দেখানো হচ্ছে সাম্প্রতিক আন্দোলনের নানা ভিডিও, বাজছে র্যাপ গান ‘কথা ক’ আর ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’।
Published : 19 Aug 2024, 08:59 AM
জুলাইয়ে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে রক্ত ঝরতে শুরু করে, অনেকের মতই বেদনায় মুষড়ে পড়েন তাহসিন আহমেদ আকিব। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এ শিক্ষার্থী সেইসব দিনের অনুভূতি ফুটিয়ে তোলেন কার্টুনে। কোনো কোনোটি শেয়ার করেন ফেইসবুকে, প্রতিবাদ জানান ছাত্র হত্যার।
প্রকৃতি শোনা বা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিলেও আকিব চোখে যা দেখেছেন তাই ফুটিয়ে তুলেছেন প্রতিবাদী রেখায়; শামিল হয়েছেন ‘কার্টুন বিদ্রোহ’ প্রদর্শনীতে।
ঢাকার পান্থপথের দৃক গ্যালারিতে শুক্রবার শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ২৩ অগাস্ট পর্যন্ত, প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এ আয়োজন।
তাহসিনের আঁকা কার্টুনে দেখা যায়, রক্তের নদীতে অর্ধেক ভেসে রয়েছেন শেখ হাসিনা ও কাগজের নৌকা। পরের কার্টুনে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবির ‘১’ সংখ্যা দেখা গেছে, যার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
তৃতীয় কার্টুনে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাথায় বসে পিটিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করতে দেখা গেছে শেখ হাসিনাকে। আর চতুর্থ ছবিতে শেখ হাসিনাকে কান্নায় নাক মুছতে দেখা গেছে, জানালার আড়ালে দেখা যায় খালেদা জিয়াকে, আর টিভি পর্দায় হাসিমুখে শপথ নিতে দেখা যায় মুহাম্মদ ইউনূসকে।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের ধারাবাহিক বর্ণনা ক্যানভাসে তুলে ধরা আকিবকে পাওয়া গেল প্রদর্শনীস্থলেই। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে পাশে থাকা মা লিপি আক্তার জানালেন, আকিব কিছু শুনতে পারে না; স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারে না।
পরে মায়ের সহযোগিতা নিয়ে কার্টুনগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে আকিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এভাবে মানুষ মারবে কেন? এভাবে মানুষকে মারার কোনো অধিকার নেই।
“মানুষ যখন শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বলেছে, তখন তিনি গুলি চালাতে কেন বললেন পুলিশকে? তিনি এভাবে মানুষ মেরে ঠিক কাজ করেননি। এজন্যই আমি এই কার্টুনগুলো এঁকেছি।”
লিপি আক্তার বললেন, আন্দোলনের দিনগুলোতে প্রতিদিনই ঘরে বসে নানা ছবি এঁকেছে আকিব।
“ছবি আঁকার মধ্য দিয়েই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে সে।”
দৃক, ইআরকি ও বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এ প্রদর্শনীতে দেখা গেল খুলনার এক পরিবারকে। হানিন আর হানছাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন মা আফরা তাশফি।
এই মা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার সন্তানেরা তো ছোট। এখন হয়তো বুঝবে না। কিন্তু এই ছবিগুলো হয়তো মনে গেঁথে থাকবে।
“ওরা এখানে এসে ছবিগুলো দেখে এত প্রশ্ন করছে, আমিও ওদের বলার চেষ্টা করছি জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা।”
প্রদর্শনীতে কিছু পানির বোতল ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়, আর বোতলের গায়ে লেখা ‘মুগ্ধ’। উত্তরায় আন্দোলনকারীদের পানি আর বিস্কুট দিয়ে সহায়তা করতে গিয়ে প্রাণ হারানো মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের স্মরণে এই বোতল তৈরি করা হয়েছে।
গ্যালারির একপাশে টিভি পর্দায় দেখানো হচ্ছিল ১৬ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত আন্দোলনের নানা ভিডিও। আর গ্যালারিতে বাজছিল আন্দোলনের সময় তৈরি করা র্যাপ গান ‘কথা ক’ ও ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’।
প্রদর্শনীস্থলেই একটি টেবিলে রাখা ছিল কাগজ আর পেন্সিল। মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী নুজহাত তাবাসসুমকে দেখা গেল ছবি আঁকতে, পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মা সামিনা তাবাসসুম।
কী আঁকছ? নুজহাত বলল, “মন্ত্রী পলকের ছবি আঁকছি। তিনি ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে অনেক মিথ্যা কথা বলেছেন। এজন্য রাসেল ভাইপারের মতো করে পলকের ছবি আঁকতেছি।”
সরকার পতনের পর স্কুলের দেয়ালে চিত্রকর্ম আঁকার কথাও জানাল এই স্কুল পড়ুয়া।
উপচেপড়া ভিড়
শনিবার বিকালে প্রদর্শনীতে গিয়ে উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। পান্থপথের দৃক ভবনের প্রবেশ গেইট থেকেই ছিল দীর্ঘ লাইন। জায়গার তুলনায় মানুষ বেশি হওয়ায় প্রদর্শনী দেখতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে অনেককে।
প্রদর্শনীটি ভবিষ্যতে খোলা জায়গায় করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান কিউরেটর রেজাউর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত মানুষ কার্টুন পছন্দ করে এবং এই প্রদর্শনীতে আসছে যে আমাদের জায়গাটি ছোট হয়ে গেছে। আমাদের ইচ্ছা আছে, সামনে আরও বড় পরিসরে কার্টুন প্রদর্শনী করার।”
এই প্রদর্শনী জুলাই মাসের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দিনলিপি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখানে যে কার্টুনগুলো রয়েছে, সবই জুলাইয়ে উত্তাল সময়ে আঁকা। ফলে এই প্রদর্শনীতে সেই চিত্রটা সবাই দেখতে পাবেন।”
রেজাউর বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের কথা বলা বা সমালোচনা করার জায়গাটি বন্ধ হয়েছিল, যার প্রভাব শিল্পেও পড়েছিল। অনেকেই কার্টুন এঁকেছেন, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেননি। এবার আন্দোলনের সময়টাতে সবাই সেই ভয়কে জয় করে এগিয়ে এসেছেন।
“অনেক কার্টুন এঁকেছেন কার্টুনিস্টরা। তারা আঁকার মধ্যদিয়ে প্রতিবাদী দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় কার্টুন প্রকাশ করে অসংগতিগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে কার্টুনিস্টদের একটা সম্পর্কও তৈরি হয়েছে।”
‘কার্টুনও জ্বলে উঠতে পারে’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে প্রকাশিত সবগুলো কার্টুন তুলে আনা সম্ভব নয় মন্তব্য করে আয়োজকরা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, “তবে যে কার্টুনগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি, আবার আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ছাত্র আন্দোলনের ওই জ্বলজ্বলে সময়টাতে।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- “দেশের প্রতিটি মানুষ এই মুহূর্তে রাজনীতি সচেতন, প্রতিটি আড্ডা রাজনৈতিক আলাপে মুখর। মানুষ প্রাণ খুলে কথা বলছে, অন্যের মতামত গ্রহণ করছে, উপভোগ করছে বাকস্বাধীনতা। অথচ এই কিছুদিন আগেও দেখা যেত মত প্রকাশে কী অদ্ভুত সংকোচ।
“রাজনৈতিক ঘটনা জাতীয় জীবনে ঘটে চলেছিল অহরহ, কিন্তু এ নিয়ে কার্টুন একেবারে হাতেগোনা। যারা করে গেছেন, তাদেরও মাথায় রাখতে হয়েছে অনেক আশঙ্কা, ভীতি।”
কিন্তু সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেছে মন্তব্য করে আয়োজকরা বলেন, “যতই ভয় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা জয় করে জনতা হয়ে উঠছে ততই দুর্দম। আর ভয়কে জয় করলে, মত প্রকাশে অসংকোচ হয়ে উঠলে কার্টুন কেমন জ্বলে উঠতে পারে, এবার আমরা দেখেছি। প্রথম আর্টওয়ার্ক এসেছে কার্টুনিস্টদের কাছ থেকেই।
“প্রথিতযশারা তো এঁকেছেনই, প্রাণখুলে তাতে যোগ দিয়েছেন নবীনরা। কেউ প্রকাশ করেছেন ব্যক্তিগত সোশাল মিডিয়ায়, কেউ এঁকেছেন সংবাদ মাধ্যমের পাতায়। কেউ নামে এঁকেছেন, কেউ বেনামে এঁকেছেন, অসংখ্য মানুষের শেয়ারে তা ছড়িয়ে গেছে অন্তর্জালে।”