Published : 29 Apr 2016, 05:33 PM
রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর বিখ্যাত শিশুতোষ গল্প দ্য জাঙ্গল বুক আমাদের সকলেরই হৃদয় ও কল্পনা জুড়ে কম বেশি জায়গা করে আছে। সেই কবে ১৮৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় দ্য জাঙ্গল বুক। বনের ভেতর নেকড়ে পরিবারের কাছে বেড়ে ওঠা একটি শিশুর গল্প আজও এই একবিংশ শতকের ব্যস্ত আধুনিক শহুরে মানুষদের মাতিয়ে রেখেছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া ওয়াল্ট ডিজনি প্রযোজিত চলচ্চিত্রটি যা নিয়ে এই মুহূর্তে মজে আছে গোটা পৃথিবী, ছেলে বুড়ো সবাই। তবে দ্য জাঙ্গল বুক'কে নিয়ে এটাই প্রথম চলচ্চিত্র নয়। এর আগে এই ওয়াল্ট ডিজনি পিকচারস বানিয়েছিল এনিমেটেড মিউজিক্যাল কমেডি ফ্লিম 'দ্য জঙ্গল বুক'। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬-এর এপ্রিলে মুক্তি পায় আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর চলচ্চিত্রটি। শুধু কি তাই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় এ পর্যন্ত দ্য জাঙ্গল বুক ও এর প্রধান চরিত্র মোগলিকে নিয়ে এখন পর্যন্ত তৈরি হয়েছে বহু কার্টুন ও এনিমেটেড শো, কমিকস, টিভি সিরিজ কত কিছু। এই শিশুতোষ গল্পটি কেবল সাহিত্যক্ষেত্রেই অনন্য নয় বরং একে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়িক মুনাফা লাভের কার্যক্রম। সম্ভবত মানুষের রক্তে সুপ্ত হয়ে থাকা আদিম বন্যতাই তাকে বার বার নিয়ে যায় জঙ্গলে বেড়ে ওঠা মোগলি ও তার পশুবান্ধব বালু, বাঘেরাদের কাছে। মানুষ যেন নিজেকে ফিরে পায় মোগলির মাধ্যমে। এমনকি শিল্পীর চোখেও বার বার কল্পিত ও অংকিত হয়েছে মোগলি ও দ্য জাঙ্গল বুক-এর অন্যান্য চরিত্র এবং ঘটনা।
আরও মজার ব্যাপার হলো দ্য জাঙ্গল বুক-এর প্রথম সংস্করণের অলংকরণ করেছিলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর পিতা জন লকউড কিপলিং।
সম্প্রতি দশ জন শিল্পী ও আঁকিয়ে দ্য জাঙ্গল বুক থেকে তাদের প্রিয় দৃশ্য ও চরিত্রগুলিকে নতুনরূপে সৃষ্টি করার রঙিন চেষ্টা করেছেন। এক নজর দেখা যাক তাদের সেই বর্ণিল শিল্পকর্ম।
লেখক ও অংকনশিল্পী সারাহ ম্যাকইন্টায়ার ও ফিলিপ রিভ যৌথভাবে এই ছবিটি আঁকেন। ফিলিপ বলেন: " দ্য জাঙ্গল বুক-এ প্রাণীরা গৃহপালিত কোন প্রাণী নয় যে জামা-কাপড় পড়বে, মোজা পড়বে । যেমনটি অন্যান্য বইতে দেখা যায়। বালু ও বাঘেরাকে হিংস্র ও বিপজ্জনক মনে হলেও তারা মোগলিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। মোগলি ওদের সাথে শিকার ও খেলা করে। আবার কখনো একসাথে ঘুমায়। মোগলি কখনো দুষ্টু বানর দলের আক্রমণে আক্রান্ত হলে বালু বাঘেরাই তাকে উদ্ধার করে। ফিলিপ আরো বলেন, সারাহ যেভাবে তাদেরকে একত্রে আরামদায়কভাবে অবস্থানে চিত্রিত করেছেন, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। তবে একটি শিশু যেভাবে কাজটি করতে পছন্দ করবে আমি সেভাবেই করেছি।
চিত্রালংকরণ: সারাহ ম্যাকইন্টায়ার।
অংঙ্কনশিল্পী বিল ব্র্যাগ বলেন: "কিপলিং- এর দ্য জাঙ্গল বুক-এর কিছু বিস্ময়কর অন্ধকারের চিত্রায়ন ছিল। আমি সেই আবহটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এটি আঁকতে গিয়ে বেশ কয়েকমাস আমার অ্যাপালোচিয়ান পর্বতমালায় কাটানো স্মৃতির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই জঙ্গলটি রাতের বেলা জীব-জন্তুর কোলাহলে মুখরিত হয়। যদিও কিপলিং-এর দ্য জাঙ্গল বুক ভারতীয় আবহে তৈরি । তারপরেও আমার মনে হয় তিনি যখন, অ্যাপালোচিয়ান সবুজ পর্বতমালায় কাটিয়েছেন তখন এ গল্পগুলি লিখেছেন"।
চিত্রণঃ বিল ব্র্যাগ
শিল্পী ইয়ান অ্যান্ড্রু পরিত্যক্ত টাউট কোয়ারী স্কাল্পচার(ভাস্কর্য) পার্ক ও তার ডরসেট বাড়ির কাছাকাছি পরিত্যক্ত খনি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। "রহস্যময় পারলৌকিক সে স্থানে নিজেকেই হারিয়ে ফেলি। আমি দ্য জাঙ্গল বুক-এর চরিত্রগুলি ভূ-প্রকৃতির অংশ হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছি। পাথরের আকৃতিতে তাদের এভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি যে দেখলে বিভ্রম লাগবে"। ইয়ান সম্পূর্ণভাবে এটি এঁকেছেন পেন্সিল দিয়ে এবং খনির আকরে সংখ্যার চিহ্নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
চিত্রণঃ ইয়ান অ্যান্ড্রু
ভারতীয় চিত্রশিল্পী ও প্রচ্ছদশিল্পী প্রভা মাল্য বললেন, " এটি একটি মা নেকড়ে, নাম রক্ষা। সে মোগলির প্রথম মিত্র। শের খানের বিরুদ্ধে মোগলির পক্ষে আজীবন লড়াই করতে প্রস্তুত। হিংস্রতা, দৃঢ়তা, সত্যিকারের শক্তিমত্তায় সে প্রজ্জ্বলিত। যুদ্ধ জয়ে সদা প্রস্তুত। আমি রক্ষার এমন দৃঢ়তা উপভোগ করি। এটি কোনো পেন্সিলের নির্দেশক ছাড়াই শুধুমাত্র কালি দিয়ে আঁকা। দৃশ্যের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা বারবার ফুটে উঠেছে। আর এজন্যই এত বাস্তব মনে হয়"।
চিত্রনঃ প্রভা মাল্য
অ্যানিমেটর ও অংকনশিল্পী লেসলি বার্নস বলেন: "আমার প্রিয় চরিত্র হচ্ছে বাঘেরা- দ্য প্যান্থার।আমি তার দৈর্ঘ্য, অলসতা ও রাজকীয় ভাবভঙ্গি পছন্দ করি। সব সময় মনে হয় কিছু একটা আছে ওর ভেতর। তাই আঁকার জন্য ওকেই বেছে নিয়েছি। গল্পে বাঘেরা আর মোগলির মধ্যে খুব ভাল বন্ধুত্ব। তাই ছবিতে তাদেরকে জঙ্গলের ভেতর একত্রে নিয়ে এসেছি"।
চিত্রনঃ লেসলি বার্নস
ব্রিটেনের চিলড্রেন'স লরিয়েট ক্রিস রিডেল। কিপলিং'এর প্রিয় কিম্ভুত ভাল্লুক বালুর চরিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। মোগলির প্রতি বালুর ভালবাসা ও যত্ন তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এবং তাঁর লেখা গল্প ও চিত্রে এমন চরিত্র এসেছে।
চিত্রণঃ ক্রিস রিডেল
"বিপদ আর শিহরণের আরেক নাম শের খান"! বললেন লেখক ও প্রচ্ছদশিল্পী কেভিন ওয়ালড্রন। তিনি আরো বলেন, "নেকড়ের গুহার মুখে বসে আছে শের খান। মোগলিকে তার কাছে হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে। সন্তানের ভাগ্য জঙ্গলের হিংস্র হত্যাকারীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে"! এরকম একটি মুহূর্তকে ছবিতে ধরে রেখেছি।
চিত্রনঃ কেভিন ওয়ালড্রন
চারুশিল্পী জিল ক্যাল্ডার 'মোগলিস ব্রাদার্স'-এর থেকে একটি দৃশ্য বেছে নিয়েছেন যেখানে বাঘেরা ও মোগলি 'লাল ফুল'-এর আগুন নিয়ে কথা বলছে। মোগলি যখন স্নেহভরে বাঘেরার গলা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে সে দৃশ্যটি আমার বিশেষ পছন্দ। আমার একটি কালো কুকুর আছে আর আমি মাঝে মাঝে ওর গলা জড়িয়ে বসে থাকি। মূলতঃ বাস্তব জীবনের সেই ভালোলাগাটাই ছিল এরকম দৃশ্য আঁকার অনুপ্রেরণা"।
চিত্রনঃ জিল ক্যাল্ডার
শিল্পী রবার্ট জি ফ্রেশন বলেন: দ্য জাঙ্গল বুক-এর জগতটা ছোট বলেই সব সময় আমি আকৃষ্ট হই। মোগলি এন্ড কোং- এর সাথেই থাকি। আমার মনে অন্য কিছুই নেই শুধুমাত্র জঙ্গলের গভীরতা আর অন্ধকার ছাড়া। বাঘেরার সাথে মোগলির আলাপ, দর্শকদের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। বাঘেরা এখানে প্রায় অদৃশ্য। আর মোগলি সন্ধ্যার আবছা আলোয় আলোকিত। আমার চিন্তা ছিল এমন একটি দৃশ্যের। যেটি আমরা একটু সময় নিয়ে দেখব। যখন ওরা নীরবে, চুপিসারে জঙ্গলের গভীর ও গোপনীয় স্থানে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
চিত্রণ- রবার্ট জি ফ্রেশন
শিশুতোষ লেখক ও শিল্পী মার্টা অ্যাটেস বললেন: "শিশুকাল থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল জঙ্গলে থাকা আর জীবজন্তুদের সাথে বন্ধুত্ব করা। আমি দ্য জাঙ্গল বুক পড়ি, তখন মোগলির সব রকমের রোমাঞ্চকর ঘটনা দেখে আমার হিংসা হতো। বালুর সঙ্গে মোগলি কী কী শিখেছিল তাই বলছে বাঘেরাকে–এমন ছবি এঁকেছি। এখানে জঙ্গলের নানা ভাষায় মোগলি কথা বলতে শেখাতে পারায় তাকে বেশ গর্বিত মনে হচ্ছে। যদিও বাঘেরা নিশ্চিত না- সে বিশ্বাস করে মোগলিকে জঙ্গলের সব বিপদ থেকে রক্ষা করতে এটাই যথেষ্ট নয়। বিশেষত শের খানের হাত থেকে…"
চিত্রন: মার্টা অ্যাটেস।
এভাবেই মোগলি ও তার সাথীরা আমাদের স্বপ্ন, কল্পনা ও ভাবনার জগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বিশেষ করে শিশুদের মনোজগতে বড় একটি আলোড়ন তৈরি করতে সক্ষম দ্য জাঙ্গল বুক। বন জঙ্গল সবুজের প্রতি ভালোবাসা, জঙ্গলের প্রাণীর প্রতি মায়া। মানুষের সাথে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক এসবই উঠে এসেছে দ্য জাঙ্গল বুক-এ। রুডইয়ার্ড কিপলিং নিজে বর্ণবিদ্বেষী হিসেবে সমালোচিত হলেও, শ্বেতাঙ্গ নয় এমন এক বালককে ঘিরে তাঁর এই অনবদ্য কাহিনী আজো সাদা কালো সব মানুষের মন জয় করে রেখেছে। হয়তো ভবিষ্যতে এই দ্য জাঙ্গল বুক নিয়ে মানুষের আগ্রহ আর ভালবাসা আরো বাড়বে। কেননা, দ্য জাঙ্গল বুক-এ আমরা যেমন জঙ্গল আর প্রাণী দেখতে পাই, তা ভবিষ্যতে আরো বিরল হয়ে উঠবে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
আর্টস বিভাগে প্রকাশিত বিপাশা চক্রবর্তীর আরও লেখা: