Published : 16 Mar 2021, 05:49 PM
১৯৩০-এর দশকের বাংলা গানে নজরুল ইসলাম ছিলেন একচ্ছত্র অধিপতি। তখন তাঁর গান না-হলে আসর বসতো না, থিয়েটার জমতো না, রেকর্ডের ব্যবসা চলতো না। অন্য কারও গানের এমন চাহিদা ছিলো না। তাঁর গানের ভাষা এবং সুর এমন ফ্যাশন-দুরস্ত ছিলো যে, কনিষ্ঠ গীতিকারেরা তাঁকে অনুকরণ করতেন। সুরকারেরা তাঁর ভঙ্গি নকল করতেন।
অবশ্য তাঁর আগেই রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানে যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন। বাংলা গানের চার তুক-বিশিষ্ট কাঠামোও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। বাংলা গানকে তিনি মুক্ত করেছিলেন গতানুগতিক রাগরাগিণীর কঠোর বন্ধন থেকে। তা ছাড়া, তিনি গড়ে তুলেছিলেন বাংলা গানের সরল সহজ সাবলীল ভাষা। তা সত্ত্বেও, ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গান কলকাতার বাণিজ্যিক থিয়েটারে ঢুকতে পারেনি। সবাক চলচ্চিত্রের যুগ তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তাতে তাঁর কয়েকটি মাত্র গানই গৃহীত হয়েছিলো পঙ্কজ মল্লিক, কুন্দনলাল সায়গল আর কানন দেবীর কল্যাণে।
আসরেও গাওয়া হতো না তাঁর গান। কারণ, জনপ্রিয় ধারণা ছিলো যে, রবি ঠাকুরের গান হলো মেয়েলি। সন্তোষ সেনগুপ্ত লিখেছেন যে, পুরুষ শিল্পীরা তাই তাঁর গান গাইতেন না। কেবল মাত্র শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরাই গাইতেন তাঁর গান। এ ছাড়া, তাঁর গান প্রধানত সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হতো ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে। এমন কি, তাঁর গানের নাম তখনো রবীন্দ্রসংগীত হয়নি। বলা হতো, রবিঠাকুরের গান। জনপ্রিয় ছিলো না এ গান, তাই এ গানের খুব কম রেকর্ডই তখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু সবার অজ্ঞাতে তাঁর গানের সর্বগ্রাসী ধারা বইছিলো অন্যান্য গানের তলে তলে।
এ অবস্থায় হঠাৎ করে নজরুল গেলেন একেবারে নীরব হয়ে, ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। আর, রবীন্দ্রনাথ তো অস্তমিত হয়েছিলেন তারও এক বছর আগে। তা সত্ত্বেও বাংলা গানের আসর বন্ধ হলো না, বন্ধ হতে পারেও না। তখন সেই শূন্যতা দূর করার জন্যে চার দিক থেকে ছুটে এলেন তরুণ গীতিকারেরা। সুবোধ পুরকায়স্থ (১৯০৭-৮৪) এলেন, প্রণব রায় (১৯১১-৭৫) এলেন, এলেন মোহিনী চৌধুরী (১৯২০-৮৭)। এঁদের মধ্যে নজরুলের সবচেয়ে বড়ো অনুসারী ছিলেন প্রণব রায়। তিনি নজরুলের এমন অনুসারী ছিলেন যে, তাঁর লেখা বহু গানই নজরুলের গান বলে ভুল হতে পারে। যেমন, তাঁর লেখা 'তোমার আকাশে এসেছিনু হায়, আমি কলঙ্কী চাঁদ', 'মেঘে আর বিজুরিতে মিশায়ে', 'ফিরিয়া ডেকো না মহুয়া বনের পাখি' ইত্যাদি গানকে এখনও নজরুল-গীতি বলে ধারণা করা হয়।
তারপর ১৯৪০-এর দশকের পরে বাংলা গানের আসরে যাঁরা প্রবেশ করেন, তাঁরা নজরুলের ভাষা অথবা ভাবের অনুকরণ করলেন না, উল্টো তাঁরা পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে বাংলা গানের জগতে নতুন একটা যুগের প্রবর্তন করেন। এক কথায়, তাঁদের ভাষা ছিলো 'গীতবিতান'-নির্ভর অর্থাৎ রবীন্দ্র-অনুসারী। শ্যামল গুপ্ত (১৯২২-২০১০), সলিল চৌধুরী (১৯২৩-৯৫), সুধীন দাশগুপ্ত (১৯২৯-৮২), গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯২৫-৮৬), নচিকেতা ঘোষ (১৯২৫-৭৬), পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-৯৯) প্রমুখ মিলে এমন একটা যুগ সৃষ্টি করেন, যাকে এক কথায় বলা যায় আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। এঁরা যে-গানগুলো রচনা করেন, সেগুলো ছিলো প্রধানত রোম্যান্টিক এবং প্রেম-বিরহের। এঁদের মধ্যে বিশেষ ব্যতিক্রম ছিলেন সলিল চৌধুরী। প্রথমে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী, কমিউনিস্ট। কারাগার ভাঙার কথা, কাস্তেকে শাণ দেওয়ার কথা লিখেছিলেন বহুবার। ১৯৪৯ সালে 'কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো' গানটা দিয়ে তিনি এই যুগের আগমন বার্তা ঘোষণা করেন। তারপর অন্যরা যখন প্রেম এবং স্বপ্নের গান রচনায় বিভোর, সলিল চৌধুরী তখনও তাঁর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখেন তাঁর নিজস্ব ভাষা-শৈলী, বিষয়বস্তু এবং ভাব দিয়ে। সিনেমার গান লিখতে গিয়ে তিনি তাঁর ভাব-ভাষার সঙ্গে বারবার আপোশ করেন, তবু তিনি যে কবি, তা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করেন।
কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, শৈলেন দত্তগুপ্ত প্রমুখ জনপ্রিয় পুরোনো সুরকারদের দিনও ম্লান হয়ে গেলো। তাঁদের জায়গায় দেখা দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-৮৯), অনুপম ঘটক (১৯১১-৪৭), শ্যামল মিত্র (১৯২৯-৮৭), সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ (১৯২৫-৭৬), রবীন চট্টোপাধ্যায় (১৯১৮-?), রবীন্ মজুমদার, অধীর বাগচী প্রমুখ সুরকার।
গায়ক-গায়িকাদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এলো। উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেললেন জগন্ময় মিত্র (১৯১৮-২০০৩) এবং কানন দেবীর (১৯১৬-৯২) মতো চল্লিশ দশকের খ্যাতিবান গায়করা। মঞ্চে আবির্ভূত হলেন এক দল নতুন গায়ক-গায়িকা। তাঁদের দল-নেতা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর পিছে-পিছে এলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায় (১৯২৫-৯২), মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৯৩১-৯২), মান্না দে (১৯১৯-২০১৩), গীতা দত্ত (১৯৩০-৭২), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (১৯৩১-), প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-), ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯২২-৯২), শ্যামল মিত্র প্রমুখ। ১৯৫০ আর ১৯৬০-এর দশক জুড়ে তাঁরা সৃষ্টি করলেন বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। তারপর অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় চলে গেছে। ইতিমধ্যে গান শেখার নতুন নতুন পথ খুলে গেছে। সেসব গানকে উজ্জ্বল করার জন্যে চমকদার অনেক প্রযুক্তি এবং ইলেক্ট্রনিক বাদ্যযন্ত্র এসেছে। বিনোদনের জন্যে মানুষের হাতে আগের তুলনায় টাকাও আছে বেশি। তবু এখনকার গান মনের ওপর তেমন দাগ কাটে না। মনকে দোলা দেয় সেই পুরোনো পঞ্চাশ ও ষাট দশকের সোনালি যুগের গানগুলোই।
সলিল চৌধুরী আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়—এই দুজন মিলে এই যুগ আরম্ভ করলেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কেবল সলিল চৌধুরীর গান করেননি। তিনি অন্যান্য গীতিকার ও সুরকারের গানও গেয়েছিলেন। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের নেপথ্য গায়ক হিসেবে তিনি অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেন। সুতরাং তাঁকে সেসব সিনেমার সংগীত পরিচালকদের কথা মানতে হয়েছিলো। এসব গান নানাজনের রচনা। বাংলা সিনেমায় তিনি প্রথম গান করেন ১৯৪১ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর। তাঁর এই গানের জন্যে তিনি বিশেষ নাম করতে পারেননি। কিন্তু ১৯৫১ সালে তিনি বোম্বাইতে গিয়ে সেখানকার সিনেমায় গান করে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর কিছু হিন্দী গান আছে, যা সমগ্র ভারতে আজও অমরত্বের দাবি করতে পারে। বাংলা সিনেমায় তিনি দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেন 'অগ্নিপরীক্ষা' (১৯৫৪) চলচ্চিত্রে গান গেয়ে। এর পেছনে আর-একজনের পরোক্ষ অবদানও ছিলো। তিনি সেকালে সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেতা উত্তমকুমার। উত্তম আর সুচিত্রা সেন সে সময়ে নায়ক ও নায়িকা হিসেবে জুটি বেঁধে যে-রকম জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে তেমনটা কেউই করতে পারেননি। সেই উত্তমকুমার এমন সুন্দরভাবে হেমন্তের গান পরিবেশন করতেন যে, তার ফলে সেই গানগুলো বাড়তি জনপ্রিয়তা লাভ করতো। বাংলা চলচ্চিত্রের গান ছাড়া রেকর্ডের মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর অসংখ্য গান। ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি রবীন্দ্রসংগীত-সহ অন্যান্য ধরনের গানও গেয়েছিলেন।
মান্না দে তাঁর সংগীত-জীবন আরম্ভ করেন বোম্বাইতে, হিন্দী গান দিয়ে। বছর দশেক পরে তিনি কলকাতায় এসে বাংলা গান করেন সিনেমার জন্যে। তাঁর গাওয়া কয়েকটা গান তখনই মুখে মুখে ফিরতো। যেমন, তুমি আর ডেকো না, এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি, তীর-ভাঙা ঢেউ আর নীড়-ভাঙা ঝড় ইত্যাদি। তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছিলেন। তাঁর বহু গানে উচ্চাঙ্গ সংগীতের ছাপ এঁকে দিয়েছেন। সিনেমার গানে যে-নাটকীয়তার প্রয়োজন, তাও তিনি সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। ষাটের দশক থেকে তাঁর গান খুবই জনপ্রিয় হয়। তিনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-সহ অনেক গীতিকারের গানই গেয়েছিলেন। কিন্তু পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানই তিনি বেশি গেয়েছিলেন। নচিকেতা ঘোষের কয়কটা গানও তাঁর কণ্ঠে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। যেমন, ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি (নচিকেতা ঘোষ), আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে, যখন কেউ আমাকে পাগল বলে, যদি কাগজে লেখ নাম (নচিকেতা ঘোষ), চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে (সুধীন দাশগুপ্ত), ও চাঁদ সামলে রেখো জোছনাকে ইত্যাদি অসংখ্য গান।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্র বাংলা গানের জগতে আসেন ১৯৪০-এর দশকে। কিন্তু ৫০ ও ৬০-এর দশকে তাঁরা তাঁদের সংগীত-জীবনের তু্ঙ্গে ওঠেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ছেলেবেলা থেকে গান শেখেন। বিশেষ করে শেখেন উচ্চাঙ্গ সংগীত। তার ফলে তিনি 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়', 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' ইত্যাদি নজরুলগীতি সার্থকভাবে গাইতে পেরেছিলেন। তা ছাড়া, তিনি কয়েকটি জনপ্রিয় গানে সুর দিয়েছিলেন। এ সব গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং লতা মুঙ্গেশকার-সহ বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা গেয়েছিলেন। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তাঁর কয়েকটি গান মুখে মুখে ফিরতো। এ গানগুলোর মধ্যে 'জীবনে যদি দীপ জ্বালোতে নাহি পারো', 'পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম, আমি চলে গেলে', 'এখনো আকাশে চাঁদ ঐ জেগে আছে', 'আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা' ইত্যাদি।
'আধুনিক গান' গেয়ে খ্যাতি অর্জন করলেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় দীর্ঘকাল উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষা করেন। তাঁর সংগীত-গুরুদের মধ্যে একজন ছিলেন বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান। তিনি তাঁর বহু গানেই তাঁর উচ্চাঙ্গ সংগীতের পারদর্শিতা কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনিও শচীনদেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সলিল চৌধুরীর মতো বোম্বাই গিয়েছিলেন হিন্দী সিনেমায় নেপ্থ্যসংগীত করার জন্যে। সতেরোটি ছায়াছবিতে তিনি কাজও করেন। তবে তাঁর খ্যাতি আসে বাংলা গানের মাধ্যমেই। তিনি তাঁর গলা ও ভঙ্গি স্বাতন্ত্র্যবিশিষ্ট। বিশেষ করে ১৯৫৪ সালে তিনি 'অগ্নিপরীক্ষা' ছায়াছবির নেপথ্য সংগীত গাওয়ার পর রাতারাতি বৃদ্ধি পায়। তাঁর এই গানের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেন তাঁর সৌন্দর্য এবং অভিনয়ের জন্যে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া 'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু আজ' ও অন্য গানগুলোর সঙ্গে ঠোঁট মেলানোয় এ গানগুলো বাড়তি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর কয়েকটি সুপরিচিত গান হলো: 'তুমি যে আমার', 'জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া', 'এ শুধু গানের দিন এ লগন গান শোনাবার', 'কে তুমি আমারে ডাক', 'উজ্জ্বল এক ঝাক পায়রা,' 'হয়তো কিছুই নাহি পাবো', 'অনেক দূরের ঐ যে আকাশ' ইত্যাদি। তিনি কয়েকটি নজরুল-গীতিও গেয়েছিলেন। এসব গানে তিনি তাঁর উচ্চাঙ্গ সংগীতের দক্ষতা কাজে লাগিয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি তাতে নানাভাবে সহায়তা করেন।
শ্যামল মিত্র একই সঙ্গে ছিলেন গায়ক এবং সুরকার। তিনি বেশি গানে সুর দেননি, কিন্তু তাঁর সুর দেওয়া গানগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো। তাঁর গাওয়া কিছু সুপরিচিত গান হলো: আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, কেন তুমি ফিরে এলে, দূর নয় বেশি দূর ওই, ধরো কোন এক শ্বেতপাথরের প্রাসাদে, নাম রেখেছি বনলতা, ভীরু ভীরু চোখে চেয়ে চলে গেলে, সেদিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যায় ইত্যাদি। শেষ গানটিতে সুরও দিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র নিজে। তাঁর গাওয়া 'যদি কিছু আমারে শুধাও', 'আহা ওই আঁকা বাঁকা যে পথ' এবং 'যা গেছে তা যাক যাক' সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর-দেওয়া। লোকসংগীতের সুরে তিনি বেশ কয়েকটা 'আধুনিক' গান গেয়েছিলেন।
স্বর্ণযুগের গায়কদের মধ্যে আর-একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন এবং যত্নের সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছিলেন। তাঁদের ছিলো বংশানুক্রমিকভাবে সংগীত চর্চার ধারা। তাঁর জন্ম কলকাতায় হলেও তাঁদের আদি বাড়ি ছিলো বরিশালের উজিরপুরে। সংগীত জগতে মানবেন্দ্রের প্রবেশ ১৯৫০-এর দশকে। তিনি একই সঙ্গে আধুনিক এবং নজরুল ইসলামের গান গাইতেন।
নজরুল নির্বাক হয়ে যাবার পরে কলকাতায় তাঁর গানের প্রচার দারুণ কমে গিয়েছিলো। সেটা আরও কমে যায় দেশবিভাগের পরে। এদিকে নজরুলের সঙ্গে এই পরিবারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিলো। মানবেন্দ্র নজরুলের গানের প্রতি যে-অবিচার করা হচ্ছিলো, তার বিরুদ্ধে একাই লড়াই শুরু করেন। আসরে আসরে তিনি তাঁর ফিল্মী গান পরিবেশন না-করে নজরুলগীতি গাইতে আরম্ভ করেন। তা ছাড়া, তিনি শতাধিক নজরুলগীতি রেকর্ড করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নজরুলগীতি আবার বাজতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালে তিনি তাঁর একটি রেকর্ডে নজরুল ইসলামের গানকে নাম দেন 'নজরুলগীতি'। অনেকেই মনে করেন যে, নজরুল-গীতি নামটা তাঁরই দেওয়া। সেটা পশ্চিমবঙ্গের জন্যে সঠিক। কিন্তু ঢাকা বেতারে তার আগেই এই নামটি প্রচারিত হয়েছিলো বলে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ আবদুল আহাদ দাবি করেছেন।
মানবেন্দ্রের কয়েকটি জনপ্রিয় গান হলো: আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি, ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে, আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি, বনে নয় বনে নয় মনে মোর, তোমার কাজল চোখে যে গভীর ছায়া, বারে বারে কে যেন ডাকে, ও আমার চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি। শ্যামল মিত্রের সঙ্গে তাঁর গাওয়া একটি সুপরিচিত গান হলো: দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা। তাঁর পাশ্চাত্য ঢঙে গাওয়া একটি বিখ্যাত ব্যতিক্রমী গান হলো 'মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য।'
১৯৬৬ সালে প্রকাশিত যে-লংপ্লে রেকর্ড নজরুলগীতির প্রতি শ্রোতাদের মনোভাব বদলে দিয়েছিলো, তাতে মানবেন্দ্র দুটি গান গেয়েছিলেন: এত জল ও কাজল চোখে এবং বৌ কথা কও বৌ কথা কও।
১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে বহু বিখ্যাত গায়ক-গায়িকার আবির্ভাব ঘটেছিলো। তাঁদের মধ্যে আর-একজন ছিলেন গীতা দত্ত। ১৯৩০ সালে তাঁর জন্ম ফরিদপুরে, বাল্যবয়সেই বোম্বাইতে বসবাস করতে আরম্ভ করেন পিতার সঙ্গে। বড়ো হলে তিনি প্রেম করে বিয়ে করেন তখনকার নাম-করা অভিনেতা গুরু দত্তকে। তাঁদের বিয়ে নাকি সুখের হয়নি। হতাশা থেকে পানাসক্ত হয়ে পড়েন। ফলে অকালে মারা যান ১৯৭২ সালে।
ভারত-জোড়া তাঁর খ্যাতি হিন্দী সিনেমার নেপথ্য গায়িকা হিসেবে। তাঁর এই লুকানো প্রতিভা আবিষ্কার করেন শচীনদেব বর্মণ। তিনি গীতাকে দিয়ে সত্তরটারও বেশি গান করান। এসব গানের মধ্যে ৪৩টি গীতা দত্তের একক কণ্ঠে। প্রায় প্রত্যেকটা গানই হিট গান বলে বিবেচিত হয়। বাংলা ছায়াছবির জগতেও তাঁর প্রকাশ নেপথ্য গায়িকা হিসেবে। 'হারানো সুর' ছায়াছবিতে তাঁর গাওয়া 'তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার' একটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গান। গীতা দত্তের কণ্ঠ ছিলো অত্যন্ত সুমধুর। তদুপরি, এ গানের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। তা এই গানকে বাড়তি আকর্ষণ জোগায়। 'এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু' এবং 'নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে' তাঁর আর-দুটি জনপ্রিয় গান।
স্বর্ণযুগের আর-একজন সত্যিকার গুণী শিল্পী ছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ সালে। তার ঠিক সত্তর বছরের জীবনে তিনি অসংখ্য শ্রোতার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভ করেন। তাঁর গলা ছিলো সেই যুগের ফ্যাশনওয়ালা গলা অর্থাৎ ভারী গলা। তিনি বহু জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন। সেসবের মধ্যে মাটিতে জন্ম নিলাম মাটি তাই রক্তে মিশেছে, এই ঝির ঝির বাতাসে, ঝনন ঝনন বাজে ইত্যাদি।
আলোচ্য কালে আরও অনেক গায়ক-গায়িকা ছিলেন, দরদী গীতিকার ছিলেন, সৃষ্টিশীল সুরকার ছিলেন যাঁরা সবাই মিলে বাংলা গানের এই স্বর্ণযুগকে গড়ে তুলেছিলেন। যেমন, সুবীর সেন। যেমন, পান্নালাল ভট্টাচার্য। তাঁদের সবারই কমবেশি অবদান ছিলো এই যুগের ঐশ্বর্য নির্মাণে। কিন্তু দ্বিতীয় সারির এই শিল্পীদের কথা বলতে গেলে আরও বহু শিল্পীর কথা উল্লেখ করতে হয়।