এক কেজি আমের রস আর এক কেজি কাঁঠালের রস ফার্মেন্টেশন-এ বসিয়েছি। দেখি মদ হয় কিনা। আগামীকাল অবশ্যই আসবেন।
Published : 13 Nov 2023, 01:54 PM
২০০৯। মার্চ মাস। ছয় বছর বিদেশে কাজ করে দেশে ফিরেছি। অজ্ঞাতকারণে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কাজে যোগদানপত্র গ্রহণ করছে না; অতএব কাজ থাকবে না, বেতনও হবে না। মুষড়ে পড়িনি কিন্তু অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত অনিশ্চয়তায় নিপতিত হয়ে কিঞ্চিদধিক দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। এরকম অবস্থায় একদিন বিকেলে ধানমণ্ডিতে ‘দখিন হাওয়ায়‘ চলে যাই। হাতে একটি ঝোলায় বেশ কিছু চকোলেটের বাক্স। দুনিয়াতে অনেকেই সুইস্ চকোলেটের কথা বলে, কিন্তু বেলজিয়ামের চকোলেট অন্য জিনিস। পৃথিবীর সেরা। ঝোলায় ন্যূহস এবং গোদিভা’র দুটি বাক্সের সঙ্গে অনেক কয়টি বাজারচলতি, তুলনামূলক কমদামের বাক্স।
দখিন হাওয়ায় ঢুকবো এমন সময় একটি গাড়ী ফুস্ করে বের হয়ে গেল। দারোয়ান বললো, স্যার তো এই মাত্র বের হয়ে গেলেন।
কোথায়?
মনে হয় হাসপাতালে।
কখন ফিরবেন?
দেরী হবে।
আমার একটি পুরোনো ভিজিটিং কার্ডে ঢাকার মোবাইল ফোন নম্বরটি লিখে আমি দারোয়ানকে অনুরোধ করে বলি, হুমায়ূন ভাই ফিরে এলে এটি দেবেন। আর এই ঝোলায় কিছু উপহার। পৌঁছে দেবেন।
পরদিন বিকেলে শাহবাগে বইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরছি। এমন সময় হুমায়ূন ভাইয়ের ফোন, চকলেট সব শেষ করে ফেলেছি। বাসার সবার পেট খারাপ। এর দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। চলে আসেন। - হুমায়ূন ভাই খুব দ্রুত কথা বলতেন। আগে থেকে শোনার অভ্যাস না থাকলে ধরা মুশকিল।
এক সন্ধ্যায় ৫-৬ কেজি চকোলেট শেষ! পাকস্থলিতে কিছু সমস্যা হতেই পারে। পরীবাগের বাসায় গিয়ে আরো কয়েকবাক্স চকোলেট নিয়ে দখিন হাওয়ায় উপস্থিত হয়ে গেলাম।
হুমায়ূন ভাই বললেন, আরো চকোলেট? ভাল করেছেন। বিষে বিষ ক্ষয় হয়ে যাবে এবার। হাত ধরে টেনে তিনি বসিয়ে দিলেন।
প্রাত্যহিক আড্ডা শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন ভাইয়ের প্রিয় মানুষেরা চলে এসেছেন। রান্নাঘরে ভাজা হচ্ছে পিঁয়াজু এবং এরকম আরো কিছু। কিছুক্ষণ পরপর সেগুলো আসতে লাগলো। সঙ্গে মুড়ি। খুবই উপাদেয় আয়োজন।
২.
কয়েকদিন যাবত হুমায়ূন আহমেদের বাসায় যাওয়া হচ্ছে না। গতকাল তিনি ফোনে মেসেজ পাঠিয়েছেন। কোন কথা লেখা নেই কেবল একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?)। অর্থাৎ কেন যাচ্ছি না। আজ সন্ধ্যাবেলায় আবার মেসেজ পেয়েছি। দুটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন (??)। হাতে কাজ ছিল তবু দখিন হাওয়াতে গেলাম। বেশিক্ষণ বসার সুযোগ ছিল না। নটা বাজতেই উঠে পড়লাম। হুমায়ূন ভাই বললেন, এখুনি যাবেন? একটা জিনিস দেখে যান।
হাত ধরে তিনি শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরের একপাশে দুটি বকযন্ত্র। একটিতে লাল, অন্যটিতে হলুদ পদার্থ। তরল।
হুমায়ূন ভাই হেসে বললেন, সারা পৃথিবীতে আঙ্গুর থেকে মদ বানায়। আঙ্গুরে চিনি আছে। ফার্মেনটেশন করে চিনি থেকে মদ। আমাদের দেশে আঙ্গুর হয় না, আম হয় কাঁঠাল হয়। এই দুই ফল চিনিতে ভর্তি। এক কেজি আমের রস আর এক কেজি কাঁঠালের রস ফার্মেন্টেশন-এ বসিয়েছি। দেখি মদ হয় কিনা। আগামীকাল অবশ্যই আসবেন। এক্সপেরিমেণ্টের ফলাফল তো জানা দরকার।
পরের দিন রাতে হুমায়ূন বাসায় ভাইয়ের বাসায় গেলাম। তার মন খুবই খারাপ। এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ। আমের রস থেকে কাঁঠালের রস থেকে মদ্য জাতীয় কিছু নির্গত হয়নি। দুঃখিত গলায় বললেন, আঙ্গুরে যেরকমের চিনি থাকে আম-কাঁঠালে সম্ভবতঃ সেই রকম চিনি থাকে না। তাই ফার্মেন্টেশনে কাজ হয় নি। কি আর করা!
৩.
হুমায়ূন ভাই সন্ধ্যায় লেখালিখি করেন না। ভোর বেলা থেকে সকাল দশটা-এগারোটা অবধি লেখেন। লেখেন মাটিতে বসে, অনেকটা জাপানী কায়দায়। ঠিক টেবিল না, বড় আড়তে খাতা লেখা ও ক্যাশ রাখার কাঠের বাক্সের মতো একটা কিছু। ওটার পেটে লেখার কাগজ আর কলম আছে কিনা চোখ ঢুকিয়ে দেখা হয় নি।
সকালে যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, সেই নিশ্চুপ সময়ের ভেতর লেখার কাজ সেড়ে ফেলেন হুমায়ূন আহমেদ। হয়তো এক কাপ চা, সাথে কিছু একটা। এক দিন মাত্র তাকে লেখার টেবিলে দেখেছি। প্রথম আলোর অফিসে বসে আছি। এমন সময় হুমায়ূন ভাইয়ের ফোন, আপনি কোথায়?
প্রথম আলো।
একটু আসতে পারবেন?
এখন?
হ্যাঁ। চলে আসেন।
হুমায়ূন ভাইয়ের বাসার দরোজা খোলা। সবসময়ই খোলা থাকে। রাতেও বন্ধ করা হয় কিনা সন্দেহ। যাই হোক, বসার ঘরে সোফায় বসে বসে হুমায়ূন ভাইকে ফোন করি। তিনি শশব্যস্ত হয়ে বের হয়ে এলেন। গায়ে হাফ হাতা শার্ট ঢলঢল করছে। একটি মাত্র বোতাম সাঁটা। হাতে দুটি বই।
বই দুটি দিয়ে মুসাফাহার ভঙ্গিতে হাত ধরে বললেন, আপনার জন্য।
বইটির নাম ‘একটি সাইকেল ও কয়েকটি ডাহুক পাখি‘। দুই কপি। বইটি তিনি আমাকে উৎসর্গ করেছেন।
এই উৎসর্গ আমি আশা করিনি। চমকে গেলাম। হুমায়ূন ভাই মানুষকে চমকে দিতে ভালোবাসেন। ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট বলেছিল, আমি ভিখিরির বাচ্চা ভিখিরি, ধন্যবাদটিও ঠিকমতো দিতে পারি না (Beggar that I am, I am even poor in thanks.)। আমারও একই অবস্থা।
বললাম, হুমায়ূন ভাই, আমি অভিভূত। কী বলবো বুঝতে পারছি না।
মৃদু হেসে ঘাড়ে হাত রাখলেন হুমায়ূন আহমেদ। বললেন, কিছু বলতে হবে না।
তারপর বললেন, কিন্তু এখন আপনাকে বসতে বলবো না। লিখছি। ফেব্রুয়ারী মাস। কিন্তু এখনও দুজন প্রকাশক পাণ্ডুলিপির জন্য অপেক্ষা করছে। একজন বলেছে দুদিনের মধ্যে পাণ্ডুলিপি না পেলে সে আত্মহত্যা করতে দ্বিধা করবে না। কারো আত্মহত্যার কারণ হতে চাই না।
৪.
ছোট ছেলে দিল্লী পাবলিক স্কুলে পড়ে। একদিন দেখি সে আর তার মা নতুন বছরের বই কিনে এনেছে। তারমধ্যে একটি ‘আমার ছেলেবেলা‘। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদের বই স্কুলে পাঠ্য শুনে খোঁজখবর করি। জানতে পারি অনেক স্কুলেই ‘আমার ছেলেবেলা‘ মিডল স্কুলে পাঠ্য। শুনে খুব ভালো লাগলো। কাকলী প্রকাশনীর বই। প্রথম প্রকাশ ১৯৯১ সালে।
একদিন শুক্রবার বিকেলে বইটি পড়তে বসি। আগেও পড়েছি। কিন্তু এবার পড়ছি ক্রিটিক্যালি কেননা ক্লাশ সিক্সের ছেলেদের জন্য এটি পাঠ্য বই।
সন্ধ্যা বেলায় দখিন হাওয়াতে কেবল অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম এবং অবসর প্রকাশনীর আলমগীর রহমান ভাই বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদের পাশে। আর মেহের আফরোজ শাওন তো আছেনই।
আমি ইতঃস্তত করে বললাম, একটি কথা বলতে চাই হুমায়ূন ভাই। বেয়াদবী নেবেন না।
আপনার কথা বলার ধরনে ঘাবড়ে যাচ্ছি।
আমি বললাম, তেমন কিছু না। ‘আমার ছেলেবেলা‘ বইটা অনেক স্কুলে পাঠ্য। আমি আজ মন দিয়ে পড়েছি। আপনি তো পাঠ্যবই হিসাবে লেখেননি। এখন পাঠ্যবই হিসাবে লেখেন।
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তিনটা কারণ বলেন লতিফ ভাই। যুক্তি হলো আসল কথা।
এক নম্বর হলো এমন কয়েকটি বিষয় আছে যেগুলি ১২-১৩ বছর বয়সী বাচ্চাদের উপযোগী না।
দ্বিতীয়, এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলি ক্লাস সিক্স-সেভেন-এর বাচ্চাদের জানার কথা না।
বুঝেছি। তিন নম্বর কারণ বলতে হবে না। বইটা আবার লিখতে হবে। কিন্তু আমার দ্বারা সম্ভব না। আপনি লিখবেন।
আমি লিখবো? হুমায়ূন ভাই রসিকতা করছিলেন কিনা বুঝতে পারছিলাম না।
আপনি পারবেন। আপনি জানেন কী করা দরকার। আপনি পাঠ্য ভার্সন লিখে দেন। ঐটা প্রকাশ করে দেয়া হবে। ভূমিকাও আপনি লিখবেন।
আমি লিখবো ভূমিকা?
হ্যাঁ, আপনি লিখবেন যে স্কুলপাঠ্য হিসাবে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে।
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তোমরা সাক্ষী থাকলে, লতিফ ভাই ‘আমার ছেলেবেলা‘ এর স্কুলপাঠ্য সংস্করণ করবেন। আমি প্রকাশককে বলে দেব।
৫.
২০১১। বিশ্বকাপ ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। খেলা হচ্ছে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে। মার্চ মাসের দশ তারিখ। বিকেলে লাঞ্চ খাওয়ার পর মতি ভাই বললেন, আগামীকাল তো চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা। এ নিয়ে প্রথম আলোতে হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখা ছাপা হলে ভালো হতো।
কিছুদিন যাবৎ হুমায়ূন ভাই প্রথম আলোর সঙ্গে অভিমান করে বসে আছেন। প্রথম আলোর জন্য লিখছেন না। কারণ জানি। কিন্তু উপস্থিত বলছি না। কে যাবে তার কাছে লেখা চাইতে?
মতি ভাই বললেন, লতিফ ভাই, আপনি বলে দেখবেন নাকি?
কাজটা আমার জন্য অস্বস্তিকর। হুমায়ূন আহমেদ একরোখা মানুষ। তাছাড়া আমি গিয়ে অনুরোধ করলেই তিনি লিখতে বসে যাবেন এরকম ভাবা যায় না।
সন্ধ্যার আগে আগে হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায় পৌঁছুলাম দুরুদুরু বক্ষে। সাহিত্য বিভাগের আলিম আজিজ সাগ্রহে সঙ্গী হয়েছেন। সঙ্গে নিয়েছি কেএফসি থেকে বড় এক বাকেট ফ্রায়েড চিকেন আর আল বাসকিন থেকে এক বাকেট আইসক্রিম। আমার স্ত্রীর কাছে শুনেছি মানুষের হৃদয়ে কাছে যেতে হয় পেট টার্গেট করে।
সেদিন বাসায় সান্ধ্যকালীন আড্ডা নেই। বইমেলা শেষ কিন্তু একটি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখছিলেন হুমায়ূন ভাই। আমি গেছি খবর পেয়ে এসে হাত ধরে ভিতরে টেনে নিয়ে গেলেন। আমার মুখের কাঁচুমাচু ভাব তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। স্নেহের সুরে বললেন, কী সমস্যা বলেন তো লতিফ ভাই?
আমি বললাম, আগামীকাল ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা। কারো-কারো ধারণা আমি বললেই আপনি কাগজ-কলম নিয়ে এখুনি লিখতে বসে যাবেন। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়ে একটি লেখা লিখে ফেলবেন। আগামীকাল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় আপনার লেখাটি ছাপা হবে।
আমার কথায় হুমায়ূন ভাইয়ের মুখে অদ্ভুত একটুকরো হাসি ফুটে উঠলো। সিগারেট দীর্ঘ একটি টান দিলেন।
আচ্ছা লিখব। আপনার বসে থাকার দরকার নেই। লেখা শেষ হলে পাঠিয়ে দিব।
ঘড়ি দেখলাম। সন্ধ্যা ছয়টা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে প্রথম আলোতে ফিরে এলাম।
রাত নটা পার হয়েছে। আমার ছোট রুমে ক্লস্টোফোবিয়ার অনুভূতি হয়। অনেক টেনশন নিয়ে আলিম আজিজকে নিয়ে সভাকক্ষে বসে আছি। এমনসময় বার্তাবাহক হাজির। লেখাটি নিয়ে দ্রুত যাই মতি ভাইয়ের অফিসে। মতি ভাই লেখাটি ছোঁ মেরে নিয়ে বার্তাসম্পাদক লাজ্জাতকে দিয়ে এলেন।
পরদিন প্রথম পাতার মধ্যভাগে হুমায়ূন আহমেদের ‘মন্তব্য প্রতিবেদন’ ছাপা হল। কী লিখেছিলেন হুমায়ূন ভাই তা আজ ঠিক মনে নেই। তবে বাংলাদেশ দল সেদিন একেবারেই ভালো খেলছিল না। ২২৬ রানের টার্গেট ধরা অসম্ভব মন হচ্ছিল। অনেকেই হতাশ হয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে অন্য কাজে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে ভাগ্য খুলে যায় বাংলাদেশ দলের। শেষ চার ওভারে দরকার ছিল ২২ রান। সেটি সম্ভব হলো। পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিতে গেল বাংলাদেশ। হুমায়ূন ভাইয়ের দোয়া আল্লাহপাক কবুল করেছিলেন সন্দেহ নেই।
৬.
হুমায়ূন আহমেদের দখিন হাওয়ার বাসার সদর দরজা কখনো খিল আঁটা থাকে না। সেদিন আমি যখন পৌঁছলাম তখন রাত পৌনে আটটা। সদর দরজার বাইরে একগাদা জুতা। বোঝা গেল ভেতরে অনেক অতিথির সমাগম। জুতা খুলে রেখে ভিতরে ঢুকে আমি কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত। অনেক মানুষজন বসে আছেন -- হুমায়ূন ভাই নেই। আমি প্রায় কাউকে চিনি না। অপ্রস্তুত লাগছিল। ঠিক এ সময় ভেতরের ঘরের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন হুমায়ূন ভাই। পরনে থ্রি কোয়ার্টার্স আর হাফ শার্ট। হুমায়ূন ভাই আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, আসেন লতিফ ভাই, বসেন।
আমি বললাম, এই পোশাক?
এক গাল হেসে হুমায়ূন ভাই আসাদুজ্জামান নূরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, একটু আগে নূর এসেছে। বললো কিছুক্ষণ পর একজন আশরাফ সাহেব আসবেন। এই দেশে মন্ত্রী আসলে কিছু একটা করতে হয়। তাই ভেতরে গিয়ে লুঙ্গি পাল্টে থ্রি কোয়ার্টার্স পড়ে এলাম। ঠিক আছে না?
সারা ঘরে হাসির রোল উঠলো। আসাদুজ্জামান নূরের পাশে বসে হুমায়ূন ভাই সিগারেট ধরালেন।
৭.
আরেকদিন সান্ধ্য আড্ডায় হুমায়ূন ভাই বললেন, লতিফ ভাই একটা কথা বলি। আপনাকে আমার খুব নিরিবিলি টাইপের ভালো মানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু আপনার বন্ধুত্ব খারাপ খারাপ মানুষের সঙ্গে। ঘটনা বুঝতে পারছি না।
আমার দুপাশ থেকে চ্যালেঞ্জার এবং এস আই টুটুল সমস্বরে বলে উঠলো, স্যার খারাপ মানুষগুলির নাম বলেন, নাম শোনা দরকার।
আমি তিনজনের নাম বলব। প্রত্যেকে অতি খারাপ। একজনের থেকে আরেকজন বেশি খারাপ। খারাপের কম্পিটিশন।
সিগারেট লম্বা টান দিয়ে ছাদের দিকে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন হুমায়ূন ভাই। তারপর আমার দিকে তাকালেন। তার চোখে মুখে রসিকতার প্রগাঢ় ছাপ। তিনি খুব কৌতুকপ্রবণ মানুষ ছিলেন।
প্রথম ব্যক্তি হলো অমুক আহমদ। পৃথিবীতে আমি নানা কিসিমের খারাপ মানুষ দেখেছি। কিন্তু এই কিসিমের খারাপ মানুষ আর দেখি নাই। তার সাইন্টিফিক নাম দেওয়া যায় ‘বদ ম্যাক্সিমাম’। লতিফ ভাই, এই লোক আপনার বন্ধু হয় কীভাবে ভেবে পাইনা!
গ্রামের মানুষ যেভাবে মুঠি বন্ধ করে বিড়ি ফোঁকে সেই স্টাইলে সিগারেটে লম্বা টান দিলেন হুমায়ূন ভাই। ছাদের দিকে অনেকখানি ধোঁয়া ছাড়লেন। ঘরে প্রায় দুই ডজন মানুষ দ্বিতীয় খারাপ লোকের নাম শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে। শাওন আমার দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি হাসলেন। এসব নিছক রসিকতা।
হুমায়ূন ভাই বললেন, দ্বিতীয় খারাপ মানুষ হল অমুক কবির পুত্র অমুক লেখক। শুনেছি লতিফ ভাই তাকে বিশেষ পেয়ার করেন।
সেই লোক কেন খারাপ তা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করলেন হুমায়ূন ভাই।
আমি মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম যে তিনি আমার বন্ধু না, বড়জোর বন্ধুস্থানীয় বলা যেতে পারে। সবার উচ্চকণ্ঠ হাসির রোলের মধ্যে আমার কথা হুমায়ূন ভাইয়ের কানে পৌঁছালো না।
এখন তৃতীয় খারাপ লোকের কথা বলি। এই লোক আগে নিয়মিত আসতো এই আড্ডায়। কবিজাতীয় মানুষ। টাকা আছে। এই লোকের জন্য স্পেশাল দোজখ বানানো দরকার। ৮ নম্বর দোজখ। তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য অন্যের বৌ ভাগিয়ে নেওয়া। এরকম বদলোক লতিফ ভাইয়ের স্নেহের পাত্র হওয়া ঠিক না।
৮.
২০০৯ এর ১৩ নভেম্বর। হুমায়ূন ভাইয়ের জন্মদিন। আমি গেছি দুপুরের দিকে। সাথে একশ বাক্স তেহারী। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে অনেকে আসবেন তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত লাঞ্চ। যা চেয়েছিলাম, হুমায়ূন ভাই অভিভূত হলেন। হুমায়ূন ভাই নিজে মানুষকে চমকে দিতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁকে চমকে দেয়া সহজ নয়। ইংরেজি সাহিত্যের একজন অধ্যাপক সাহিত্য বিষয়ে অনেকক্ষণ জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করে গাত্রোত্থান করলে বাসা ফাঁকা হয়ে গেল। মেঝেতে হুমায়ূন ভাই আর শাওন বসে আছেন। হুমায়ূন ভাই বললেন, আপনার প্রিয় লেখক কে?
আপনি।
আমার কথা বাদ থাক। ফ্রানয্ কাফকার লেখা পছন্দ?
পড়েছি প্রায় সবই, তবে আমার প্রিয় লেখক না।
আমারও না। একজন শক্তিশালী লেখকের নাম বলেন।
সল বিলো।
হুমায়ূন আহমেদ মাথা নেড়ে বললেন, একমত। হারযোগ (Herzog) পড়েছিলাম। পড়েছেন?
ঘাড় নাড়লাম, পড়িনি। Henderson the Rain King পড়েছি।
হুমায়ূন ভাই বললেন, পড়িনি। হারযোগ সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার বই। এতো বড় বই লেখা আমার জন্য কষ্টকর।
আমি বললাম, আপনি লিখলে ব্রাদার্স কারমাযোভ তিনশ পৃষ্ঠায় লিখতেন।
এক চোট হাসলেন হুমায়ূন আহমেদ। বললেন, ইমদাদুল হক মিলনের ‘নূরজাহান’ পড়েছেন?
মাথা নাড়লাম।
হুমায়ূন ভাই বললেন, এ লেখাটা টেনে বারশ পৃষ্ঠা করার প্রয়োজন ছিল না। দুই থেকে তিন শ’ যথেষ্ট ছিল।
আপনার ‘মধ্যাহ্ন’ প্রায় চার শত পৃষ্ঠা।
দুই খণ্ডে লেখা। আপনি প্রথম আলোতে রিভিউ করেছিলেন।
তৃতীয় খণ্ড লিখবেন না?
দেশভাগের গল্প মন খারাপ করে। লিখতে ইচ্ছে করে না। তবে কখনো লিখতে বসে যেতে পারি। বলা মুশকিল। আপনার তো অনেক পড়াশোনা। আমার স্টাইলে আর কেউ লেখে মনে হয়?
গত একশ’ বছরের সারা পৃথিবীর সত্তুর-আশি জনের লেখা উপন্যাস পড়েছি, আপনি তাদের থেকে আলাদা। তবে হারুকি মুরকামির মধ্যে আপনার ছায়া দেখি।
জাপানী? একটি বই দিয়েন। পড়বো।
কোনো বই নেই আমার কাছে। কোনো বই পড়িনি। নিউ ইয়র্কারে দুটো গল্প পড়েছি।
মুরকামির কথা আমাকে কে যেন বলেছে। সেও বলেছে মুরকামির লেখার স্টাইল আমার সঙ্গে মিলে। বই আনাতে হবে।
আড্ডায় সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন না হুমায়ূন আহমেদ। এই দিন অনেক কথা বলেছিলেন। অন্য কেউ না থাকায় পরিবেশ অনুকূল ছিল। আরেক দিন বিস্তারিত লেখা যাবে।
৯.
একদিন নানা কথার পর কিছুটা কৌতুক করে হুমায়ূন ভাইকে বলেছিলাম, নোবেল প্রাইজ পেলে আপনাকে ঝামেলায় পড়তে হবে?
কেন?
নোবেল বক্তৃতা লিখতে হবে। ঝামেলার বিষয় না।
হুমায়ূন ভাই মৃদু হেসে বলেছিলেন, আমার সমস্যা নেই। আপনি লিখে দেবেন।
এ কাজটি আমি করেছিলাম। হুমায়ূন ভাইকে দেখাতে পারিনি যদিও। নোবেল ভাষণের খসড়াটি নিম্নরূপ:
১০ ডিসেম্বর ২০২৫/নোবেল প্রাইজ অনুষ্ঠান। সকালে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে যথারীতি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরণ করা হয়েছে। সাহিত্যের লরিয়েটের বক্তৃতা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্টকহোম কনসার্ট হলে আলো—আঁধারির ছায়া। পুরস্কার প্রদান শুরু হলো বিকেল ছয়টায়। বাইরে প্রবল ঠাণ্ডা, তুষারপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ‘কনসার্ট হল’ দেড় হাজার অতিথির উপস্থিতিতে উষ্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে সিতার ও সরোদ বাজছে। রাজা কার্ল গুস্তাফ অনুষ্ঠান হলে এলেন ঠিক ৫: ৫০ মিনিটে, রাণী ও ক্রাউন প্রিন্সেসকে নিয়ে। আরো পাঁচ মিনিট পর আট জন নোবেল লরিয়েট সার বেঁধে প্রবেশ করলেন এবং নির্ধারিত আসন গ্রহণ করলেন। অতিথিরা দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ করতালি দিয়ে অভিবাদন জানালেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন নোবেল ফাউণ্ডেশনের চেয়ারম্যান কার্ল—হেনরিক হালদিন। দীর্ঘ বক্তব্যে সকলকে স্বাগত জানিয়ে তিনি ওস্তাদ আমজাদ আলী খান ও সঙ্গীদের সরোদ বাদনের ঘোষণা দিলেন। রাগ খাম্বাজের আঙ্গিকে সরোদের অনবদ্য সুরমূর্ছনায় দ্রুত এক স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি হলো।
আমজাদ আলী খানের কুড়ি মিনিটের জাদুকরী বাদনের পর পুরস্কার প্রদান পর্ব। প্রথমে পুরস্কার গ্রহণ করলেন পদার্থ বিজ্ঞানের নোবেল বিজয়ীরা, তারপর রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অর্থনীতি। সবশেষে সাহিত্যের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী বাংলাভাষার কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাম ঘোষণা করা হলো। হুমায়ূন আহমেদ এগিয়ে গেলেন, এগিয়ে এলেন রাজা কার্ল গুস্তাফ। মাঝামাঝি স্থানে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠিত হলো। করতালির ঝড় শেষ হওয়ার পর নোবেল ফাউন্ডেশানের চেয়ারম্যান বললেন, ‘এখন নোবেল অভিভাষণ দেবেন ২০২৫ সালে সাহিত্যের নোবেল বিজয়ী ড. হুমায়ূন আহমেদ।’
হুমায়ূন আহমেদ চারদিকে তাকালেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলায় বলবেন। শ্রোতাদের সমস্যা হবে না। সবার কানে ওয়ারলেস হেডফোন। ইংরেজীসহ সাতটি ভাষায় একযোগে ইন্টারপ্রিট করা হবে ৭টি চ্যানেলে। টাচ স্ক্রীণে চাপ দিলেই হলো।
হুমায়ূন আহমেদ বলতে শুরু করলেন:
“মহামান্য রাজা কার্ল গুস্তাফ, রাজপরিবারের মান্যবর সদস্যবৃন্দ, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, আমার পূর্বজ নোবেল বিজয়ীগণ, সম্মানিত অতিথিবৃন্দ—আপনাদের সান্নিধ্যে আমি ধন্য হয়েছি। স্টকহোমের এই শীতার্ত সন্ধ্যা আপনাদের উপস্থিতিতে ঝলমল ক’রে উঠেছে।
আমি শ্রদ্ধা ভ’রে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করতে চাই। এই বাঙ্গালী কবিকে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। বলা যায় বাংলা কাব্য কথাসাহিত্যের তুলনায় একশত বৎসর এগিয়ে।
এ অনুষ্ঠানে আমার বাবা উপস্থিত থাকলে আমি সবচে’ বেশী খুশী হতাম। তিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শহীদ হন। প্রতিটি যুদ্ধে সৈন্যদের চেয়ে বেশী মারা যায় নিরীহ মানুষ। আমরা বাবা সেরকম নিরীহ মানুষদের একজন। অতি সাধারণ একজন মানুষ, হাতে ছিল বড় একটি ম্যাগনোলিয়া যার সুঘ্রাণে আমাদের শৈশব, কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে মনোরম উষ্ণতায়।
আমি যৌবনের প্রারম্ভেই উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ লিখেছিলাম যখন আমার বয়স ১৯। কেন আমি লিখতে শুরু করেছিলাম তা আজ আর স্মরণ হয় না। কিন্তু লেখালিখির পথে কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পরই আমি অনুভব করেছিলাম একজন সৎ লেখকের উচিৎ স্বীয় প্রবণতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। সাহিত্য নিরীক্ষার ক্ষেত্র নয়। একজন সৎ ঔপন্যাসিক সারজীবনে তো বিভিন্ন খণ্ডে একটি মাত্র উপন্যাস লিখে থাকেন।
কেন লিখি। বস্তুতঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি লিখি নিজের আনন্দের জন্য। লেখার সময় পাঠকদের কথা আমার মাথায় থাকে না। আমি লিখি কারণ লিখে আনন্দ পাই। লিখতে লিখতে কখনও আমার চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হতে থাকে। আবার কখনও অসম্ভব আনন্দে হৃদয়পাত্র পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। লেখা আমার কাছে সৃজনশীলতা নয়—বরং, আপনাদের কাছে সসংকোচে স্বীকার করি, লেখালিখি আমার জন্য এক ধরনের চিকিৎসা যা আমার Sanity restore করে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন আমাদের Sanity ক্ষতবিক্ষত করে, আমাদের মানসিক স্থৈর্যের বিনাশ করে, আমাদের সুস্থতা কেড়ে নেয়, ক্ষয় করে আমাদের চিন্তার ভারসাম্য। আমি যখন লিখি প্রতিটি অধ্যায় আমার ক্ষতিগ্রস্থ সত্তা মেরামত ক’রে সারিয়ে তোলে, দূর করে আহৃত বিকার।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যকারণের মতো এও আমার আর স্মরণ হয় না কেন আমি বিজ্ঞান পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তবে সত্তর দশকের প্রথমভাগে নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি’র জন্য পলিমার কেমিস্ট্রিতে অধ্যয়ন করার দিনগুলো ছিল অসাধারণ রোমাঞ্চকর। এ সময় আমি জীবনের বস্তুগত সীমাবদ্ধতা হৃদয়ঙ্গম ক’রে তুচ্ছ বিষয় থেকে তৃপ্তি আহরণের কৌশলটি রপ্ত করেছিলাম। দেশে প্রত্যাবর্তর্নের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে আমি লেখালিখিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। আবার বিজ্ঞান চর্চাও চলতে থাকতো। বলতে সংকোচ হয় কিন্তু এ কথা সত্য যে এক সময় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করি।
সাহিত্য ও বিজ্ঞান দুটি পথে যুগপৎ হাঁটতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না কারণ সৃষ্টিরহস্যের উন্মোচন সর্বদাই আমাকে আলোড়িত করে। কিন্তু মানুষের জীবনে প্রতিদিন বরাদ্দ সময়ের পরিমাণ ২৪ ঘণ্টা যা বাড়ানো যায় না। অন্য দিকে লেখার জন্য সকালটাই সবোর্ত্তম সময় যখন ছাত্ররা ক্লাশ রুমে অধ্যাপকের জন্যে অপেক্ষা করে। তাই আমি অধ্যাপনার দায়িত্বটি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি কথাসাহিত্যের জগতে চলে আসি। এটা আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জিং ছিল কারণ একটি দরিদ্র দেশের সব পাঠকের পকেটে অতটা উদ্বৃত্ত টাকা থাকে না যা দিয়ে সে একটি উপন্যাস কিনে ঘরে আনতে পারে। কিন্তু সেই দরিদ্র পাঠকও দেখা গেল অন্য দিকে সাশ্রয় ক’রে হুমায়ূন আহমেদের বই কিনছে। প্রকাশকরা আমার উপন্যাসের জন্য অগ্রিম দিতে শুরু করলেন। স্বীকার করা সমীচীন হবে যে, এ সময় আমি টিভির নাটকও লিখছিলাম যা সারাদেশের মানুষ গ্রহণ ক’রে আমার উপন্যাসের বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। এরপর আমি চলচ্চিত্র বানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা থেকে কদাচিৎ লগ্নির অর্থ উঠে এসেছে। আমার বানানো সিনেমা মানুষ গ্রহণ করেনি।
যারা আমার পূর্বসূরী এবং সমসাময়িক—তাদের আমি পাঠ করেছি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সমবেদনার সঙ্গে কারণ আমি দেখেছি যুগে যুগে ঐতিহ্যের হাত ধ’রেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন সাহিত্যের। অন্য সব লেখকের মতোই আমি নিরলসভাবে অধ্যয়ন করেছি। এই অধ্যয়ন কেবল গ্রন্থপাঠ নয়—আমি মানুষকে অধ্যয়ন করেছি। চারপাশের মানুষেরা কীভাবে জীবনযাপন করে, তাদের উপলব্ধি ও অভিব্যক্তি কীরূপ—তা পর্যবেক্ষণ করেছি পরম মমতা ও একাগ্রতার সঙ্গে। আমার কাছে সব সময় মনে হয় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে পারে—হোক সে রাস্তার নিশ্চল ভিক্ষুক, ছাপড়া দোকানের চা-ওয়ালা, পাড়ার মাস্তান, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে জবানবন্দী আদায়ে পারঙ্গম গোয়েন্দা, গোয়ালান্দা ঘাটের বিগতযৌবনা পতিতা, হতদরিদ্র লজিং মাস্টার কি জমিদারের লাঠিয়াল—তাকে নিয়েই একটি কাহিনী শুরু করা যেতে পারে। লেখার জন্য ঐতিহাসিকভাবে খ্যাত ব্যক্তিবর্গ বা রাজন্যবর্গের জীবনচরিতের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি আমাকে। অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে আমি আবিষ্কার করেছি মহাপ্রাণ সত্তা। কিন্তু সাহিত্য মুখ্যতঃ জীবনের দর্পণ নয়। সাহিত্যে জীবনের ছায়াপাত থাকতে পারে মাত্র। তাই বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ করেছি। সম্পূর্ণ অবাস্তব অনুষঙ্গ আমি বাস্তবের সঙ্গে অকাতরে মিশিয়েছি। জমজমাট গল্প তৈরীর জন্যই তা’ আমি করেছি। মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। উপন্যাসের মৌলিক উদ্দেশ্য মানুষকে গল্প শোনানো।
মানব জাতির সৃষ্টিতে পরমেশ্বরের একটি পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো বৈশিষ্টে বিশিষ্ট ক’রে তোলা। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ তিনি আমাকে কল্পনার ক্ষমতা দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা এই জন্যে যে কল্পনার প্রতিভা সহজলভ্য নয় অথচ একজন গল্প বলিয়ের জন্য তা কত না অপরিহার্য।
আমি রহস্য গল্প লিখেছি—পাঠক তা খুশীমনে গ্রহণ করেছে। আমি বিজ্ঞানের কল্পকাহিনী লিখেছি। সেসবও তুলনারহিত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আমি ভূতের গল্প লিখেছি। তার জন্যও পাঠকের অভাব হয়নি। এ কথা বলার মধ্যে কণামাত্র অত্যূক্তি নেই যে নব্বুইয়ের দশক থেকে আমি যাই লিখি না কেন মনে হয়েছে পাঠক তার জন্য অপেক্ষায় ছিল। এমতরূপ সৌভাগ্য সকল লেখকের হয় না।
আপনারা হয়তো বিস্মিত হবেন জেনে যে যে-ভাষায় আমি লিখি তিনশত বছর আগেও সে ভাষায় গদ্য সাহিত্য রচিত হতো না। প্রথম উপন্যাসটি রচিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। গত তিনশত বৎসর যারা বাংলা গদ্যের উদ্ভাবনে ও বিকাশে অবদান রেখেছিল তাদের সবার কাছেই আমি ঋণী। সপ্তদশ শতকে জন্ম হলে আমি হয়তো গল্প বলতে পারতাম, কিন্তু গল্প লেখা সম্ভব হতো না।
আমি সাধারণত দীর্ঘ পরিসরে গল্প ফেনিয়ে তুলতে পারি না। আমি কয়েকটি চরিত্র সৃষ্টি করি। তাদের নামিয়ে দেই মঞ্চে। তারপর তাদের একজনের সঙ্গে আরেক জনের দেখা হয়—কথা হয়। এই কথাগুলি আমি শুনতে পাই। আমার উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা যে ভাষায়, যে ঢংয়ে কথা বলে সেভাবেই তাদের উচ্চারিত সংলাপগুলো আমি লিখে ফেলি। এই সংলাপগুলোতে কেবল তাদের বক্তব্য ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয় না, এই সংলাপে প্রতিটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এই জন্যে অল্প পরিসর হলেই আমার গল্প বলার কাজটা হয়ে যায়।
তারপরও বাস্তবতা এই যে দীর্ঘ পরিসর নিয়ে আমি দুই-চারটি উপন্যাস লিখেছি। আমার সর্বশেষ উপন্যাস ‘দ্বিতীয় অপরাহ্ন’ আমার লেখা দীর্ঘতম উপন্যাস। কিন্তু এরকম বড় উপন্যাস আমি আর লিখতে চাই না। প্রথমত দীর্ঘ কাল একটি মাত্র কাজ নিয়ে ব্যাপৃত থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত একটি বড় উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত থাকলে অনেক ছোট উপন্যাস আর কখনও লেখা হয়ে ওঠে না।
উপন্যাসের সারবত্তা গল্পের কাঠামো এবং গল্পের মানুষগুলো। আমার গল্পে প্রোটাগনিস্ট থাকে না যে অর্থে ‘প্রোটাগনিস্ট’ শব্দটি সমালোচনার গ্রন্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমার গল্পের পাত্রপাত্রীরা আশেপাশেরই চরিত্র—সে সন্ত হোক বা পাড়ার মাস্তান হোক। আমি তাদের মানবিক সত্তার ওপর আলোকপাত করেছি ব’লে মনে হয়। মানুষের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গী ধনাত্মক। ভালো মানুষের চরিত্র স্পষ্ট ক’রে তোলার জন্য দুষ্ট মানুষের চরিত্রের প্রয়োজন হয় বটে কিন্তু দুষ্ট মানুষটিকে ক্রিমিনাল বা কালপ্রিটরূপে উপস্থাপন করার প্রয়োজন অনুভব করিনি।
একটি উপন্যাস সমাজের অনেক ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি না লেখকের ভূমিকা সমাজ-সংস্কারকের। যে রচনা সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা হয় তা সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত। অন্য দিকে তা সমাজের উপকারে আসতেও অক্ষম। তার কারণ মানুষ মূলতঃ পরামর্শবিমুখ। তবে সে সত্য থেকে মিথ্যাকে, ভালো থেকে মন্দকে আলাদা করতে সক্ষম।
গল্প বা উপন্যাস লেখার সময় আমি সর্বদাই অনুমান ক’রে নিয়েছি আমার পাঠক প্রজ্ঞাবান—যে অন্ধকার থেকে আলোকে পৃথক ক’রে নিতে সক্ষম। পাঠককে এই স্বাধীনতা দিতে পরাঙ্মুখ নই। ধর্ম প্রচারকদের আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তাদের কর্মকৌশল ধার করার কথা আমি কখনো বরদাশত করিনি। সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে রচিত কোনো রচনাই আমাকে প্রমুগ্ধ করে না।
আজ এই ২০২৫—এ পৃথিবীর চালচলনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস অতিমারীর আবির্ভাবে মানুষের আত্মসন্তুষ্টি বড় রকমের ঝাঁকি খেয়েছে। মানুষের অনেক অহংকার চূর্ণ হয়ে গেছে। সুইডেনের পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে আমরা জেনে যাই বছরে কত ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে রাষ্ট্রগুলো রণসজ্জার নামে। সেই বোমারু বিমান যা আকাশে কয়েক মাইল উঁচু থেকে নিখুঁত দক্ষতায় বোমা ফেলতে পারে একটি সূঁচের অগ্রভাগ লক্ষ্য ক’রে তা আমাদের কোনো কাজে আসেনি। একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস মানুষের তাবৎ দম্ভ, সকল অহংকার মাটিতে আছড়ে ফেলেছে। ২০২৫ এর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে নতুন একটি পৃথিবীর পুনরুত্থানের কথা ভাবতে আমি ভালোবাসি যেখানে মানুষ আড়ম্বরের ভার পরিত্যাগ ক’রে সাধারণভাবে বাঁচতে প্রস্তুত।
ঘাড় ফেরালে দৃষ্ট হয় সভ্যতার বিকাশ হয়েছে প্রতিদিন নিত্যনতুন পণ্য সামগ্রীর আবিষ্কারের পথ অবলম্বন করে যার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়। ভূতগ্রস্থ মানুষ নতুন নতুন সামগ্রীতে নিজ বসতবাড়ী জাদুঘরে পর্যবসিত ক’রে ফেলেছে। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের আক্রমণের পর পৃথিবীর অনেক মানুষই উপলব্ধি করেছে এত এত আবিষ্কার ছাড়াও আমরা বেঁচে থাকতে পারি। এতো কথা, এতো অনুষ্ঠান, এতো পার্টি অনাবশ্যক। জীবনের প্রতিটি দিন ক্রীসমাসের উৎসব দিয়ে সাজানোর দরকার নেই। তবে এ কথাও সত্য যে আমি কখনো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় দেখতে চাইনি নিজেকে। যদি আমি নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বড় পুরস্কারে ভূষিত হতাম, যদি তাবৎ পৃথিবীর রাজদণ্ড তুলে দেয়া হতো আমার হাতে, তবু এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হতো না দু’কাঁধ ধ’রে পৃথিবীটা ঝাঁকিয়ে দেই। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী কৌশলে ক্ষমতা দখল করে এবং বৈধতার প্রয়োজনে আমাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আহ্বান জানায়। আমি বলেছিলাম আপনারা ভুল ব্যক্তির কাছে এসেছেন। মানুষের সভ্যতার গতিপথ পরিবর্তনের দায় আমি নিজ কাঁধে কখনোই তুলে নেয়ার কথা ভাবিনি। একজন গল্পবলিয়ের কাজ তা নয়। আমি আদ্যোপান্ত সচেতন থেকেছি যেন আমার রচনা নীতিকথার পশরা না হয়ে ওঠে।
কিন্তু আট বছর আগে সিরিয়ার তিন বছর বয়সী ছেলেটির সেই কথাটি আমার মগ্নচৈতন্য আনুপূর্ব ছিন্নভিন্ন ক’রে দিয়েছে। মানুষের তৈরী বোমার আঘাতে ওর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে সভ্যতার নির্মম উন্মাদনার শিকার সেই বালক চোখভরা ব্যথা নিয়ে বলেছিল, ‘আমি ঈশ্বরকে সব ব’লে দেব।’
আমরা যত নির্দয়ভাবেই সেই বালককে আঘাত ক’রে থাকি না কেন—আমার পরম বিশ্বাস স্বয়ং ঈশ্বর ওর চিকিৎসা করেছেন। ঈশ্বর নিজ হাতে তার ক্ষতগুলো সারিয়ে দিয়েছেন। সে এখন পরম শান্তিতে আছে ঈশ্বরেরই নৈকট্যে।
ঈশ্বরের যে ক্ষমতা আছে মানুষের তা নেই। তবু আমাদের একবার চেষ্টা ক’রে দেখতে হবে এই ভারসাম্যহীন, ভঙ্গুর, বিকারধর্মী, দানবসদৃশ, অমানবিক পৃথিবীর শ্মশ্রুষা করা যায় কিনা।
পৃথিবীতে নতুন নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো নানা নীতিকথায় সমৃদ্ধ সংবিধান রচনা ক’রে চলেছে। সংযোজনের পর সংযোজন দিয়ে সেই সব সংবিধানের কলেবর ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় আধুনিক সভ্যতা নামক দানবের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সারা বিশ্বের জন্য একটি সংবিধান প্রয়োজন। আমি ভেবেছি একটি মানবিক পৃথিবীর জন্য কোনো সুপরিসর বাকবিস্তারের প্রয়োজন নেই। একটি কার্যকর সংবিধানের দুটি মাত্র নীতিবাক্যই যথেষ্ট। কী এই দু’টি নীতিবাক্য?
প্রথম নীতিবাক্য: আমি আপনার দেহে আঘাত করবো না, আপনার জীবন সংশয় হয় এমন কোনো কাজ করবো না। আপনিও আমার দেহে আঘাত করবেন না—আমার জীবন সংশয় হয় এমন কোনো কাজ করবেন না।
দ্বিতীয় নীতিবাক্য: আমি আপনার ধন-সম্পদ অর্থ বিত্ত ছিনিয়ে নেব না বা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো না, আপনিও আমার ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেবেন না বা নেয়ার চেষ্টা করবেন না।
এই বিশ্বসংবিধান জগতের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে। আজ যদি পৃথিবীর মানুষ আমার কাছে কোনো একটি উপদেশ চায়, আমি এরকম একটি বিশ্বসংবিধান রচনার কথাই বলবো।
সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, এই আলোকজ্জ্বল সন্ধ্যা কথার ভারে আর ভারাক্রান্ত না করি। প্রতি বছরকার এই মহতী মিলনমেলা পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন ছড়িয়ে দিক এই প্রত্যাশা ক’রে আমার বক্তৃতা শেষ করছি।
আমি আপনাদের সকলের, এই পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করি।”
দীর্ঘ করতালিতে ‘কনসার্ট হল’ উচ্চকিত হয়ে উঠলো। হুমায়ূন আহমেদের মনে হলো, পৃথিবীতে তার আগমন সার্থক হয়েছে।