কবি শামসুর রাহমান স্মরণ: কেমন আছে তাঁর পরিবার

কবির প্রয়াণদিবসে লিখেছেন কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজ

হাসান হাফিজহাসান হাফিজ
Published : 16 August 2022, 05:07 PM
Updated : 16 August 2022, 05:07 PM

কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুদিন আজ ১৭ আগস্ট। তিনি প্রয়াত হন ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের এই তারিখে। এবার তাঁর ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকী। সমকালীন বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি জীবনভর শুধু কবিতাচর্চাই করেননি। ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড়ে বন্দিনী দেশমাতৃকার মুক্তি, স্বৈরাচারবিরোধী এবং প্রগতির সপক্ষের সব আন্দোলন সংগ্রামে অন্যতম লড়াকু অগ্রসেনানী ছিলেন। মাটি, মানুষ, স্বদেশের প্রতি সুগভীর দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকার, স্বপ্ন প্রত্যয় বিধৃত হয়ে আছে তাঁর নিবিষ্ট মেধাসঞ্জাত রচনাসমূহে। তাঁর অবিস্মরণীয় কবিতাবলি-- ‘আসাদের শার্ট’, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’র মত কালজয়ী কবিতাবলীর দ্যুতি ও শক্তি সর্বদাই আমাদের পথ দেখায়। উদ্দীপনা ও সাহসের সঞ্চার করে।

বিপুল তাঁর রচনাসম্ভার। কাব্যগ্রন্থই ষাটের অধিক। আরো লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, আত্মকথা, কলাম,গান। অনুবাদও করেছেন বেশ কিছু। অবিশ্রাম সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। শিশুসাহিত্যেও বলিষ্ঠ অবদান রয়েছে এই কবির। মৃত্যুর পরে তাঁর রচনাবলির দু’টি খণ্ড ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে। সম্পাদনা করেছেন আবুল হাসনাত (তিনিও প্রয়াত)। তৃতীয় খণ্ডটি শিগগিরই প্রকাশিত হবে। এ তথ্য জানালেন কবির পুত্রবধূ টিয়া রাহমান।

কবির জন্ম পুরনো ঢাকার মাহুতটুলিতে, ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। পৈতৃকবাস ছিল নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী গ্রামে। ১৯৪৮ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯, তখন মননের গহিন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনীকিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা--তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গদ্য পদ্য মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক।

সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার, পদক, সংবর্ধনা। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, জাপানের মিৎসুবিশি পদক, স্বাধীনতা পদক, জীবনানন্দ পুরস্কার, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, ভারতের আনন্দ পুরস্কার, কবিতালাপ পুরস্কার, ইত্যাদি। ভারতের তিন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেছে।

‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতা পেশায় ১৯৫৭ সালে যে চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন। জীবনে উত্থান-পতন, দারিদ্র্য, হতাশার ঘূর্ণিপাকে দুলেছেন, তবু খেই হারান নি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে।

এখন কেমন আছে কবি পরিবার

শ্যামলী এক নম্বর রোডে কবির ডুপ্লেক্স বাড়ি। এসওএস শিশু পল্লীর ঠিক পূর্ব দিকে। ১৬ আগস্ট ২০২২ সকালবেলা গিয়েছিলাম কবির বাড়িতে। জীবদ্দশায় তাঁর বাড়িতে নিত্যদিন ভক্ত অনুরাগীদের ভিড় লেগেই থাকতো। এখন বাড়িটি সুনসান, নীরব, নিঝুম। কথা হলো কবির পুত্রবধূ টিয়া রাহমানের সঙ্গে। নানা বিষয়ে আলাপচারিতা হয় আমাদের। মাতৃস্নেহে কবির দেখাশোনা করতেন টিয়া। ১৯৯১ সালে কবিপুত্র ফাইয়াজ রাহমানের ঘরণী হয়ে আসবার পর থেকে তিনি পরম যত্ন ও মমতায় কবিকে আগলে রাখতেন। কবি শামসুর রাহমানও তাঁকে নিজের মেয়েদের চাইতে বেশি ভালোবাসতেন। ফাইয়াজ-টিয়া দম্পতির দুই কন্যা নয়না ও দীপিতা ছিল কবির পরম প্রিয়, নয়নের মণি।

কবি শামসুর রাহমানের তিন কন্যা, দুই পুত্র। এক পুত্র মতিন অকালে প্রয়াত হয়। কন্যা সুমাইয়া ইসলামের স্বামী ছিলেন এনএসআইয়ের কর্মকর্তা। এখন অবসরপ্রাপ্ত। তাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। এরা থাকেন ঢাকার ধানমণ্ডীতে। অপর কন্যা ফৌজিয়া সাবেরিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। তার তিন ছেলে। ছোট মেয়ে শেবা রাহমান কানাডায় থাকেন। তার এক ছেলে। পুত্র ফাইয়াজ রাহমানের বড় মেয়ে নয়না রহমান ইংরেজিতে অনার্স পাস করেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে। মাস্টার্স করেছেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনার্স, মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস। কবি শামসুর রাহমানও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নয়না রাহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে সেকশন অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন গত জুলাই মাসে। তার স্বপ্ন ও ইচ্ছা, ইংরেজিতে পিএইচডি করবেন। নয়নার ছোট বোন দীপিতা রাহমান ফরিদপুর সরকারি মেডিক্যাল কলেজে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। কবির স্ত্রী জোহরা রাহমান ইন্তেকাল করেন ২০১১ সালে।

স্মৃতিতাড়িত টিয়া রাহমান বললেন, আব্বুকে মনে প্রাণে ভালোবাসতাম। তাঁর মতো মহৎ মানুষ এই পৃথিবীতে আর হবে না। যারা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, কাছে থেকে দেখেছেন, তারা জানেন কীরকম মানুষ উনি ছিলেন। স্বল্পভাষী মানুষটির কোনো লোভ লালসা ছিল না। কখনো বাড়ি-গাড়ি, সয় সম্পত্তির পেছনে ছোটেন নি। ওসবের দিকে আব্বু ফিরেও তাকাতেন না। তাঁর একটাই ছিল চাওয়া, ধ্যান জ্ঞান ছিল একটাই, তা হলো কীভাবে আরো ভালো লেখা যায়। সবসময় চাইতেন আদরের দুই নাতনি যেন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। তিনি বলতেন, মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। নয়না, দীপিতাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে-- এই সত্যই আমাকে সারাক্ষণ পীড়িত করে। এই বোধ আমাকে নিরন্তর কষ্ট দেয়।

টিয়া রাহমান তার উদগত অশ্রু সামলে বললেন আরো কিছু কথা। কবির জীবন সায়াহ্নের কিছু উজ্জ্বল অম্লান স্মৃতি হাতড়ালেন। জানালেন, জীবনের শেষ দিকে আব্বুর একটাই চিন্তা ছিল, নয়না-দীপিতার জীবনে কী হলো, কতটা প্রতিষ্ঠা ওরা পেল, কেমন ভালো মানুষ হলো, সেটা আর দেখে যেতে পারলাম না। আমাকে তিনি অসম্ভব স্নেহ করতেন। আমি উনার খাওয়া-দাওয়া, পোশাক আশাক- সব দিকেই সব সময় খেয়াল রাখতাম। পড়ন্ত বেলায় চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। ভীষণ পড়ুয়া মানুষটির খুব আফসোস ছিল এই কারণে। তখন আমাদের বাড়িতে আট/দশটা খবরের কাগজ আসতো। আমি প্রতিটি থেকে উনাকে পড়ে পড়ে শোনাতাম। খুব মিস করি আব্বুকে। সারা বাড়ি ভরে তাঁর স্মৃতি ছড়ানো। এরকম গুণী, দেবতুল্য, স্নেহশীল মানুষকে কিছুতেই ভুলে থাকা যায় না। সেটা সম্ভব নয়।

কবির লেখা থেকে

কবি শামসুর রাহমানের আত্মজৈবনিক গ্রন্থের নাম ‘কালের ধুলোয় লেখা’। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠে। অন্যপ্রকাশ বই আকারে বের করেছিল কবির জীবদ্দশায়, ২০০৪ সালের একুশে বইমেলায়। বইটির তৃতীয় মুদ্রণ হয়েছে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। বেশ কিছু দুর্লভ ও মহার্ঘ আলোকচিত্র ছাপা হয়েছে বইটির শেষ দিকে। ‘কালের ধুলোয় লেখা’ বইটিতে উনিশ শ একাত্তরের অবরুদ্ধ পাকা হানাদার শত্র অধিকৃত ঢাকা শহরের লোমহর্ষক বর্ণনা আছে। সেখান থেকে একটুখানিক উদ্ধৃতি (পৃ ২৮০) :

“অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে একদিন বিকেলে আমাদের বাসায় এসে হাজির হলেন তেজী মুক্তিযোদ্ধা আলম (হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক) এবং তাঁর সহযোগী শাহাদত চৌধুরী। কিছুক্ষণ ওঁরা আমার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। আমি তাঁদের আমার সদ্য-লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনালাম। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে রচিত কবিতাবলী শুনে ওঁরা কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন বলে স্থির করলেন। কয়েকটি কবিতা শেষ পর্যন্ত আলভির মারফত শাহাদত চৌধুরী কলকাতায় শ্রদ্ধেয় আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর কাছে পাঠাতে পেরেছিলেন। আবু সয়ীদ ও তাঁর সহধর্মিণী গৌরী আইয়ুবের উদ্যোগ ও উৎসাহে আমার ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থটি কলকাতায় ১৯৭২ সাল-এর জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়। এই বই-এর দু’চারটি কবিতা কলকাতার সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ মজলুম আদিব ছদ্মনামে বেরিয়েছিল। এই ছদ্মনামটি রেখেছিলেন খোদ আবু সয়ীদ আইয়ুব। মজলুম আদিব-এর অর্থ হচ্ছে নির্যাতিত লেখক। সত্যি, তখন আমরা যারা শত্রু-অধিকৃত ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় বন্দি জীবন যাপন করছিলাম, তাদের অনেকে শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে অত্যন্ত নিপীড়িত ছিলাম।

যা হোক, আমার কয়েকটি কবিতা শার্ট ও প্যান্টের কোনও কোনও অংশে লুকিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ পর ওঁরা আমার এখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন যে, অল্প কিছুক্ষণ পরেই ইসলামপুরে কিছু কাজ সেরে আবার আমার এখানে ফিরে আসবেন। আমি বহুক্ষণ অত্যন্ত চিন্তিত অবস্থায় পায়চারি করতে শুরু করলাম। তাঁরা দু’জন শত্রুর হাতে ধরা পড়েন নি তো? বিকেলের রোদ মুছে যাওয়ার পর সন্ধ্যা এলো, আমার দুশ্চিন্তাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করলো গাঢ়ভাবে। বেশ কিছুক্ষণ পর এসে ওঁরা আমাকে শঙ্কামুক্ত করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করতেই দেরি হয়ে গেল, বললেন তাঁরা। আবার কখনও দেখা হতে পারে,এই সম্ভাবনার কথা জানিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিলেন। আমি গভীর অভিনিবেশে ওঁদের যাওয়ার পথে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।

ক’দিন পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে ঢাকা শেরাটন) যে জবরদস্ত বিস্ফোরণটি হলো, তা আলম, শাহাদত এবং তাঁদের কোনও সঙ্গীরই কাজ, এটা জানা গেল বিশ্বস্তসূত্রে। পরে আবার কোনও কোনও জায়গায় যে মুক্তিযোদ্ধাদের এই ধরনের কাজের খবর কানে এলো তাতেও আলম এবং তাঁর অন্য কোনও সঙ্গীর সম্পৃক্ত থাকার কথা জানতে পারলাম। তবে এসব কথা অন্য কাউকে বলার উদ্দীপনাকে নিজের মনেই সঞ্চিত রাখতে চেষ্টা করেছি। কোথায় কার কাছে এ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনি, সে ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। কোথায় কে কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে, কে বলতে পারে। এই সতর্কতা আমাকে ভবিষ্যতে কোনও ফাঁদে পা দেয়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অফিসে আমার কামরায় কাজে অকাজে সময় যাপনের সময়ও লোকজন বুঝে কথাবার্তা বলতাম।...”