Published : 13 Nov 2024, 10:17 PM
আজ ১৩ নভেম্বর। লেখক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন।
অন্য সবার মতো করে আমি বলতে পারিনা যে আমার ছোটবেলা কেটেছে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে। কারণ হুমায়ূনের বই আমি প্রথম পড়া শুরু করেছি তার মৃত্যুর বছর দুয়েক পর। 'রূপার পালঙ্ক' ও 'নন্দিত নরকে' দিয়ে শুরু করেছিলাম। কিছুদিন আগে শেষ যে বইটা পড়েছি তা হলো 'রুমালী'।
২০১৪ থেকে ২০২৪—সুদীর্ঘ এই সময়ে গুটিকয়েক বই ছাড়া তাঁর বাকি সব বই পড়া হয়েছে। কিছু বই পড়া হয়েছে বারবার। কিছু বই পড়ার ইচ্ছা জেগেছে বারবার। সেসব বইয়ের কথা বলবো। তার আগে বলে নিই কেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ আমার প্রিয়! কেন আমি তাকে ভালোবাসি!
ছোট থেকেই আমার গল্পের প্রতি টান ছিলো। পড়তে খুব ভালোবাসতাম আমি। হাতের কাছে খুব বেশি বই ছিলো না। স্কুলের পাশে লাইব্রেরি গুলোতে ৫-১০ টাকায় ছোট ছোট বই পাওয়া যেত। ভূতের গল্পের বই, হাসির গল্পের বই—এসব। তাই পড়তাম। একই গল্প বারবার পডতাম। আমার নানা আমাকে খুব গল্প বলতেন। আমি শুনতাম। এভাবেই গল্প ভালো লাগতে শুরু হয়। এভাবেই আমি 'পড়তে' শুরু করি। 'পড়া'কে ভালোবাসতে শুরু করি। তখন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বাংলা বইয়ের সাথে একটা বাড়তি বই দিতো। 'আনন্দপাঠ'। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যখন আমি এই বইটা প্রথম হাতে পেলাম, আমার খুশি আকাশছোঁয়া হয়েছিল কিনা আমার মনে নেই তবে পড়ার জন্য আরোও বেশি গল্প পাওয়া গিয়েছিল। স্কুল জীবন পার করেছিলাম এভাবেই। হাতের কাছে যেসব গল্প পাওয়া যেত তাই পড়তাম। যখন কলেজে উঠি তখন আমি দ্বিতীয়বারের মতো বই মেলায় যাই। হুমায়ূন আহমেদের বই কিনি। 'রূপার পালঙ্ক', 'নন্দিত নরকে'। আমি বই দুটো পড়লাম। এরপর আরোও বই কিনলাম, পড়লাম; এক সময় হিমু, মিসির আলী ও শুভ্রের সব গল্প পড়ে ফেললাম। এবং আমি আমার এই 'পড়তে' ভালোবাসা ব্যাপারটা নিয়ে খুব আনন্দ পেলাম। কারণ আমি হঠাৎ করে ভীষণ সুন্দর মায়াময় গল্পের এক জগতের দেখা পেলাম। এমন এক জগত যার দেখা আমি অন্য কোনো লেখকের গল্প-উপন্যাসে পেলাম না। সুন্দর করে অনেকেই লেখেন। আমার প্রিয় লেখক আরোও অনেকেই। কিন্তু 'হুমায়ূন আহমেদ' আলাদা। তিনি প্রচন্ডরকম ভাবে প্রিয়। তাঁর প্রতি ভালোবাসা খুব প্রবল।
তাঁর লেখায় যে মায়া তা আর কোথাও নেই। কাঁদতে ইচ্ছে করলে খুব অদ্ভুতভাবে হুমায়ূন পড়তে ইচ্ছে হয়। এটাই তাঁর লেখার জাদু। তিনি মানুষকে তাঁর লেখা দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখতে পেরেছিলেন। তার গল্পের কাহিনি, তার বইয়ের লাইন মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছি—ঠিক এতোটাই মোহাচ্ছন্ন হয়েছিলাম।
২০১৪ এর কোনো একদিনে হুমায়ূন আহমেদের লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। আমি মুগ্ধতা নিয়ে তার বই পড়ি। বই পড়ে যে ভীষণ কষ্ট পাওয়া যায় এবং সেই কষ্ট দিনের পর দিন আনন্দের সাথে মনে লালন করা যায় তা আমি জেনেছি হুমায়ূনের বই পড়ে।
তার বই না থাকলে অনেক কিছুই হতো না। তাঁর লেখা পড়ে পড়ে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা এসেছে, আগে থেকেই যে ভালোবাসা ছিলো তা বেড়েছে। অবাক মনে হলেও, তাঁর লেখা পড়েই বিশ্বসাহিত্য নিয়ে জানার আকাঙ্ক্ষা হলো। তিনি আমাকে আরোও বেশি করে গল্প-উপন্যাসকে ভালোবাসতে শেখালেন, আমাকে সাহিত্যে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করলেন, ছোট ছোট বিষয়ে সৌন্দর্য খুঁজতে তিনিই আমাকে শেখালেন। নানাবাড়ি যখন যেতাম, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতাম কিন্তু তখন তো আমি বৃষ্টির এই শব্দের সৌন্দর্য বুঝিনি। হুট করে একদিন জানলাম এই সামান্য জিনিসও কেমন অপার্থিব সুন্দর। জোছনা রাতে নানাবাড়ির উঠোনে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখে মনে হতো কি সুন্দর! কিন্তু সেই সুন্দরের সীমাটুকু বুঝতাম না। 'অবাক জোছনা' কি—তা জানতাম না। আকাশের চাঁদের দিকে তাকালে চাঁদের আলো যে গায়ে মাখতে ইচ্ছে করতে পারে তাও জানা ছিলো না। হাত বাড়িয়ে যে চাঁদের আলো ধরতে ইচ্ছা করবে, ধরতে না পেরে কান্নাও চলে আসবে—তাও কি আমি কোনোদিন জেনেছিলাম?
হুমায়ূন আহমেদের লেখার কথা বলতে গেলে একটা বিষয় উল্লেখ না করে পারা যায় না। তাঁর বই পড়ে নতুন নতুন অনেক বইয়ের নাম জেনেছি ও পড়েছি; সেই সাথে জেনেছি বিভিন্ন গান ও সিনেমার কথা, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বিভিন্ন উক্তির কথা। লেখায় তিনি প্রচুর রেফারেন্স ব্যবহার করতেন—যা ছিল অসামান্য একটি বিষয়।
আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই রয়েছে। Jac Vanek এর একটি কথা আছে—
"You are the books you read, the films you watch, the music you listen to, the people you meet, the dreams you have, and the conversations you engage in. You are what you take from these. You are the sound of the ocean, breath of the fresh air, the brightest light and the darkest corner. You are a collective of every experience you have had in your life. You are every single second of every day. So drown yourself in a sea of knowledge and existence. Let the words run through your veins and the colors fill your mind until there is nothing left to do but explode. There are no wrong answers. Inspiration is everything. Sit back, relax, and take it all in."
প্রথম বাক্যটিই "you are the books that you read"— এ কথাটা আমার ক্ষেত্রে একদম সত্য হয়ে গিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের কারণে এবং তার পরের বাক্যগুলোও আমার ক্ষেত্রে সত্য হয়েছে হুমায়ূনের কারণেই।
এই যে আমি ভালোবাসি, সুন্দরের খোঁজ করি, বই পড়ি, সিনেমা-নাটক দেখি, গল্প শুনি, রেডিওতে গান শুনি, আকাশ দেখি, গাছ ভালোবাসি, ছবি তুলি, লিখতে চেষ্টা করি, এই যে আমার 'আমি'—সব কিছুতেই রয়েছে হুমায়ূনের গল্পের ছোয়া। জীবনকে দেখতে ও বুঝতে আমাকে তিনিই শিখিয়েছেন। আমি ভাবি, তাই আমি আছি। ভাবতেও আমি শিখেছি তার গল্প পড়ে।
তার গল্প উপন্যাসের সংখ্যা তো কম নয়। প্রিয় তালিকায়ও তো কম বই স্থান পায়নি। আজ সব বইয়ের কথা বলা না গেলেও ৫ টি বইয়ের কথা তো বলাই যায়।
সবার আগে বলা যাক 'আজ আমি কোথাও যাব না' বইয়ের কথা—দুজন মানুষের আমেরিকা যাওয়া নিয়ে স্বপ্ন দেখার গল্প, সেই স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প, উদারতার গল্প, স্বপ্ন পূরণের গল্প। আমরা স্বপ্ন দেখি। একের পর এক স্বপ্নভঙ্গের পরও আমরা স্বপ্ন দেখি, নিজের স্বপ্নের কারণে আমরা উদার হতে ভুলিনা, স্বপ্ন যখন পূর্ণ হয় তখন আমার সাথে সেই একই স্বপ্ন দেখা মানুষটাকে আমরা মনে করি—এটুকুই তো বিষয়; এই গল্পের দেখা বাস্তবে মেলে না, তাই বারবার এই বইয়ের কাছে আমি ফিরে যেতে চাই।
'যদিও সন্ধ্যা' নামে হুমায়ূন আহমেদের একটা বই আছে। বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল 'blissful sorrow' যে ব্যাপারটা—তা সম্পূর্ণটাই তিনি এই বইয়ে ঢেলে দিয়েছেন। বাবা-ছেলের সম্পর্ক, ছবি আঁকার ডিটেইল, বিষন্নতা, একাকীত্ব—সব মিলে এই বই। এ বইটাতে একটা কথা আছে—
"অভ্যস্ত জীবনে হঠাৎ ঘূর্ণির কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই সবার নিজের জীবনে থাকুক। প্রতিটি জীবন নদীর মতো। একটা নদীর সঙ্গে আরেকটা নদীর মিলে-মিশে যাওয়া খুব খারাপ ব্যাপার।"
জীবনের এই পর্যায়ে এসে এর মতো সত্যি আমার আর কিছুই মনে হয়না।
'অপেক্ষা' বইয়ের সুপ্রভার কথা আমার মনে কেন যেন গেঁথে থাকে। একজন মানুষের অপেক্ষায় বাকি সব মানুষের জীবন এক ধরনের স্থিরচিত্র হয়ে যাওয়ার পক্ষে আমি নই। আমি হারিয়ে যাওয়া কিংবা ইচ্ছা করে ফিরে না আসা সেই মানুষের জন্য কাঁদতে পারি, তার জন্য আমার অপেক্ষা চলমান থাকতে পারে, কিন্তু নিজের জীবন বা অন্যের জীবনকে স্থিরচিত্র বানিয়ে নয়! তবুও তাইই ঘটে। আমরা দেখি কেউ প্রচন্ড কষ্ট পেলে সে তার আশেপাশের সবাইকেও তার মতো কষ্টে দেখতে চায়। সে হারিয়ে যাওয়া এক মানুষের অপেক্ষা করতে থাকে ওদিকে তার জীবন থেকে জলজ্যান্ত একটা মানুষ হুট করে নাই হয়ে যায়। কিন্তু মৃত মানুষ তো আর ফিরে আসবে না ভেবে তার অপেক্ষা কেউ আর করেনা। আমাদের সব অপেক্ষা শুধু তো জীবিতদের জন্যই।
'মেঘ বলেছে যাব যাব' বইটা আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর একটা। বেকার যুবক হাসান ও তার পরিবার-প্রিয়জনের গল্প হলো 'মেঘ বলেছে যাব যাব'। এ গল্পে তিতলী আছে, রীনা আছে। এ গল্পটা চিত্রলেখারও। এদের সবার গল্পকে নিজের গল্প মনে হয়, সবার কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে হয়। জীবন তাও থেমে থাকে না। সে তো নদীর মতোই বহমান।
জীবনে গল্প থাকে, আনন্দ-দুঃখ থাকে। জীবনে বাঁচার জন্য জীবনকে জানতে হয়, বুঝতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ বুঝেছিলেন জীবনকে, জীবনের অনেক খুঁটিনাটি তুলে ধরেছিলেন তার গল্প-উপন্যাসে। আমার মতো হয়তো আরোও অনেককে শিখিয়েছেন ভালোবাসতে, উদার হতে, পাখির গান শুনতে, সূর্যাস্ত দেখতে, জীবনকে বুঝতে। তিনি আজ নেই। তার সৃষ্টি আছে। তার জাদুকরী সব লেখা আছে। কোথাও কোনো পাঠক হয়তো তার কোনো একটা বই হাতে নিয়েছে যেমন আমি নিয়েছিলাম সেই ২০১৪ এর কোনো একদিন বিকেলে বা সন্ধ্যায়। এবং বই পড়ে মুগ্ধ হচ্ছে কিংবা জানছে জীবনবোধ এবং মনে মনে ভাবছে বইয়ের নাম কি করে এমন সুন্দর হয়—'পাখি আমার একলা পাখি', 'তেতুল বনে জোছনা', 'শঙ্খনীল কারাগার', 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'চলে যায় বসন্তের দিন', 'আজ আমি কোথাও যাব না', 'আমার আছে জল', ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে' কিংবা 'এপিটাফ'।
শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ এবং ভালোবাসি আপনাকে।