এক ইদের সকালে কবি-বন্ধু নির্মল হালদার শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর জানতে চাইল, আর কার ফোন পেয়েছি। প্রতি বছরের মতো এবারো শঙ্খ ঘোষ।
Published : 17 Jun 2024, 11:27 AM
পাঞ্জাবি আর পাজামা একটু ঢলঢলে। নতুন। জুতো থেকে বেরিয়ে আসছে পা। সে-জোড়াও নতুন। কানে আতর-ভেজা তুলো কিন্তু সেঁটে আছে। কপালে চন্দনের ফোঁটা। বাচ্চাদের একটা দলে ভিড়ে গিয়ে সে হাঁটছে ইদগাহের দিকে। তারা অবশ্য বলত ইদগাঁ। গ্রাম ছাড়িয়ে, বামনি পুকুরের পাড়ে, গোরস্থান-লাগোয়া, ছোট্ট আর জীর্ণ ছিল ইদগাহটি।
এখন আর নেই। এখন গোরস্থানের ঠিক বাইরে বিশাল এক গম্বুজ আর সুউচ্চ মিনার শোভিত ইদগাহটি আন্তর্জাতিক না-হলেও জাতীয় একটা চেহারা পেয়েছে।
কিন্তু তখন, আমাদের শৈশবে ছিল ছোট্ট ইদগাহ। গ্রামটাই তো ছিল ছোটো। গাঁয়ে ক-টা পশু কুরবানি হল বকরিদে, সরকারি রেওয়াজ ছিল গোনার। আমাদের গাঁয়ে কাজটা করত রাধু চৌকিদার। মনে আছে, চোদ্দো কী পনেরোটা গোরু আর গোটা-দুয়েক খাসি কুরবানি হত। অর্থাৎ, ওই ক-টা পরিবারই থাকত গাঁয়ে। বড়োজোর আর-দুয়েকটা বেশি।
ইদ=উল-ফিতরে, ইদের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় অনেকের হাতে থাকত চাল-ভর্তি কাঁসার থালা। ওপরে গম আর কাঁচা ছোলা ছড়ানো। দানের উদ্দেশ্যে। ভাবতাম, চালের সঙ্গে মিশিয়ে গম বা ছোলা দেওয়র মানে কী? এতে ফের গম বা ছোলা তো বেছে বেছে আলদা করতে হবে! কিন্তু সেকালের গরিবরা এতই গরিব ছিল যে, এসব কথা ভাবার বিলাসিতা তাদের ছিল না। দান গ্রহণের জন্যে ইদগাহে বেশ কিছু আতুরজন সকাল থেকেই হাজির থাকত। আশপাশের গাঁয়ে নামাজের সময় আধঘণ্টা আগেপিছে হলে সুবিধেই হত তাদের। একাধিক গাঁয়ের দান নিতে পারত। এটা ছিল ফিতরার অতিরিক্ত। এখন আর সেই দানপ্রথাটি নেই।
ইদ। আরবি এই শব্দটির অর্থ: সমবেত হওয়ার দিন; খুশি আর আনন্দ ফিরে আসার মরসুম; যেদিনটি প্রতি বছর আনন্দ ফিরিয়ে আনে। এক কথায় উৎসব।
এমন উৎসব ইসলামে রয়েছে দু-টি। একটি তো আরবি শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে, যার নাম— ইদ-উল-ফিতর; অন্যটি জিলহজ মাসের দশ তারিখে, যার নাম, ইদ-উল-আদহা (আজহা)। এই দুই ইদকে একসঙ্গে বহুবচনে বলা হয়— ইদান।
ইদ-উল-আজহা, বলতে গেলে, ত্যাগের উৎসব। হাদিস খুললে, এমনকি গুগল খুললেও, দিনটির মাহাত্ত্য জ্বলজ্বল করে। ভেসে ওঠে আল্লাহর নির্দেশে ঊষর মরুভূমিতে প্রিয়তম পুত্রকে কোরবানি দেওয়ার দৃশ্য। এমনই মর্মান্তিক, এমনই মহৎ ত্যাগের সে-দৃশ্য যে, মহাকবিরা প্রভাবিত না-হয়ে পারেননি। পৃথিবীর একাধিক সেরা সাহিত্যে তাই এই আখ্যান নানা রূপে বর্ণিত হয়েছে।
তবু, আমরা দিন আনি দিন খাই। আমাদের নাক মাংসের নানা পদের সুগন্ধের জন্য সারাটা দিন ‘উন্মুখ’ হয়ে থাকে।
একটা প্রাণীর শরীরে কী কী প্রত্যঙ্গ থাকতে পারে? অন্তত ভিন্ন-ভিন্ন পদ তৈরির সূত্রে সেসব প্রত্যঙ্গ আমাদের জানা। মগজ ভুনা বা কারি। কলিজা ভুনা। তিল্লিও আছে। থোকা-থোকা চর্বির ভেতর লুকোনো গুর্দু অর্থাৎ বৃক্ক, যাতে রয়েছে প্রতি একশো গ্রামে প্রায় একুশ গ্রাম প্রোটিন। জিভ— অক্স টাং তো দেশে দেশে, নানা রূপে, বিখ্যাত ডিস। ক্ষীরি— মাখনের মতো তার কাবাব। রগরগে ঝোল-সমৃদ্ধ পায়া। বট। ষাঁড়ের ল্যাজের সুপ খেতে কেমন? শিরদাঁড়ার মাংসের ফালি থেকে রুপোলি রেজালা। সিনার হাড়গুলোও যেন নরম আর চর্বিতে মোড়া।
‘ট্রপিক অব ক্যানসার’-এ হেনরি মিলারের এরকম একটা লাইন আছে— তাহলে মাংসই মাংসের কাছে আসুক!
পৃথিবীতে এমন একটাও জাতি কি আছে, যারা পশুবলি দেয় না? মাংসের প্রয়োজনে এই বলি-প্রথার চল শুরু সেই নবপলীয় যুগে, যখন শিকার ছেড়ে মানুষ কৃষিসভ্যতার দিকে ঝুঁকেছে। সে-প্রায় আট হাজার বছর পেরিয়ে গেল।
২
পশ্চিম আকাশে, দিগন্তের একটু ওপরে, অস্তগামী সূর্যের লালাভ পটভূমিকায় ক্ষীণ চাঁদটিকে একবার দেখতে পাওয়া আমাদের মতো গ্রাম্য বালক-বালিকার কাছে ছিল একটি আবিষ্কার-বিশেষ। নানা বাধাবিপত্তিতে প্রতি বছর তো আর সে-চাঁদের সাক্ষাৎ মিলত না। তাই, চাঁদ না-দেখার ব্যর্থতার পর থেকে, অর্থাৎ সন্ধ্যায়, চেষ্টা চলত আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের খবর শোনার। ঢাকা বলেছে? কিন্তু, সে তো পাকিস্তান। ওরা দেখলে তো আমাদের ইদ হবে না। দেখতে হবে এই দেশেই, সে দিল্লিতে হোক অথবা আরো দূরের বোম্বাইতে। ইদ হবে দেশজুড়ে, আনন্দে মিশবে সারা দেশ, তবেই না উৎসব!
চাঁদের খবর তো হল— সবাই নিশ্চিন্ত। কিন্তু ছোটোরা? তাদের চঞ্চলতা যেত বেড়ে।
সব বছর যে এরকম একসঙ্গে ইদ পালন হয়, এমন তো নয়। কোনো কোনো বছর ইদের দিন নির্ধারণ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তবু চেষ্টাটা থাকে এমনই। ইদের চাঁদের সন্ধ্যায় আর ইদের দিন রেডিয়োর নব ঘুরিয়ে আমরা খুঁজতাম কোথাও কোনো অনুষ্ঠান যদি হয়। এত খুশি, এত বড়ো উৎসব-- গান তো অবিরাম হওয়ারই কথা; ইদের নানারকম গান। বা, অন্য কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান। নাটক। আমাদের ইদ তো কোনো-একদিন শুরুই হয়েছিল সেই বিখ্যাত গানটি দিয়ে— ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’!
কলকাতা কেন্দ্র থেকে এতটা পাওয়া যেত না। হয়তো কয়েক মিনিটের একটা অনুষ্ঠান হল, তাতে শুধুই ধর্মের কথা আর ভারী ভারী সব উপদেশবাণী। কোনো বছর-বা একটুখানি দুর্বল প্রাণের গান বা গীতিআলেখ্য— তাও মিনিট পনেরো। অভিমান হত খুব। বোঁ করে কাঁটাটা ঘুরিয়ে দিতাম ঢাকায়। অমনি শুরু হত একের পর এক উচ্ছ্বাসগীতি। বাঁধনহারা। যেমনটা আমরা চাইতাম আমাদের ছোটোবেলায়, সেই উনিশশো ঊনষাট ষাট কি একষট্টির দিনগুলোতে। কোনো বছর এমন হত, পূর্ব পাকিস্তানে ইদ ঘোষণা হয়েছে আর সারা দিনব্যাপী রেডিয়োতে প্রচার হচ্ছে ইদের রকমারি অনুষ্ঠান। আমরাও শুনছি, কিন্তু সব কেমন পানসে লাগছে। সেদিন তো আমাদের ইদ হয়নি, বড়োরা সবাই রোজা রেখেছেন যে! রোজা থাকলে আর ইদ কীসের। সেমাইয়ের পায়েস, পিঠে-পুলি, হালুয়া— এসব সারাদিন ধরেই খাওয়ার আয়োজন না থাকলে আর ঘনঘন খাওয়ার পীড়াপিড়ি না থাকলে ইদ টেরই পাওয়া যায় না!
আজকাল রেডিয়ো-টিভির ভরসায় থেকে ছোটোরা আর মন খারাপ করে না। তাদের দাদারা পাড়ায় পাড়ায় নিজেদের আনন্দ তৈরি করে। নানান খেলাধুলোয়, তাতে ক্যুইজও থাকে, বাংলার প্রায় প্রতিটি এলাকা ইদের দিনে মুখরিত হয়। বাংলা ব্যান্ডের গানের তালে এখনকার বাঙালি তরুণদের ইদ উদযাপিত হচ্ছে। প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে কোথাও রাত দশটা বেজে যায়। বাসি নবান্নের মতো বাসি ইদ তো আর পালন করার রেওয়াজ নেই। তাই যত রাতই হোক, সব প্রতিযোগিতা বা সব অনুষ্ঠান সেদিনই শেষ করতে হবে।
৩
কিন্তু, ইদের শুভেচ্ছা বিনিময়-পর্ব এখন আর শেষ হতে চায় না। ওয়াটসঅ্যাপে, ফোনে, মেসেঞ্জারে, ফেসবুকে শুভেচ্ছার ভিড়। এটা লক্ষ্য করার যে, দেশে দেশে যেমন অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে অন্যের নৈকট্যলাভের প্রতি আগ্রহ।
অথচ ওয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকের আগে দুই ইদের সকালে একটা ফোন আসত। বাড়ির সবার খোঁজখবর নিতে, ছোটোদের নতুন পোশাকের খবর নিতে, ইদের স্পর্শ পেতে। এই ভাবে কিছুক্ষণ সঙ্গ দেওয়া-নেওয়া চলত। আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছার বদলে সে ছিল এক মধুর বন্ধন।
এক ইদের সকালে কবি-বন্ধু নির্মল হালদার শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর জানতে চাইল, আর কার ফোন পেয়েছি। প্রতি বছরের মতো এবারো শঙ্খ ঘোষ। শুনে তার বিস্ময়— তাহলে তো ওঁকেও ইদ মোবারক জানাতে হয়! সেই থেকে শঙ্খবাবুর, নির্মলের আর আমার একটা ইদ-বৃত্ত গড়ে ওঠে।
শঙ্খ ঘোষ আজ আর নেই। তবু তাঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সে-বৃত্ত বেড়ে-বেড়ে যাচ্ছে।
তা বাড়ুক। ইদ-উল-আজহার দিনে এইটুকু কামনা তো আমরা করতে পারি, শুভেচ্ছা বিনিময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমস্তরকমের সহিংসতা যেন কমে যায়।