কাগজটি ছিঁড়ে ভাপ উঠতে থাকা সামান্য ভেজা তোয়ালেটি মুখে লাগাতেই প্রাণটি জুড়িয়ে গেল।
Published : 16 Sep 2024, 10:50 PM
পেছনে বসা বাঙালির সাথে কথা বলার ইচ্ছা বাদ দিয়ে আমি গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম। ঘুম ভাঙলে দেখলাম বিমানটি আকাশে নেই, ব্যাংককের মাটিতে। বাঙালি পরিবারটিও নেই। ইতোমধ্যেই নিশ্চয়ই নেমে গেছে। বিমানবালারা অনেকের মত আমাকেও নামতে বারণ করলো। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড খিদেয় ঘুম ভাঙলে বিমানের ভেতরের অন্ধকারে উঠে দাঁড়ালাম। বিমানটি আকাশে, আমি টলছি। দেখতে পেয়ে এক সেবক কাছে এলে বললাম আমার খুব খিদে পেয়েছে, কিছু খাবার চাই। সে বললো রাতের খাবার অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, আপনাকে ডাকা হয়েছে কিন্তু আপনি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের চোখেই বললাম কিন্তু আমার প্রচণ্ড খিদে, আমার কিছু খেতেই হবে। লোকটি কিছুক্ষণ পরে একটি প্যাকেট হাতে দিয়ে বললো ডিনারের কিছু নেই কিন্তু চাইলে এ দুটি স্যান্ডুইচ খেতে পারেন।
আমি গপ গপ করে স্যান্ডউইচ দুটি গিলে ফেললাম। খাওয়ার সময় স্যান্ডউইচের ভেতর কী আছে তা একেবারেই খেয়াল হয়নি। খুবই মজার স্যান্ডউইচ। সেবককে আবার ডেকে বললাম আমার খিদে যায়নি, আরো খাবার চাই। আবারও আগের মত দুই স্যান্ডউইচ সে নিয়ে এলো। ভেতরে হলুদ মত কিছু দেয়া একটি শেষ করার পর পেটের গর্জন হয়তো কিছুটা কমেছিল। তাই পরের স্যান্ডউচটিতে কী আছে দেখার ফুসরত হলো। এক পরত পনিরের ওপর লাল মাংসের একটি স্তর। সেটিও মুখে পুড়ে চিবোতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা ভেতরের মাংসটি কীসের ছিল? শুয়োরের হতে পারে কি? ছোটকাল থেকে জেনে এসেছি শুকরের মাংস খাওয়া হারাম – বারণ। মুখ থেকে বমি করে ফেলে দেব? কোথায় ফেলবো? বিমানের এতো সুন্দর পরিবেশটিকে আমার বমি দিয়ে নষ্ট করবো? দুর্গন্ধ পেয়ে অন্য যাত্রীরা আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাবে না? কিন্তু এরকম একটি স্যান্ডউইচ তো একটু আগেই আমি খেয়ে ফেলেছি। জিভ, মুখ বা পেট তো তাতে বিদ্রোহ করে ওঠে নি। বিদ্রোহ না করলে কি হবে, শুকরের মাংস খাওয়া হারাম সেটিই মোদ্দা কথা। তার মানে আমি ক্কবিরা গুনাহগার হয়ে গেছি ইতোমধ্যেই। একবার যখন গুনাহ করেই ফেলেছি আরেকবারও না হয় করলাম। আমার পেটে তো এখনো অনেক খিদে। তাছাড়া এটি শুকরের মাংস তো নাও হতে পারে।
সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা গুনাহ দেবার মালিক আল্লাহ। তিনি নিশ্চয়ই মোল্লা-মৌলভিদের মত গোড়া নন। তিনি খৃষ্টান ও হিন্দুদের শুকর খেতে যেহেতু বারণ করেন নি আমাকেও হয়তো কিছু বলবেন না। তাছাড়া তিনি নিশ্চয়ই আমার খিদের প্রচণ্ডতার কথা ভেবে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন। এই যুক্তিতে স্যান্ডউইচের বাকি অংশটুকুও সাবাড় করে ফেললাম। বিমান সেবক পানি নিয়ে এলে জিজ্ঞেস করে জানলাম মাংশটি আসলেই ছিল শুকরের – এটিকে হ্যাম বলা হয়। জীবনের প্রথম আমি শুকরের মাংস খেলাম!
ব্রুস লী – ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চোখে প্রচণ্ড ঘুম ও শরীরের অসীম জড়তা নিয়ে হংকং এ যখন নামলাম তখন ওখানে প্রায় ভোর হয়ে আসছে। ট্রাঞ্জিট লাউঞ্জের কর্মীদের বেশির ভাগই আমার বয়সের কাছাকাছি, কিন্তু সবার মুখই গম্ভীর, জাতিতে চীনা। প্রায় সবাই শক্ত সামর্থ্য, করিৎকর্মা এবং একটি করে ওয়াকিটকি হাতে যাত্রীদের বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে। এধরনের দৃশ্য আমি এই প্রথম দেখলাম আগে যা শুধু সিনেমায়ই দেখেছি। সুন্দর ও চোখে পড়ার মত ফিটফাট পোষাকে ওদের দেখে খুব ভালো লাগলো।
কিন্তু ওদের মত আমার দেহ এতো শক্ত নয়, এবং আমার চলাফেরাও ওদের মত তড়িৎ গতির নয় বলে বেশ হীনম্মন্যতা পেয়ে বসলো। এঁদের সবার চেহারাই বেশ গম্ভীর। ভাবলেশহীন ধাতব পদার্থের মত চেহারার আড়ালে ওরা কী ভাবছে তা বোঝার কোনই উপায় নেই। ঘুমে আড়ষ্ট হয়ে থাকা দেহ নিয়ে মস্তিষ্ক আমাকে বললো ইচ্ছা হলেই চ্যাংদোলা করে মাথার ওপরে তুলে ওরা আমাকে আছাড় মারতে পারে। কিছুদিন আগেই ব্রুস লী’র একটি সিনেমায় এধরণের আছাড় দেয়া দেখেছি। সাথে সাথে আমার আশেপাশের সবগুলো চীনা চেহারাকে বিভিষীকাময় শত্রু মনে হতে লাগলো। তবুও ভয়ে ভয়ে সবচেয়ে নিরীহ চেহারার লোকটির কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমার পরবর্তী ফ্লাইট প্রায় দশ ঘণ্টার আগে ছাড়বে না বলে বড় সুটকেসটি ট্রানজিটে ফেলে না রেখে নিজের কাছে রাখাই ভালো।
অবন্ধুসুলভ ও অপরিচিত চীনাদের ভয়ার্ত চেহারা দেখে দেখে এবং ঘুম চোখে ও অবসাদগ্রস্ত দেহে সুটকেসটি টানাটানি করতে গিয়ে নিজেকে বারবার ভর্ৎসনা করছিলাম। পা টলছে, পেটেও ভীষণ খিদে। কী প্রয়োজন ছিল আমার বিদেশে আসার? উচ্চশিক্ষার বিদেশি একটি ডিগ্রি না থাকলে আমার কী হতো? একটি মাত্র ছাত্রের - তাও ছাত্র হিসেবে এতো ভালো নয় – ‘স্যার আপনি বরং আরবে চলে যান’ কথাটিকে অপমানজনক ভেবেই না আমি আদাজল খেয়ে লেগেছিলাম বিদেশে আসার জন্য।
কিন্তু তা করতে গিয়ে আমি কী পেছনে ফেলে এসেছি? আমি ফেলে এসেছি আমার বৃদ্ধ মা ও বাবা, স্নেহশীল ভাই ও বোন, বন্ধুবান্ধব, এবং অগণিত গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী। সেখানে সমাজে আমার একটি স্থান ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদই দিলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও আমাকে সবাই শ্রদ্ধা, সম্মান, ও ভালোবাসার চোখে দেখতো। সেসবের প্রকাশ দেখাতে কি এদের অনেকেই বিমান বন্দর পর্যন্ত ছুটে আসে নি? আমার গলার টাই ও জুতার ফিতা বেঁধে দেয়নি? নিজ নিজ বাসা থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে আসে নি? খেতে না চাইলেও পিছু পিছু হেঁটে মুখে খাবার তুলে দেয়নি? দুইচোখের পানির বাঁধ ঠেকাতে পারছিলাম না কোনমতেই। ওরা আমার সুটকেস তো বটেই , বিমানে চড়ে বসা অব্দি আমার হাতের ব্যগটিও বয়ে বেড়ায় নি?
তাদের এতো ভালোবাসা ফেলে রেখে আমার এতোদূরে চলে আসার কী প্রয়োজন ছিল? এখন আমি নিস্তেজ ও দুর্বল দেহে এই অপরিচিত পরিবেশে এতো ভারি একটি সুটকেস টানাটানি করছি। এদিক সেদিক উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটছি আর এসব ভাবছি। পরবর্তী দশটি ঘণ্টা আমি কী করবো, কোথায় ঘুমাবো, কী খাব? পকেটে যে তিরিশটি ডলার আছে তা যদি এখন খাওয়ার পেছনেই খরচ করে ফেলি তাহলে জাপানে পৌঁছে টাকা পাওয়ার আগের ক’দিন কীভাবে চলবো?
সাহসী বাঙালি – হঠাৎ মনে হলো আমি তো বাস করি বর্তমানে। অতীতের ভালোবাসায় বন্দি থেকে এবং অজানা ভবিষ্যতের ভয়ে থাকার কোন মানে হয় না।
সাথে সাথে চলে গেলাম একটি খাবারের দোকানে। পাঁচ ডলারের অনেক কমেই বেশ কটি খাবারে পেটটি পুরে ফেলতে পারলাম। চোখের ঘুমও চলে গেল, আরো গেল শরীরের অবসাদ। সকাল হয়ে গেছে। যাত্রীর আনাগোনাও বেড়েছে। ইউরোপীয়, পশ্চিমা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয়, এমন কি পাগড়িমাথার এবং শাড়ি পরিহিতা যাত্রীও চোখে পড়লো। তাঁদের চেহারাগুলো এতোক্ষণ দেখা চীনাদের মত অবন্ধুসুলভ নয়। সামনাসামনি না হলেও টেলিভিশন এবং সিনেমা দেখে দেখে এঁদের প্রত্যেকের চেহারা আমার খুবই পরিচিত।
বাহ, নিজেকে তো এখন আর এতো অসহায় লাগছে না। এই ঘণ্টাখানেক আগের আমি’র চেয়ে এখনকার আমি’র সাথে কোন তুলনাই হয় না। এখন আমার আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ড। এটি যে পেটের খিদে নিবৃত্ত হওয়ারই ফল তা বেশ বুঝতে পারলাম! আমি এই বিমান বন্দরে আবদ্ধ থাকবো না। আমি হংকং দেশটি ঘুরে দেখবো। টাকা খরচ বেশি করা যাবে না। অবস্থা বুঝে পায়ে হেটেই বেড়াবো। সুটকেসটি বিমান বন্দরের সিকিউরিটি লকারের ভেতরে জমা রেখে বেরিয়ে পড়লাম।
ফিতাল – সকাল প্রায় সাতটা বাজে। রোদে চারিদিক ঝকঝক করছে। আমি একটি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে কোথায় যাওয়া যায় বোঝার চেষ্টা করছি। পাশে দাঁড়ানো প্রায় সব যাত্রীই চীনা। এঁদের নিয়ে ভয় আর করছে না মোটেই। একটির পর আরেকটি বাস চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কারো কারো সাথে আলাপ করার চেষ্টা করলাম। সুবিধা হলো না। বিমান বন্দর থেকে নিয়ে আসা একটি ম্যাপের সাথে একটি খুটিতে লাগানো বাসের যাত্রাপথ নির্দেশিকাটি মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিলাম। যুবক বয়সী এক চীনা একই নির্দেশিকার পাশে এসে দাঁড়ালো। সাগ্রহে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে নাম বললো, ফিতাল। বুঝতে না পেরে আমার দুই-তিন-চার বার প্রশ্নের উত্তরে বারবার বললো নামটি ওর ফিতাল। এবার পকেট থেকে কাগজ বের করে বললাম নামটি তুমি ইংরেজিতে এখানে লিখে দাও। সে সুন্দর ইংরেজিতে লিখলো পিটার।
প কে ফ এবং র কে ল বলা একই উচ্চারণে কথা বলতে থাকা পিটার জানালো সে একটি টুরিস্ট কোম্পানীতে চাকুরি করে। কাজেই আমাকে সে সারা হংকং ঘুরিয়ে দেখাতে পারবে। বললাম আমি তো তোমাকে কোন পারিশ্রমিক দিতে পারবো না। সে তখন পাশের পাবলিক বুথ থেকে নিজ অপিসে ফোন করে এসে জানালো কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই সে আমার গাইড হবে। ওর উচ্চারণ বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছে ভেবে বললাম তুমি শুধু আমাকে বলে দাও আমি কোন কোন দর্শনীয় স্থানে কীভাবে যাব, তাতেই হবে। তোমাকে আমার সাথে আসতে হবে না। তখন সে কাগজে লিখে নিশ্চিত করলো ওকে কোন পারিশ্রমিক দিতে হবে না। সে শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করছে বলে ওর কোম্পানী আমার সাথে আসতে বলেছে।
পিটারের সাথে একটি বাসে চড়ে বসলাম। সাগরের ওপরের পুল দিয়ে হংকং-এর এক দ্বীপ থেকে আরেকটিতে যাওয়ার সময় সে স্থানগুলোর বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল। সাগরের নীচ দিয়ে একটি পাতাল সুড়ং দিয়ে যাওয়ার সময় সে বললো এটি হচ্ছে হংকং দ্বীপ থেকে চীনের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সুড়ং। মূল ভূখণ্ডের যে স্থানে বেরোলাম পিটার জানালো সেটি হংকং এর সুপ্রসিদ্ধ কাউলুন ডিস্ট্রিক্ট।
সে আমাকে বিভিন্ন বাজারের অলিগলি ঘুরিয়ে দেখালো। যেটির কথা বেশি মনে আছে তা হচ্ছে প্রচণ্ড ঘিঞ্জি খাবারের দোকানের সারি। মাছ ও বিভিন্ন জন্তুর ঝলসানো বুক, পা, উরু, বা মাথা। রিডার্স ডাইজেস্টে পড়া একটি অত্যন্ত ব্যায়বহুল ও সুস্বাদু চীনা খাবারের কথা মনে পড়লো। তাইপের কোন রেস্তোরাঁয় জ্যান্ত বানরের মাথাকে উপরে রেখে দেহটিকে একটি টেবিলের নিচে ঝুলিয়ে রাখা হয়। খদ্দেররা একটি হাতুড়ি দিয়ে মাথাটি ভেঙে চামচ দিয়ে মগজটি বের করে নেয়। একটি বিশেষ ধরনের সসে চুবিয়ে মগজটি ওরা মজা করে যখন খায়, টেবিলের নিচে বানরের দেহটি তখনো ছটফট করতে থাকে। পিটারকে জিজ্ঞেস করলে সে এই খাবারের ব্যাপারে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল।
বাজারের রেস্তোরাঁয় আরো ছিল ছোট বড় অনেক ধরণের পাখি, জীবিত ও আগুনে ঝলসানো। ছিল ডিম – নানা রঙের ও আকারের। অনেক ডিমের ওপরে পুরু কাদা লেপটানো। পিটার বললো কাদার ভেতরে এভাবে অনেকদিন রেখে দেয়ার ফলে ডিমের একটি বিশেষ স্বাদ হয়। কোন কোন দোকানে ছিল এসব ডিমের স্তুপ, আমাদের আড়তদারদের দোকানে যেমন দেখা যায়।
আমার তখনকার চোখে একটির সাথে আরেকটি লেগে থাকা কাউলুনের দালানগুলো ছিল আকাশচুম্বী কিন্তু দেখতে অনেকটা আজিমপুরের চীনা বিল্ডিং এর মত। ঘরগুলো খুপড়ির মত। প্রতিটির সামনে রোদে শুকানোর জন্য লেপ তোষক বা পরিধেয় কাপড় ঝুলছে। ওই সময়ে হংকং ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এর পরই সম্ভবতঃ ছিল বাংলাদেশ। আমার মনে হয়েছিল ধানমণ্ডি, বনানী, গুলশানের বিশাল বিশাল যায়গা নিয়ে এক একটি বাড়ির পরিবর্তে আবাসন সমস্যা সমাধানে আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদদের হংকং-এর দিকে নজর দেয়া উচিৎ।
বেঁধে দেয়া সময়ের মাঝেই পিটার আমাকে বেলা দুইটার মাঝে আবার বিমান বন্দরে পৌঁছে দিল। ওর আচরণ ও ব্যবহারে আমি এতোই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে জাপানে পৌঁছে আব্বাকে প্রথম চিঠিতে লিখেছিলাম ‘এই ফিতালের কথা আমি কখনো ভুলবো না’। আসলেও ভুলিনি। পিটারের সাথে থাকা সুময়টুকু আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের কথা। কিন্তু বিনা পারিশ্রমিকে যে ধৈর্য, নিষ্ঠা, এবং উৎসাহের সাথে সে আমার গাইডের কাজটি করলো সে এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
সম্ভবতঃ বিকাল চারটার দিকে ক্যাথে প্যাসিফিকের আরেকটি বিশাল বিমানে চড়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য তাইপে – ফরমোযা দ্বীপ বা জাতীয়তাবাদী চীনের রাজধানী। হংকং এ সারাদিন ঘুরে পরিশ্রান্ত হয়ে আছি। ঘুমে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। তাইপে বন্দরে নামার সাথে সাথে ছুটতে হলো পরবর্তী জাপান এয়ারলাইন্সের বিমানের খোঁজে।
প্রমোদ শ্রীবাস্তভ – শ্রান্ত পায়ে চলন্ত এস্কেলেটর দিয়ে হাঁটছি। পেছন থেকে হন হন করে আসতে আসতে একজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। ভারতীয় চেহারা, আমার বয়সের কাছাকাছি। আমার দিকে আগ্রহী দৃষ্টিতে নিয়ে তাকাচ্ছে। যে গতিতে পেছন থেকে আসছিল ঠিক তেমনি চোখমুখ থেকে বুদ্ধি ও শক্তি যেন ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে। পরিচিত হতে হাত বাড়িয়ে দিল। ভারতের, উত্তর প্রদেশের প্রমোদ শ্রীবাস্তব। আমি বাংলাদেশের শুনে শুদ্ধ বাংলায় বললো সে কোলকাতায় পড়াশোনা করছে। জাপানের ওসাকায় যাচ্ছে ইউনেস্কোর একটি মাইক্রোবায়োলজি কোর্সে। আমিও একই কোর্সে এবং একই শহরে যাচ্ছি শুনে দেখা গেল জাপান এয়ারলাইন্সের আমাদের পরবর্তী বিমানটিও এক। বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট।
ওর চলাফেরা যেমন দ্রুত, কথা বলার গতিও তাই। সেই তুলনায় আমি একটু ধীর। তাই ওকে আমার বেশি পছন্দ হচ্ছিল না। তারচেয়েও ওর স্মার্টনেসটা বেশি আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। ইতোমধ্যেই জানিয়েছে কোলকাতায় ইস্ট জেনেটিক্স নিয়ে পিএইচডি-র গবেষণা করছে, ওসাকাতেও তাই করবে। হীনম্মন্যতায় পেয়ে বসেছিল বলে ভাবছিলাম আমি কী বলি। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ঢাকায় করা আমার তিনটি গবেষণার কথাই বললাম এবং জানালাম যে জাপানে আমি ইম্মোবিলাজড এনজাইম নিয়ে কাজ করবো। মনে হলো সে ভীষণ ইম্প্রেসড হয়েছে। তবুও ভাবছিলাম একই কোর্সে স্মার্ট এই ছেলেটির সাথে প্রায় একটি বছর কী করে কাটাই! কিন্তু আমার প্রতি ওর আগ্রহের কোন কমতি নেই। বোর্ডিং পাসে দুজনের অনেক দূরের সিট দেখে বললো বদলে এক সাথে বসা যায় কিনা। আমি বললাম না, ওসাকায় নেমে দেখা তো হচ্ছেই।
ঢাকা থেকে রওনা হয়ে এটি আমার পঞ্চম বিমান। নির্দিষ্ট আসনে বসার সাথে সাথে অসম্ভব বিনয়ের ভঙ্গিতে এক বিমান সেবিকা এসে কাছে দাঁড়িয়ে আরো বিনয়ের সাথে একটি থালা সামনে ধরলো। মেয়েটির পরিধানে এমন পরিপাটি পোষাক ছিল যা আমি আর কখনো দেখিনি। অন্য যাত্রীদের দেখাদেখি থালা থেকে আমি কাগজের মোড়কে জড়ানো একটা কিছু হাতে নিলাম। অন্যদের দেখাদেখি বুঝতে পারলাম এটি খাবার কোন বস্তু নয়, বরঞ্চ মেহমানদের মুখহাত ধোয়ানোর একটি ব্যবস্থা। কাগজটি ছিঁড়ে ভাপ উঠতে থাকা সামান্য ভেজা তোয়ালেটি মুখে লাগাতেই প্রাণটি জুড়িয়ে গেল। মনে হলো বিমান বালারা এতো ভালো হয়! এরপর খাবার এলো, যা চাই তাই এলো অতি বিনয়ের সাথে। মনে হলো যাত্রীদের সামান্যতম সেবা করতে পেরে ওরা কৃতার্থ হয়ে যাচ্ছে।
গত চল্লিশ বছরে আমি বহু দেশ ঘুরেছি, বহু ধরণের বিমানে চড়েছি, বহু সেবক সেবিকার সেবা গ্রহণ করেছি। কিন্তু জাপান এয়ারলাইন্সের সেদিনকার বিমান সেবিকাদের আতিথেয়তার সাথে সেসবের কোন তুলনা খুঁজে পাই না।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা আটটার দিকে আমাদের বিমানটি ওসাকার ইতামি বন্দরে অবতরণ করলো।
৪ঠা জানুয়ারি, ২০১৯