অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ ছিলেন আমাদের প্রজন্মের জন্য একজন আদর্শ শুদ্ধ সাহসী লড়াকু মানুষ এবং একাডেমিক।
Published : 30 Nov 2024, 01:30 PM
আমি অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ নামের সাথে, যিনি গত ২৬ নভেম্বর ২০২৪ প্রয়াত হয়েছেন, প্রথমে পরিচিত হয়েছিলাম দুভাবে--প্রথমত আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর কন্ঠস্বর পত্রিকার মাধ্যমে, এবং দ্বিতীয়ত তাঁর ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা পদে কর্মরত থাকার মাধ্যমে। দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ১৯৬৮ সালের শেষভাগে যখন আমি নিজেও সিলেট সরকারি এম. সি. কলেজে যোগদান করেছিলাম, এবং যখন আমার আর একজন প্রয়াত ঘনিষ্ঠজন আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর সাথে যৌথভাবে শিল্পকলা নামে একটি শিল্পসাহিত্যের প্রবন্ধের উপর লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতাম। অবশ্য মানতেই হবে অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ-এর সাথে সরাসরি পরিচয় হবার মাধ্যমটিও ছিল আবদুল মান্নান সৈয়দ।
মান্নান-এর সুবাদে আমিও কন্ঠস্বর পত্রিকাতে লেখালেখি শুরু করি এবং মনে পড়ে কোনও একদিন ঢাকা কলেজে অধ্যাপক হারুন-উর রশিদকে আমি দেখি। কথা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তেমন ভাবে নয়—অনেকটাই ভাববাচ্যে। মানুষটাকে তখন যেমন দীর্ঘদেহী মনে হয়েছিল তেমনি একটু নির্বিকার বা দূরবর্তী বলেও ধারণা জন্মেছিল। কিন্তু আমার প্রথম প্রতীতিটি যে ঠিক ছিল না তা অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ-এর সাথে এর পরেও পরোক্ষভাবে আমার দেখা হয়েছে অনেকবার, এবং আমার প্রথম ধারণাটি থেকে সরে আসতে অনেকটা সময়ই লেগেছে। মনে পড়ে, সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ সালে, যখন তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে উনার সাথে আমার দেখা হয় সাভারে, যেটি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ক্যাম্পাস। এই সেমিনারেই তাঁর সাথে আমার সরাসরি "ডিসকোর্স" হয় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসুচি, এবং পাঠপ্রক্রিয়া নিয়ে। যদিও এ বিষয়গুলো নিয়ে উনার সাথে অনেক বিতর্ক এবং মতপার্থক্য আমার হয়েছিল, উনি আমার মতামতকে অনেক মূল্য দিয়েছিলেন—এবং বলতে গেলে, এই সময় থেকেই উনার সমন্ধে আমার ধারণার পরিবর্তনের শুরু।
সময়ের পরিহাস, ১৯৯৮ সালে উনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হন এবং এর দু'বছর পরই, অর্থাৎ ২০০০ সালে, আমার কর্মস্থল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে যোগদান করেন। ফলে তাঁকে আমি সহকর্মী হিসাবে পাই দীর্ঘ আট বছর। আমরা পাশাপাশি অফিস ঘরে বসতাম। তাঁর ঘরে একটি হেলান দিয়ে বসার কাঠের একটি চেয়ার ছিল, যেটিতে বসতে আমার ভীষণ ভাল লাগতো, সেই চেয়ারে বসে অনেক সময় কাটিয়েছি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা করে—সাহিত্য, ব্যাক্তিগত জীবন, হাসিঠাট্টা, এমনকি দেশ ও বিদেশের রাজনীতি। বুঝতে পেরেছি মানুষটি আপাদমস্তক যেমন ধার্মিক, তেমনি উদার, জ্ঞানী, পড়ুয়া, বাগ্মী, এবং সর্বোপরি আপোষহীনভাবে সাহসী।
একটি উদাহরণ দিই। আমি একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি--আমার নাক দিয়ে অজস্র রক্তপাত হচ্ছিল যেটি আমার একধরণের গ্রীষ্মকালীন "ক্রনিক" অসুস্থতা ছিল সেই সময়। মনে আছে উনি আমাকে তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে দোয়া পড়ে সাহস দিচ্ছিলেন এবং আমার বাসাতে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ-এর সবচাইতে বড় গুণগুলোর ভেতর দু'টির উল্লেখ না করলেই নয়—মানুষের গুণকে স্বীকৃতি দেয়া এবং সাহস। মনে পড়ছে উনি নিজ উদ্যোগে আমাদের সহকর্মী, এবং আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু, সেলিম সারোয়ার-এর (আমরা এক সাথেই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে কর্মরত ছিলাম তখন, যদিও সেলিম সারোয়ার আমার সহকর্মী ছিল জগন্নাথ কলেজে সেই সত্তরের দশকেই) সেক্সপীয়ার-এর সনেটের বাংলা অনুবাদ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা বোর্ডকে রাজী করিয়েছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দকে কবি নজরুল ইসলাম-এর উপর গবেষণার জন্য স্কলার ইন রেসিডেন্স হিসাবে নিয়োগ দিতে।
শিক্ষক হিসাবে আমাকে উনি উচ্চাসনে বিবেচনা করতেন, যার যোগ্য আমি কতোটা ছিলাম জানি না। একবার সেমেস্টার-মধ্যভাগে উনি অসুস্থ হলে তাঁর "কম্প্যারাটিভ গ্রামার" বিষয়টি আমাকে পড়াতে অনুরোধ করেছিলেন এই বলে যে, “আপনিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়াবার যোগ্যতম ব্যাক্তি।" জানি বক্তব্যটি বাড়াবাড়িই ছিল, তবু ভাল লেগেছিল তাঁর প্রশংসাবাণী। অনুবাদক হিসাবেও আমাকে উনি মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ ও প্রশ্রয় দিতেন।
আমি মনে করি উনার মতো সাহসী লড়াকু মানুষ আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে খুব কমই দেখেছি--যেমন কর্মজীবনে এক শুদ্ধ একাডেমিক যোদ্ধা ছিলেন, তেমনি ব্যাক্তিগত জীবনে ছিলেন একজন লড়াকু মানুষ—কিভাবে বাঁচতে হয় জানতেন। তাঁর প্রান্তীয় অসুস্থতার আগে আরও একবার বেশ কঠিন অসুখে পড়েছিলেন যার জন্য তাঁকে শল্যচিকিৎসা নিতে হয়েছিল। সে সময় তাঁর মনোবল দেখে আমরা সবাই একই সাথে চমৎকৃত এবং শ্রদ্ধাবনত হয়েছিলাম। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ ছিলেন আমাদের প্রজন্মের জন্য একজন আদর্শ শুদ্ধ সাহসী লড়াকু মানুষ এবং একাডেমিক।