কেউ আছে কেউ নেই

কামালউদ্দিন নীলুকামালউদ্দিন নীলু
Published : 27 Nov 2021, 05:07 AM
Updated : 27 Nov 2021, 05:07 AM


মনটা ভালো নেই। একের পর এক বন্ধুরা চলে যাচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে সারারাত কেটে গেল অসলো'র ব্যালকনিতে, কিছুক্ষণ পায়চারী করে, খানিকটা বসে থেকে। ফিরে ফিরে ব্যালকনির প্রস্ফুটিত ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা। শীতকাল আসছে, কিছুদিনের মধ্যে ফোটা ফুলগুলো নিভে যাবে, ফুলগাছগুলো হারিয়ে যাবে- ঠিক বন্ধুদের মতোই! প্রায় একই রকম। আজ আমার কাছে প্রতিটি ফুল হয়ে উঠছে বন্ধুদের মুখ। ভাবছি, আবার ফুলগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটছি, ভাবছি:

হায়! জীবন এতো ছোট কেনে?
এ ভুবনে?

কিছু ভাবতে পারছি না! চিন্তাগুলো সব শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেদের মতো! ফুলেদের সাথে ঘোরাফেরার মধ্যে কখন যেন ব্যালকনির কোণায় অপরাজিতা লতাগাছের নিচে দাঁড়ালাম। বালককাল থেকে ওকে আমি অপরাজিতা না বলে, বলি নীল-প্রজাপতি ফুল। দেখতে অবিকল প্রজাপতিদের মতো। এইজন্য আমি তাকে এই নামে ডাকি। আস্তে আস্তে মনের অজান্তেই কখন যেন বসে পড়েছি নীল-প্রজাপতি গাছের নিচে রাখা চেয়ারটাতে। কিছুক্ষণ ধরে শত শত নীল-প্রজাপতির সাথে খেলা করলাম! কিছু সময় পরে প্রজাপতিদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে একমনে আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখছি! শরৎ শুকতারা আমাকে দেখছে, আমিও তাকে দেখছি! ভীষণ লুকোচুরি চলছে! ইতিমধ্যে আমার মস্তিষ্কে কোথা থেকে রবিবাবু এসে হাজির। এটা বাঙালি মধ্যবিত্তের এক স্বভাব, সকল সঙ্কটে রবীন্দ্রনাথ! হ্যাঁ, তাতো অবশ্যই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া বাঙালি মধ্যবিত্তের শক্তির জায়গাটা কোথায় শুনি? ধীরে ধীরে আমার কাছে আকাশটা হয়ে উঠছিলো শিল্পী এডভার্ড মুঙ্ক-এর ক্যানভাসে আঁকা ছবি "দ্য স্ক্রীম"-এর আকাশ! অবিকল সেই আকাশ, হ্যাঁ, সেই একই চিৎকার।

একাদশী রজনী
পোহায় ধীরে ধীরে-
রাঙা মেঘ দাঁড়ায়
উষারে ঘিরে ঘিরে।
ক্ষীণ চাঁদ নভের
আড়ালে যেতে চায়,
মাঝখানে দাঁড়ায়ে
কিনারা নাহি পায়।
বড়ো মøান হয়েছে
চাঁদের মুখখানি,
আপনাতে আপনি
মিশাবে অনুমানি।


রবিবাবুর কবিতা শেষ হতেই চোখ ফিরে ফিরে আসে অপরাজিতা লতা গাছটির দিকে। আমার ব্যালকনির সব ফুলগাছের মধ্যে কেবল নীল-প্রজাপতি লতা ফুলগাছটি শীতে মারা যায়, আবার বসন্তে জেগে ওঠে! বিস্ময়কর প্রকৃতি! অলৌকিক এক অনুভূতির মধ্যে ডুবে থাকা। ভাবছিলাম, ইশ্ ছোটলু ভাই যদি আমার অপরাজিতা লতা গাছটির মতো আবার জেগে উঠতো! যদি তাই হয়, সত্যিই যদি তাই ঘটে! তবে? এইসব ভাবতে ভাবতে পেছনে ফিরে দেখা। সৈয়দ শামসুল হক (হক ভাই) অনূদিত ছোটলু ভাইয়ের কণ্ঠে ম্যাকবেথ-এর সংলাপ:

তাঁর মৃত্যু অন্য কোনো কালে হয় হতো।
তেমন সময় যদি হতো এই উচ্চারণ যাতে।
সম্মুখের দিনের পরে দিন পরে দিন, পায়ে পায়ে
বড় দীন মিছিলের অগ্রসর দিন থেকে দিনে
বহমান সময়ের শেষ বিন্দু বিপলের দিকে;
আর আমাদের পেছনের দিনগুলো আলো ধরে
ধূসর মৃত্যুর দিকে বোকাদের পথ দেখিয়েছে।
যাও, নিভে যাও, নিভু নিভু দীপ, জীবন নিতান্ত
এক চলমান ছায়া, হতভাগ্য এক অভিনেতা
রঙ্গমঞ্চে কিছুকাল লাফায় ঝাঁপায়, তারপর
আর শোনা যায় না সংবাদ। এ হলো কাহিনী
এক নির্বোধ কথিত, অলঙ্কারে অনুপ্রাসে ঠাসা
ইতি তাৎপর্যবিহীন।

অসাধারণ ম্যাকবেথ চরিত্রের নতুন সৃষ্টি। নতুন ব্যাখ্যা। এরকম বাঁক আর শরীর নিয়ে খেলা বাংলা থিয়েটারে আর দুটো অভিনেতাকে মঞ্চে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না! এটা কি সেই নতুন ভাবনায় সৃষ্ট নতুন সৃষ্টি? তাই কি? ছোটলু ভাইকে আমি প্রায় ঠাট্টা করে বলতাম- 'এই যে বাংলার স্যার লরেন্স অলিভিয়ের'! এটা বলতেই তিনি বড্ড হো হো করে হেসে উঠতেন! সত্যি অসাধারণ এক অভিনেতা আমাদের সময় এবং কালের। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন দুর্দান্ত মেধাবী এবং বুদ্ধিমান অভিনেতা, অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন মহান মানুষ। থিয়েটার সম্পর্কে তার জ্ঞানের কথা মনে করে আমি অবাক হয়ে ভাবি, জিজ্ঞাসা করি:

উড়ে গেছে… একা একা এমনি হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।

আমার কাছে ছোটলু ভাইয়ের অভিনয়ের বড় জায়গাটি হলো রূপান্তর প্রক্রিয়া। এটা ছিল জাদুর মতো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। কখনো কখনো ভাবতাম এটা কী করে সম্ভব- এইভাবে সময় এবং স্থানের মধ্যে মুহূর্তটি তৈরি করা? তার অভিনয় ছিল জাদুকরী। আমার কাছে অনেকটা রূপান্তরিত নান্দনিকতার মতো।

ঢাকার মঞ্চে "ম্যাকবেথ"! খুব সম্ভবত এটা ছিল বাংলাদেশে প্রথম ব্রিটিশ থিয়েটার পরিচালক দ্বারা পরিচালিত স্টেজ পারফর্মেন্স। এই কাজটার সাথে বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। নাটকটিতে অভিনয় করেছিল দেশের বড় নাট্যদল "থিয়েটার" ও "নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়"-এর প্রায় সকল অভিনেতা, অভিনেত্রী- কেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন ভাই ছাড়া। সহযোগিতায় ছিল ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল। এটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত কাজ। এই প্রযোজনাটির পেছনের মানুষটি, অর্থাৎ, নাট্যঅধিকারী ছিলেন রামেন্দু মজুমদার (দাদা)। আমি ছিলাম "মঞ্চ অধ্যক্ষ"। সমস্ত ডিজাইন আনা হয়েছিল লন্ডন থেকে। এমনকি কস্টিউমের জন্য কাপড় পর্যন্ত। সে এক এলাহি কা–কারখানা। রীতিমতো হইচই চলছে। ঢাকার প্রায় সব পত্রিকায় প্রতিদিন খবর ছাপা হচ্ছে প্রযোজনাটির বিভিন্ন দিক নিয়ে। সবার মধ্যে একটা সাজ সাজ রব। শুধু তাই নয়, এটাকে বলা যেতে পারে- এক ধরনের ভালো অভিনেতাদের সম্মেলন। সবাই যার যার চরিত্রে ছিলেন অসাধারণ। সবাই ছিলেন পরিশ্রমী। এটা প্রায় পেশাদার কোম্পানির মতো হয়ে উঠেছিল। এটা ছিল আমাদের জন্য একটা নতুন স্বপ্ন, নতুন অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের থিয়েটারের একটা প্রধান বাঁক বলা যেতে পারে।


অন্যদিকে এর বিরোধিতাও করা হয়েছিল- সংস্কৃতির নব্য-সাম্রাজ্যবাদের নামে। তাতে মুখ্য ভূমিকায় ছিল সেই সময়ের চরম বামমুখী নাট্যসংগঠনগুলো। শেকস্পীয়রের ভাষায় বলা যেতে পারে: "নোংরা বাতাসের মধ্য দিয়ে ঘোরাফেরা"। এখনো তাদের মধ্যে কেউ কেউ জীবিত এবং নাট্যচর্চায় মগ্ন। আমাকে এখানে আরো বলতে এবং উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, যারা প্রযোজনাটির সাথে জড়িত ছিলেন তারা প্রায় সবাই "বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি"-র বন্ধু বা সহযোগী সদস্য বা "ছাত্র ইউনিয়ন"-এর সদস্য ছিলেন। কী অদ্ভুত, আজব, আশ্চর্যজনক প্যারাডক্সিকাল অবস্থা! "পুরো পৃথিবী এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ"!

আমি আজও ভুলিনি সারা যাকের (ভাবি) আর নিমা আনামের অভিনয়। ঝড়, বজ্রধ্বনি, বজ্রবিদ্যুৎ, কখনো বিদ্যুতের ঝলকের মধ্যে তারা সৃষ্টি করে চলছিলো একের পর এক রহস্যময় মুহূর্ত। আর রহস্যময় মুহূর্তগুলো যেন মূর্ত হয়ে উঠছিলো: Suit the action to the word, the word to the action-এর দ্বিমেরুর মধ্যে। আমার এখনো মনে আছে সেই অসাধারণ অভিনয় এবং শেকস্পীয়রের সংলাপের প্রতিটি মুহূর্ত:

২য় ডাকিনি: ডুমো ডুমো জলের সাপা
কড়ায় ছেড়ে সেদ্ধ ভাপা;
টিকটিকি চোখ,
ব্যাংটির নোখ,
লোম বাদুরের,
জিভ কুকুরের,
বোলতার হুল, প্যাঁচার ডানা,
একটি সাপের জিভ দু'খানা,
গিরগিটির পা-
এক সাথে সব কড়াতে আয় চাপা;
তবেই কুহক তবেই জগৎ বশ,
টগবগাবগ ঘোর নরকের রস।

এক কথায় যেমনটি ছিল তাদের চরিত্র রূপায়ণ প্রক্রিয়া, একই রকম ছিল পারফর্ম্যাটিভিটির জায়গা। চমৎকার সিঙ্ক্রোনাইজেশন, এক বিস্ময়কর ছন্দসমতা। আমার কাছে তাদের অভিনয় ছিল নাট্যকার এডমন্ড রোস্ট্যান্ড-এর "সিরানো ডি বার্গের‌্যাক" নাটকের সংলাপের মতো এক অসাধারণ অভিব্যক্তি: "নাট্যকারের সেরা শব্দগুলি অভিনেতার হৃদয় ছাড়া মৃত"।

আজও আমি ভুলতে পারিনি মুহাম্মদ জাকারিয়া (দাদু) এবং ফেরদৌসী মজুমদারের (ভাবি) অভিনয়। বিশেষ করে "ম্যাকবেথ" নাটকের পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য। 'লেডি ম্যাকবেথ' চরিত্রে ফেরদৌসী মজুমদার (ভাবি) "যা নরকের দাগ! উঠে যা, বলছি"- বলার সময় কী অসাধারণভাবে হাত ধোয়ার মতো হাত ঘষতেন আর বিড়বিড় করে বলতেন: "কে ভেবেছিল, ঐ বুড়োটার শরীরের মধ্যে এতো রক্ত থাকবে"? ডাক্তারের চরিত্রে মুহাম্মদ জাকারিয়া (দাদু) বিস্ময়ে দর্শকের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকতেন। দুজনেই একসাথে পারফর্মেন্সে একটি দুর্দান্ত মুহূর্ত তৈরি করতেন; যা ছিল শব্দহীন রহস্যে পরিপূর্ণ। মুহূর্তটি শেষ হতেই মুহাম্মদ জাকারিয়া ফিসফিস করে বলে উঠতেন: "কথাটা শুনেছ?" অসাধারণ অভিনয়ক্রিয়া। আমি কীভাবে ভুলে যাবো সেই অভিজ্ঞতা এবং মুহূর্তটি? তাদের অভিনয়কে লি স্ট্রাসবার্গের ভাষায় বলতে হয়: "অভিনয় হলো কাল্পনিক উদ্দীপনার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানার ক্ষমতা এবং কাল্পনিক পরিস্থিতিতে বাস্তব চিন্তা ও অনুভূতি তৈরি করা"।


এইসব কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে শেকস্পীয়রের পঞ্চম অঙ্কের সপ্তম দৃশ্যে ছোটলু ভাইয়ের অভিনয়ের কথা, যে দৃশ্যের বিষয় ছিল একক যুদ্ধে একজন অত্যাচারীর চূড়ান্ত ধ্বংসের পূর্বাভাস। যখন ছোটলু ভাই ফাঁকা মঞ্চের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দর্শকদের চোখে চোখ রেখে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে উচ্চস্বরে সংলাপ ছুঁড়ে দিতেন:

ম্যাকবেথ: না, আমি রোমান নই, রোমানের মতো আমি নিজ
তরবারি দিয়ে প্রাণ নেবো না নিজের। যতক্ষণ
দেহে প্রাণ আছে, নেবো প্রাণ শত্রুরই কেবল।

তখন ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তন হয়ে উঠতো একটি শব্দহীন গোরস্তান। এ আমার কাছে ছিল মন্ত্রমুগ্ধ মুহূর্ত- "শব্দের সাথে ক্রিয়া"- বিস্ময়কর! এখনো মনে আছে- ছোটলু ভাইয়ের সঙ্গে বার্টোল্ট ব্রেখটকে নিয়ে আলাপ আলোচনা। এটা ছিল আশির দশক। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় তখন ভীষণভাবে যুক্ত বার্টোল্ট ব্রেখটের তত্ত্ব ও তত্ত্বের অনুশীলন নিয়ে। একদিকে আসাদুজ্জামান নূর (ভাই) একের পর এক ব্রেখটের নাটক অনুবাদ, ভাবানুবাদ, রূপান্তর করে চলেছেন। ছোটলু ভাই নির্দেশক, কখনো-সখনো নূর ভাই। দলটি মঞ্চস্থ করছিলো The Good Person of Szechwan , Mr Puntila and his Man Matti , Rise and Fall of the City of Mahagonny. নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের পাশাপাশি আমি তখন বহুবচন-এর সাথে নির্দেশনা দিচ্ছি The Threepenny Opera, পদাতিক (টিএসসি) নাট্যদলের সাথে The Mother, চট্টগ্রামের থিয়েটার ৭৩-এর সাথে The Exception and the Rule. অন্যদিকে জামিল আহমেদ নির্দেশনা দিচ্ছেন চট্টগ্রামের তির্যক নাট্যগোষ্ঠীর সাথে The Decision. আরণ্যক নাট্যদলে মামুনুর রশীদ নির্দেশনা দিচ্ছেন Coriolanus. নাট্যচক্র টিএসসির সুইমিংপুলের স্থানটি বেছে নিয়েছিল The Caucasian Chalk Circle মঞ্চস্থ করার জন্য। এটা ছিল আমার কাছে আমাদের নাট্যজগতের শ্রেষ্ঠ সময় ও কাল। আজও ভুলে যাইনি। আমার শেখার জন্য এটা ছিল এক মহান সময়। কীভাবে ভুলে যাই সেই দিনগুলো! এইসব অভিজ্ঞতা কি ভুলে যাওয়া সম্ভব?

সম্ভবত ১৯৮২ সাল। মহিলা সমিতির মঞ্চে নাটক দেখা শেষে ছোটলু ভাই আমাকে ধরে নিয়ে গেল তার বেইলি রোডের বাড়িতে। দীর্ঘ এক আড্ডা। কেবলই ব্রেখটের তত্ত্ব, প্রয়োগ ও আমাদের কালচারাল কনসেপশনের মধ্যে প্রয়োগের বিষয় নিয়ে। চমৎকার আলোচনা এবং দারুণ এক অভিজ্ঞতা ছিল। তারপর বিদায় নেওয়ার পালা। রিকশায় চলতে চলতে ভাবছিলাম- ব্রেখটের তত্ত্বের সারমর্ম আরো বুঝতে হবে। "রাস্তার দৃশ্য একটি এপিক থিয়েটারের জন্য বেসিক মডেল"। ব্রেখটের তত্ত্ব এই 'বেসিক মডেল'- এটা কি হতে পারে? এইসব ভাবতে ভাবতে রাত পেরিয়ে গেল। দিনকয়েক পরে একদিন শিল্পকলা একাডেমির থিয়েটার বিভাগের পরিচালক এস. এম. মহসিন (ভাই) ডেকে পাঠালেন। বললেন "তোমাকে শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব প্রযোজনায় নির্দেশনার দায়িত্ব নিতে হবে, আর সেটা হচ্ছে বার্টোল্ট ব্রেখটের The Three penny Opera" শিল্পকলা একাডেমির পরে আমি নাটকটি বহুবচন নাট্যদলের সাথে নির্দেশনা দেই।

এই আশির দশকেই এক এক করে এনএসডি'র বন্ধুরা দেশে ফিরতে শুরু করি। মহসিন ভাই ছাড়া প্রায় সকলেই বেকার। সময়টা আমাদের জন্যে খারাপ ছিল। একদিকে সামরিক শাসন, অন্যদিকে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান। থিয়েটার দলগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা মারাত্মক খারাপ ছিল। প্রায় কোনো তহবিল ছিল না। পেশাগত থিয়েটার চর্চা করা খুব কঠিন ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা সবাই কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং আমরা এটা করলামও।

আশির দশকে আমরা বিভিন্ন থিয়েটার গ্রুপের সাথে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছি। অধিকন্তু চেষ্টা করেছি থিয়েটার চর্চার বিভিন্ন দিক এবং পদ্ধতি চালু করার। কেউ নির্দেশনা দিচ্ছে, কেউ ডিজাইনের কাজ করছে, কেউ থিয়েটার ট্রেনিং প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত। সমস্ত কাজ ছিল উদ্ভাবনী এবং পরীক্ষামূলক। একের পর এক আমরা আমাদের থিয়েটার জগতে একটি নতুন শৈল্পিক অভিব্যক্তি তৈরির চেষ্টা করছিলাম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমার বলা উচিত সৃজনশীল কাজের জন্য এটা একটা দুর্দান্ত সময় এবং যুগ ছিল। এখন সেই সময়গুলো হারিয়ে গেছে মহসিন ভাইয়ের মতো! সবকিছু চলমান, কিন্তু কিছু একটা অনুপস্থিত! কী অবাক করা ব্যাপার! তবুও মনে পড়ে সেইসব অতীতের কথা। আমাদের শক্তির পেছনে মহসিন ভাই ছিলেন একটা পালকী, একটা বেগ, একটা গতি। তিনি ছিলেন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক। মহসিন ভাইয়ের অর্থনৈতিকভাবে আমাদেরকে বাঁচানোর একের পর এক উপায় তৈরি করার চেষ্টা আমাকে অবাক করে! এটা আমাদের জন্য ছিল থিয়েটার ভ্রমণের এক আশ্চর্যজনক যাত্রা! টাকার পরিমাণ এমন কিছু নয়, কিন্তু প্রচুর কাজ তিনি আমাদের জন্য তৈরি করেছিলেন। তিনি আমাদেরকে অন্যভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। আজ আমাকে বলতেই হবে শিল্পকলা একাডেমির থিয়েটার বিভাগের প্রাক্তন সহকারী পরিচালক আব্দুর রব রশিদী (বাবুল ভাই)-এর ভূমিকার কথা। তিনি ছিলেন মহসিন ভাইয়ের অন্যতম সক্রিয় সহযোগী; এন.এস.ডি'র সকল প্রাক্তন ছাত্রের সবচেয়ে বড় সমর্থক। আজ আমি তাঁদের সম্পর্কে বলবো। জাতীয় নাট্যশালা তৈরির পেছনে এই দুই ব্যক্তি ছিলেন প্রধান স্থপতি (ব্রেনচাইল্ড)। আমাদের নাট্যকর্মীরা অনেকেই এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভূমিকাটির কথা জানেন না। তাদের যথাযথ উদ্যোগ ছাড়া আমাদের সময়ে এই ধরনের উজ্জ্বল এবং কার্যকরী থিয়েটার ভবন পাওয়া অসম্ভব ছিল। মহসিন ভাই ইতিমধ্যে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তার কাজটি বিদ্যমান থাকবে, এবং আমাদের কাছে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকবে- এটা আমার বিশ্বাস।

আশির দশক ছিল আমাদের সবার জন্য চরম খারাপ সময়। কোনোভাবে টিকে আছি ঢাকা শহরে। ঋণগ্রস্ত হতে না চাইলেও হতে হতো বেঁচে থাকার জন্য। বলা চলে শিল্পকলা একাডেমির কাছ থেকে যতোটুকু পেতাম সেটাই একমাত্র আয়ের মূল উৎস। মাঝেমাঝে বিটিভি'র নাটকে অভিনয়। পকেটে টান পড়লেই শেষ আশ্রয়স্থল বাবা। সেটা ছিল ১৯৮৩ সাল। সেই উদ্দেশ্যে বাড়িতে যাওয়া। আমাকে বাড়িতে দেখে বাবা-মা দুজনেই খুশি। বিশেষ করে বাবা (মিয়া মতিন)। কারণ একটাই, থিয়েটার নিয়ে আড্ডা দেবার একজন মানুষ ঘরে ফিরেছে। হ্যাঁ, যথারীতি বাড়িতে পৌঁছানোর পর থেকেই বাবার সাথে থিয়েটার নিয়ে আড্ডা, বেশিরভাগ সময় আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতো ঢাকার নাট্যচর্চা।


সেই আলোচনায় বাবা দুঃখের সাথে বলেছিলেন- "কেউ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থিয়েটার স্থাপত্য এবং আমাদের ঐতিহ্য যশোরের বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলো না! পারলে থিয়েটারের মানুষদের বোলো বিষয়টা; মনে করিয়ে দিয়ো এটার স্থপতি ছিলেন সতু সেন। তুমি কি জানো সতু সেন ছিলেন বাংলা থিয়েটারের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিবিদ? তিনি ১৯২৫ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য লন্ডনে যান, কিন্তু পরবর্তীতে থিয়েটারের টানে লন্ডন ছেড়ে সোজা নিউইয়র্কে যান এবং আমেরিকান ল্যাবরেটরি থিয়েটারে যোগ দেন। তিনি কিন্তু রিচার্ড বোলেস্লাভস্কির অধীনে থিয়েটার করেছেন, যিনি ছিলেন কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভস্কির প্রাক্তন সহযোগী এবং শিষ্য। তুমি কি জানো ইব্রাহিম আল কাজীর আগে সতু সেন এন.এস.ডি'র ডিরেক্টর ছিলেন? তুমি কি জানো কালক্রমে তিনি ভসেভলদ মায়ারহোল্ড, ম্যাক্স রেইনহার্ড এবং গর্ডন ক্রেইগের মতো বিখ্যাত প্রযোজক ও পরিচালকদের খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন? সতু সেন কিন্তু শিশির ভাদুড়ীর নিউইয়র্কের দুর্ভাগ্যজনক ভ্রমণের উদ্ধার অভিযানেরও সহযোগী।"

শিশির ভাদুড়ীর নাম মনে পড়ায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস "নিঃসঙ্গ সম্রাট"-এর কথা মনে পড়লো! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওপরে রাগ হলো এই ভেবে যে এইরকম একজন দুর্দান্ত অভিনেতাকে এইভাবে আক্রমণ সুনীল বাবু না করলেও পারতেন! কারণ শিশির ভাদুড়ী সম্পর্কে আমি বাবা-মা'র কাছ থেকে যেটা শুনেছি সেটার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাইনি! শিশির ভাদুড়ী ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। তিনি স্টেজ পারফর্মেন্সের জন্য ফরিদপুরে এলে আমাদের বাড়িতে থাকতেন। এক কথায়, তিনি ছিলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু। দুজনের বন্ধুত্বের পেছনে ছিল ফরিদপুর টাউন থিয়েটার মঞ্চ। দুজনেই ছিলেন বিস্ময়কর অভিনেতা। সময়টা পঞ্চাশের দশক।

মায়ের কাছ থেকে তাঁদের দুর্দান্ত অভিনয়ের গল্প শুনেছি। শুনেছি অহীন্দ্র চৌধুরী, অমলেন্দু লাহিড়ী এবং যামিনী লাহিড়ীর অভিনয়ের গল্প। শুনেছি নাটকের আবহসংগীতে বামনদাশ গুহ রায়ের (বামনদাশ কাকা) বাদ্যযন্ত্রের অতুলনীয় ব্যবহার। তাঁর জলতরঙ্গের ব্যবহার ছিল চমৎকার। সড়ক দুর্ঘটনায় বহু বছর আগে চলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলাদেশে আর কেউ জলতরঙ্গ বাজাতে পারে বলে শুনিনি। তিনি ছিলেন সম্ভবত প্রথম এবং তিনিই শেষ ব্যক্তি।
বাবার কণ্ঠে রবিবাবুর কবিতা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "কালিন্দী" নাটকের রামেশ্বর চক্রবর্তীর সংলাপ, সঙ্গে সংস্কৃত শ্লোক, শচীন সেনগুপ্তের ঐতিহাসিক নাটক "সিরাজ-উদ-দৌলা"-র সংলাপ, ডি এল রায়ের "শাহজাহান" নাটকের গুরুত্বপূর্ণ সংলাপের অংশ আবৃত্তি, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের "আলমগীর" নাটকের সংলাপ পাঠ- এইসব শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে আমার বড় হয়ে ওঠা। বাবার কণ্ঠ ও উচ্চারণ ছিল অতুলনীয়। কণ্ঠস্বরের ওঠানামার খেলা ছিল বিস্ময়কর! যা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "রঙ্গমঞ্চ" প্রবন্ধের কথা:

ভাবুকের চিত্তের মধ্যে রঙ্গমঞ্চ আছে, সে রঙ্গমঞ্চে স্থানাভাব নাই। সেখানে জাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে। সেই মঞ্চ, সেই পটই নাট্যকারের লক্ষ্যস্থল, কোনো কৃত্রিম মঞ্চ বা কৃত্রিম পট কবিকল্পনার উপযুক্ত হইতে পারে না।

বাড়িতে বাবার সাথে আড্ডা মারতে মারতে প্রায় একটা সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। হঠাৎ বিটিভি থেকে ফোন এলো ঢাকায় ফিরতে হবে, নতুন ধারাবাহিকে অভিনয় করতে হবে। সম্ভবত নাসির উদ্দিন ইউসুফ (বাচ্চু ভাই)-এর প্রযোজনা, নাট্যকার- সেলিম আল দীন, নাটক "লাল মাটি কালো ধোঁয়া (আয়না)"। ফিরতে হবে ঢাকায়। মা'র অনুমতি পেয়ে গেছি। বাবার অনুমতির জন্যে তার ঘরে যেতেই দেখলাম বাবা সংস্কৃত শ্লোক আওড়াচ্ছেন। "ললিত-লবঙ্গ-লতা-পরিশীলন-কোমল-মলয়-সমীরে"। আমি আস্তে করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অপূর্ব ছিল তার বলার ভঙ্গী! দারুণ সুরেলা। বাবার আবৃত্তি শেষে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসতেই আবার শুরু:

তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে
কেউ তা জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন মনে,
কেউ তা মানে না।
ফিরি আমি উদাস প্রাণে,
তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতন এমন টানে
কেউ তো টানে না।

শেষ হতেই শুরু, আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুনত্ব আর নবীনত্ব নিয়ে ভাবছিলাম। "নতুনত্ব কালের ধর্ম, নবীনত্ব কালের অতীত"! এই চিন্তা থেকেই কি তাঁর "অচলায়তন" সৃষ্টি?

আলো এবং অন্ধকার, বন্ধ এবং মুক্তি, সুরের সাথে বেসুর, সনাতনের সাথে নতুনের লড়াই, অত্যাচারী ও নিপীড়িতদের মধ্যে লড়াই। এটা মানুষের শক্তির গল্প, মানুষের স্বাধীনতার গল্প। এখানেই রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক এবং আধুনিক:

রামায়ণকে যদি সুর করিয়া পড়িতে হয় তবে আদিকা- হইতে উত্তরকা- পর্যন্ত সে সুরকে চিরকাল সমান একঘেয়ে হইয়া থাকিতে হয়, রাগিণী হিসাবে সে বেচারার কোনোকালে পদোন্নতি ঘটে না।

কী চমৎকার বাউল চরিত্রের ব্যবহার। এ একটা বিশুদ্ধ মানব চরিত্রের প্রতিফলন। এক মানব চরিত্রের ব্যাখ্যা:

এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি।

"অচলায়তন" থেকে এবার দাদাঠাকুরের গানের অংশ। বাবা গানটি কবিতার ঢঙে আবৃত্তি করছেন আর কিছু একটা খুঁজছেন- বুঝতে পারছিলাম না! এবার বাবা গলাটা আরো উঁচুতে উঠিয়ে শুরু করলেন:
বুঝি এল, বুঝি এল, ওরে প্রাণ।
এবার ধর দেখি তোর গান।
ঘাসে ঘাসে খবর ছোটে
ধরা বুঝি শিউরে ওঠে,
দিগন্তে ওই স্তব্ধ আকাশ পেতে আছে কান।

আবৃত্তি শেষ করে বাবা আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চিঠিটা আলী যাকেরকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কোরো। তুমি না পারলে হারূনকে বলবে আমার কথা। কিছুদিন আগে বিটিভিতে আলী যাকেরের নির্দেশনায় "অচলায়তন" দেখলাম। অসাধারণ কাজ, ব্রিলিয়ান্ট ওয়ার্ক। রবীন্দ্রনাথের নাটক এইভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব! লক্ষ্য করেছো- প্রাচীর ভাঙার দৃশ্য? কী অসাধারণভাবে মানবমুক্তির প্রতীক হয়ে উঠলো ওই প্রাচীর:

এত চাপেও যখন দেখলুম তোমার মধ্যে প্রাণ কিছুতেই মরতে চায় না তখনই আমি প্রথম বুঝতে পারলুম মানুষের মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য, হাজার বছরের অতি প্রাচীন আচারের চেয়ে সত্য।

এই রকম ভাবনা দেখেছিলাম শম্ভু মিত্রের "রক্তকরবী" নাটকে, কলকাতার শিশির মঞ্চে।

ঢাকায় পৌঁছানোর পরে চিঠিটা খ. ম. হারূন (মামা)-কে দিই। লোক মুখে শুনেছিলাম ছোটলু ভাই চিঠিটা পড়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন! জানি না সেই চিঠির হদিস পাবো কিনা! কীভাবে পাবো? ওরা যে নেই!

শূন্য কুয়াশায় মুছে যায় সব তার; একদিন বর্ণচ্ছটা মুছে যাবো আমিও এমন…