“শিল্পী হওয়ার জন্য আজন্ম চেষ্টা করছি, এখনো শিল্পী হতে পেরেছি বলে মনে করি না; চেষ্টা করে যাচ্ছি,” বলেন এ চিত্রশিল্পী।
Published : 06 Nov 2023, 12:19 AM
নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হচ্ছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী। আগামী ২৮ নভেম্বর শিল্পীর জন্মদিন সামনে রেখে রোববার থেকে ঢাকার দুটি গ্যালারিতে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী শিল্পকর্ম প্রদর্শনী।
রোববার সন্ধ্যায় জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মিলনায়তনে ‘রেট্রসপেকটিভ প্রদর্শনী’র উদ্বোধন করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে দেখে মজার ছলে অধ্যাপক রফিকুন নবী বলেন, “এই অনুষ্ঠানে মাননীয় স্পিকারকে পেয়েছি, এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আমি সংসদ সদস্য। কোনো ভুল কথা বললে ‘এক্সপাঞ্জ' করবেন।”
কঠিন কথাও বলেছেন তিনি। জীবনের ৮০ বছর পেরোনো সহজ ছিল না জানিয়ে ‘টোকাই’ কার্টুন চরিত্রের স্রষ্টা ‘রনবী’ বলেন, “জীবনের এই যাত্রায় যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি- খুব সহজ তো ছিল না। নানা প্রতিকূলতায় তো আমাদের পথচলা।
“এই পথচলার মধ্য দিয়েই নিজেকে জানতে হবে। জয়নুল আবেদীন স্যার আমাদের বলতেন, ‘আমাদের জীবনে যা ঘটছে, কেন ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে- সেসব জানতে হবে। এই মানুষের দুঃখ-কষ্ট জানতে হবে, বুঝতে হবে'।”
এখনও শিল্পী হওয়ার সাধনা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাসে স্যার জানতে চেয়েছিলেন, এখানে কেন পড়তে এসেছি? উত্তরে বলেছিলাম, শিল্পী হব। তখন স্যার বলেছিলেন, ‘শিল্পী তো বানাতে পারব না’।
“শিল্পী কেউ বানাতে পারে না, শিল্পী তার কাজের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে হয়। সেই থেকে শিল্পী হওয়ার জন্য আজন্ম চেষ্টা করছি। এখনো শিল্পী হতে পেরেছি বলে মনে করি না। চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, “আমরা একজন গুণী ব্যক্তিকে নিয়ে এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিজেরাও সম্মানিত হচ্ছি। রফিকুন নবী সমাজ সচেতন একজন চিত্রশিল্পী। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণেও তার অসামান্য প্রতিভা রয়েছে। বাংলাদেশ ও মানুষ তার শিল্পীকর্মে প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে।
“শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০ বছরের জীবনকাল এদেশের নানা সময়ের চড়াই-উৎরাই তাকে স্পর্শ করেছে। তার শিল্পকর্ম নিয়ে এই ‘রেট্রসপেকটিভ প্রদর্শনী’ তরুণ প্রজন্মের সামনে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের উন্মোচন করবে।”
স্মৃতিচারণ করে শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, “আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন শিল্পী রনবীর কার্টুন খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করতাম। তখন ভাবতাম রনবী বুঝি একজনের নাম। পরে জেনেছি রনবী হলো একজন শিল্পীর নামের সংক্ষেপ।”
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “শিল্পী হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, প্রশাসক হিসেবে তিনি জীবনের এই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছেন। তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি একজন ভালো মানুষ, এই অনন্য রূপটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। ‘রেট্রসপেকটিভ’ মানে তো ফিরে দেখা।
“এই প্রদর্শনীতে আমরা ফিরে দেখব- রফিকুন নবীর শিল্পকর্ম। টোকাই সিরিজের যে ছবি, তার মধ্য দিয়ে সমাজের যে চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তা আমাদের ভাবিয়েছে। সমাজকে সুপথে উজ্জীবিত রাখার জন্য তরুণ প্রজন্মের মাঝে রফিকুন নবীর মতো শিল্পীর চিন্তাকে আমাদের বুঝতে হবে।”
গ্যালারি চিত্রকের পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, “এই প্রদর্শনীটি আয়োজন করতে পেরে আমরা গর্বিত। যারা এই প্রদর্শনীতে তাদের সংগ্রহ থেকে আমাদের সহযোগিতা করেছেন, তাদের ধন্যবাদ জানাই।”
অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “নবী ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ৬৬/৬৭ সালের দিকে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মিছিল, সভায় ক্যাম্পাস তখন উত্তাল। আমরা তখন আর্ট কলেজে যাই, দিস্তার দিস্তা কাগজ নিয়ে পোস্টার আঁকতেন আর্ট কলেজের শিল্পীরা। আমরা সেসব ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে রাস্তায় আন্দোলন করেছি, শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি।
“যেসব শিল্পী নেপথ্য থেকে আমাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রসদ যোগাতেন, তাদের অন্যতম ছিলেন রফিকুন নবী। নবী ভাই সম্পর্কে গভীর কথা বলার তো আমার সুযোগ নেই। তিনি মানুষটাই এত গভীর। তার গভীরতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাকে খুঁজে পেতে হবে তার শিল্পকর্মে।”
শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মদিন উদযাপন পর্ষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “স্যারের জন্মদিন ২৮ নভেম্বর। কিন্তু ওই সময়টায় এবং ডিসেম্বর মাসে তো নানা রকম অনুষ্ঠান থাকে৷ এজন্য আমরা একটু আগেই আয়োজনটি শুরু করেছি।
“আর স্যারের এত বড় পরিসরের কাজ রয়েছে, সব তো আনা সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করেছি উল্লেখযোগ্য কাজগুলো প্রদর্শন করতে।”
এমিরেটাস অধ্যাপক রফিকুন নবীর শিল্পকর্ম নিয়ে মাসব্যাপী প্রদর্শনী হচ্ছে ঢাকার দুটি গ্যালারিতে। এছাড়া গ্রন্থ প্রকাশ, শিল্পীর কার্টুন নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ প্রকাশ, চিত্র প্রদর্শনী ও কার্টুন প্রদর্শনী রয়েছে কর্মসূচির মধ্যে।
১৯৫৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রফিকুন নবীর সৃজিত শিল্পযাত্রার নানা পর্যায়ের বৈচিত্র্যময় শিল্পধারাকে ৯৩টি চিত্রকর্মের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা প্রদর্শিত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে।
রোববার থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা, শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী সকলের জন্য উন্মুক্ত। বৃহস্পতিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন প্রদর্শনী বন্ধ থাকবে।
আর ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে ২০২২ ও ২০২৩ সালে রফিকুন নবীর আঁকা ৫১টি চিত্রকর্ম নিয়ে আরেকটি প্রদর্শনী হচ্ছে, যা চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা প্রদর্শনী সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদেও থাকবে সপ্তাহব্যাপী আয়োজন, যা শুরু হবে ২৮ নভেম্বর। এই আয়োজনে রফিকুন নবীর কার্টুন প্রদর্শনী, বই প্রকাশ, গানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা থাকবে।
রফিকুন নবীর কার্টুন নিয়ে ‘টোকাই’ শিরোনামে চার খণ্ডের গ্রন্থ সিরিজের মোড়ক উন্মোচন করা হবে। এটি প্রকাশ করেছে গ্যালারি চিত্রক। এছাড়াও রফিকুন নবীর কার্টুন সংবলিত ‘ঊনসত্তুরের ছড়া’ নামে একটি গ্রন্থ পুর্নমুদ্রণ করছে চারুকলা অনুষদ।