সালভাদর দালির বিগলিত স্মৃতি

অমৃতা ইশরাতঅমৃতা ইশরাত
Published : 8 Jan 2022, 04:57 PM
Updated : 8 Jan 2022, 04:57 PM


দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি বইটি আর্কাইভে পড়ছিলাম। কুড়ি শতকের অন্যতম চিত্রশিল্পী, ভাস্কর এবং গ্রাফিক্স ডিজাইনার সালভাদর দালির (১৯০৪-১৯৮৯) আত্মজীবনীমূলক বই। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে দালি নিজেই তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত চারশো পৃষ্ঠারও বেশি এই বইটিতে দালির জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট-বড় অসংখ্য ঘটনাসহ তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো স্থান পেয়েছে। বইটি শুরু হয়েছে চমৎকার একটি বিবৃতি দিয়ে। "At the age of six I wanted to be a cook. At seven I wanted to be Napoleon. And my ambition has been growing steadily since." ছয় বছর বয়েসে দালি 'কুক' হতে চেয়েছিলেন আর 'সাত' বছর বয়সে 'নেপোলিয়ন'। বইটি পড়তে পড়তে ভাবনার গভীরে যেতে চাইছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। বইটির প্রচ্ছদ আমাকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। ভাবনাগুলো ক্রমশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। জর্জ এলিয়ট বলেছিলেন–"Don't judge a book by its cover!" তবুও বইটির প্রথম সংকলনের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত দালির আঁকা "দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি" চিত্রকর্মটিতে আমার দৃষ্টি বারবার নিবদ্ধ হতে চাইছিল। চিত্রকর্মটি যে আগে দেখিনি– এমনটাও নয়। অসংখ্যবার দেখেছি, ভেবেছি। তবে আবিষ্কারের নেশা বোধহয় কখনোই পুরনো না। শুরুতেই বলে রাখা ভালো অদ্ভুতুড়ে দালি কিউবিজম, ফিউচারিজম ও মেটাফিজিক্যাল পেইন্টিংয়ের অবিচ্ছিন্নতায় এমন এক সুররিয়ালিস্টিক আবহ সৃষ্টি করেন, যা চিত্রকলার ইতিহাসে বিস্ময়কর। 'দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি' দালির সবচে' আলোচিত ছবি। এ ছবির সূচনা ডাইনিং টেবিলে, ক্যামেম্বার্ট পনির গলে যাওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। গ্রীষ্মের উষ্ণতায় পনির নরম হয়ে এসেছিল। সাদা গলিত পনিরের দিকে চেয়ে জগৎশ্রেষ্ঠ দূরাভিসারী দালির মনে হলো সময় এভাবেই চলছে, গলে পড়ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে। সময় ঝুলে আছে অবিন্যস্ত কাপড়ের মতন। গলে পড়ছে পনিরের মতন। ক্রমান্বয়ে গলিত পনিরের জায়গা দখল করে নিল ঘড়িগুলো। 'পারসিসটেন্স অব মেমোরি' চিত্রকর্মের প্রধান চরিত্র ঘড়ি। অনেকগুলো ঘড়ির অভিব্যক্তিতে যুক্তি এবং কালাতীত অবস্থাকে ধরতে চেয়েছেন দালি। যদিও সময়ের অস্থিরতার স্মারক ঘড়িগুলোর কোনোটাই সদর্থের ইঙ্গিত দেয় না। সুপরিচিত পরাবাস্তববাদী অংশটি নরম গলানো পকেট ঘড়ি। এটি দালির নমনীয়তা এবং কঠোরতার প্রতিনিধিত্ব করে, যা সেই সময়ে তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। যেমনটি ডন অ্যাডেস লিখেছেন, "নরম ঘড়িগুলি স্থান এবং সময়ের আপেক্ষিকতার একটি অবচেতন প্রতীক যা একটি নির্দিষ্ট মহাজাগতিক ক্রম ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত পরাবাস্তববাদী ধ্যানকে নির্দেশ করে"। অ্যাডেস'র ব্যাখ্যানুসারে দালি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।


এ প্রসঙ্গে ইলিয়া প্রিগোগিন একবার দালিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাস্তবে এমনটি হয়েছিল কি না? প্রত্যুত্তরে দালি জানিয়েছিলেন, নরম ঘড়িগুলি আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত নয়, বরং সূর্যের তাপে ক্যামেম্বার্ট গলে যাওয়ার পরাবাস্তববাদী উপলব্ধি দ্বারা অনুপ্রাণিত। কম্পোজিশনের মাঝখানে, অদ্ভুত একটি মানব চিত্র (অনেকটা দানবাকৃতি) শিল্পীর স্ব-প্রতিকৃতির একটা বিমূর্ত ফর্ম যা হয়তো দালি নিজেকে উপস্থাপন করবার জন্যে ব্যবহার করেছিলেন। তবে এই প্রাণীটি হিয়েরোনিমাস বশ অঙ্কিত 'দ্য গার্ডেন অফ আর্থলি ডিলাইটস'র প্যারাডাইস বিভাগের একটি চিত্রের উপর ভিত্তি করে আঁকা হয়েছিল বলে মনে করা হয়, যা দালি অধ্যয়ন করেছিলেন। প্রাণীটিকে বিলুপ্ত অথবা কাল্পনিক কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি হিসেবে ধরা যেতে পারে; যা প্রায়শই স্বপ্নে দেখা যায় যেখানে স্বপ্নদ্রষ্টা প্রাণীটির সঠিক ফর্ম কিংবা স্পেসিস চিহ্নিত করতে পারেন না। লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, প্রাণীটির চোখ বন্ধ (ঈষৎ কুঞ্চিত) যা ইঙ্গিত করে সে স্বপ্ন দেখা অবস্থায় রয়েছে। এই আইকনোগ্রাফি এমন একটি স্বপ্নকে নির্দেশ করে, যা হয়তো দালি নিজে দেখেছিলেন। আর প্রাণীর ওপরে লেপ্টে থাকা ঘড়িটি স্বপ্নের মধ্যে অতিবাহিত হওয়া সময়কেই ইঙ্গিত করে। পেইন্টিংয়ের নীচে বাম দিকের কমলা রঙের ঘড়িটি পিঁপড়েয় ঢাকা। দালি প্রায়শই তাঁর চিত্রকর্মে পিঁপড়েকে ক্ষয়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতেন। ঘড়ির যে-গোলাকার ডায়াল সময়ের ঘূর্ণায়মানতাকে প্রকাশ করে, সেই বৃত্তের বেড়ি ভেঙে পড়েছে অর্থাৎ সময় দংশিত হচ্ছে কালো পিঁপড়ের সমষ্টিগত আক্রমণে। যেখানে বৃত্ত রয়েছে, সেখানেও পিঁপড়ের আক্রমণে সব সংখ্যা উধাও হয়ে গিয়েছে, ঘড়ির দেহ হয়ে পড়েছে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত। কমলা ঘড়ির পাশে থাকা ঘড়িটির ভেতরকার নীল জল পান করছে একটি মাছি। সূর্যের আঘাতে মাছিটি মানুষের ছায়া নিক্ষেপ করছে বলে মনে হচ্ছে।

উত্তর-পূর্ব কাতালোনিয়ার ক্যাপ ডি ক্রুস উপদ্বীপের ডানদিকের খড়খড়ে শিলাগুলিও রয়েছে চিত্রটিতে। পেইন্টিংয়ের সামনের অংশে অদ্ভুত এবং পূর্বাভাসমূলক ছায়াটি পানি পর্বতের (Mont Panié) প্রতিবিম্ব। বিশাল পর্বতের নিচে সময় যেনো ক্ষুদ্রতম অনুষঙ্গ। এখানে সময় ছড়িয়ে আছে বালুকাবেলায়, সাগরে, দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে। 'পারসিসটেন্স অব মেমোরি' বাস্তবতাবাদী চিত্রকলার এমন একটি রূপ যা জাগ্রত চেতনার চেয়ে স্বপ্নে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, আর দালির সার্থকতা এখানেই!