মান্নান-এর কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি,
Published : 03 Aug 2024, 09:01 PM
আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর সাথে আমার সামনাসামনি পরিচয় হবার অনেক আগে থেকেই তার নাম আমার জানা ছিল তার "সত্যের মতো বদমাস" গল্পসঙ্কলনের মাধ্যমে, বিশেষ করে ঐ গ্রন্থটি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক অশ্লীলতার সিলমোহরে নিষিদ্ধ হবার কারণে। আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম মূলত তার লেখাতে মানবচরিত্রের—নারী এবং পুরুষ—নিরপেক্ষ জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষমতার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা একাধিক স্থানে দেখতে পেয়েছি মানিক বন্দোপাধ্যায়-এর কথাসাহিত্যকর্মে। একজন মা-ও যে নারী এবং তারও যে একটি জৈবিক চাহিদা থাকতে পারে সেই "সত্য" সামাজিক নিষেধের কারণে যতটাই "বদ" এবং কঠিন মনে হতে পারে সেটা কিন্তু আসলে সত্যই, আর একজন লেখকের সেটা অনুধাবন করার সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকা একান্তই অপরিহার্য। মনে আছে এমন মা-র চরিত্র আমরা পেয়েছি ১৯৩১ সালে মার্কিন উপন্যাসিক পার্ল এস. বাক-এর লেখা "দ্য গুড আর্থ" উপন্যাসে।
মান্নান-এর নিজেরও মানিক বন্দোপাধ্যায়-এর প্রতি বিশাল দুর্বলতা ছিলো, এবং যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়-এর বাংলা বিভাগের এককালীন অধ্যাপক, বর্তমানে প্রয়াত, ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য (আমরা দুজনই তাঁর অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলাম) রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, মান্নানকে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য গবেষণার আমন্ত্রণ জানালেন, মান্নান আমার সাথে অনেক আলাপ এবং মন্ত্রণার পর মানিক বন্দোপাধ্যায়-এর উপর গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মান্নান সেই গবেষণা শেষ করেনি।
মান্নান-এর সাথে সিলেটে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয়, এবং তারপর দ্রুত ঘনিষ্ঠতার কথা একাধিকবার বিভিন্ন স্থানে আমি বর্ণনা করেছি, আর তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। ১৯৬৯ থেকে টানা এক নাগাড়ে আমাদের বন্ধুত্ব গড়িয়েছে ২০০৮ পর্যন্ত, যার ভেতর আমরা সহকর্মী ছিলাম সিলেট এম সি কলেজ এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজে--বিশেষ করে জগন্নাথে দীর্ঘ নয় বছর ধরে--এবং তারপর ১৯৮৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। অবশ্য ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত আমি দু'বার বিদেশে ছিলাম বিধায় আমরা কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তবে ২০০৫ থেকে ২০০৮ সময়কালে আমরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার সহকর্মী হতে পেরেছিলাম যখন মান্নান নজরুল রেসিডেন্ট স্কলার হিসাবে সেখানে কর্মরত ছিলো। ফলে মানুষ মান্নান এবং লেখক মান্নান এই দুই চরিত্রেই আমি তাকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়েছি।
মান্নান-এর গভীরে অপরিহার্যভাবে এক কবি বাস করতো--যে কবি ছিলো শতকরা একশত ভাগ অকৃত্রিম এবং অকপট। একথা আমি মান্নান-কে একাধিকবার বলেছি। বলেছি: "আপনি গল্প লেখেন, উপন্যাস লেখেন, নাটকও। আপনার গভীর বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ রচনা বাংলাভাষাতে উদাহরণ রূপে রয়ে যাবে--যেমন জীবনানন্দ এবং নজরুল-এর উপর একাধিক সান্দর্ভিক প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ। কিন্তু আমি মনে করি আপনার আসল লেখক-অস্তিত্ব হলো কবি।" একথা আমি শেষবার বলেছিলাম ১৯৮৪ সালে যখন মান্নান সারা রাত জেগে "রাত্রি" কবিতাটি লিখেছিলো এবং পরদিন সকাল ন'টাতে আমি যখন তার গ্রীন রোডের বাসাতে গিয়েছিলাম—যেটি আমার দীর্ঘসময়ব্যাপী একটি অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিলো--সে আমাকে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সেই লম্বা কবিতাটি পড়ে শুনিয়েছিলো। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা!
বাংলাদেশের সাহিত্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির জগতে মান্নান ছিলো আমার "মেনটর"। ষাটের দশকের সব কবিদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনেছি তারই মাধ্যমে। সত্তরের দশকে জগন্নাথ কলেজ ছিলো সাহিত্যের নাভিগোলক। ঐ কলেজে আমি সান্নিধ্য এবং ঘনিষ্ঠতা পেয়েছি শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সহিদুর রাহমান, সেলিম সারওয়ার-এর মতো আরও অনেকের। "কন্ঠস্বর" পত্রিকার আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর সাথে আমার পরিচয় মান্নান-এর সৌজন্যেই, এবং পরবর্তীকালে ওই লিটল ম্যাগাজিনে একাধিক গল্প ও প্রবন্ধ লেখা। তখন আমি এক অবিশ্বাস্য জগতে বিচরণ শুরু করি। বলতে বাধা নেই, যদিও আমি ইংরেজি সাহিত্য পড়েছিলাম সাহিত্য ভালবেসেই, কিন্তু আমার সাহিত্যিক হবার বাসনা কোনো দিনই ছিলনা। মান্নান সে বাসনার প্রজ্জ্বলক। আর তাই আমার পিতার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, এবং তাঁর ইচ্ছাতে পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষাতে পাশ করে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে চাকরি পেয়েও আমি লেখক হবার কাঙ্ক্ষাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি এবং ওই চাকরি নেই নি।
মান্নান-এর কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি, যেমন: প্রুফ দেখার সনাতন নিয়মকানুন, বাংলা বানান পদ্ধতি (যদিও এখনও হলফ করে বলতে পারিনা আমি বাংলা বানানে পারদর্শী--আসলে আমি মনে করি বাংলা ভাষার উচ্চারণ অনেকাংশে ইংরেজি ভাষা থেকে অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞানসিদ্ধ হলেও বাংলা বানান বেশ বিভ্রান্তিকর), বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধির উপায়, বাংলা বাক্য গঠন প্রণালী, বাংলা ছন্দ, এবং সম্পাদনা। মান্নান "সমকাল" পত্রিকা-সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরকে সম্পাদক হিসাবে ভীষণ শ্রদ্ধা করতো এবং আমার সাথে একজন আদর্শ সম্পাদক হিসাবে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলো। আমি অবশ্য "সমকাল"-এ কখনো লিখি নি।
মান্নান অত্যন্ত অগ্রসরমান পাঠক ছিলো। বিদেশী সাহিত্য এবং সাহিত্য-তত্ত্ব নিয়ে তার পড়াশুনা আমার চাইতে অনেক বেশি ছিলো। তার সাথে আমার সুররিয়ালিজম, ড্যাডাইজম, ইম্প্রেশনিজম, কিউবিজম, ফবিজম, স্ট্রিম অব কনসাসনেস, এমন কি সাহিত্যে ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ গ্রন্থিক আলোচনা হয়েছে, এবং তার পড়াশোনার পরিধি ও সেই সব পড়াশোনার বিশ্লেষণাত্মক নান্দনিক ধারণক্ষমতা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তার অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ "মাতাল মানচিত্র" তারই সাক্ষ্য দেয়।
আমাকে মান্নান অনুবাদকর্মে উৎসাহিত করতো, যে কাজটি আমাকে প্রায় নিয়মিত করতে হতো আমাদের যৌথ সম্পাদনাতে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন "শিল্পকলা" এবং "চারিত্র্য"-এর জন্য। ফলে আমি এক সময় আবিষ্কার করলাম আমি আপাদমস্তক আনুবাদকর্মে আসক্ত হয়ে গেছি, এবং আমার বর্তমান পরিচিতি অনুবাদসাহিত্যিক রূপেই।
প্রথম জীবনে মান্নান জীবন যাপনে এবং মানসিকভাবে নির্জনবাসী ছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার প্রথম দিকের দুটি কাব্য গ্রন্থের কবিতাগুলো তার সাক্ষী--১৯৬৭ সালে প্রকাশিত "জন্মান্ধ কবিতা গুচ্ছ", এবং ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত "জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা"। মানতেই হবে তার চিন্তাস্রোত, উপমা, প্রতীক, সাদৃশ্য, এবং সর্বোপরি তার ভাষা ও বাক্যবিন্যাস ছিলো পীড়াদায়কভাবে বিচ্ছিন্ন—ঠিক তার নির্জন বসবাসের মতো। এই নির্জনবাস সময়ের সাথে যদিও অনেক পরিবর্তিত হয়েছে--মানুষ এবং লেখক উভয় রূপেই, যার সাক্ষী আমি স্বয়ং--মান্নান কখনই আমজনতাকে বিনোদন দেবার জন্য লিখতো না। তার বিশ্বাস ছিলো: এই সদাপরিবর্তমান জীবনে বোধ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, কৌতূহল, অনুসন্ধান এবং উপলব্ধি অবিরত গঠিত, পুনর্গঠিত, বিস্তৃত, এবং অগ্রসরমান হচ্ছে। তাই মান্নান-এর অন্তর্গত চারিত্র হলো সদা অগ্রসরমান হওয়া। মনে পড়ছে আমি মান্নান-কে নিয়ে প্রথম যে প্রবন্ধ ততকালীন "পাকিস্তান অবজার্ভার"-এ লিখেছিলাম, সম্ভবত ১৯৭০ বা ১৯৭১-এর প্রথমার্ধে, তার শিরনাম ছিলো: Ever-moving Forward Abdul Mannan Syed.
অনেকেই মান্নানকে অন্তর্মুখী এবং অনেক ক্ষেত্রে চারিত্রিকভাবে মৌল-চিন্তক বলে ভুল বোঝে। একথা ঠিক মান্নান কিছুটা অন্তর্মুখী ছিলো, কিন্তু মৌল-চিন্তক কক্ষনোই ছিলো না। আমি বলেছি "কিছুটা অন্তর্মুখী" কারণ মান্নানকে আমি প্রথমে ঐ ভাবেই পেয়েছি, কিন্তু পরবর্তীকালে যে সে ভীষণ আড্ডাবাজ হয়ে উঠেছিলো তার সাক্ষ্য তার সমসাময়িক অনেক তরুণ লেখক/কবি অবশ্যই দেবে। এর সবচাইতে বড় প্রমাণ মান্নান এমন একজন অগ্রজ লেখক ছিলো যে তার অনেক অনুজ লেখক-কবিদের নিয়ে পরিচিতিমূলক ও বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেছে। আমার জানা মতে ঐ সময়ের আর কোনো কবি-লেখক এমনটা লিখেছে বলে মনে হয় না।
আর মৌল-চিন্তক? আমি নিজে জানি মান্নান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো বাংলাভাষার সবচাইতে প্রভাবশালী আধুনিক কবি হলো জীবনানন্দ দাশ, আর সে বিশ্বাস থেকেই তার "সিগনেচার" গ্রন্থ রচনা "শুদ্ধতম কবি"। অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলাম-ও তার অনেক প্রিয় কবি ছিলো। মান্নান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে "কবিগুরু" বলেই মানতো। মান্নানকে অনেকবারই বলতে শুনেছি: আসলে একজন বাঙালি মুসলমান হিসাবে আমি আমার অস্তিত্বের ভেতর এক যৌগিক ঐতিহ্যের অধিকারী বলে অনুভ করি। সত্যিকথা বলতে কি আমি মান্নান-এর ভেতর যে প্রগাঢ় কাব্যিক এবং নান্দনিক মনের পরিচয় পেয়েছি তেমনটা অনেক তথাকথিত স্বঘোষিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের ভেতরে পাইনি।
আমার বন্ধু মান্নান আর নেই আর তাই বলতে পারছি না: ঘুমোবার আগে আমাদের অনেক প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথা ছিলো বন্ধু। অনেক লম্বা পথ পারি দেবার অঙ্গীকার করেছিলাম আমরা আমাদের চিরঘুম ঘুমোবার আগে। অথচ তুমি ঘুমিয়ে পড়লে কথা না রেখে!