জীবন এবং সৃজনশীলতার অনুধাবনে এই গ্রন্থটি পাঠককে তাড়িয়ে ফিরবে; কুমার চক্রবর্তী বলছেন, “যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজের দিকে মানুষের অভিযাত্রা— তা এক গোপন, একান্ত, ও অন্তর্ঘাতী ভ্রমণ; তবে এর স্বভাব অন্তর্বৃত ধরনের— ধাঁধাময়, হেঁয়ালি, আর অবোধ্য।
Published : 25 Mar 2025, 09:25 PM
কী এক আশ্চর্য এই কিতাব, খেয়ালপাতার গান, যাকে পাঠকমাত্রই বুঝে নিয়েছেন, এই গ্রন্থের যে কোনো বিন্দুই হয়ে উঠতে পারে পাঠের উন্মেষ বিন্দু এবং, এই পাঠের যেন কোনো শেষ নেই; এই গ্রন্থ পাঠককে পুনঃপুনঃ পাঠের আহ্বান জানায়, যেভাবে আমরা জানিনা কোথায় দিনের শেষ, কিংবা রাতের শুরু; আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানিনা কীভাবে এই মহাবিশ্বের উদ্ভব কিংবা কীভাবেই বা তার সমাপ্তি নির্ধারিত হয়ে আছে। অজানিতভাবে বস্তুবিশ্বে এবং মহাকালে বিস্তৃত হয়েও আমরা যেন সময় এবং স্থানের সমাপতনের মধ্য দিয়ে একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে রয়েছি বহুকাল; কীভাবে কবিতার জন্ম হয়, আর যে কোনো কবির প্রথম এবং শেষ কবিতার মধ্যে দূরত্ব কী? সে কি এক সরলরেখার দুই প্রান্তিকতা, নাকি একটি সরলরেখা ক্রমশঃ হ্রস্ব হতে গিয়ে একটি বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে? একইভাবে আমরা জারিত হতে থাকি যখন আমরা ভাবতে শুরু করি শাশ্বতের পরিপ্রেক্ষিতে মুহূর্ত আসলে কী ! এই পুস্তকটি পাঠ করতে গিয়ে আমি ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ি; কিন্তু ধ্যান থেকে বিযুক্ত হয়েই ধ্যানীকে বুঝে নিতে হয় যে তিনি ধ্যানমগ্ন ছিলেন। মুহূর্ত আসলে সময়কে অবলোকনের নিমিত্তে এক জরুরী স্থবিরতা; কিন্তু এই স্থবিরতা পাললিক মাটির অনড় শিলায় রূপান্তরিত হওয়া নয়, বরং সৃজনশীলতার জন্য এক জরুরী উপাদান, যা তাকে করে অন্তর্মুখী—যেন এক অবধূতীয় বোধ, যেন সৃষ্টির উন্মেষবিন্দু, যেন পরমাত্মার স্বপ্ন হতে জাগ্রত হবে এই জগৎ, এই মহাবিশ্ব। কুমার চক্রবর্তী, যিনি এই বইটির রচয়িতা, যিনি একইসাথে কবি, পাঠক, দার্শনিক এবং সৃজনশীল সত্তার প্রতিনিধি হয়ে বুঝে নিতে চাইছেন মহাকালের আচ্ছাদনে জন্মমৃত্যুর মধ্য দিয়ে কী প্রকারে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া জাগ্রত হয়ে আছে, কীভাবে আমাদের অজান্তেই ব্যক্ত আর অব্যক্তের মধ্যে আমরা নিরন্তর এক সাঁকো নির্মাণ করে চলেছি। সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া একান্তই অদৃশ্যমানতাকে দৃশ্যমান করে তোলে না, একইসাথে দৃশ্যমানকেও সে অদৃশ্যমান করে তোলে। সৃজনশীল প্রক্রিয়ার সাথে অন্বিত হয়ে আছে চিন্তা, কিন্তু কে পূর্বগামী— চিন্তা না ভাষা (শব্দ)?
ওঁ, ধ্বনিটির মধ্য দিয়েই মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়েছে, এমনটি জেনেছি আমরা ভারতীয় অধিবিদ্যায়, একইভাবে খ্রিষ্টিয় অনুষঙ্গে আমরা জানি, ‘শুরুতেই ছিল শব্দ, এবং শব্দ ছিল ঈশ্বরের সাথে, এবং শব্দই ঈশ্বর।’ । এই গ্রন্থে ‘ভাষার দুঃখ’ প্রবন্ধে মিশেল ফুকোর বরাত দিয়ে আমরা জেনেছি ভাষা আগে, ভাবনা পরে। ভাষা, ভাবনা, কবিতা, শিল্প নিয়ে মহাজনদের—স্পিনোজা, কান্ট, সেজান, শোপেনহাওয়ার, কিয়ের্কেগার্দ, এলিয়েট, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, আপন মাহমুদ, প্রমূখের— চিন্তাচূর্ণ উঠে এসেছে এই গ্রন্থবিস্তারে। ‘বুদ্ধের নির্বাণ’ আর ‘নীৎশের সাফারিং’ এই দুই অনুধ্যান, কোনো এক অদৃশ্যতায়, বইটিকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে, তাকে শাসিত করে রেখেছে, যদিও এই গ্রন্থের লেখক তাকে অমান্য করতে পারেন। কুমার চক্রবর্তী, তাঁর বইয়ের মুখবন্ধে, আমাদেরকে জানিয়েছেন, ‘এই বইয়ে কোনো দর্শন চিন্তা নেই, আছে কিছু চূর্ণচিন্তা। আছে কিছু আনন্দিত অপরমনষ্কতার ভাববিস্তার।’ সেই অপরমনস্কতার ভাববিস্তারের পথ ধরেই আমরা লেখকের ‘টিটমাউস পাখিটি,’ প্রথম অনুপ্রবন্ধে দেখি কীভাবে কাণ্ট সময়ের অধিবিদ্যার কাছে পরাজিত হয়ে চলেছেন; নিস্তদ্ধ, দুর্ভর সময় তাঁকে গ্রাস করে চলেছে; যে পাখিটি বসন্তকালে তাঁকে গান শুনিয়েছিল, কিন্তু জীবনের অন্তিমে পাখিটি হয়েছে অপস্রিয়মাণ; সময়ের পথ ধরে হারিয়ে গেছে দুইটি সত্তা—দার্শনিক কাণ্ট আর টিটমাউস পাখি; এখানে সময় যেন মৃত্যুরই এক রূপক। কুমারের ভাষায়, ‘…কিন্তু যে যুগলমুহূর্তটি রচিত হয়েছিল দুই অজানা সত্তার দুরত্যয় মহিমাব্যঞ্জনে, তাই আজ সেই অপসৃত মৃত সময়কে আমাদের স্মরণে হাজির করে যায়।’ আশ্চর্য এই কিতাব প্রকৃত প্রস্তাবে সময়ের অধিবিদ্যারই এক গ্রন্থ । তাঁর ‘সুখিত দুঃখ’ নিবন্ধে দেখি দার্শনিক শোপেনহাওয়ারকে, যিনি জীবনভর তাড়িত হয়ে ফিরেছেন তাঁর প্রিয় দুই শব্দ— উইল (ইচ্ছা) আর আইডিয়া (ধারনা/চিন্তা)— নিয়ে। দুঃখবাদী দার্শনিক হয়েও তিনি ছিলেন কামুক এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ— এ যেন বুদ্ধের অস্থিত্ব বিষয়ক মৌল উপপাদ্যের প্রাথমিক শর্তের মূর্তায়ন। কুমারের চিন্তায়, ‘কিয়ের্কেগার্দের জীবনে ও মনে ছিল ঈশ্বর, এবং সেই ঈশ্বর যার ভার অবহনীয়।’ তিনি বিভিন্ন মনীষীদের চিন্তার সূত্র ধরে বলছেন, সুখের চেয়ে দুঃখের মহিমা বেশি। দুঃখ প্লাবী, অনপেক্ষ, এবং অনুশীলনময়…দুঃখ নিজের থেকে বেজে ওঠে, বাজায়,’ যে চিন্তা রবীন্দ্রনাথের, যিনি তাঁকে জেনেছেন ব্যথা-পথের পথিক হিসেবে, যেখানে দুঃখকে নিয়েই জেগে ওঠে সকালসন্ধ্যার গান। সমগ্র গ্রন্থ জুড়ে সেই গান হয়ে ওঠার এক আর্তির অনুরণন শুনি। অকালপ্রয়াত কবি আপন মাহমুদ কবি হয়ে উঠতে চেয়েছেন একান্তই তাঁর আত্মপ্রতিস্বের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে। লালন ফকির আসামান্য প্রতীকী ব্যঞ্জনায়, ‘লণ্ঠনে রূপের বা্তি,’ যা আগুন আর হাওয়ার কুহেলিকা, যেন ‘জ্বলছে সদাই’-এ আমরা নিমজ্জমান, আমরা ব্যথাভারাতুর। লন্ঠন নিভে গেলেও রূপ থেকে যায় নানা মধ্যস্ততায়, যেভাবে অনেক নক্ষত্র মরে গেছে বহুকাল আগে, কিন্ত দূর আকাশে সেইসব নক্ষত্রেরা আজো দীপ্যমান। কবি আপন মাহমুদ আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন এইভাবে, ‘কারা যেন ঘুমের ভেতর ছেড়ে দিয়েছে রেলগাড়ি—সেই থেকে খুঁজে পাচ্ছি না ব্যক্তিগত নৌকা, ভাটিয়ালি…।’ যখন কোনো শিল্পী মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বয়ম্ভু এবং সমান, তখন তিনি রচনা করে যান মহৎ শিল্প, এমন অভিমত রেখে গেছেন কাফকা। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে যে দোলাচল, তাকেই যেন পুনঃপুনঃ কুমার চক্রবর্তী তাঁর ভাবপ্রকল্পে, তাঁর চিন্তাবিগ্রহে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে যান, ‘এফিটাফই মৃত আর জীবিতের মধ্যকার একমাত্র ও একক ভাষাসন্ধি যা চিরস্তদ্ধতায় চিহ্নটিকে পৃথিবীর বুকে উঁচিয়ে ধরে রাখে। তা বস্তুত এক কালচিহ্ন যা নির্বাকভাবে কথা চালিয়ে যায় অনন্তের সাথে।’
জীবন এবং সৃজনশীলতার অনুধাবনে এই গ্রন্থটি পাঠককে তাড়িয়ে ফিরবে; কুমার চক্রবর্তী বলছেন, “যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজের দিকে মানুষের অভিযাত্রা— তা এক গোপন, একান্ত, ও অন্তর্ঘাতী ভ্রমণ; তবে এর স্বভাব অন্তর্বৃত ধরনের— ধাঁধাময়, হেঁয়ালি, আর অবোধ্য। এ হলো সাধারণ থেকে বিশেষ হওয়ার প্রতি ব্যক্তির মানসিক অভিগামিতা । রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমরা প্রত্যেকেই এক বিশেষ আমি।’ এই বিশেষ আমির জাগরণ দিগন্তের দেখা দেওয়ার মতো ঘটনা। নিট্শে একেই বলেছেন সৃষ্টির স্রষ্টা হয়ে ওঠা ।’ নিট্শের ‘উইল টু পাওয়ার’ চিন্তাটির অভিমুখ, প্রকৃত প্রস্তাবে, প্রতিটি শিল্পী প্রতিনিয়তই যেন নিজেকে অতিক্রম করে যান। কুমার আরও সুন্দর করে বলছেন, ‘জীবনের অগ্রগামিতা হলো……
এমনকি নিজের কাছেও নিজেকে ভিন্ন করে তোলা।’
যারা সৃজনশীল প্রক্রিয়ার সাথে লিপ্ত, তাঁদের জন্য অবশ্যই এই বইটি পাঠ্য হয়ে উঠুক। তাই কতগুলো ‘আত্মদর্পণে লিখন’ নিয়ে এই বইটি মূদ্রিত, সেই গণনায় আমি যেতে চাই না। ‘খেয়ালপাতার গান’ ধরেই বলি, আমরা প্রতেকেই যেন এক একটি খেয়ালপাতা, কিংবা ‘খেয়ালপাতাময় দেহ,’ আর এই দেহ যেন এক একটি গান হয়ে উঠতে চাইছে। নিট্শে আর বুদ্ধ জীবনের গভীরে দুঃখের যে অধিষ্ঠান দেখেছেন, তাকে অতিক্রম করে যাবার অনুপ্রেরণাও যুগিয়েছেন। বুদ্ধের ‘নির্বাণ’ প্রসঙ্গে কুমার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘পারমার্থিক এবং ব্যাবহারিক সত্যের কথা বলেছেন বুদ্ধ, সম্ভবত পরমার্থকে নিজের মতো বোঝা এবং বোঝার ধারণাটি হলো নির্বাণ। যেহেতু সময়ের ভেতর সত্তার বা বস্তুর স্থায়ী অস্তিত্ব বলে কিছু নেই, সবই অনিত্য-বাস্তব, তাই সময়ের বাইরে যাওয়াই অস্তিত্বের উদ্দেশ্য, আর এটাই নির্বাণ।’
অসামান্য এই গ্রন্থটির নাম হয়ে উঠতে পারত, ‘দ্য বুক অফ দ্য ডেড’ কিংবা ‘তোমারি ঝরনা তলে,’ ইত্যাদি; কিন্তু খেয়ালপাতার গান মূলত নশ্বরতার বিরুদ্ধে সৃষ্টিশীল সত্তার এক বিদ্রোহ, যেখানে সে পরাভূত হতে বাধ্য, তবু সত্তার এই বিদ্রোহ নিরন্তর। তবু, ‘শাশ্বতের পরিপ্রেক্ষিতে’ ‘স্পিনোজার কাছে দেহ আর আত্মা অভিন্ন।……ঈশ্বর ও প্রকৃতি একাকার, সুতরাং তাঁর কাছে মৃত্যুভাবনা কোনো বিশেষ জায়গা নেয় না, বরং জায়গা ছেড়েই রাখে। সেই জায়গাটি হলো ভাবনামুক্তি।’ পাঠক হিসেবে আমি আছি এক গোলকধাঁধায়, তাই পুনঃপুনঃ ফিরে আসি উৎসমূলে, যদিও এই বইটির কোনো উৎসমূল নেই, যেন জন্ম নিয়েই সে ব্যাপ্ত। ‘বুদ্ধের ভ্রমণ’ প্রবন্ধে কুমার চক্রবর্তী আমাকে এক অসামান্য চিন্তায় বুঁদ করে রাখেন; আমি আচ্ছন্নতায় হেঁটে চলি, এই অনুভবে, ‘ব্যক্তি বুদ্ধের ভ্রমণ এই নির্বাণেই হয়তো সমাপ্ত, কিন্তু তাঁর চিন্তার ভ্রমণ চলমান রয়েছে।’ এ হলো মৃত্যুর বিরুদ্ধে সৃজনশীলতার একমাত্র বিদ্রোহ, একার্থে এ হলো ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষের দ্রোহ।
খেয়ালপাতার গান বইটি আমারও লেখা হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু খেদ নেই, কারণ আমার রয়েছে বইটির পাঠের আনন্দ!