বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে জীবনানন্দের উৎকণ্ঠা

উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হ’লে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সুদূরপ্রসারী অবক্ষয়ের যে অপ্রতিরোধ্য সূচনা হ’বে এ নিয়ে তিনি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

ফয়জুল লতিফ চৌধুরীফয়জুল লতিফ চৌধুরী
Published : 24 Feb 2024, 04:38 PM
Updated : 24 Feb 2024, 04:38 PM

কলকাতার “দেশ” পত্রিকার ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ১৬ চৈত্র সংখ্যায় কবি জীবনানন্দ দাশ একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’। কার্যতঃ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ দাশ স্থায়ীভাবে কলকাতায় অভিভাসন গ্রহণ করেন, ১৯৪৭-এর আগস্টে ব্রিটিশ ভারতবর্ষ বিভক্ত হ’য়ে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়; বরিশালের মানুষ জীবনানন্দ ইন্ডিয়া’র নাগরিক হ’য়ে যান। তিনি ইন্ডিয়া’র নাগরিক হতে চান নি, কেবল বাংলা সাহিত্যের রাজধানী কলকাতার বাসিন্দা হ’তে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক কারণে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হ’য়ে পড়ে; জীবনানন্দ পশ্চিমবঙ্গে থেকে যান। তাঁকে বলা হয়েছিল দৈনিক স্বরাজ পত্রিকা যতদিন টিকে থাকবে ততদিন তিনি কাজ করবেন। এ কথা অবশ্য পরে রক্ষা করা হয়নি।

দেখা যায় পৃথিবীর নানা বিষয় নিয়ে জীবনানন্দের উৎকণ্ঠা ছিল। হুমায়ুন কবির সম্পাদিত “চতুরঙ্গ” পত্রিকার আশ্বিন ১৩৫৭ সংখ্যায় জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি নাতি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অশোকানন্দ দাশ ও ভূমেন্দ্র গুহ এই প্রবন্ধটি “কবিতার কথা” গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও তাঁর প্রগাঢ় দুশ্চিন্তা ছিল যা তিনি পাঁচটি নিবন্ধে সবিস্তারে প্রকাশ করেছেন। বঙ্গে কবিদের দুরবস্থা, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের নির্বিকাশ, বাংলা উপন্যাসের ভবিষ্যৎ, বাংলায় জঙ্গীবাদী অভ্যূত্থানের সম্ভাবনা, আনবিক শক্তির প্রদুর্ভাব, আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি লেখালিখি করেছেন। এমনকী মানুষের জীবনাঙ্গীয় নানা সমস্যা তাঁকে ভাবিত করেছে। ১৯৪৬’এ পাণ্ডুলিপির খাতায় নির্মিয়মাণ একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “আধুনিক সভ্যতায় নর-নারীর জীবনে দুশ্চিন্তার শেষ নেই আর।” এ নিবন্ধে তিনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নিষ্প্রেমে স্ত্রী’র সঙ্গে জীবনযাপনের বাধ্যবাধকতাজনিত দুশ্চিন্তার কথাও ভেবেছেন।

কেবল ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ শিরোনামীয় উপর্যুক্ত নিবন্ধ নয়, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দেই পাণ্ডুলিপির খাতায় তিনি একই বিষয়ে আরেকটি নিবন্ধের মুসাবিদা করেছিলেন; এবার অবশ্য ইংরেজীতে, ‘The Future of Bengali Language and Literature’--এই শিরোনোমে। কাঠামো ও রচনাশৈলীর বিবেচনায় দুটি নিবন্ধের তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে যদিও কিন্তু জীবনানন্দীয় উৎকণ্ঠার অভিমুখ অভিন্ন। বাংলা নিবন্ধটির শুরু এইভাবে: “পূর্ব পাকিস্তান তৈরি হবার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কী হবে--কী হতে পারে--ভেবে দেখেছি মাঝে মাঝে।” ইংরেজি প্রবন্ধটিতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ এবং সেই সঙ্গে সদ্য স্বাধীন ইনডিয়ায় বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না পাওয়ার কারণে বাংলা সাহিত্যের ওপর এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে নিয়ে জীবনানন্দ তার চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করেছেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেব স্বীকৃতি দেয়ার পরিকল্পনা শুরু হয় যার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮-এ সরকার জানিয়ে দেয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশরই মাতৃভাষা ছিল না। মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ’রও মাতৃভাষা ছিল না উর্দ্দু। এ সব নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে তার খবর প্রচার করে নবপ্রতিষ্ঠ ইন্ডিয়ার পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল। কারণ তখনও পশ্চিবঙ্গের মানুষেরা পূর্ববঙ্গকে ঘনিষ্ঠ জ্ঞান করতেন।

১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে মিছিলে পুলিশের গুলি চালনা এবং মৃত্যুর খবরাদি পশ্চিমবঙ্গের খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’ প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে খবরটি প্রকাশ করেছিল। ১৯৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারী ছিল বৃহস্পতিবার। ২২শে ফেব্রুয়ারী শুক্রবার দিনের সর্বশেষ সংস্করণে ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’র ছয় কলাম জোড়া শিরোনাম ছিল “ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ”। এর নিচে তিনটি উপ-শিরোনাম। তিন কলাম জোড়া প্রথম উপ-শিরোনাম ছিল: “১ জন নিহত ও ১৬জন আহত: ৮জনের অবস্থা গুরুতর”। দ্বিতীয় উপ-শিরোনাম ছিল: বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রগণ কর্তৃক ১৪৪ ধারা অমান্য। অতঃপর তৃতীয় উপ-শিরোনাম ছিল: “কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠি চার্জের ফলে আরও ৪শত লোকের প্রাথমিক চিকিৎসা।” প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছিল এভাবে: “ঢাকা ২১শে ফেব্রুয়ারী — অদ্য অপরাহ্নে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভকারী এক ছাত্রদলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ ১০ রাউন্ড গুলী বর্ষণ করিলে একজন নিহত ও ১৬জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে ৮ জনের আঘাত গুরুতর। আহতদের মধ্যে ৮জনকেই হাসপাসালে স্থানান্তর করা হইয়াছে। কাঁদুনে গ্যাস ছাড়ার ফলে অভিভূত আরও প্রায় ৪শত লোককে মেডিক্যাল কলেজের আউট ডোর বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। তাঁহাদের মধ্যে ৫০ জনের শরীরে লাঠির আঘাত ছিল। কতিপয় ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে।”

পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’; আবার অন্য একটি সংবাদে ‘পুলিশের গুলিতে গতকল্য ও অদ্য এ যাবত ৬ জন নিহত হয়’ উল্লেখ করা হয়।

এ সময় চাকুরীহীন জীবনানন্দ তীব্র আর্থিক সংকটে জর্জ্জরিত; অন্যদিকে চাকুরী খালি’র বিজ্ঞাপন খোঁজার জন্য নিয়মিত পত্রিকা পড়ে থাকেন। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা নিয়ে পূর্ব বঙ্গের ঘটনাবলী তাঁর জানবারই কথা। উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হ’লে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সুদূরপ্রসারী অবক্ষয়ের যে অপ্রতিরোধ্য সূচনা হ’বে এ নিয়ে তিনি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ প্রবন্ধে জীবনানন্দ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তাঁর উৎকণ্ঠার প্রধান তিনটি কারণ ব্যক্ত করেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাষা অবক্ষয়ের শিকার হ’য়ে পঁচিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যেই এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে যাবে।

প্রবন্ধ দুটি পড়লে পরিচ্ছন্নভাবে প্রতীয়মান হয় যে জীবনানন্দ মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষার পার্থক্য ও গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন। উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হলে তার পরোক্ষ প্রভাবে বাংলা সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই ছিল তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ। ইন্ডিয়া বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ না-ক’রে তুলনামূলকভাবে অপরিণত হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। এর ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর, এটাই ছিল তাঁর আশংকা। তিনি আক্ষেপের সুরে লিখেছেন, “বাঙালী একদিন—এমনকি কুড়ি-বাইশ বছর আগেও মনে করেছিল যে, বাংলা যে রকম ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষার স্থান স্বভাবতই তার প্রাপ্য। তার আশা-ভরসার ভুল ক্রমে ক্রমে সে বুঝে আসতে পারছিল। তবুও শেষ পর্যন্ত অনুমান—হয়তো প্রত্যাশা করা যাচ্ছিল যে, ক্যানাডা সুইটজারল্যান্ড সোভিয়েট রাশিয়া বা ইউরোপে যেমন কোনো একটি মাত্র প্রধান ভাষা ও সাহিত্য নেই—ভারতের মতন এত ভাষার এত বড়সড় দেশেও কয়েকটি উঁচু দরের ভাষা সমান রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাবে হয়তো ; সেরকম হলে বাংলাও একটি রাষ্ট্রভাষা হতে পারত। কিন্তু সেরকম কিছু হয় নি। হিন্দীকেই একমাত্র প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।”

প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো পঞ্চাশ-এর দশকে বাংলা ভাষার ইতব্যসরে অর্জিত শক্তি সম্পর্কে জীবনানন্দের দৃঢ় আস্থা। বাংলার তুলনায় তার কাছে হিন্দী ছিল অপরিণত। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজী রাষ্ট্রভাষা ছিল। কিন্তু এ কালপর্ব পৃথিবীর একটি প্রধান ভাষা হিসাবে বাংলার বিকাশ ও ক্রমঃপরিণতির যুগ। জীবনানন্দ লিখেছেন: “নবাবী আমলে ও পরে বৃটিশ যুগ থেকে আজকের তিন-চার দশক অবধি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উঠতি-পড়তির ভেতর বেশ একটা একটানা যুগ চলে গিয়েছে ; ভাষা ক্রমে ক্রমে তৈরি হচ্ছিল, স্বস্থ হল, ভারতবর্ষের একটা বড় ভাষা হয়ে দাঁড়াল।”

ব্রিটিশ আমলে ইংরেজী রাষ্ট্রভাষা হলেও বাংলা ভাষার বিকাশে এর অবদান স্বীকার করতে জীবনানন্দের কার্পণ্য হয় নি। তিনি এমতরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন: “অবিশ্যি ইংরেজিও একদিন রাষ্ট্রভাষা ছিল, কিন্তু ইংরেজির প্রভাবে বাংলার কোনো ক্ষতি হয় নি, উপকার অনেক হয়েছে। সেদিনকার (প্রায় দেড় শ’ বছর আগের) বাংলার চেয়ে ইংরেজি অনেক বেশি মহত্তর ভাষা ছিল, তার সাহিত্যেও সেই অনুপাতে বিভিন্ন সিদ্ধি ছিল। উঠতি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ইংরেজি অকাতরে দান করেছে ; দরকার মতো ভাষাকে ঢেলে সাজিয়েছে পর্যন্ত ; চিন্তাভাবনায় যুক্তির মর্যাদা বেড়ে গিয়েছে—যদিও সাহিত্য যুক্তিমাত্র নয়। ইংরেজির কাছ থেকে বাংলা যা পেয়েছে খুব সম্ভব তার স্বভাবনির্মিতি ও ক্ষমতার ফলে এবং প্রায় এক শ’ বছর ধরে একটানা বড় সাহিত্যিকদের জন্ম দিয়ে সহজে ও সুস্থতায় তা সে আত্মসাৎ করতে পেরেছে।” —এ হেন স্বীকারোক্তি অন্য কেউ করেছেন বলে মনে পড়ে না।

জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ: “রবীন্দ্রকালের বাংলা পৃথিবীরই প্রায় যে কোন বড় ভাষার সমান হয়ে উঠল।”—জীবনানন্দের এই পর্যবেক্ষণ আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। কেননা ১৯৫০-এর দশক থেকে গত ষাট-সত্তর বছরে ভাষা হিসাবে বাংলার অর্জন ও সমৃদ্ধিতে আমাদের অবদানের মূল্য পরিমেয় হয়ে উঠবে। এই পরিব্যাপ্ত সময়ে এমন ক’জন লেখক আবির্ভূত হয়েছেন যাদের হাতে বাংলা ভাষার প্রকাশক্ষমতা বিকশিত হয়েছে এই হিসাব কষার সময় এসেছে। এহেন পরিমাপ জরুরী কারণ জীবনানন্দের ভাষায়: “উনিশ শতকের বাংলা মননের সবদিক দিয়েই বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে এসেছিল ; সেই জন্যেই হয়তো বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার মর্যাদাও বেড়ে গিয়েছিল ঢের।”— বাঙ্গালী জাতির গভীর চিন্তা ও মননশীলতার উন্নতি হয়েছে না অবক্ষয়ের ঢালে নেমে গেছে সে প্রশ্ন এখন শিরোধার্য।