বিটোফেনের শেষবেলার কাজ ব্যঞ্জনাহীন, যেন দূরবর্তী কিছু একটাতে লিপ্ত।
Published : 25 Aug 2024, 11:38 PM
রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে যা বলেন তার দ্যোতনার্থটি হয়তো এই--তাঁর বেলা চলে যায় সাঁঝবেলায়, ঈশ্বরের সুরে সুর মিলিয়ে মিলিয়ে। রবীন্দ্রনাথের এই ব্রহ্মসংগীতটি ঈশ্বরের পথকে পাথেয় করার, একাত্ম হওয়ার এক আভাসসন্ধানের স্নিগ্ধতায় আত্মসমর্পিত। পরমের পথই নিজের পথ, নিজের মিশে যাওয়ার পরম মার্গ--এই চিরন্তন এবং জীবনচলতি ভাবনারই সহনীয় এবং অনুমেয় উপস্থিতিতে গানটি বাঙ্ময়। কিন্তু শিল্পে শুধু সুরের সঙ্গে সুর মেলানোই অভীষ্টসিদ্ধির পথ নয়, অসহনীয় আর অনুনময়তাকে আবাহন, বেখাপ্পা হওয়া সত্ত্বেও, তার এক বিকল্পতা। এমনকি যে-রবীন্দ্রনাথ এই গানটি বেঁধেছিলেন, তাঁর জীবনও এ পথের ছায়ানুবর্তী হয়নি। জীবনের প্রথমেই একটি অর্থহীনতা, এক ‘‘তারকার আত্মহত্যা’’, তাঁকে শুধু আকুলিতই করেনি, বিস্মিত এবং স্তম্ভিত করে তুলেছিল এবং তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল সারাজীবন: ‘‘কেন গো কী হয়েছিল তার।/একবার শুধালে না কেহ--/ কী লাগি সে তেয়াগিল দেহ।’’ কিন্তু আর-এক অর্থহীনতা নতুন দর্শনবিভাবে আরও তীব্র এবং বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছিল তাঁর মাঝে, মৃত্যুর চরম মুহূর্তে মনে হয়েছিল: ‘‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে/ সরল জীবনে।’’ বিপর্যস্ত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ: প্রথমজীবনে কাদম্বরীর মৃত্যুতে, শেষজীবনে ঈশ্বর-নিশ্চিতির দোলাচলে; আর এর প্রতিসরিত বোধ তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছিল এসব কবিতা, যা তাঁর এতদিনকার ভাবনার আদলের, জীবনদর্শনের একবারে বিপরীত; বিশ্বাসের জায়গায় সন্দেহ, নিশ্চিতির জায়গায় অনিশ্চিতি যেন হাহাকার করে ওঠে। পল সেজানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁর শেষবেলার ছবিগুলো যেন তুলির আলাদা চিহ্নায়নে সুনির্দিষ্টে অধিক উদ্ভাবনময়। প্রথম দিকের মিশ-খাওয়া রঙের শৈলী থেকে একদম আলাদা। দীর্ঘসময় ধরে কোনো বিষয় নিয়ে ধ্যানী থাকার পর, সংবেশিত হয়েই তিনি ছবি আঁকতেন; আর শিল্পের প্রতি এই নিবেদনই, এই আত্মোৎসর্গই তাঁর মৃত্যুকে তরান্বিত করেছিল। এমন অসংখ্য উদাহরণে ভরপুর শিল্পের ইতিহাস: রেমব্রান্ট, মাতিস, বাখ, ভাগনার এমনকি পিকাসোর ভিতরও এই বদলে যাওয়ার অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। শেষ বছরগুলোতে পিকাসোর মধ্যে দেখা যায়, শৈল্পিক বন্যতা আর স্বাধীনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস-- ১৯৬৮৭২ সময়ের মধ্যে তিনি একশর বেশি ছবি এবং একশর বেশি খোঁদাইশিল্পের কাজ করেছেন। শেষবেলার শিল্প যেন এতদিনকার জীবনকে অস্বীকার করে নতুন ভিন্নার্থকতাকে শিরোধার্য করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে, তা যেন সময়কে পেরিয়ে কোনো-এক সময়হীনতায় যাওয়ার এক বন্যতা। বেলাশেষের শৈলীতে একটি প্রতিসরিত ভাব কাজ করে। এটা মৃত্যুময়তা বা বয়স্কতার কোনো সরাসরি উদ্ভাসন নয়। এ হল আমিত্বের এক অপরিহার্য অবস্থা যেখানে সবকিছুকে ভেঙেচুড়ে ভিন্নতায় জেগে উঠতে চায় শিল্পীর নির্জ্ঞান, পরিণত হতে চায় রূপে-অরূপে, যা বিসংগতিময়। এক অনবদমিত সত্তা নতুন জাগরণের তাড়নায় তার শেষ কালচিহ্ন রেখে যায়, যেন উত্তরকাল খুঁজে পায় তাঁর জীবনের আলোঅন্ধকারের নিশানাকে। মৃত্যুর নিশ্চিত আর অনপনেয় ছায়ার নীচে এসে নিজ শরীর ও আত্মাকে নতুন বঙ্কিম প্রকাশের মাধ্যমে মৃত্যুকে অস্বীকারের এক দুর্মরতাই যেন ধ্বনিত হয় শেষবেলার কাজে। এই দুর্মরতার কারণেই বিটোফেন সম্পূর্ণ বধির হয়েও রচনা করে বসেন নবম সিম্ফনি, বৃদ্ধ বাখ কোনোরকম যন্ত্রানুসঙ্গের দ্বারস্থ না-হয়েই তাঁর দ্য আর্ট অব ফিউগে রচনায় নামেন; কারণ তিনি তখন শ্রাব্য-সংগীতের ধারাকে অতিক্রম করে গেছেন। গ্রিক-আলেকজান্দ্রীয় কবি কাভাফির শেষদিকের একটি অভিনব কবিতা ‘‘মাইরেস: আলেকজান্দ্রিয়া, খ্রিস্টাব্দ ৩৪০’’- কে তাঁর লেট স্টাইল হিসেবে গণ্য করা যায়, কারণ এ কবিতাটিতে কবি গতানুগতিক চিন্তার বাইরে এক ভিন্ন চিন্তাকে উপস্থাপন করেন যা পাঠকের চেতনাকে প্রতিভাবে বিদ্ধ করে। পাউল সেলানের শেষ জীবনের কবিতায়ও দেখা যায় এক অবরুদ্ধতা যা পাঠকের জন্য দুষ্প্রবেশ্য। জেমস জয়েসের ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা যায়। তাঁর শেষ কাজ ফিনেগানস ওয়েক এক দুরবগাহ কাজ। বলা হয়, বইটি ইংরেজিতে লেখা আবার ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধেও লেখা। পয়ষট্টিটি ভাষা ব্যবহার করেছেন তিনি যা প্রকারান্তরে হয়ে উঠেছে দেরিদার কথায় ‘‘বাবেলিয়ান অ্যাক্ট অব ওয়ার’’। তথাকথিত পাঠযোগ্যতার বিরুদ্ধে যেন এই লেখা। জয়েসের এই লেট স্টাইল যেন ইংরেজি ভাষার এক আরম্ভহীনতার আরম্ভ, এক শেষের শুরু যেখানে তা এতদিনকার স্থিতরূপ থেকে উৎপাটিত হয়ে বন্য আর সার্বত্রিক হয়ে পড়ে। শিল্পী অঁরি মাতিস মৃত্যুর পনেরো বছর আগে আঁকার প্রথাগত শিল্পকৌশল পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে নতুন এক কৌশলকে অবলম্বন করেছিলেন যেখানে তুলি ও ক্যানভাস ছাড়া ছোটো ছোটো কাগজের টুকরাকে গোয়াশ রঙে এঁকে ইমেজ নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মাতিস তাঁর এই শিল্পভ্রমণের রীতিকে বলেছিলেন ‘‘শতভাগ আলাদা’’ বলে। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টাকে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে দেখা হয়েছিল, তাঁর এ কাজকে বলা হয়েছিল এক ‘‘আরামজনক চিত্তবিক্ষেপ’’ বলে।
একজন লেখক কি সারাজীবনই এক ধরনের লেখা লিখে যান, বা একজন শিল্পী কি এক ধরনের ছবিই এঁকে যান সারাটি জীবন? উত্তর তো সহজ: মোটেই না, আবার উত্তর অসহজ: টু বি অর নট টু বি। একজন শিল্পীর কাজ স্থানকালনিরপেক্ষ নয়, নয় ইচ্ছা বা প্রজ্ঞানিরপেক্ষ। নিজের কথাই যদি বলি, শুরুতে কবিতাতে লক্ষণা থাকলেই মনে হত কবিতাটি হয়ে উঠেছে, কিন্তু যতই দিন যায়, মনে হয় ব্যঞ্জনাই কবিতার মূল বিষয়; শব্দালঙ্কারের চেয়ে অর্থালঙ্কারই যেন কাঙ্ক্ষিত। আরও মনে হত, কবিতায় কবির অহমের জটিল প্রকাশ না ঘটলে তা হবে না কোনো উৎকৃষ্ট কবিতা; ইন্দ্রিয়বিপর্যয়, সংবেদন আর স্নায়ুর গহনসঞ্চার ছাড়া কবিতা হবে না নতুন। তখন করণকৌশলকে অনিবার্য মনে হত কবিতা লেখার জন্য। আর এখন মনে হয় কবিতা হোক অহম্বর্জিত, সরল অনাবিল আর আয়াসহীন।
বিখ্যাত লেখক এবং নন্দনতাত্ত্বিক থিয়োডোর আডোরনোর গ্রন্থ নাইট মিউজিক-এর শুরুর প্রবন্ধটি হচ্ছে ‘‘বিটোফেনস লেট স্টাইল’’, যার আরম্ভ পংক্তিটি হল: ‘‘একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর শেষের কাজগুলোর পরিপক্বতা ফলের পক্বতার মতো নয়। এই কাজগুলো সাধারণত ভরাট ধরণের মতো নয় বরং ভাঁজ পড়া, এমনকি ফাঁটাও হয়; তাতে থাকে মিষ্টত্বের অভাব, আর কেবল সুস্বাদকে উপেক্ষা করে তা হয় কটুস্বাদযুক্ত।’’ আডোরনো আরও বলেছেন, একটি শিল্পকর্মে ধ্রুপদি নন্দনের যে সহজলভ্য উপস্থিতিটুকুন দরকার বলে প্রচলিত, শেষবেলার কাজে এ ধরনের কোনো সুষমাই থাকে না, বরং তা ইতিহাস অপেক্ষা সুবৃদ্ধির চিহ্নসমূহকে ধারণ করে রাখে। আর এর সাধারণ ব্যাখ্যা এই যে, তা প্রচলিত রূপের পূর্ণত্বকে ভেঙে, ঐকতানকে নিংড়ে যন্ত্রণাভোগের বিসংগতিতে এবং মুক্ত সত্তার আত্মবর্ধনের মাধ্যমে সকল ইন্দ্রিয়জ আনন্দকে অবজ্ঞা করে, নতুন আত্মপ্রকাশের এক ব্যক্তিতা আর আত্মগতের ফল হয়ে ওঠে। আডোরনো এসব কথা বলেছেন বিটোফেনের শেষ জীবনের স্টাইলকে উদ্দেশ করে, যেখানে বিটোফেনের জীবন ও নিয়তির মন্দ্রতা ক্ষণে ক্ষণে বেজে চলে সমূহ স্ফটিক সহযোগে। তিনি বলছেন, যে, এই শেষপর্বের শৈলী এমন যেন শিল্পতত্ত্ব মৃত্যুমর্যাদার সঙ্গে মুখোমুখিতায় রত, তা যেন বাস্তবের আয়নায় দাবিকে বাতিল করে, প্রত্যাখ্যান করে। ‘‘লেট স্টাইল’’ ধারণাটি আডোরনো তুলে ধরেন ১৯৩৭ সালের spätsil Beethovens প্রবন্ধে। বিটোফেনের শেষবেলার কাজ ব্যঞ্জনাহীন, যেন দূরবর্তী কিছু একটাতে লিপ্ত। তা যেহেতু নতুন কিছু বলতে উন্মুখ, তাই সেখানে রয়েছে আপসহীন ব্যক্তিক উপাদান, বহুস্তরিক ও বহুস্বরিক নির্মাণ। প্রথা এবং আত্মগততার সম্পর্ক বোধগম্য হয়, শিল্পের বাহ্যিক নিয়ম মৃত্যুচিন্তায়ই নিয়োজিত থাকে কিন্তু শিল্পের বৈধতা যদি মৃত্যুবাস্তবতায় ক্ষয়ে যায় তবে তা নিছক এবং নিশ্চিতই অর্থহীন। মৃত্যু জীবের জন্য প্রযোজ্য, তার সৃষ্টির জন্য নয়; আর তা প্রকারান্তরে শিল্পে এক ভাঙা রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়, যাকে বলে রূপক। স্বাতন্ত্রিক অভিপ্রায়ে বিটোফেন তাঁর শেষ কাজগুলোকে কালের গভীরে এমনভাবে আলাদা করে রাখেন যেন তারা, সম্ভবত, শাশ্বতের রাজ্যে রক্ষিত। আডোরনো প্রবন্ধটি শেষ করেন এই বলে যে, ‘‘শিল্পের ইতিহাসে, শেষ কাজগুলো হল এক আকস্মিক বিপর্যয়।’’
এডওয়ার্ড সাইদ আডোরনোর এই ধারণায় প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়ে লেখেন একটি বই--অন লেট স্টাইল: মিউজিক অ্যান্ড লিটারেচার অ্যাগনেস্ট দ্য গ্রেইন। সাইদ বলেন, ‘‘লেট স্টাইল’’ হল এক ধরনের নির্বাসন; যা-কিছু স্বাভাবিক ও গ্রহণীয়, তার বাইরে বেঁচে থাকাই ‘‘লেটনেস’’ ধারণা। ‘‘লেটনেস’’ এ-ই বোঝায়, যে, কেউই মোটের ওপর এই অবস্থাকে অতিক্রম করে যেতে পারে না, বলেছেন তিনি। এই ধারণাটিকে অনুধাবন করলে লেটনেস বোঝায় শিল্পীর বা লেখকের এমন-এক সৃষ্টি-পরিক্রমা যখন তিনি তাঁর এতদিনকার সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা থেকে বের হয়ে নতুন এক লীলায় উপনীত হন যা আগেকার অবস্থার পরিপূরক নয়, বা নয় পূর্বের অবস্থার পক্বতা; বরং প্রত্যাহৃত এক অবস্থা যা একেবারে ভিন্নত্বে নিয়ে যায় লেখককে, শিল্পীকে।