ম্যানবুকার ২০১০ জয়ী হাওয়ার্ড জ্যাকবসন-এর দ্য ফিঙ্কলার কোয়েশ্চেন

aziz_hashan
Published : 21 Oct 2010, 09:40 AM
Updated : 21 Oct 2010, 09:40 AM


হাওয়ার্ড জ্যাকবসন (জন্ম ২৯.৮.১৯৪২)

[ব্রিটিশ লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন ২০১০ সালের ম্যানবুকার পুরস্কার পেয়েছেন তার হাস্যরসাত্মক উপন্যাস 'দ্য ফিঙ্কলার কোয়েশ্চেন'র জন্য। এ উপন্যাসটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে। বহুল পঠিত ও আলোচিত এ উপন্যাসের নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত অংশটির অনুবাদ বাঙালি পাঠকদের জন্য আমরা তুলে ধরছি। জ্যাকবসন ১৯৪২ সালের ২৫ আগস্ট ম্যানচেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটেনের ইহুদি চরিত্রের মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের উপস্থাপনে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার হাস্যরসাত্মক উপন্যাসগুলো। তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে, 'কামিং ফ্রম বিহাইন্ড', 'দ্য মাইটি ওয়ালজার', 'হু'জ সরি নাউ', 'কালুকি নাইটস', 'দ্য ফিঙ্কলার কোয়েশ্চেন' ইত্যাদি।

দ্য ফিঙ্কলার কোয়েশ্চেন উপন্যাসটির জন্য ২০১০ সালে ম্যানবুকার পুরস্কার পেয়েছেন ৬৮ বছর বয়সী জ্যাকবসন। ম্যানবুকার পুরস্কার প্রদান কমিটির প্রধান বিচারক অ্যান্ড্রু মশন বলেন,'দ্য ফিঙ্কলার কোয়েশ্চেন' একটি অসাধারণ বই। অবশ্যই খুব হাসির। কিন্তু একই সঙ্গে খুব বুদ্ধিদীপ্ত, খুব কষ্টের ও অতি সূক্ষ্মতার পরিচায়ক এটি। এটা পড়ে যা মনে হয় তা এবং তার চেয়েও বেশি কিছু বোঝায় উপন্যাসটি। এ মহান পুরস্কারের যোগ্য বিজয়ী এটি।" জ্যাকবসনের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসেই ইহুদি মনস্তত্ত্বের রয়েছে সুনিপুণ উপস্থাপন। ইহুদি মনস্তত্ত্ব¡ বোঝা ও তার শৈল্পিক উপস্থাপনে সফলতার জন্য তাকে ইহুদি-আমেরিকান লেখক ফিলিপ রথের সঙ্গে তুলনা করে 'দ্য ইংলিশ ফিলিপ রথ' বলা হয়। আর তিনি নিজেকে পরিচয় দেন 'অ্যা জিউস জেন অস্টিন' বলে। -অনুবাদক]

গ্রন্থসংক্ষেপ: দ্য ফিঙ্কলার কোয়েশ্চেন

এ ঘটনাটি সে আগেই বুঝে থাকতে পারে।

তার জীবনে একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটেই চলছিল। তাই সে এটার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে পারে। কি ঘটবে তা সে আগেই বুঝতে পারতো। ঘুমের আগে ও পরে কেবল সে সম্পর্কে আবছা ধারণা নয়, বাস্তব জীবনের সব বিপদ সম্পর্কে সে আগেই জানতে পারতো। ল্যাম্প পোস্ট ও গাছপালা তার দিকে তেড়ে আসতে দেখে তার পা কাঁপতো। অনেক গতিতে চলমান গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপথ দিয়ে চলতো। আর তাকে আবর্জনা ও ছড়ানো ছিটানো হাড়ের মধ্যে ফেলে দিতো। তার ভাঙা চোরা মাথার খুলি থেকে তরল তীক্ষè বস্তু বের হতো।

নারী সবচেয়ে খারাপ। জুলিয়ান ট্রেজলভ কোনো নারীকে দেখলে তার শরীর নয়, মন বিচলিত হতো। সে তাকে অস্থির করে তুলতো।

সত্যি সে স্থির থাকতো না। কিন্তু তাকে অস্থির করলেও ঐ নারী তার কি ভবিষ্যৎ নিয়ে আসতো সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে-ই ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতো।

মানুষের কোনো বিষয় আগেই বুঝতে পারার পদ্ধতি ভুল, এটাই সত্যি। ট্রেজলভের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। কোনো নারীকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার পরিণাম কল্পনা পারতো-তার বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ও তা মেনে নেওয়া, একসঙ্গে দু'জনে ঠিক করা ঘর, দামী পর্দার মধ্য দিয়ে ঘরে বেগুনি আলোর রেখার হাতছানি, মেঘের মতো দুলতে থাকা বিছানার চাদর, চিমনি থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া সুগন্ধ-টাইলসের ঘর ও তার জানালা, তার সুখ, তার ভবিষ্যৎ- এগুলো সবই ভেঙে পড়তো যখন নারীটি তাকে ছেড়ে যেতো।

অন্য কোনো পুরুষের জন্য বা তার প্রতি ও তাদের যৌথ জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে সে তাকে ছেড়ে যেতো না। একটি সার্থক ট্রাজিক ভালোবাসার স্বপ্ন থেকে সে তাকে ছেড়ে যেতো- বেদনাহত, অশ্রুসিক্ত এবং অনেক সময় তাকে বিদায় না বলেই চলে যেতো নারীটি। ঘটনাগুলো অনেকটা জনপ্রিয় ইতালিয়ান নাটকের মতোই ঘটতো।

সেখানে কোনো শিশু নেই। শিশুরা গল্প নষ্ট করে।

তেড়ে আসা ল্যাম্প পোস্ট ও সব কিছু ভেঙে পড়ার মাঝের সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে ভালোবাসার মানুষটিকে তার শেষ কথাগুলো বলার শক্তি সংগ্রহ করতো। তবে তা ইতালিয়ান নাটক থেকে ধার করা সংলাপের মতো নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময় তার মধ্যে কাঁপুনি তুলতো, তার হৃদয় ভেঙে যেতো এবং তাদের দেখা হওয়ার আগে নারীটির মরার মতো অবস্থা হতো।

ভালোবাসার নারীর উপস্থিতি ট্রেজলভের কাছে মনোরম হয়ে উঠতো। উৎসবে নারীটির মধ্যে সে হারিয়ে যেতো, তবে তার মধ্যে প্রিয়তমার হারিয়ে যাওয়াই তার বেশি ভালো লাগতো। প্রেমে পড়ার ব্যাপারটি এভাবেই সে বুঝতে পারতো। ভাবনার জগতে কখনো নারীটি তার কাছ থেকে সরে যেতো না, কোনো প্রস্তাবও দেওয়া হতো না।

এই-ই ছিলো তার জীবনের কাব্য। বাস্তবিক অর্থে সৃজনশীলতা নষ্টের জন্য দায়ী করে নারীরা ট্রেজলভকে ছেড়ে চলে যেতো।

বাস্তবতায় সেখানে শিশুরা থাকতো। কিন্তু বাস্তবতার অন্তরালে অন্য কিছুর ইঙ্গিত থাকতো।

এক স্কুল ছুটির দিনে বার্সেলোনায় সে এক ভবঘুরে গণককে তার হাত দেখালো।

গণক বললেন, "আমি একজন নারী দেখছি।"

উত্তেজিতভাবে ট্রেজলভ প্রশ্ন করলো, "সে কি সুন্দরী?"

গণক বললেন, "আমার কাছে না। কিন্তু তোমার কাছে হতে পারে। আমি বিপদও দেখছি।"

ট্রেজলভ আরো উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো, "দেখা হলে আমি কিভাবে তাকে চিনবো?"

'তুমি বুঝতে পারবে।'

'তার কি নাম আছে?'

হাতের বুড়ো আঙুল পিছনে ফিরিয়ে গণক বললেন, 'নিয়ম অনুসারে, নাম অপ্রয়োজনীয়। তবে তুমি তরুণ বলে আমি তোমার জন্য আলাদা কাজ করছি। আমি জুনো দেখছি-তুমি কি জুনো নামে কাউকে চেনো? '

তিনি একে হুনো উচ্চারণ করলেন।

ট্রেজলভ এক চোখ বন্ধ করলো। জুনো? সে কি জুনো নামে কাউকে চিনতো? কেউ কি জুনো নামে কাউকে চেনে? না, দুঃখিত, না, সে চিনতো না। কিন্তু সে জুন নামে একজনকে চিনতো।

'না, না, জুন থেকে বড়ো।' জুন থেকে বড় না হওয়ায় গণক তার ওপর ক্ষুব্ধ হলেন। 'জুডি… জুলি… জুডিথ। জুডিথ নামে কাউকে তুমি চিনতে?

হুডিথ।

ট্রেজলভ হাত নাড়লো। তবে সে জুলিয়ান ও জুডিথ শব্দ দুটি পছন্দ করলো। হুলিয়ান ও হুডিথ ট্রেজলভ।

'বেশ, সে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। জুলি বা জুডিথ বা জুনো–আমি এখনো জুনো দেখছি।'

ট্রেজলভ অন্য চোখ বন্ধ করলো। জুনো, জুনো…

সে জিজ্ঞেস করলো, "সে কতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?"

'তুমি তাকে না পাওয়া পর্যন্ত'

ট্রেজলভ মনে মনে তাকে খুঁজতে থাকলো। 'তুমি বললে সে বিপদজনক। কিভাবে সে বিপদজনক?'

কণ্ঠে কর্কশ আওয়াজ তুলে সে গণককে তার দিকে তেড়ে আসতে দেখলো–আদ্দিও, মিও বেলো, আদ্দিও।

'সে-ই বিপদজনক তা আমি বলিনি। আমি কেবল বিপদ দেখেছি। তুমিও তার জন্য বিপদজনক হতে পারো। অথবা অন্য কিছু ব্যক্তি তোমাদের দু'জনের জন্যই বিপদজনক হতে পারে।'

ট্রেজলভ প্রশ্ন করলো, "তাই আমার কি তাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত?"

গণক লাফ দিয়ে উঠলো। 'তুমি তাকে এড়াতে পারবে না।'

সে ছিলো সুন্দরী। অন্তত ট্রেজলভের চোখে।

গণক যা জানতে পেরেছিলো তার সবকিছু তাকে বলেনি। কোনো ব্যক্তি, কোনো কোনো ঘটনা তার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিলো।

দুর্ঘটনার চেয়েও বড় কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছিলো।

দুর্ঘটনা ও দুঃখে পূর্ণ ছিলো তার জীবন। একদিন, তার কাছেই একটি মানুষের ওপর গাছ ভেঙে পড়লো। ট্রেজলভ কান্না শুনতে পেলো ও বিস্মিত হলো। কারণ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো মানুষটি সে নিজেই। লন্ডনের পাতাল পথের এক ক্ষিপ্ত অস্ত্রধারীর কথা তার খুব মনে পড়ে। এমনকি কোনো পুলিশই তাকে কোনো দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। স্কুলজীবনে তার বাবার এক বন্ধুর সুন্দরী মেয়েকে ভালোবেসেছিলো। গ্রীষ্মের শেষে ফোটা গোলাপের পাপড়ির মতো ছিলো তার গায়ের রঙ। তার চোখ মনে হতো সব সময় ভেজা। সে ছিলো যেনো অপ্সরী। চৌদ্দ বছর বয়সে মেয়েটি মারা যায়। আর ট্রেজলভ তখন বার্সেলোনায় তার ভাগ্য গড়ার চেষ্টা করছিলো। মেয়েটির জীবনের শেষ সময়ে এমনকি তার শেষকৃত্যেও তার পরিবার তাকে আসতে দেয়নি। তারা তার ছুটির দিনগুলো নষ্ট করতে চায়নি। তারা তাকে বলেছিলো। কিন্তু তার কষ্ট হোক তা তারা চায়নি।

তাই জীবনে সে শুধু হারিয়েছিলো। উনপঞ্চাশ বছর বয়সেও সে ছিলো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। মায়ের পেট থেকে পড়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সে তেমন কোনো আঘাত পায়নি। এখনো তার বিয়ে হয়নি। তার জানামতে, তার ভালোবাসার বা যৌন সম্পর্কের কোনো নারী এখনো মারা যায়নি। কেউ কেউ তার সঙ্গে অনেক দিন থেকেছে। তবে তা কোনো স্মরণীয় প্রেমের স্মৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাকে ছেড়ে গেছে। প্রেমের ট্রাজিক পরিণতি তাকে চির তরুণের চেহারা এনে দিয়েছে।

গ্রীষ্মের শেষের এক রাত্রির প্রথম প্রহর, চাঁদ ছিলো প্রেমাতুর। পুরনো বন্ধু ও তার স্ত্রীর সঙ্গে রাতের খাবার সেরে ট্রেজলভ ফিরছিলো। খাবারের বিষাদ তার মুখে লেগেছিলো। বন্ধু দম্পতির একজন তার সমবয়সী, আর একজন বয়সে বড়ো। সম্প্রতি তারা বিয়ে করেছেন। রাস্তায় ঝামেলা এড়ানোর জন্য সে লন্ডনের চেনা এক পথ ধরে হাঁটছিলো। একটি ক্যাবে ওঠার আগ পর্যন্ত পুরনো সব স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে তার মন কষ্টে ভরে উঠলো। পাতাল রেল স্টেশনের খুব কাছে তার বাড়ি হলেও সেদিন সে একটি ক্যাব নিয়েছিলো।

সে বললো, 'কী অবর্ণনীয় দুঃখ।' সে তার এক বন্ধুপতœী ও সাধারণ নারীদের মৃত্যুর কথা ভাবলো। যেসব মানুষ একা চলে যায় তাদের কথাও সে চিন্তা করলো। কাজেই নিজের বিষয়টি তার চিন্তার মধ্যে চলে আসলো। প্রেমিকাকে হারানো খুবই দুঃখজনক। কিন্তু ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগ পর্যন্তও বাহুলগ্না বা আলিঙ্গনে কোনো নারী না থাকাটাও কম দুঃখের নয়।
সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো, 'ওইটা ছাড়া আমি কীসের জন্য?'। সে এমন একটি মানুষ যে জীবনকে ভালোভাবে চালাতে পারেনি।

সে বিবিসি ছেড়েছে। সেখানে সে কাজ করতো এবং সেখানে থেকে আদর্শ বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু এখন সে বিবিসিকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে। মনে পড়লে প্রতি নিঃশ্বাসের সঙ্গে সে এটাকে অভিশাপ দেয়।

প্রচণ্ড অভিশাপ।

বিবিসি সম্পর্কে তার ধারণা এমনই। এটা তাকে অপব্যবহার করেছে। ভালোবেসে পুরো জাতি একে বলে 'আন্ট'। কিন্তু আন্টরা স্নেহ-ভালোবাসা ও মায়া মমতার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ট্রেজলভ মনে করে, শ্রোতাদের নেশাগ্রস্ত করে বিবিসি। তাদের চিন্তাশক্তি কমিয়ে অসার করে তোলে তা। সেখানে যারা কাজ করে তাদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এরকমই। পদমর্যাদার লোভ ও অহমিকার শিকল পরিয়ে কোনো কোনো কর্মীর ক্ষেত্রে সে ক্ষতি অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তারপরেও তাদের পদোন্নতি হয় না, কেবলই ব্যর্থতা।

চাঁদের মতো উঁচু ও দুলতে থাকা ক্রেনগুলো ভবনটিকে ঘিরে রাখতো। সে ভাবতো এটা নিয়তি নির্ধারিত। আমার শেষটাও শুরুর মতোই নিয়তির খেলা। বিবিসি আমার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। ভয়ের সিনেমায় যেমন পৃথিবী তার আবরণ খুলে ফেলে তেমনি সে তার মাথার খুলি থেকে তরল বেরোনোর শব্দ শুনতে পেতো। সে তার গতি বাড়াতো। একটি গাছ তার দিকে তেড়ে আসতো। পথ হারিয়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়তো। বিপদ। দুশ্চিন্তায় তার পা কাঁপতো। উৎকণ্ঠায় রাতে তার আত্মা কাঁপতে থাকতো।

সে নিজেকে বলতো, তুমি যে জায়গা খুঁজছো তা কোথাও পাবে না। তা সব সময় ভিন্ন কোথাও থেকে আসে। নম্রতা থেকে আক্রমণাত্মকভাবে কীভাবে কিছু পাওয়া যায়–তাকে জোর করে নিয়ে যাও, প্রথমে অস্পষ্ট কোনো জায়গায় নেবে, তারপর তাকে বলবে কোনো শব্দ বা ঝামেলা না করতে এবং এক এক করে তার ঘড়ি, মানিব্যাগ, কলম ও মোবাইল বের করে নিতে হবে।

তারপর যখন সে নিজের পকেট পরীক্ষা করে তা খালি পাবে, বাস্তবে কী ঘটেছে সে বিষয়ে তখন সে নিশ্চিত হবে।

মানিব্যাগ নেই, মোবাইল ফোন নেই।

তার জ্যাকেটের পকেটে কলমও নেই।

তার হাতে ঘড়ি নেই।

এবং তার মধ্যে কোনো আলোড়ন নেই, রক্ষার কোনো তাগাদা নেই, বর্তমানে টিকে থাকার মতো কিছু নেই।

কিন্তু তার কি কখনো এসব ছিলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ছিলো শিক্ষার নানা শাখার সঙ্গে যুক্ত। স্বীকৃত কোনো বিষয় হিসেবে নয়, কিন্তু আর্টসের নানা ক্ষেত্রে ছিলো তার লেখাপড়া। প্রত্নবিদ্যা, কাব্য, সংবাদমাধ্যম ও যোগাযোগ, উৎসব ও থিয়েটার প্রশাসন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, মঞ্চ ও আলোক সজ্জা, রুশ ছোটগল্প, রাজনীতি ও জেন্ডার। লেখাপড়া শেষ করার পর কখন এবং কোথায় তার লেখাপড়া শেষ হয়েছে সেটা স্পষ্ট হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এতগুলো শাখায় কেউ লেখাপড়া শেষ করে না। ট্রেজলভ এমন একটি সার্টিফিকেট পেলো যে, সে সব কিছু করতে পারতো। এটা দিয়ে সে তখন বিবিসিতে গ্রাজুয়েট ট্রেইনিশিপ নিলো। নেওয়ার সময় বিবিসি ট্রেজলভকে দিয়ে সব কিছু করাতে পারতো। তাকে রেডিও ৩-এর জন্য লেট-নাইট আর্টস প্রোগ্রাম প্রযোজনার দায়িত্ব দেওয়া হলো।

নিজেকে সে বাগানের বড় বড় বৃক্ষের পাশে ক্ষুদ্র গুল্ম মনে করতো। ট্রেইনিরাও বিবিসিতে আসার কয়েক দিনের মাথায় তার চেয়ে পদাধিকারে বড় হয়ে যেত। চুপচাপ থাকায় তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটতো না। তারা প্রোগ্রাম কন্ট্রোলার, স্টেশন প্রধান, বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাহী, এমনকি মহাপরিচালক বনে যেতো। কেউ চলে যেতো না। কাউকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হতো না। কর্পোরেশনটি তার সেখানে কর্মরতদের পরিবারের সদস্যদের চেয়েও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতো। ফলশ্রুতিতে সেখানকার প্রত্যেকে প্রত্যেককে খুব গভীরভাবে জানতো। কেবল ট্রেজলভই ছিলো এর ব্যতিক্রম। সে কাউকে জানতো না।

ক্যান্টিনে নানাজন তাকে দেখে উল্লাস প্রকাশ করতো। কিন্তু এসবে তার কান্না পেতো। দুঃখ-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে সে বলতো, 'চিয়ার আপ।' তার প্রোগ্রামে অনেকগুলো বেদনার সঙ্গীত থাকায় তাকে একবার নোটিশ পাঠানো হলো।

অনেক বছর পরে তার বোধোদয় হলো যে, বিবিসিতে গভীর রাতে সে যা প্রচার করছে তা কেউ শুনছে না। ভোর তিনটায় মৃত কবিদের নিয়ে জীবিত কবিদের আলোচনা কে শুনতে চায়?–সে পদত্যাগ করলো। পদত্যাগ পত্রে সে লিখলো, 'আমার প্রোগ্রামটির প্রচার বন্ধ হলে কেউ কি তা খেয়াল করবে?' 'আমি যদি কাজ বন্ধ করে দিই তাহলে কেউ কি আমার অনুপস্থিতি বুঝতে পারবে?'–দ্বিতীয়বার লিখেও সে কোনো উত্তর পেলো না।

আন্টি কোনোটিই শোনেনি।

সাউথ কোস্টে নতুন যাত্রা করা একটি আর্টস ফেস্টিভ্যালের একজন সহকারি পরিচালক নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে সে সেখানে আবেদন করলো। 'নতুন যাত্রা করা' মানে একটি স্কুল লাইব্রেরি যেখানে কোনো বই নেই, কেবল কম্পিউটার আছে। কোনো শ্রোতা নেই, কিন্তু তিন জন বক্তা আছেন। এটা তাকে বিবিসির কথা মনে করিয়ে দিলো। পরিচালক তার সব চিঠিতে সহজ ইংরেজিতে সব কথা লিখলো এবং কথা বলার সময়ও সে তাই করলো।

পরিচালক নারীটি জিজ্ঞেস করলো, 'উদ্দীপক বলছেন কেন যখন আপনি যৌন আবেদনময়ী বলতে পারেন?'

'কারণ একটি আর্টস ফেস্টিভ্যাল যৌন আবেদনময়ী হয় না।'

'এবং আপনি জানতে চাচ্ছেন কেন আমি তা বলছি? কারণ আপনি উদ্দীপকের মতো শব্দ ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন।'

'এতে সমস্যা কী?'

'এটা পরোক্ষ ভাষা।'

'উদ্দীপকে কোনো পরোক্ষ ভাব নেই।'

'এভাবে আপনি তা বলতে পারেন।'

সে কোনো ভনিতা ছাড়া জিজ্ঞেস করলো, 'আমরা কি উচ্ছ্বাস দিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারি?'

তারা একসঙ্গে শুতো। তাদের আর কিছু করার ছিলো না। যখন আর কেউ তাদের ফেস্টিভ্যালে আসতো না তখন তারা জিমনেশিয়ামের মেঝেতে ঘুমতো। ট্রেজলভ তাকে ভালোবাসতো এটা কেবল তখনই বুঝতে পেরেছিলো যখন সে তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো।

তার নাম ছিলো জুলি এবং তাকে ছেড়ে যাওয়ার সময়ই কেবল সে বুঝতে পেরেছিলো।

হুলি।

তারপর সে আর্টস এ তার ক্যারিয়ার শেষ করলো এবং বেমানান একটি চাকুরি নিলো ও একই ধরনের একটি নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললো। নতুন চাকুরি নিয়ে সে প্রেমে পড়লো এবং তার প্রেমও শেষ হলো – অথবা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে সে বাধ্য হলো। সব সময় সে কেবল ঘড়ির পে-ুুলামের মতো ঘুরতে থাকলো। এবার সে এক ইতালিয়ান কার্পেন্টারের সহকারি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তার প্রেমে পড়লো। ঐ নারী ভিক্টোরিয়ান যুগের ঘরের জানালা পাল্টানো ও মেরামতের কাজ করতেন। প্রতি শুক্রবার রাতেই ট্রেজলভ পারিশ্রমিক পেতো। সে নারীও টেজলভকে প্রেমে ফেললেন এবং ছেড়ে দিলেন। এরপর লন্ডনের একটি বিখ্যাত স্টোরে চাকুরি নিয়ে ট্রেজলভ মেঝেতে আসবাব সরবরাহকারী এক নারীর প্রেমে পড়লো। সেও তাকে ছেড়ে চলে গেলো। নারীটি বললো, 'তুমি কি মনে করবে তা আমি জানতে চাই না। এটা আমাদের দু' জনের ওপরই খারাপ প্রভাব ফেলছে।'

ট্রেজলভ বললো, 'তুমি এটা ঠিক করেছিলে।'

'আমি ঠিক করিনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম। আমি অবশ্যই কামনা করেছিলাম। তুমি দুর্বল তা আমার জানার প্রয়োজন ছিলো। সারা দিন আমি নরম জিনিস নিয়ে কাজ করি। ঘরে ফিরে আমি কঠিন কিছু চাই। শক্ত কিছু আমি চাই, নরম তুলতুলে দিয়ে আমার চলবে না।'

তার ছিলো লাল চুল ও রুক্ষ ত্বক। সে খুব দ্রুতই উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। ট্রেজলভ সব সময়ই তার খুব কাছে যেতে ভয় পেতো।

'আমি একটি পাথর।' একটু দূরে থেকে সে এটা বলতো। 'শেষ পর্যন্ত আমি তোমার সঙ্গে থাকবো।'

নারীটি তাকে বলতো, 'ভালো, অন্তত সে কারণে তুমি ঠিক আছো।' 'এটাই শেষ। আমি এখনই তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি।'

'কেবল আমার চাহিদা আছে বলে?'

'কারণ আমার কাছে তোমার কোনো চাহিদা নেই।'

'দয়া করে আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি যদি আগে পাথর না হই, এখন থেকেই পাথর হবো।'

'তুমি পারবে না। এটা তোমার ধরন না।'

'তুমি অসুস্থ হলে কি আমি সেবাও করবো না?'

'তুমি করবে। আমি অসুস্থ হলে তুমি আমার জন্য চমৎকার। কিন্তু আমি সুস্থ্য থাকলে তুমি আমার কোনো কাজে লাগো না।'

না যাওয়ার জন্য সে তাকে অনেক অনুরোধ করলো। তার কপাল নিজের কাছে নিয়ে দুই হাত দিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে তার ঘাড়ের দুই পাশে মাথা রেখে কাঁদতে থাকলো।

নারীটি বললো, 'কিছু উত্তাপ।'

তার নাম ছিলো জুন।

চাহিদা একটি আপেক্ষিক বিষয়। অন্য সবার মতো তার চাহিদা ছিলো না। তার জীবনে যে সব ঘটনা ঘটেছিলো বা ঘটে নাই সেগুলো নিয়ে ভাবার মতো কেউ ছিলো না। তার নিসঙ্গতা ও এই না থাকার বিষয়টি সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারতো না। তার অসম্পূর্ণতা, বিচ্ছিন্নতা, শেষের জন্য অপেক্ষা বা কোনো শুরুর অপেক্ষায় শেষ, তার গল্প একটি প্লট খুঁজতো।

ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় দুর্ঘটনাটি ঘটলো। ট্রেজলভ এটা জানতে পেরেছিলো, কারণ তার কয়েক মুহূর্ত আগে কোনো কারণে সে ঘড়ি দেখেছিলো। তার পূর্বাভাস পাওয়ার ক্ষমতার কারণে হতে পারে। কিন্তু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোর উজ্জ্বলতা, অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ঝলমলে রূপ–একটি সেলুন তখনো খোলা ছিলো এবং রেস্তোরাঁ ও পত্রিকার এজেন্টগুলো কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল–তখন হয়তো সন্ধ্যা ছিলো। রাস্তা ফাঁকা ছিলো না। অন্তত এক ডজন মানুষ ট্রেজলভকে বাঁচাতে এসেছিলো, কিন্তু কেউ পারলো না। হামলাটি সম্ভাবত রিজেন্ট স্ট্রিট থেকে অল্প কয়েক হাত দূরে এবং বিবিসি'র খুব কাছে হয়েছিলো–প্রত্যক্ষদর্শীরা ধাঁধার মধ্যে পড়েছিলো। সম্ভাবত তারা ভেবেছিলো ঘটনায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা খেলা করছিলো অথবা থিয়েটার বা রেস্তোরাঁয় খাওয়া শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে গৃহবিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলো। তারা হয়তো ভেবেছিলো–কোনো দম্পতির জীবনের ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটছে।

এ ঘটনাটি ছিলো ট্রেজলভের কাছে সবচেয়ে বিব্রতকর। এটা তার কোনো ভালোলাগা সুখ দেওয়া নারীর চলে যাওয়া নয়। হামলাটির কারণে পাওয়া কষ্টের জন্য নয়, একটি হাত তাকে পিছন দিয়ে ঘাড়ে শক্ত করে ধরলো এবং এতো জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে একটি ভায়োলিনের দোকানে ঢোকালো যে, জানালার শার্শির কাচের পিছনে যন্ত্রগুলো জোরে শব্দ করে বাজতে থাকলো। তার নাক ভাঙার আওয়াজ শোনার আগ পর্যন্ত সে যন্ত্রগুলোর আওয়াজ শুনতে পেলো। তার ঘড়ি, মানিব্যাগ, কলম, মোবাইল ফোন চুরি হলো না। এসবের পিছনে যে দুঃখের বিষয় তার জন্য ছিলো তা হলো, হামলাকারীর ফিসফিসানি শুনে সে বুঝতে পারলো যে সে একজন নারী।