নিজের কাছে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ছিল — সেই অবস্থা হতে উত্তরণ সম্ভব হলো। মানসিক স্থিরতা ও শান্তি পাওয়ার উপায়টা বুঝতে পারলাম। নিজের মনের ভিতরে নিউট্রাল জোন আবিষ্কার করতে পারলাম। আমার জীবনপথে কীভাবে ও কোনদিকে এগোতে হবে তা নির্ধারণ করতে পারলাম। অপরাপর মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক ও পারস্পরিকতা কেমন হওয়া দরকার তাও বুঝে উঠতে পারলাম। সোজা কথায়, নিজের সম্পর্কে একটু বুঝ-জ্ঞান হলো। খানিক আত্মস্থিতি এলো। আর প্রেমবোধ হয়তো একটুখানি জাগ্রত হলো। আর এই একটু-একটু প্রাপ্তিগুলোই আমার জন্য অনেক বেশি। তাই আমি অনন্তরূপে কৃতজ্ঞ আমার মুরশিদের কাছে। কারণ তিনি তার চিন্ময় অবয়বে আমাকে আমার নিকটে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

তাহলে সাধনা করে আল্লাহ-খোদা-ঈশ্বর-ভগবান বিষয়ে আমার কী জ্ঞান হলো? এই বিষয়ে কথা বলাটা বিপদজনক। হজরত আবু হুরায়রা-কথিত একটি বিখ্যাত হাদিস আছে : 'আমি রাসুলের কাছ থেকে দুই পাত্র জ্ঞান পেয়েছি। একটির কথা আমি সবাইকে বলি। অন্যটির কথা বললে আমার গলা কাটা যাবে।' সেইসব সর্বনেশে কথা যে কী, তা কে যে জানে! তবে ঈশ্বরের প্রসঙ্গে ভগবান বুদ্ধ নীরব থাকতেন। ঈশ্বর কি আছেন? তিনি কি নাই? তিনি কি যুগপৎ আছেন ও নাই? তিনি কি আছেন-ও না, নাই-ও না? এই চার রকম প্রশ্নেই তিনি নিশ্চুপ রইতেন। কেন? কারণ আমরা যেই অর্থে কোনো কিছু 'আছে' বুঝি, ঈশ্বরের আছে-ত্ব ঠিক সে-রকম নয়। আবার নাই কথাটাও এখানে প্রযোজ্য নয়। এটা আসলে একটা উপলব্ধির ব্যাপার।

তো আমার উপলব্ধিটা কী? ভাষার সীমাবদ্ধতা জেনেও ঝুঁকি নিয়ে বলেই ফেলি। মুরশিদের ধ্যানে নিমগ্ন থেকে নিজের ভিতরে ডুব দিয়ে একসময় অপরোক্ষভাবে অনুভব করলাম : আমার যা সারসত্তা, আমার মুরশিদের সারসত্তাও সেটিই এবং সেটি এই বিশ্বনিখিলের সারসত্তা। কেউ যদি বলেন, এ তো তোমার কল্পনা। আমি হেসে বলব, জ্বি। এটা হয়তো কল্পনাই। কিন্তু এই অনুভূতিটিই আমাকে আমার ও অন্যসবকিছুর মাঝে সম্পর্কের সমীকরণটি প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করিয়েছে। ওটিই আমাকে সত্য উপলব্ধির গূঢ় মাত্রাকে অনুধাবন করিয়েছে। এটিই আমার আত্মিক মূলধন। এটিই আমার সাধনার ব্যক্তিগত অর্জন। এখন যদি কেউ বলেন, এতে কী হইল? আমি সবিনয়ে বলব, কিছুই হইল না। এই 'কিছুই না' হওয়াটাই আমার সবকিছু। জয় গুরু।

মার্চ ২০২২