ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের প্রকাশনা শিল্পের মর্যাদা অর্জন

saifullamahmud_dulal
Published : 25 Oct 2015, 12:26 PM
Updated : 25 Oct 2015, 12:26 PM

ইউরোপে হেমন্তে গাছের পাতায় যখন তামা রং ধরে, প্রকৃতি জানান দেয় পাতাঝরা আর আসন্ন বিষণ্ন শীতের কথা; ঠিক তখনই আয়োজন হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। যে দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী বই পুড়িয়ে দিয়েছিলো, সেখানেই এখন বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা! সেই মেলায় যাবার জন্য সেবাস্তিয়ান উইলহেম আমাকে ৬৫তম আন্তর্জাতিক ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের মেলায় অংশ নিয়ে এক বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ইতোপূর্বে টোকিও আন্তর্জাতিক বইমেলা, হংকং আন্তর্জাতিক বইমেলা, কলকাতার বইমেলা দেখেছি। তবে এ কথা না বল্লেই নয়, আমাদের একুশের বইমেলাও গর্ব করার মতো বিষয়! প্রথমতঃ এই মেলার সাথে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য মেশানো, দ্বিতীয়তঃ মাসব্যাপী দীর্ঘ বইমেলা বিশ্বে আরো কোথাও নেই!

আমি মেলার দু'দিন আগে চলে যাই দুবাই। তারপর দুবাই থেকে আমার সাথে সঙ্গী হলেন অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম। আর মেলায় গিয়ে পেলাম অঙ্কুর প্রকাশনীর মেজবাহকে। আগে এভাবে আমাদের প্রকাশকেরা ব্যাক্তিগত উদ্যোগে বা মেলার আমন্ত্রণে অংশ নিতেন। এবার ব্যতিক্রম ঘটলো, আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ অংশ নেয়। প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন- সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও কবি কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কবি মাহবুবুল হক শাকিল। সেই সাথে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম এবং নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান শায়ক। সমিতির সভাপতি ওসমান গনি যাবার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি যেতে পারেননি অসুস্থতার জন্য। অথচ গনি ভাই এবং প্রিয়ভাজন মাজহার বারবার মেলায় যাবার জন্য বলেছেন। অফিসের ছুটি সংক্রান্ত জটিলতার জন্য তা আর হলো না।


বারবার মনে পড়ছিলো সেই ২০০৪ সালের অংশগ্রহণের স্মৃতি। প্রতিদিন পঁচাত্তর ইউরতে ভাড়া সই করা গেষ্ট হাউসে। তখন অনেক রাত। সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা গেষ্ট হাউসের তিন তলা থেকে নিঝুম রাতের ফ্রাঙ্কফুর্ট দেখছিলাম। মনে হচ্ছিলো, আকাশের নক্ষত্রগুলো নেমে এসেছে এই অচেনা বিদেশি শহরে। আর ভাবছিলাম- এই দেশ ফ্রানৎস কাফকা, ফেডরিক এঙ্গেলস, কার্ল মার্কস, আইনষ্টাইন, বেটোফেন, গুন্ট্রার গ্রাসের দেশ। এই শহর ঐতিহাসিক শহর। এই শহর মহাকবি গ্যাটের শহর, এই শহর ছাপাখানার জনক গুটেনবার্গের শহর।

স্বর্ণকারের ছেলে গুটেনবার্গ ১৫১৫টি বর্ণ পৃথক পৃথক করে শিশা গালিয়ে খোদাই করে অক্ষর তৈরি করে ছাপাখানার জন্ম দেন ফ্রাঙ্কফুর্ট নগরীর মাইনস নামক স্থানে। সর্ব প্রথম একটি কবিতার বই, পরে 'গুটেনবার্গ বাইবেল'ও ছাপা হয় এই প্রেসে।

পৃথিবীর মানুষকে আলোকিত করার অর্থাৎ প্রিন্ট্রিং প্রেসপিতা গুটেনবার্গ ঋণগ্রস্থ হয়ে এক পর্যায়ে নিজ শহর ছেড়ে পালিয়ে যান এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।

আবার যে দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী ঘোষিত নিষিদ্ধ বই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, আজ সেই দেশেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার ইতিহাস পনের দশক থেকে। তবে ১৯৪৯ সাল ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা ঐতিহ্যের রূপ নেয়। সেই বছর ১৮ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরের মেলার জার্মানের ২০৫টি পুস্তক প্রকাশক অংশ নেয়। পরে অন্যান্য দেশও যুক্ত হয়। এখন যার জন্য মেলার আয়োজকরা ৩৬৫ দিনই অনবরত কাজ করেন। (দ্রঃ বইবিশ্বে দশদিন, রবীন আহসান, প্রকাশকঃ শ্রাবণ, প্রকাশকালঃ ২০০৮, ঢাকা। পৃষ্ঠা/১২।)

ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলা প্রতিবছর, প্রকাশক, বইবিক্রেতা, এজেন্ট, পাঠক এবং লেখাই বাহুল্য লেখকদের জন্য এক তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। সেই গ্রন্থের তীর্থস্থান এবার সরকারীভাবে বাংলাদেশ অংশ নিলো এবং ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স এসোসিয়েশন (IPA)-এর কংগ্রেসে বাংলাদেশ সদস্য পদ অর্জন করে। যার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের প্রকাশনা শিল্প বহির্বিশ্বে মর্যাদা অর্জন করলো।

গত ১৫ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে ৬৭তম ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ড উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কবি মাহবুবুল হক শাকিল। পরে মেলায় বাংলাদেশের সাথে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। একটি বইমেলার কর্তৃপক্ষের সাথে, অপরটি আইপিএ'র সাথে। প্রথম বৈঠকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লাউরিয়া কওস-এর সাথে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও কবি কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কবি মাহবুবুল হক শাকিল অংশ নেন।

অপর দিকে ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স এসোসিয়েশন কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারী ফজে বার্গিনোর সাথেও বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় প্রাধান্য পায়, একুশের বইমেলায় আইপিএ'র অংশগ্রহণ নিয়ে।

এই স্বীকৃতির ফলে প্রকাশনা অঙ্গনে বাংলাদেশের নতুন যাত্রা শুরু হলো।