আন্তোনিও মাচাদোর কয়েকটি কবিতা

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
Published : 5 July 2015, 04:55 PM
Updated : 5 July 2015, 04:55 PM


আন্তোনিও মাচাদোর প্রতিকৃতি: পাবলো পিকাসো
স্প্যানিশ সাহিত্যের আধুনিক পর্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য আন্তোনিও মাচাদো। এ যুগের কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কা ও হুয়ান রামোন হিমেনেথ বাংলাভাষায় যতটা অনূদিত ও পরিচিত, ততটা পরিচিতি পাননি এই অসামান্য স্প্যানিশ কবি। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ অনুবাদকদের একজন খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের মূলোপম তর্জমা, গদ্যভাষ্য ও কন্ঠে আর্টসের পাঠকদের জন্য প্রথমবারের মতো ত্রিতল বিন্যাসে উপস্থাপিত হলো স্প্যানিশ ভাষার জীবনানন্দ দাশ আন্তোনিও মাচাদো। বি.স.

৯ই সেপ্টেম্বর ২০১১। নেপালের একটি পাহাড়ী পল্লী নাগরকোট। সেখানে এক প্রান্তে পাহাড় ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত কান্ট্রি ভিলা হোটেলের একটা কাঠের ঘরে বসে লিখছি যাত্রা শেষের বৃত্তান্ত। উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় নির্জন, মহা নিরবতায় জানলার ধারে কাঠের চেয়ার টেবিলে বসে লিখতে আর পড়তে ভাল লাগে, বেশ ভাল্লাগে। এতোক্ষণ ধরে পড়ে শেষ করলাম আন্তোনিও মাচাদোর কবিতার বই Times Alone। রবার্ট ব্লাই-এর চমৎকার অনুবাদে কবিতাগুলো পড়তে পড়তে দেখি কখন চোখে পানি এসে গেছে। প্রকৃতি, শিল্প, জীবন জগত মানুষের, ফড়িং-এর ঝিঁঝি পোকা আর পাইনতরুর এমন চমৎকার সমাবেশ নাগরকোটের এই সময়ের সঙ্গে একেবারে হুবহু মিলে যায়। এখানে মেঘ এসে একেকবার ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু, আবার কিছুটা পরিস্কার হয়ে গেলে দেখা যায় নিচে বহু নিচে পাহাড়ের ঢালে মানুষের ঘরবাড়ি। অলস পাখায় ওড়ে চিল, দু একটা কাক ডাক দিয়ে উড়ে যায় এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। মিশে যায় তারা ঝাপসা আর কুয়াশার মাঝে। এমন জায়গা কেবল নিরবতা আর নির্জনতারই উপযোগী।

মাচাদোর অনেকগুলো কবিতার সঙ্গে এই নিসর্গ একেবারে এক হয়ে মেশে। একটা কবিতায় মাচাদো লিখছেন:
নীল গিরি, নদী ও খামার
বাবলা গাছের কঞ্চি তামাটে চিকন
আর পাহাড়ের গায়ে আলমন্ড বাদামের শ্বেত শাখা!
উফ্, যেন বরফ রয়েছে ফুটে, আর
গাছে গাছে ঝুলে আছে স্থির প্রজাপতি!
ওদিকে সীমক্ষেতের গন্ধ বয়ে হঠাৎ বাতাস
ছুটে যায় খামারের উৎফুল্ল নিরবতা ভেদ করে।

গোল্ডেন বাউ-এর ঊনত্রিশ ত্রিশ পরিচ্ছেদে সিরিয়া-লেবাননের পাহাড়ের বর্ননার সঙ্গে এখানকার নাগরকোটের এই দৃশ্যের কত মিল। মাচাদোর আরেকটি কবিতা এতো ভালো লাগলো যে অলক্ষ্যে চোখে পানি এসে গেল:

আরেকটি রাত

ছেলেটির জলপট্টি বাঁধা কপালে
ঢিপ ঢিপ করে পড়ে জ্বরের হাতুড়ি।
'মা গো, ওই যে হলুদ পাখি!
ওই যে প্রজাপতি ওড়ে কালো, বেগুনে!'
'ঘুমা বাছা' বিছানার পাশে বসে মা
চেপে ধরে সন্তানের ক্ষুদে হাত
'আমার জ্বলন্ত ফুল, রক্তের জবা, বাবা
কে তোরে এমন করে হিম শীতল করে?'
খোলা নাঙ্গা ঘরে শুধু ল্যাভেন্ডারের মৃদু ঘ্রাণ:
বাইরে ক্রমেই চাঁদ ফুলে পুরুষ্ট হয়,
আঁধার শহরকে, আর শহরের ঘরবাড়ির চূড়ায়
সে শুধু লেপন করে সাদা আর সাদা।
ঝাপসা আলোয়, যেন কোথা থেকে ভেসে আসে
অদৃশ্য বিমানের চাপা গুঞ্জরণ।
'ঘুমোলি বাজান, আমার শোণিত কুসুম?'
রোয়াকের জানলার কপাট ওঠে কেঁপে, বলে
'ওহ্, বড্ড শীত, মাগো, হিম শীত, কেবলি যে শীত।'

সময় ঘনিয়ে এলো যাবার। গাড়ি আসবে সাড়ে এগারোটায়; এখন বাজে সোয়া এগারো। যাই, শেষবারের মতো গুছিয়ে নিই। বিদায় কান্ট্রি ভিলা, বিদায় নাগরকোট। বিদায় ওই উঁচু উঁচু পর্বতমালার মহা নির্জনতা আর মহানিদ্রাপরিবৃত মহান নিরবতা। বিদায়!
গাড়ি চলে এলো ঠিক সারে এগারোটায়। গতকাল এই গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলো কাঠমান্ডু। সেখানে সিটি সেন্টার শপিং মল-এ কিছু নেপালী ক্যাসেট কিনে ফেরার পথে ভক্তপুর হয়ে এলাম। ভক্তপুরেই অনেক কিছু আছে কেনার মতো। একটা পেল্টিং স্কুলে নিয়ে গেল কৃষ্ণগোপাল–গাড়ির মালিক-কাম-ড্রাইভার। ছেলেটা ভালোই, বেশ সুদর্শণ। ছোট ছোট দুই মেয়ে। ষোল মাসের বাচ্চা মেয়ে আর বৌ নিয়ে সে থাকে নাগরকোট। বৌ দেখতে পুরোপুরি আদুরে চাইনিজ। বড় মেয়েটাও ভারী সুন্দর। ছয় বছর কি আরো কম বয়স-থাকে নানীর সাথে ভক্তপুরে। এখানে সে স্কুলে যায়। ভক্তপুরে একটা কাল-চক্র-মান্ডালা কিনলাম। দাম একটু বেশিই হয়ে গেল, কিন্তু ছবিটা যত্ন করে বাঁধিয়ে রাখলে ঘরের সৌন্দর্য বাড়বে।

কাল রাতে ডিনার শেষে হোটেলের ঘরে ফিরে মাচাদোর বই পড়লাম কিছুক্ষণ। প্রশস্ত জানালা! ভোরে আকাশ পরিস্কার থাকলে ঝকঝকে আলো–রোদ নয় আলোয় ঘর ভরে যায়; জন ডান যাকে বলেন ইকুয়্যাল লাইট। নিচে, বহু নিচে দেখা যায় উপত্যকার ওপর ঝুলে আছে সাদা সাদা মেঘ। নীল আকাশ, সবুজ উপত্যকা আর তারই ওপর উবুর হয়ে বসে ওম দেয় পেঁজা পেঁজা মেঘ। মাঝে মাঝে কোত্থেকে উড়ে এসে সব ঝাপসা করে দেয় মেঘ। ঘরদোর ভেজে না, তবে কেমন এক অশরীরী গন্ধ বয়ে আনে কুয়াশার মতো এই সব মেঘ যারা বাষ্প নির্মিত কিন্তু একটা চুলও ভেজাতে অক্ষম–যেমন ইয়েটসের কবিতায় বাইজানটাইন সম্রাটের উঠোনে মধ্যরাতে জ্বলে ওঠা শিল্পের আগুনে জামার আস্তিনও পোড়ে না। এখন তাপমাত্রা বোধ হয় ঊনিশ ডিগ্রীর বেশি নয়। ঘরের ভেতর গেঞ্জি পরেই থাকা যায়। অনেকক্ষণ ধরে মাচাদোর কবিতাগুল–হাইকু ধরনের কবিতাগুলো জোরে জোরে আবৃত্তি করি। স্বপ্ন নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে, আত্মা নিয়ে ভারী সুন্দর সুন্দর অভিব্যক্তি এইসব কবিতায়। খুব সহজ বাংলায় বহুদিন ধরে, বহু ঘসে মেজে অনুবাদ করলে মন্দ হয় না। বন্ধুবর রাজু আলাউদ্দিন সেরকমই অনুরোধ করেছেন। বইটা তাঁরই; এখন পড়তে দিয়ে খুব উপকার করেছেন।

কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে বসে এইসব লিখতে লিখতে নজরে পড়লো একটা কবিতা । চোদ্দ নম্বর এই কবিতায় মাচাদো লিখছেন:

আত্মারাম, ঘুমিয়ে রয়েছো ভাই?

রাতে যেসব যৌবন থাকে ব্যস্ত, কর্মচঞ্চল
তারা কি হয়েছে শান্ত? আর চিন্তার জলচাকা
ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে, ঘুরে ঘুরে গিয়েছে শুকিয়ে?
আর পেয়ালা হয়েছে শূন্য
বয়ে নিয়ে কেবলি, সারবত্তাহীন ছায়া?
না (সে কি করে হয়?), আত্মা আমার নেই ঘুমে অচেতন
জেগে আছে, স্পষ্ট আছে জেগে
আছে সে তো না ঘুমিয়ে, না স্বপনে, বরং দেখছে চেয়ে
দূরের গন্তব্য, আর শুনছে
মহানৈঃশব্দের তীর থেকে ভেসে আসা একটানা সুর।


অনুবাদ মোটেও সহজ নয়। থেসারাস নিয়ে বসতে হবে। ইদানিং চট করে প্রতিশব্দ আসে না। প্রচুর সময় দিয়ে সমার্থ শব্দ খুঁজে বার করে করতে পারলে উৎরে যেত বলে মনে হয়। আরেকটি কবিতা চেষ্টা করা যাক। দু নম্বর কবিতা এটি–নাম "বাল্যস্মৃতি":
শীতের বিকেল এক
আকাশে মেঘভার। ছাত্রেরা পড়া করে
এক ঘেঁয়ে সুরে জানলার কাঁচে
অনবরত ঝরে বরিষণ ধারা।
ছুটি হয়ে গেছে শেষ। একটা পোস্টারে
দেখা যায় কাবিল দৌড়ে পালায়, আর
হাবিল রয়েছে পড়ে মৃত। রক্ত মাখা স্থান থেকে
খুব একটা দূরে নয়।
ওদের শিক্ষক তার খ্যাসখ্যাসে শূণ্যগর্ভ স্বরে
বাজখাই আওয়াজ ছাড়ে। দীনহীন বেশ তার
বৃদ্ধ জয়িফ; জীর্ণশীর্ণ হাল, শুকিয়ে গিয়েছে বড়,
হাতে ধরা একখানা পুরনো কিতাব কেবল ।

আর বাচ্চাদের পুরোটা দঙ্গল
সুর করে পড়া শেখে:
"এক হাজারে এক শো তো এক শো হাজার,
এক হাজারে এক হাজার তো দশ লক্ষ বার।"

শীতের বিকেল মেঘে ঢাকা।
ছাত্ররা সুর করে পড়া শেখে
একঘেঁয়েমি জমে ওঠে ঘরের ভিতর, আর
জানলার কাঁচে শুধু ধারা বরিষণ।

নাহ্, হচ্ছে না কিছুই, তবু যা হোক সময়তো কাটছে, আর অন্তত একটা কাঠামো তো দাঁড় করানো গেল। মন্দ কি, আরেকটা চেষ্টা করে দেখি। এর নাম "বন্ধুর দাফন"। কোড শিফটিং বলে একটা কথা আছে। সৎকার বললে বাংলায় যেন দাহটাই বেশি মনে আসে। কিন্তু দাফনে গোর দেওয়ার অনুষঙ্গই বেশি। তাই "দাফন"ই লিখলাম।

জুলাইয়ের এক ভয়াবহ অপরাহ্নে
ওরা তার দাফন সারলো।
পোড়ানো সূর্য তখন জ্বলছে আকাশে।
কবরের খোলা হা থেকে একটু দূরেই
পড়ে ছিলো পচা গোলাপের পাঁপড়ি,
লাল লাল জেরেনিয়াম আর
সেসব থেকে উঠছিলো ঝাঁঝালো সুবাস।
আকাশ পরিস্কার নীল। জোরালো আর শুকনো
বাতাস এক বইছিলো সারাক্ষণ।
দুই গোরখোদক
মোটা একটা রশির জালে
কফিনটা কিছুক্ষণ ঝুলিয়ে রেখে
আস্তে নামিয়ে দেয় কবরের মাঝে. . .
সেখানে নামতেই বেশ জোরে শব্দ হয়
নিরবতায় ধপ করে ওঠে জোরে আওয়াজ।
মাটি স্পর্শ করা কফিনের ধপাস আওয়াজ
সে তো গুরুতরই বটে।
কালো বাক্সের ওপর তখন
শুকনো ধুলো উড়ে ওঠে
গভীর গর্ত থেকে
জেগে ওঠে ফ্যাকাশে ও সাদা শ্বাস, আর
বাতাসে তা কিছুক্ষণ ছড়ায়, জড়ায়।
"আর তুমি, ছায়াহীন কায়াহীন তুমি,
ঘুমাও বন্ধু আর বেঁচে থাকো;
তোমার নিরব হাড়ের শেষ শান্তি হয়ে বাঁচো,
বেঁচে থাকো…
এখন তো সবই শেষ
ঘুমাও বন্ধু আর ঘুমের ভিতর দ্যাখো
নিরাপদ আসল খোয়াব।