আবহমান বাংলায় ঋতুরাজ বসন্তের এমন চিত্র যেমন তার ছবির বিষয় হয়েছে, তেমনি গ্রামীণ জীবনে শীতের রূপকেও তিনি আঁকতে ভোলেন নি।
Published : 13 Dec 2024, 02:29 PM
রেজাউল করিম। সামাজিক যোগা্যোগ মাধ্যমে পরিচিত আর. করিম নামে। রং ও রেখার এক শিল্পী। অসংখ্য ভূদৃশ্য ও শতাধিক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতির জন্য তিনি ইতিমধ্যে একাধিক গণমাধ্যমে আলোচিত। বয়সে তরুণ হলেও, তার শিল্পিত উপস্থাপন প্রবীণের দক্ষতা-ছোঁয়া।
মনে পড়ছে আবু হেনা মোস্তফা কামালের 'ছবি' নামক কবিতার লাইন: "ভ্যান গগ্—যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে এনে/ ব্যবহার করতেন—"। আর. করিম সম্পর্কে কথাটি পূর্ণরূপে সত্য না-হলেও হাতের নাগালে যা পাচ্ছেন, মুহূর্তেই তা করিমের নিপুণ ছোঁয়ায় অসাধারণ হয়ে উঠছে এবং অল্পসময়ের ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকে। বইছে প্রশংসার লিলুয়া বাতাস। এইসব শিল্পের উৎসের সন্ধানে প্রশ্ন করলে আর.করিম ঘুরেফিরে ভ্যান গগের মতো আকাশ কিংবা শস্যের কথাই বলেন অর্থাৎ মোটাদাগে প্রকৃতি।
আর করিমের জন্ম গত শতাব্দীর শেষদিকে। জন্মেছেন বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ ও মিষ্টি পানের জন্য বিখ্যাত মহেশখালীতে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যই যেন তাকে প্রতিনিয়ত প্ররোচিত করছে শিল্পের পথে। চোখ মেললেই একদিকে যেমন দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ, অন্যদিকে আকাশ আর সমুদ্রের নীল মিলেমিশে একাকার। রঙের এমন বৈচিত্র্যময় খেলা করিমের চারদিকে। তিনিও এসব হৃদয়ে শুষে নিয়ে এঁকে চলছেন বিরামহীন। কী কাগজ, কী দেয়াল, কী ঝরাপাতা, কী চায়েরটেবিল— সবকিছুই যেন তার যেমন ইচ্ছে তেমন ছবি আঁকার ক্যানভাস।
আর.করিমের ছবি আঁকার সূচনা শৈশবে। পাঠ্যবইয়ে শিল্পী হাশেম খানের করা চিত্রকর্মগুলো বেশ আগ্রহ ভরে দেখতেন করিম। ছবিগুলো তাকে আলোড়িত করতো। তিনিও সেইসব ছবির অনুকরণে নিজেই আঁকার চেষ্টা করতে লাগলেন পুরোদমে। কিছু হতো, কিছু হতো না। তবুও চেষ্টার কমতি নেই। সেই চেষ্টাই তাকে আজ স্বীকৃতি দিয়েছে চিত্রশিল্পী হিসেবে।
আর. করিমের ছবি আঁকবার বিশেষ দিকটি হলো স্কেচ করা। করিম তার প্রিয়জনদের ছবির স্কেচ করতে দারুণ পটু। কাগজে মার্কারপেনে আঁকা এইসব স্কেচগুলোর নাম দিয়েছেন কাগজে টানটোন। এই ছবিগুলো সাধারণত জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে এঁকে থাকেন করিম। এছাড়া মৃত্যুদিনে স্মরণ করেও আঁকছেন কিছু। শিল্পের নানান আঙিনায় থাকা প্রিয় সব মুখ নিজের মতো করে এঁকে থাকলেও প্রধান ঝোঁক কবিতা কিংবা কথাসাহিত্যের দিকেই, যা তার আঁকা ছবিগুলোর দিকে মনোযোগ দিলেই টের পাওয়া যায়। আর. করিমের স্কেচবুকের পৃষ্ঠা জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ থেকে শুরু করে সুনীল-শক্তি-শঙ্খ কিংবা শামসুর রাহমান-সৈয়দ শামসুল হক- আল মাহমুদ- বেলাল চৌধুরী-শহীদ কাদরী হয়ে মহাদেব সাহা-নির্মলেন্দু গুণ-আবুল হাসানসহ এই সময়ের আনিসুল হক-সুমন্ত আসলাম-সরকার আমিন-আহমাদ মোস্তফা কামাল - পিয়াস মজিদ প্রমুখ। এছাড়া বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে সঙ্গীত জগতের ভূপেন হাজারিকা, মান্না দে, সুবীর নন্দী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, খুরশিদ আলম, এন্ড্রু কিশোর, আইয়ুব বাচ্চুসহ অনেকেই।
এক্রেলিক কিংবা জলরঙেও নিজের জাত চিনিয়েছেন আর. করিম। এই মাধ্যমে করিম কিছু কিছু পোর্ট্রেট করলেও মূল মনোযোগ প্রকৃতিতে। কখনো জলরঙের ব্যবহারে কাগজের পৃষ্ঠাজুড়ে দৃশ্যমান হচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ শিমুল ও এর ডালে একটা কোকিল; আবহমান বাংলায় ঋতুরাজ বসন্তের এমন চিত্র যেমন তার ছবির বিষয় হয়েছে, তেমনি গ্রামীণ জীবনে শীতের রূপকেও তিনি আঁকতে ভোলেন নি। তার আঁকায় কোনো এক বৃদ্ধ শীতে কেঁপে বের হয়েছেন খেজুর রসের সন্ধানে আবার পরমুহূর্তেই দেখি কেউ একজন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নেমে আসছেন। এইসব চিত্রের সাথে সাথে তিনি কোনো এক নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এঁকে ফেলছেন সেই নদীর বর্তমান দশা কিংবা পাশের ধানক্ষেত থেকে ধান কাটবার দৃশ্য।
এতকিছু ছাপিয়ে, সাধারণের নজর কাড়ে আর. করিমের করা পাতার কাজ। ঝরাপাতা কেটে করিম তৈরি করেন প্রিয় মুখের অবয়ব। কখনো-বা পাতা কেটে করা ডানা ঝাপটানো পাখির এমন দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়— শূন্যে মেলে ধরলেই হয়তো উড়ে যাবে এক্ষুণি। আর. করিমের শিল্পসত্তা অকৃত্রিম। এখানে ভণিতা নেই কোনো, জোরজবরদস্তি নেই। তাইতো চায়ের দোকানে বসে, এককাপ চা বেঞ্চে ঢেলে দিয়েই নির্মাণ করে ফেলেন প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। কিংবা মাটিতে পানি ঢেলে কাজী নজরুল ইসলামের এমন এক চিত্র তৈরি করে ফেলবেন, যা দেখে মনে হবে কম্পিউটারের কোনো কারিশমা! ইদানিং স্কুল-রেস্টুরেন্টের দেওয়ালগুলোতে শোভা পাচ্ছা করিমের হাতে আঁকা ছবি ও লেখা।
শৈল্পিক অভিব্যক্তির নানান মাধ্যমে যার যাতায়াত অনায়াস তিনি চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত যদিও ইচ্ছে ছিলো চারুকলায় পড়ার। হয়ে ওঠেনি নানান সীমাবদ্ধতার কারণে। অনেকটা বাধ্য হয়েই পড়ালেখা করছেন সমাজবিজ্ঞানে। এই পাঠও তাকে বেশি দূর টানেনি, তাকে টেনেছে অবারিত মাঠ, ঘন সবুজ বন, শান্ত নদী, সাগরের ঢেউ, পাহাড়ের অপার মুগ্ধতা, ছবি আঁকার খাতা৷ এইসব নিয়েই মেতে আছেন তিনি। থাকতে চান জীবনের শেষ অবধি।
ছবি আঁকার শুরুটা খুব সুখকর ছিলো না তার। ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা পারিবারিক সীমাবদ্ধতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়েছে করিমকে। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল পরিবারের সমর্থন পাওয়া করিমের কাছে ছিলো আশাতীত। কিন্তু করিম পরিবারকে জয় করে নিয়ে আঁকছেন এবং ছবি আঁকাকেই একমাত্র নেশা ও পেশা করে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তার।