মেঘে ঢাকা চাঁদ, ঈদ্, বৃষ্টি এবং হাবিব রিক্সাওয়ালা

রুখসানা কাজলরুখসানা কাজল
Published : 13 June 2019, 04:25 AM
Updated : 13 June 2019, 04:25 AM


ছবি: সংগৃহীত
আজ পর্যন্ত আমি কখনো নিজের চোখে ঈদের চাঁদ দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
খুব শৈশবে চাচাতো, কাকাতো পাড়াতো ভাইবোনরা দল বেঁধে ঈদের চাঁদ দেখবে বলে চলে যেত মধুমতি নদীর চরে। আমরা গুড়গুড়ির দল ওদের পিছু নিতাম। সাথে আসত টমি। ওর গলার বেল্টে লাগানো ঘুঙর আমাদের খুশির সাথে ঠিনঠিন করে বাজত, ঈদ ঈদ ঈদ।
সে কী চাঁদ দেখার ধূম ! এ দেখতে পায় ত ও পায়না। একটা সময় বড়দের চাঁদ আবিস্কারের হুল্লোড় শেষে আমাদের কাঁধে নিয়ে বলত, অই অই, উই যে চাঁদ, দেখেছিস ? দেখিস্নি ? আন্ধা নাকি তুই । উই যে কাস্তের মত কেউবা আবার লাঙ্গলের ফলার মত দুবার তিনবার বলে যখন রেগেমেগে গলা চড়িয়ে জানতে চাইত, এখনো দেখিস্নি হাব্লি ? ভয় পেয়ে তখন বলতাম , হ্যা হ্যা দেখেছি ত ! অইইইইই যেহ —-
তারপরেই দৌঁড় । ভোঁ—
আসলে ত লাল নীল গোলাপী সাদা মেঘ ছাড়া কিছুই দেখিনি আমি।
কিন্তু চাঁদ থাকুক চাঁদের ঘরে আমাদের ঘরে ত ঈদ এসেছে। এবার লুকিয়ে রাখা জামাজুতো পরতে পারবো আর ঈদি পেয়ে মনের সুখে আইসক্রীম খেতে পারবো এই আনন্দেই আমরা খুশি। ঈদ মুবারক মা । ঈদ মুবারক বাপি। ঈদ মুবারক টমি –ঈদ মুবারক – হাহাহহিহিহি—
দুই বাড়ির মাঝখানে দেওয়াল। রাধাদির মা শেষ রোজার ইফতারের পরে পরে ডাক দিতো, ও দিদি। মা ছুটে বেরিয়ে আসত, হায় হায় রে একবারে ভুলে গেছি রে রাধুর মা। কালো মুখে উদার হেসে কাকীমা বলত, নাও দিদি । সেই সাথে এক থালা ইফতারি চলে যেত দেওয়ালের ওপার। আর এক বোঝা সওদা আসত এপারে। আমার মায়ের গোপন পুঁজিতে কেনা বাড়তি বাজার এগুলো। আমরা জানতাম বাপির পয়সা কম। আর মায়ের কাছে আছে, মা ব্যাংক। বাপি ত মাঝে মাঝে আমাদের দিকে চোখ টিপে মাকে খুশি করতে বলত, রেখো, মা, দাসেরে –
মা ছিটকে উঠে চলে যেতে যেতে পদ্মনালের মত দু হাত ছটফটিয়ে বলত, হচ্ছে কি ! করছ কি শুনি ! এই যে তুমি যাও ত যাও। তোমার অমুক বান্ধবীর কাছে চলে যাও। বেচারি চা নিয়ে বসে আছে তোমার জন্যে । যাও যাও। মাথা খারাপ মানুষজন সব !
কিসের কি বান্ধবী আর চা ! বাপি আমাদের নিয়ে জাঁকিয়ে বসত গল্প হাসি আড্ডায়। খানিক পর মাও ট্রে হাতে চলে আসত কি যেন কি দরকারি কথা বলার অছিলায়।
রোজার শেষ দিকে মা বাপি হিসেব নিয়ে বসত। এবারের ধার্য করা ফেতরা আর যাকাতের হিসাব নিয়ে। সাড়ে সাত ভরির উপর সোনার গয়না , রুপার থাকলেও যাকাত দিতে হবে। আর আছে জমানো টাকার উপর যাকাত। জমানো টাকা ছিল না আমার মা বাপির। ছিল জমি। তায় চলমান অস্থির খরচ। তবু মাকে দেখেছি কিছু নাম লিখে তার পাশে টাকার পরিমাণ লিখতে। অতি ক্ষুদ্র। যবের দানা সমতুল্য। তবু দানের আনন্দে মায়াবী উজ্জ্বল। আর দোয়া পাওয়ার আশায় লাজুক মহান। বাপি মাকে বলত, জানো রাবি, ইসলামের এই যাকাত প্রথাটা খুব ভাল। অবশ্য যদি পালন করা হয়। একেক জন ধনীলোকের যাকাত দিয়ে একজন গরীব এতিম পরিবার কিছু করে তার জীবন নির্বাহ করতে পারে।
এক লাখ টাকার যাকাত হয় আড়াই হাজার টাকা। সাড়ে সাত ভরির সোনা এবং পাঁচ তোলার উপর রূপা থাকলে যাকাত দিতে হবে। আমি চেষ্টা করি কাউকে রিক্সা কিম্বা ঠেলা গাড়ি কিনতে সাহায্য করতে। কারো পড়ার খরচ দিতে। বিদায় হজ্জের ভাষণে হযরত মুহম্মাদ (সাঃ) উপস্থিত হাজীদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, হে মানুষ মণ্ডলী বলে। তিনি বলেছিলেন, মানব ঐক্য গড়ে তুলতে। নারীর সুরক্ষা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে। মহান আল্লাহ এবং ঈমানে বিশ্বাস রাখতে।
তাহলে সঊদি বাদশাহ কারা ? মানুষ কি ? তারা কি মানছে মহানবী প্রদত্ত বিদায় হজ্জের নির্দেশনামাকে? সউদি আরব মদদ দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ নারী শিশুকে খুন হতে। মানবাধিকার অস্বীকার করে জবাই করছে মহানবীর উম্মতদের। তেলের পয়সার জোরে ধর্ষণ করছে নারী গৃহ শ্রমিকদের, নিজেদের নারীদের অধিকার হরণ করে বানাচ্ছে বন্দিনী , উচ্ছৃখল জীবন যাপন করছে চরম অহংকার নিয়ে। ইসলামে অহংকারে নিষেধ আছে। পরিস্কার বলা আছে, অহংকার হচ্ছে পতনের মূল ধাপ এবং আল্লাহ অহংকারকারীকে পছন্দ করেন না।
এমন নয় যে এবারই প্রথম ঈদের চাঁদ মেঘে ঢেকে ছিল। বাইশ বছর আগে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি ঈদ করতে। শিশুটি ছোট। আরিচা ঘাটে ইফতার করতে করতে জানলাম, তখনো চাঁদ দেখা যায়নি। আমি খুশি আরো একটি দিন বেশি বাড়িতে থাকা যাবে এই ভেবে। নিজের ছোট্ট শহর থেকে একবার বেরিয়ে পড়লে আর ফেরা হয় না। কেবল শেকড় ছেড়ে দূরে দূরে বহুদূর চলে যাওয়া ! যতদিন থাকি তাই লুটে নিই নাড়ির গন্ধটুকু।
ফেরি যখন পদ্মার মাঝামাঝি গাড়ির জানালা দিয়ে দেখি অনেকেই হই হই করে "ঈদ মুবারক ঈদ মুবারক" বলে খুশিতে হাসছে। চাঁদ দেখা গেছে। কূল নাই, কিনার নাই আদিগন্ত অন্ধকারে ঢাকা পদ্মার বুকের উপর আকাশ মুখ ঝুলিয়ে হাসিমুখে চাঁদ দেখাচ্ছে সবাইকে। কেউ কেউ অবশ্য ফুট কাটছে, চাঁদ কিন্তু সদ্যোজাত নয় হে। দুদিনের পুরনো। বাসি চাঁদ।
এবারের ঈদে্র সারাদিন বৃষ্টি বৃষ্টি । ঈদের আগে থেকে ঝেঁপে নেমেছে। একেবারে সুর তুলে ঝরছে। আমি মনে মনে চাইছিলাম, বৃষ্টি হোক। আমার ছেলেটা আঁতেল টাইপের। পুরনো টিশার্ট, থ্রী কোয়ার্টার প্যান্টুলুন, দাড়িগোঁফে জ্যান্ত উল্লুক। ধুর ধুর। দু চোখে দেখতে পারিনা ওকে। তার উপর বললাম, একটা মাত্র উৎসব। নতুন কিছু ত নাও। চোখ গোল্লা করে নাকের পাটা ফুলিয়ে চরম বিরক্তি দেখিয়ে জানালো, মা, ঈদের সময় নতুন জামা, জুতা কিনতে হবে এইসব ট্যাবু থেকে বেরিয়ে এসো। দরকার হলে যেদিন খুশি কিনব বলে চলে গেলো। একটু পর আবার উঠে আসে, এই দেখো গুগুলের সিইও সুন্দর পিচাইও দাড়ি রেখেছে। কি খারাপ লাগছে দেখতে !
দুদুটো আগাছা ভর্তি মুখ। রাগে দুঃখে মনে হল মার দিই। ছেলে হাহা করতে করতে চলে গেলে ভাবি, আহা ও যদি মেয়ে হত ! কতবার যে মার্কেটে যেতে হত কতকিছু কিনতে ! ঘরে একটা হাসিখুশি ঈদ ঈদ ভাবও থাকত।
আমি রান্নাবাড়ি সেরে ঘর গুছিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঠানো শাড়ি পরে এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখি। বন্ধুদের সাথে কথা বলি। আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ নিই দিই। হঠাত তাকিয়ে দেখি সার সার কয়েকটি রিক্সা আমগাছের নীচে জমে আছে। আমাদের ফ্ল্যাট ঘেঁষা ঘুপচি দোকান থেকে চা খাচ্ছে পলিথিনে মাথা ঢাকা রিক্সাওয়ালা হাবিব। ওর বাড়ি বরিশালের কোন নদীর ধারের কোনো এক গ্রামে। বাড়ি যাবে ঈদের তিনদিন পর। উৎসবের সময় রিক্সা টানলে ভাড়া বেশি পাওয়া যায় বলে থেকে গেছে । এবার একটু খারাপ লাগে । প্রতি বর্ষায় ওর ঘরের মাটির দাওয়া ভেঙ্গে পড়ে। ছোট ছেলেটা মাদ্রাসায় পড়ত। এবার চান্স পেয়েছে সরকারী ইশকুলে। মেয়েটা ক্লাশ নাইন। একবার একটি লিস্ট দেখিয়েছিল হাবিব, পেত্যেকবার বাড়ি যাওনের সুময় মেয়ে খালি বই চায় । আমি এতবই কই পাই কন ত ভাবি !
মেয়েটার হাতের লেখা অতি কাঁচা। আজকাল প্রাইমারী শিক্ষকরা কি প্রতিদিন দুপাতা ইংরেজি বাংলা হাতের লেখা লিখতে দেয় ছাত্রছাত্রীদের ? ইংলিশ মিডিয়ামে দেয় সে জানি। বোর্ডের খাতা দেখলে বুঝতে পারি, দেশে পড়াশুনায় এক মহা ফাঁকিবাজ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে।
মেয়েটার জন্যে বই কিনে দিয়ে হাবিবকে বলি, মেয়েকে এখনই বিয়ে দিও না হাবিব। পড়াও । হাবিব কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
ইন্টারকমে দারোয়ানকে বলি হাবিবকে উপরে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে। ওর জন্যে কিছু খাবার ভরে রাখি আইসক্রিমের বক্সে। ভেজা লুঙ্গিটা হাঁটু থেকে নামিয়ে নিয়েছে হাবিব। বক্সটা ওকে দিয়ে দরজা লাগাবো , দেখি দাঁড়িয়ে আছে। কিরে হাবিব কিছু বলবি ?
ভাবি কামালের আব্বাও আছে—সসংকোচ লজ্জায় হড়বড়িয়ে বলে ফেলে হাবিব।
লজ্জা পাই। কি ছোট আত্মা আমার! নীচ মানসিকতায় পূর্ণ প্রাণ। দিয়ে থুয়ে খাওয়ার মন ত আমারো নেই। ধিক আমাকে ! এই আমিই আবার ক্লাশে পড়াই সাম্য স্বাধীনতা , নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মানবাধিকার। শেম ! শেম !
অমরাবতী ফুলগাছের আড়াল থেকে দেখি, চারজন রিক্সাওয়ালা মুঠোভরে পোলাউ মাংস খাচ্ছে। মনে পড়ে যায় আমাদের শহরের বড় মসজিদের হুজুরের কথা। ইসলামে এমনও উপদেশ আছে, যদি একটি পাড়ায় একজন লোক অভুক্ত থাকে ত তুমি তাকে অন্ন দাও। তোমার ভাগ থেকেই দাও। দিও কিঞ্চিৎ না করে বঞ্চিত।
এখনকার হুজুররা এসব কথা বলে না। তাদের ওয়াজের প্রথম এবং প্রধাণ কথাই থাকে নারী। নারীর মস্তক থেকে তার স্বভাব, চরিত্র, স্তন, পেট, নিতম্ব সবকিছু।
ঈদের আনন্দ ম্লান হতে থাকে।