কথিত আছে, লেখার আগে মোট বাইশ বার ওই ফিল্মটি তিনি দেখেছিলেন এবং তৎসহ আরও সব পরিচালকের করা 'কিং লিয়র'। সঙ্গে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা।
Published : 11 Jul 2024, 03:56 PM
অসীমকে কেউ স্বপ্নে দেখেনি
বছর কয়েক আগে এক বন্ধুর অনুরোধে বাংলাদেশ যাওয়ার কথা উঠেছিল। হাতে সময় ছিল খুবই কম। যখন তিনি জানতে পারেন, আমার পাসপোর্টই নেই, হতবাক হয়ে যান। হয়তো-বা বিরক্তও। সন্দিগ্ধ তিনি জানতে চান-- রেশন কার্ড আছে তো?
এখন দেখি, সবাই গেছোদাদা বা দিদি। এই স্টেটসে তো এই কানাডায়, নিদেন লন্ডনের রাস্তায় ঝিরঝিরে হাওয়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
একটু পাগলাটে যারা, কেউ পালেরমোয়, কেউ-বা ইস্তানবুলে।
একটু আগেই আমি সার্বিয়া আর ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তে ঘুরছিলাম। দানিউব নদীর তীরে। তার মিনিট পনেরো আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদরের পোষ্য ইতালির লেজটুকু কাঁপতে দেখছিলাম, যে-লেজের ২০০ কিমি নীল দুরত্বে তিউনিসিয়া হাঁ করে আছে।
এর পর ঘুমিয়ে পড়ব। স্বপ্ন দেখব না। স্বপ্নে দূরের কিছু দেখা যায় না। অসীমকে কেউ স্বপ্নে দেখেনি।
(১৪ অক্টোবর ২০১৫)
‘কথার চিঁড়ে হাওয়ার দধি
হচ্ছে ফলার নিরবধি’
"এটা তো আমাদের প্রত্যেক দিনের অভিজ্ঞতা যে কথা মিথ্যে হয়ে যায়, কাজের সঙ্গে তার যোগ ছিন্ন হয়ে গেলে। সমস্ত কাজের একটা মূল উৎস আছে: সামাজিক উৎপাদন। এই উৎপাদন আর শ্রমের উৎস থেকে ভদ্রলোক-জীবনযাত্রার সর্বাত্মক বিচ্ছেদ, প্রত্যেক মুহূর্তে মিথ্যা করে দিচ্ছে আমাদের বাগযন্ত্র আর কলমের ডগা থেকে উদগীর্ণ এই ফেনিল, অনর্গল শব্দস্রোতকে। এই বিচ্ছেদ, মুহূর্তে-মুহূর্তে মিথ্যের ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছে আমাদের অস্তিত্বে; আমাদের, ধর্মীয় রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বা সামাজিক, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে। এই পুরো ব্যাপারটা সুকুমার রায় টের পেয়েছিলেন হাড়ে-হাড়ে। তিনি লিখেছেন: 'পুরাণে লেখে গন্ধর্বেরা বাক্যভোজী, তাহারা নাকি শব্দ আহার করিয়া থাকে। এক হিসাবে, গন্ধর্ব শ্রেণীর জীব আমাদের মধ্যে বড় কম নয়।"
-- প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য, অর্থ-অনর্থ, (টীকাটিপ্পনী, প্যাপিরাস, পৃষ্ঠা ৪৫)।
প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য* সম্বন্ধে আমরা—এই ‘আমরা’র পরিধিটি ছোটো নয়-- খুব কম জানি। তিনি আড়ালে-থাকা সদাক্রিয়াশীল এক মানুষ। আমার দেখা সবচেয়ে নিখুঁতপ্রয়াসী বাঙালি। নিখুঁতপ্রত্যাশীও বটে। কম লিখেছেন, খুবই কম। কেননা, কোনো লেখার আগের পর্বটিতেই তাঁর সময় চলে গেছে কুড়ি-কুড়ি বছর যেন-বা। ১৯৩২ সালে জন্ম। কিন্তু প্রথম বই 'টীকাটিপ্পনী' বেরোয় ১৯৯৮ সালে। বেশি নয়, মাত্র ৬৫ বছরের কাছাকাছি বয়সে এসে!
কেমন খুঁতখুঁতে? মাত্র একটির কথা, অন্যের মুখে শোনা, লিপিবদ্ধ থাক।
কলকাতায় গ্রিগোরি কোজিনতসেভের 'কিং লিয়র' ফিল্মটি এসেছে। প্রদ্যুম্নদা দেখেছেন এবং ভালো লাগার কথা অশোক সেন মশায়কে বলেছেনও। অশোক সেন 'বারোমাস' পত্রিকায় তাঁকে লিখতে অনুরোধ করলে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য রাজিও হয়েছেন। এত দূর পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল। সমস্যার শুরু তারপর।
এ তো ছাপানো বই নয়, যা হাতের মুঠোয় থাকতে পারে! একটা ফিল্ম-- হলে দেখানো হচ্ছে, ঘটনার পর ঘটনা, দৃশ্যের পর দৃশ্য, তার বিন্যাস, সংলাপ, আলো-অন্ধকার, অভিনেতার কলাকৌশল, নেপথ্যে পরিচালকের দৃষ্টি ও মনন— এ-সব একবার মাত্র দেখে সবকিছু সম্বন্ধে লিখে ফেলা কি সম্ভব!
সেই সঙ্গে আছে শেক্সপিয়রের নাটকের মুদ্রিত রূপটি, এবং নানা পরিচালকের আগের করা 'কিং লিয়র' ফিল্ম, 'কিং লিয়র' সম্বন্ধে কত জনের কত লেখা-- এত সব ছেড়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে একটি মাত্র 'কিং লিয়র' ফিল্ম নিয়ে কী করে লেখেন তিনি?
শুরু হয় কলকাতার এবং আশপাশের সমস্ত ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ-- কেউ কি সম্প্রতি দেখাবেন ফিল্মটি?
কথিত আছে, লেখার আগে মোট বাইশ বার ওই ফিল্মটি তিনি দেখেছিলেন এবং তৎসহ আরও সব পরিচালকের করা 'কিং লিয়র'। সঙ্গে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা।
এত সবের পর আমরা পেয়েছি মাত্র সাড়ে আট পৃষ্ঠার একটি লেখা, যা মৃত্যুপথযাত্রীর সত্যকথনের মতো, প্রতিটি শব্দ ধরে-ধরে যা পড়তে হয় বা কান খাড়া করে শেষ কথাগুলো শুনতে।
এটি গল্প মনে হতে পারে। কিন্তু গল্পের চেয়ে সত্যি!
(২১ অক্টোবর ২০১৫)
----
* টুকরো এই লেখাটির বছর ঘুরবার আগেই প্রদুম্ন্য ভট্টাচার্য চলে যান আমাদের সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। দিনটি ছিল ২ অক্টোবর ২০১৬।
অতি ও রিক্ততা
মানুষ কিছু একটা চেয়েছিল। বাড়তি একটা কিছু। ঠিক কী, স্পষ্ট জানত না। ঈশ্বর? হয়তো সেরকমই একটা কিছু। চেয়েছিল হয়তো একটা মেয়ে-ঈশ্বর। বা, নিশ্চয় চেয়েছিল পুরুষ-ঈশ্বর। কে বলতে পারে, হয়তো-বা ক্লীব একজনই, যার দুর্দান্ত হুঙ্কারশক্তি আছে আর করুণা। ছাতা, ল্যাপটপ, মিঠাপাতি, অন্ধকার ঘরে মুমূর্ষু অজগরের মতো পিতামহ... চাইবা মাত্র বহু কিছু সে পেয়েছে। শুধু সার্বজনীন একটা ঈশ্বর এখনও পায়নি।
(২২ অক্টোবর ২০১৫)
রইল বাকি এক
বামফ্রন্ট আগেই গিয়েছে। পিছু ধাওয়া করে অদৃশ্য হয়েছে বিদ্বজ্জন আর সুশীল সমাজ। এ বার শীতও গেল! রইল শুধু অসহিষ্ণুতা।
(১২ ডিসেম্বর ২০১৫)
টোটোপাড়া
সামনেই বইমেলা। দুই বাংলায় বই প্রকাশের দমছুট চেষ্টা। মনে হতেই পারে, অজস্র বইয়ের ভিড়ে কবিতার বই-ই দলভারী।
দেশ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যার বিজ্ঞাপন দেখে তেমনটা কিন্তু মনে হল না। সেখানে হাজারো রকমের বই। ভূত, পিশাচ, রবীন্দ্রনাথের কাজের লোক, মমি, নরখাদক, জীবনানন্দের উপন্যাস-ভাবনা, অমিতাভ বচ্চন, উদ্ভিদবিদ্যা, আবদুল কালাম, কাদম্বরী-কেচ্ছা, তুষারচিতা, নরেন্দ্র মোদির জমকালো ভিড়ে কবিতা্র বই বিরল হয়ে-আসা টোটোপল্লির অন্ধকার শিকেয়। বড় জোর দশ শতাংশ।
তবু গুজবটি দীর্ঘ দিন রকের ওপাশে একপায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে আর গজগজ করছে—এ-ত কবি!
ওদের জিভে জোড়া বাজ পড়ুক। একান্তই যদি না পড়ে, ওদেরই নরখাদক এসে টেনে নিয়ে যাক দুবাইয়ে, ছোটা শাকিলের পরীক্ষামূলক কোনো অরক্তপাত হিংসায়। আর যদি পিশাচ আসে? বিদঘুটে সেই চরিত্রটি ধারালো অগ্নিজিহ্বায় গুজবটিকে উলটেপালটে চাটুক।
আর, যে সদ্যতরুণটি এগিয়ে আসছেন, আউড়াচ্ছেন একটু পুরনো হয়ে-যাওয়া পঙক্তি-- 'বসন্তে এনেছি আমি হাবাযুবকের হাসি...' বা ওইরকম কিছু, তাঁকে বলব না-- যান, সেঁধিয়ে যান আরো ভেতরে, যেখানে হাবা এক যুবতী ইনিয়েবিনিয়ে কী সব বকছে। তার কথার ময়লাগুলো দেখুন। আপনি তো জানেন, সেইসব কথার মৌলিকতা একান্ত ভাবে আপনারই আবিষ্কারের অপেক্ষায় ধ্বনিত হচ্ছে। বলব না। কেননা, তিনি জানেন।
(২১ জানুয়ারি ২০১৬)
আত্মকথা
এই কথাটা অভিযোগের মতো শোনা যায়, আমি নাকি খুব কম লিখি। ওই ক-টা তো বই!
ধরা যাক, পরিমাণ দিয়েই লেখাকে মাপলাম। তাহলে ভাবতে হয়, কতটা লিখলে তাকে 'যথেষ্ট' বলব। যথা ইষ্ট? ইষ্টও তো বহুবিধপথে আসে। কোন পথের ইষ্টকে গ্রহণ করব?
এ-সব কথা মনে আসছে এই নিশ্চিতি থেকে যে, পরিমাণের প্রসঙ্গে একবার ঢুকে গেলে কবিতার হওয়া-না-হওয়া নিয়ে কিছু বলার সুযোগ আর থাকে না। সে-সুযোগ নেওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই।
'এবার কবিতা লিখে আমি চাই পন্টিয়াক গাড়ি'-- এমন একটা কথার কথা লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবির অহংকার থেকে। কবির এই অহংকার পৃথিবীর কবিতাসমাজে স্বীকৃতিও পেয়েছে। কিন্তু, কবিতা লিখে অহংকার করবার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। এটা হয়তো আমার ব্যর্থতা।
আগ্রাসী হতে পারিনি। পড়াশোনাও বেশ কম। অতিরিক্ত শ্রমও দিতে পারিনি। তাই, নগণ্য কবিতাপ্রয়াসী হিসেবে, জানি, অধিকাংশ গোত্রে আমি গ্রহণযোগ্য নই। এমন তরুণ কবির দেখা পেয়েছি, যাঁরা আমার লেখা পড়েননি বা পড়ার যোগ্য মনে করেননি। এবং, এমন অনেক-অনেক তরুণ কবি আছেন, যাঁদের সঙ্গে মুখোমুখি আলাপও হয়নি আমার মতো ঘরকুনোর।
এর পরও পঁয়ষট্টি-অতিক্রান্ত একটা নিঃসঙ্গ মানুষ কেন লেখার চেষ্টা করে?
এটা একটা রহস্যই বলতে হবে।
(২৮ জানুয়ারি ২০১৬)
না
একটি না-এর জন্যে, 'না' বলার ক্ষমতা অর্জনের জন্যে কত দূর যেতে হয়? যেতে রাজিও আছি। তবু সাদা, ছেঁড়া, ছিট-ছিট রক্ত-লেগে-থাকা, একটি মাত্র বিবেচনাপূর্ণ অথচ সাহসী 'না'-এর অপেক্ষায় এত কাল কেটে গেল আমার!
(২ মার্চ ২০১৬)
অন্ধকার
সূর্য ডুবে গেছে কোন সন্ধ্যেয়। সেই সন্ধ্যে থেকেই আলোর পর আলো জ্বেলে যাচ্ছে মানুষ। হায়, যত ভরসা ওই আলোর ওপরেই। অথচ পিলসুজের ওপর অন্ধকারের অনন্ত শিখাই যে তার চিরসঙ্গী, কী করে সে ভুলে যায়!
(২৮ মার্চ ২০১৬)
রাতের ছবি
রাস্তা টানা শুনশান। প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে ভূতের মুণ্ডু ঝুলে আছে চোখধাঁধানো আলোর মতো। সামনের তরুণ মেহগনি গাছের কচিপাতায় ঠিকরে পড়ছে আলো। রাত দেড়টার পাতারা দুলছে প্রেতাত্মার হাওয়ায়। রোগাটে কুকুর একটা, নরক থেকে ঘুরে এসে কী যেন খুঁজে যাচ্ছে নবতম নরকের খটখটে রাস্তায়। খাবার?
দূরে লাঠির শব্দ। পাহারাদার, যার নাম গার্ড। কবন্ধ প্রহরী। রাস্তার একপ্রান্ত গিয়ে ঠেকেছে বিদ্যাভবন নামের স্কুল-খাঁচায় আর অন্য প্রান্ত মোড়ের বন্ধ তেলেভাজার দোকানে। সামনে ডিভাইডারের ল্যাম্পপোস্টে সাঁটানো বোর্ডে একগাদা বইয়ের ফাঁকে এক শিশুর আতঙ্কিত মুখচ্ছবি। তার ওপরে লেখা: Stuck on Maths?
এমন রাস্তার পাশে আমি কি ঘুমিয়ে পড়ব? নিশ্চিন্তে?
(২৮ মার্চ ২০১৬)
ভূতের ভবিষ্যৎ
বুকে হাত দিয়ে বলো তো, ভূত তুমি দেখেছ কখনো? তাহলে বিশ্বাস করো, এগুলো এমন এক ভূতের লেখা, যে দ্বিতীয় ভূতটিকে দেখার আশা না-করেই বেঁচে আছে|
(৩০ মার্চ ২০১৬)
কবিতার কথা
কবিতার কাজ কী? বহু পুরনো ভাবনাটা আজ আবার উঁকিঝুকি দিল একটি বিখ্যাত পঙক্তি, বহুপঠিত, আবার পড়ে| পঙক্তিটির লেখক জীবনানন্দ দাশ|
''মানুষের মৃত্যু হ'লে তবুও মানব থেকে যায়|''
কী বিপদজনক এই পঙক্তি! কবিতার কাজ কি মানুষকে মহান করে দেখা? নাকি এই পৃথিবীকে অবিনশ্বর রূপে প্রতিষ্ঠিত করা? মানুষ যতটুকু, ততটুকুই| এই পৃথিবীও| এমনকি ব্রহ্মাণ্ডও| বস্তু সদাপরিবর্তনশীল| হয়তো-বা রূপান্তরকামীও| ধ্বংস হয়, বিচূর্ণ হয়| আবার নতুন রূপে প্রকাশিত হতে চায়| শূন্য অনন্ত বলে চিরকাল অনড় থাকতে চেয়েছে| পারেনি| বস্তু প্রতি মুহূর্তে শূন্যকে আঘাত করে-করে শূন্যতা বিনষ্ট করে গেছে| এমন চরম সংঘাতে মানুষ নামের তুচ্ছ প্রজাতিটিকে অমরত্ব দানের চেষ্টা কি শিশুর হাতে ললিপপ ধরানো নয়?
যদি এমন হত পঙক্তিটি: 'ঈশ্বরের মৃত্যু হলে তবুও ঈশ্বর থেকে যায়', তাহলেও মুক্তি পেতেন না কবি| স্থান-কাল-পাত্রভেদের কারণে একটু রশ্মিময় হত বড় জোর| তা-ও হত কি! জানি না|
এই ধরনের কবিতা থেকে হয়তো-বা আমাদের সতর্ক-দূরত্বে থাকা উচিত| এমন কবিতা শুধু শুনতে বা পড়তে ভালো লাগে, কেননা এতে রয়েছে মনস্কামনা পূরণের সিঁড়ি।
মানুষের মৃত্যু হলে বস্তুর রূপান্তর হবে মাত্র| সেদিন আর কোনো 'মানব' থাকবে না|
তবু এই সংশয় থেকেই যাচ্ছে যে, কবিতা কি এমন ভাবে পড়া উচিত?
(৩০ মার্চ ২০১৬)
আ মরি আত্মভাষা!
ভাষা এক ছুরি, যেটা শত্রুর, এবং বন্ধুরও, হৃদপিণ্ডের অন্ধকারে আচমকা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। এবং পেশি নিংড়ে বের করা যায় রক্ত।
মিথ্যা কথার একমাত্র শিক্ষক ভাষা।
চরম ভুল বোঝাবুঝির ঘূর্ণিতে মানুষ এবং পৃথিবী যে ঘুরে মরছে বা মরবার ভয়ে ঘুরছে, তার জন্যেও দায়ী ভাষা।
ভাষা আমাদের গামছা, স্নান করবার পর গা মুছে যেটি ক্রমাগত নিংড়ে গেলেও নোংরা জল ছাড়া আর কিছুই বের হয় না।
ভাষা তা-ই, যা আমরা বলতে চাইছি; কিন্তু পেরে উঠছি না।
আমাদের অক্ষমতাকেও সফল ভাবে প্রকাশ করতে পারে না যা, সেটাই হল ভাষা।
জ্ঞানত এবং অজ্ঞানতাবশত কিছু ব্যবহারিক ভুল তো করেইছি। তার জন্যে বহুবার ক্ষমা চাইতে গিয়ে বোবার মতো ফিরে যে এসেছি, সে তো ভাষারই অভাবে! যথাসময়ে ভাষা হাজির হয়নি ঠোঁটে। খুঁজে পাই-ই নি তাকে, সেই প্রতারককে।
এই বাচাল প্রতারককে নিয়ে আমি কী করব?
(২৩ এপ্রিল ২০১৬)
সবার কথা কথার কথা নয়!
তাঁর লোকপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। মানুষটির কাছের জন হিসেবে নিজেকে ভাবতে ভালোবাসেন-- এমন প্রার্থীর সংখ্যাও বহু। প্রতি রবিবার তাঁর বাড়িতে ভিড় লেগেই থাকে। তবু আমরা তাঁকে দেখে, তাঁর সান্নিধ্য পেয়েও কিছু শিখিনি, শিখি না।
তখন আমি একটি পত্রিকা-অফিসে। সন্ধে গড়িয়ে গেছে। আন্দাজ করছি, জরুরি একটা কাজে শঙ্খ ঘোষের বাড়ি যেতে হবে। ততক্ষণে হাতে কিছু কাগজপত্র পৌঁছে গেছে। ডিরোজিওর নামে একটা কলেজ হচ্ছে রাজারহাটে। সেখানে মূর্তি বসবে ডিরোজিওর। মূর্তির বেদিতে থাকবে সেই স্বপ্নদর্শী অকালপ্রয়াত মানুষটির একটি কবিতা। সঙ্গে বাংলা অনুবাদ।
হাতের কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি, কানে এল--- ওতে ডিরোজিওর সেই কবিতার তিনটি অনুবাদ রয়েছে। আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তিনজনই নামকরা। একজন মার্কিনপ্রবাসী! এও বলা হয়, কোনোটাই হয়নি অবশ্য। উনি যদি ঠিকঠাক করে দেন। অথবা নিজেই যদি করেন একটা অনুবাদ। সঙ্গে এও শুনলাম-- কাজটা কিন্তু শক্ত!
অফিস থেকে বেরোবার মুখে সন্দীপনদার (চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে দেখা। ঢুকছিলেন। কোথায় যাচ্ছি? শুনে বলেছিলেন, এটা কিন্তু করে আনতেই হবে।
শক্ত প্রস্তাব। কিন্তু এত ওপরমহল থেকে অনুরোধের ভঙ্গিতে আসা নির্দেশ-- চেষ্টা করি বুঝতে, কতটা ওপরমহল সেটা-- ঠেলে ফেলা মুশকিলের। ফলে যেতেই হয়।
ফাঁকাই ছিল তাঁর হাজারো বইয়ে ঘেরা বসবার ঘর। তখনও তিনি নিজে সমস্ত বইপত্র ঘাঁটতেন। অবস্থান পালটে-পালটে যেত বইগুলোর। পছন্দের বই চলে আসত সামনে। যে-বইটি এগিয়ে আসত, জ্বলজ্বল করত যেন সেটি।
হেসে কথাটা বলতেই তিনি জানান, এ তো অনুবাদ হয়েই আছে। আবার কী দরকার? সম্ভবত পল্লব সেনগুপ্তর নাম বলেন তিনি।
কারো কথা শুনে নয়, হলে নিজেই হবেন, তবু আমার দুর্বল চেষ্টা চলতেই থাকে রাজি করানোর। কেননা, অস্পষ্ট ভাবে বললেও কর্তারা যে চাইছেন শঙ্খবাবুই করুন অনুবাদ!
কথার চাপানউতোর-- কতক্ষণই-বা চালানো যায় তাঁর সঙ্গে-- যখন চলছে, সন্দীপনদার ফোন।
বলো শঙ্খদাকে, জীবিত অবস্থায় একমাত্র তাঁর লেখাই পাথরে খোদাই হবে। এ তো শিলালিপি!
শুনে হাসি চাপতে না-পেরে সামনের শুভ্র পোশাকের মানুষটিকে বলি-- সন্দীপনদা। কী-সব বলছেন।
শুনে হেসে ফেলেন তিনিও। যখন নিমরাজি হন, রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। উঠে পড়ি।
সেই অনুবাদ শেষ পর্যন্ত তিনি করেছিলেন। এবং অসামান্য সে-অনুবাদ। কেউ যদি জিজ্ঞেস করতেন, কেমন? নির্দ্বিধায় বলতাম, ডিরোজিওর মূল কবিতার চেয়েও ভালো।
কথা এটা নয়। এর পরেরটা। ভুলে যেতে পারি, তাই লিখে রাখছি।
সেই ডিরোজিও-নামাঙ্কিত কলেজের উদবোধন। করবেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। আমন্ত্রণ করতে এসেছিলেন সম্ভবত তখনকার তথ্যসচিব। শঙ্খবাবু বলেছিলেন, নির্ধারিত দিনটিতে তাঁর কাজ রয়েছে। বাড়িতে কেউ আসবেন। ফলে অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হবে না।
অনেক অনুরোধেও তাঁকে যখন রাজি করানো গেল না, হতাশ তথ্যসচিব ফিরে যান। কিন্তু রাজি তো করাতেই হবে। ফলে ভার পড়ে ওজনদার এক বিধায়ক মশাইয়ের ওপর। বোঝাবার চেষ্টা তিনিও কম করেননি। কেননা, মুখ্যমন্ত্রী দোর্দণ্ডপ্রতাপ। তিনি বিশেষ করে চাইছেন, শঙ্খবাবু আসুন। এও নাকি বলেন, তাঁর নির্দেশ মতো শঙ্খবাবুর বসবার ব্যবস্থাও হয়েছে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই। তবু বিধায়ক ব্যর্থ হন এবং বিস্মিতও। জানতে চান, ওই দিনের নির্ধারিত কাজটি ঠিক কী!
জানতে পারেন, বর্ধমানের কোনো-এক জায়গা থেকে একদল তরুণ আসবেন কবিতা শোনাতে।
শুনে খানিকটা হতভম্বও কি হননি বিধায়ক মশাই! অস্ফুটে বলেছিলেন, ওটা অন্যদিনে করা যায় না?
না। কেননা, ওই তরুণদের ফোন নাম্বার শঙ্খবাবু জানেন না যে!
অখ্যাত, অজ্ঞাত একদল তরুণ কবির অপেক্ষায় নির্ধারিত দিনটিতে বসে থাকবেন তিনি। কেননা, কথা দিয়েছেন। এমনকী সে-কারণে মুখ্যমন্ত্রীরও আমন্ত্রণ গ্রহণে অক্ষম।
নিজের কথার এতোটা মূল্য কি আমরা দিই? এমন শিষ্টাচারবোধের তোয়াক্কা না-করেই কোন পায়ে যে দিনের পর দিন তাঁর বাড়ির সিঁড়ি আমরা ভাঙছি!
(২৮ এপ্রিল ২০১৬)
(ক্রমশ)