Published : 03 Jun 2024, 10:31 PM
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের যিনি পরে এম এন রায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী।
মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের ত্রয়োদশ পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।
১৭
দাবা, সমাজতন্ত্র এবং অশ্বারোহণ
আমার স্প্যানিশ শিক্ষক ছিলেন মেক্সিকোর জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চেম্বার অব ডেপুটির সভাপতি ডন ম্যানুয়েল। দেশে থাকতে যখন ছাত্র ছিলাম সে সময় শখের বশে দাবা খেলতাম আমিও। খেলাটা ভাল করে শেখার ইচ্ছা ছিল। বসে খেলা যায় এমন ক্রীড়ার মধ্যে একমাত্র এটাই আকর্ষণ করত আমায়। তাস খেলাকে স্রেফ সময়ের অপচয় বলে মনে হতো। চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে আমার শিক্ষকের কোনো নাকউঁচু ভাব ছিল না। তাই আমার মতো শৌখিন খেলোয়াড়ের সঙ্গে যখন-তখন খেলতে বসে যাওয়ায় আপত্তি ছিল না তাঁর।
স্প্যানিশের পাঠ নেওয়ার দরকার ছিল না আর আমার। কিন্তু তারপরও সপ্তায় তিনবার করে বৃদ্ধের আসা-যাওয়া চলতে লাগল। আমার তো নয়ই, ভদ্রলোকেরও আপত্তি ছিল না এতে। উনি পছন্দই করতেন। তবে শেখার বিষয় বদলে গেছে। আগে শিখতাম স্প্যানিশ আর এখন শিখতে লাগলাম দাবা। মাঝেমধ্যে দন মানুয়েলও যোগ দিতেন আসরে। উনি যখন আসতেন তখন দুই ওস্তাদের দ্বৈরথ কাছ থেকে দেখে শেখার সুযোগ হতো আমার। দুজনের মধ্যে দন মানুয়েলকেই বেশি বুদ্ধিধর বলে মনে হতো। উনি সম্ভবত তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কাপাব্লাংকার ধরন অনুসরণ করতেন। অপরজন পদ্ধতিআশ্রয়ী ছিলেন কিছুটা বেশি। অধিকাংশ সময় দন মানুয়েলের বুদ্ধির স্ফুলিঙ্গকে ধৈর্য্যের অস্ত্রে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে নিতেন। শুরুর দিকে চালগুলো হয়ে যাওয়ার পর দন মানুয়েল নিজের বেশি শক্তির গুটিগুলো দিয়ে সর্বাত্মক আক্রমণ সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ সেই আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়ার পর যেন আগ্রহ হারাতে শুরু করতেন মানুয়েল। প্রতিপক্ষের আক্রমণের পালা শুরু হতো তখন। শিক্ষকমশাই প্রাথমিক আক্রমণ ঠেকাতে তাড়াহুড়ো করতেন না কোনো। রাজাকে আগে নির্দিষ্ট জায়গায় ক্যাস্ল্ করা ছিল তাঁর প্রথম চিন্তা। তাঁর খেলার রক্ষণশীল ধরন আক্রমণের ধারটাকেই কেমন ভোঁতা করে দিত। ফলে খেলাটা তখন শুধুই ধৈর্য্য ও সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
দন মানুয়েল বেশিরভাগ সময় হেরে গেলেও ওনার শৈলীটাই বেশি পছন্দের ছিল আমার। কিন্তু যখনই ওই পদ্ধতি প্রয়োগের চেষ্টা করতাম তখনই শক্তিশালী গুটিগুলোকে নাড়ানোর আগেই চ্যাম্পিয়নমশাই খেলায় জিতে যেতেন। একদিন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। একদম অপ্রত্যাশিত বলাও ঠিক হবে না আবার। খেলা শুরুর আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম রাজার ক্যাসল করা ঠেকিয়ে দেব। আমার প্রথমদিকের চালগুলো যথারীতি একেবারে অপেশাদার ছিল। ফলে সেদিকে কোনো লক্ষই করলেন না উনি। নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন এলোপাথাড়ি চাল চালছি তাই নিরুদ্বিগ্ন খেলে যাচ্ছিলেন। নিজের রাজাকে দুর্গে ঢোকানোর ব্যাপারে কোনো তাড়া ছিল না ওঁর।
আমার কালো হাতিটার রাস্তা খোলার জন্য একটা ঘোড়াকে ইচ্ছা করে বিসর্জন দিলাম। ব্যাপারটা বুঝতে চ্যাম্পিয়নমশাইয়ের আধা সেকেন্ড দেরি হলো। তারপর তাঁর শান্ত ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে “গেল” বলে ওঠায় বেশ চমকে উঠি। শব্দটা বারবার বলে চললেন উনি। আমার কাছে কিন্তু কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছিল না খেলায় আমার জয়টা কীভাবে হবে। ট্যাকটিক্যাল জিতটা অবশ্য হয়েছে। আমার হাতির অবস্থানের কারণে ওনার রাজাকে ক্যাসল করা যাচ্ছিল না কিছুতেই। তারপরও জয়ের পাল্লাটা আমার দিকে কীভাবে ঝুঁকে আছে তা বোধগম্য হচ্ছিল না। ওস্তাদ তখন নিজেই নিজেকে হারিয়ে খেলার ইতি টানলেন। পরবর্তী আলোচনায় খেলায় শুরুর দিকের চালের মাধ্যমে সুবিধাজনক ট্যাকটিক্যাল অবস্থান তৈরি করে আক্রমণের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে শেখার চেষ্টা করলাম।
হারের ব্যাপারটাকে শিক্ষকমশাই দৃশ্যত সহজভাবে নিলেও আমি বুঝতে পারছিলাম বিষয়টা তাঁকে বিমর্ষ করেছে। ওনার কথায়, আমার জয়টা ঝড়ে বক পড়ার মতো না। আক্রমণটা খুব প্ল্যানমাফিক সাজানো হয়েছিল। অন্তত শেষের পাঁচটা চাল প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য সব চাল মাথায় রেখে খুব ভেবেচিন্তে নেওয়া হয়েছিল। তারপর উনি বললেন, আমাকে আর মোটেই শিক্ষানবিশ খেলোয়াড় বলা চলে না। আরো বললেন, খেলাটা আমি নিজেও শেষ করতে পারতাম কারণ ওই খেলায় কোনোভাবেই হারা সম্ভব ছিল না যদি না কোনো গুরুতর ভুল চাল আমি দিতাম। আর এই পর্যায়ে এসে আমার পক্ষে আর ওরকম ভুল করা সম্ভব নয়। এসব কথায় আমি তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম। এভাবে একই শিক্ষক থেকে আমার দুটো সার্টিফিকেট পাওয়া হলো। প্রথমটা স্প্যানিশ ভাষায়, দ্বিতীয়টা দাবায়।
পরদিন দন মানুয়েল হাজির হলেন চ্যাম্পিয়নকে হারানোর জন্য অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু সত্যি সত্যি আমি এতে নিজের কোনো কৃতিত্ব দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওনাকে সেটাই বললাম। পুরোটাই একটা কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু স্পষ্টতই তাঁর ফুর্তি যাচ্ছিল না। মনে হয় যতটা না আমার জয়ে, তার চেয়ে বেশি তাঁর সফল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দিয়েছি বলে। উনি এবার একই পদ্ধতিতে তাঁর সঙ্গে খেলতে আহবান জানালেন আমাকে। খেলতে বসে একই পদ্ধতি প্রয়োগ করলাম। নার্ভাস লাগছিল আমার। চ্যাম্পিয়ন আমাদের খেলা দেখছিলেন বসে বসে। জিতে গেলাম খেলাটা। চ্যাম্পিয়নের জন্য সমানে সমান প্রতিপক্ষ একটা জুটেছে ভেবে দন মানুয়েল বেজায় খুশি হলেন। তবে আমি বিষয়টাকে সেভাবে দেখিনি। দাবাখেলাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা কখনোই ভাবিনি আমি। একটা সময় পর্যন্ত অনেক খেলেছি আমরা। চ্যাম্পিয়ন নিঃসন্দেহে আমার চেয়ে অনেক ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। চালের বৈচিত্র্য ছিল তাঁর নখদর্পণে। আর চাল শেখা আর পাল্টা চালে বৈচিত্র্য আনার চর্চায় আমার না ছিল সময়, না ছিল ধৈর্য্য। তবে শুরুর চালের যে বিন্যাস দিয়ে চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে ছিলাম ওটা আসলেই ভাল ছিল। দু’বছর পর মস্কোয় একই কম্বিনেশনে আলেখিনের সঙ্গে একটা খেলা ড্র করেছিলাম। তখনও তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হননি। জানার কোনো সুযোগও ছিল না যে, এই মানুষটাই পরের বছর কাপাব্লাংকাকে হারিয়ে দেবেন।
আমার দাবাজ্বর অচিরেই কেটে গেল। এল এরাল্দোর সম্পাদনার কাজটা ছিল যেমন আকর্ষণীয় তেমনি আনন্দের। এরপর সেখানকার সমাজতন্ত্রী দলের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে গেলাম। প্রথমেই যে কাজটা করলাম সেটা হচ্ছে পার্টির মুখপত্র কাগজটিকে আট পৃষ্ঠার নিয়মিত সাপ্তাহিকে বদলে দিলাম। ওটার জন্য সামান্য যে টাকাপয়সা দরকার ছিল সেটার ব্যবস্থা করা আমার জন্য কঠিন ছিল না। দলের সম্পাদকের কাছ থেকে ছোট প্রেসটাও কিনে নেওয়া হলো। নতুন কিছু যন্ত্রপাতি আর টাইপসেট যোগ করা হলো। ওটা পার্টির মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হলো। স্থবির অবস্থা কাটিয়ে দল শেষমেশ এগোচ্ছে দেখে সান্তিবানঞেস যারপরনাই খুশি হলেন। পুরো সময়টাতে পার্টির অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব রাতের পর রাত আলোচনায় দারুণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। সোশ্যালিস্ট পার্টি মার্কসবাদকে সহজে স্বীকার করতে রাজী ছিল না। আমাদের এসব আলোচনা এই ছোট বৃত্তের বাইরে নিয়ে যেতে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু প্যামফ্লেট ছাপার বুদ্ধি দিলাম। পার্টির প্রেসের পেছনে যে পয়সা খরচ করেছি সেটা কাজে লাগানোর ভাল উপায় সেটা। আধাডজন প্যামফ্লেট বের করলাম যার অধিকাংশ আমার লেখা। তারপর বললাম, এবার সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্যে একটি সম্মেলনের ডাক দিয়ে সমাজতন্ত্রী দলের পক্ষ থেকে একটি ইশ্তাহার প্রকাশ করা হোক।
এসবই ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। রাশিয়া থেকে বলশেভিক বিপ্লবের সংবাদ ততদিনে “নয়াবিশ্বে” পৌঁছে গেছে। এই খবরে যারা প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখত তাদের কল্পনা যেন ছুটতে শুরু করল। বিষয়টা স্বপ্ন রইল না আর। ইউটোপিয়া রইল না। সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি প্রতিষ্ঠার ডাকের বিষয়টিকে অবাস্তব কল্পনা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আর থাকল না। রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকারের সম্ভাবনা যখন থেকে বাস্তব রূপে দেখা দিল তখন থেকে রাষ্ট্রের প্রতি নৈরাজ্যসিন্ডিকেটবাদী তাত্ত্বিক পূর্বানুমানভিত্তিক বিরুদ্ধতার দৃষ্টিভঙ্গী একটা ঝাঁকুনি খেল। ইশ্তাহার তো ব্যাপক সাড়া ফেলে দিল। “লা লুচা”-র যে সংখ্যায় ইশ্তাহারটা প্রকাশ হয়েছিল সেটার তিনটি সংস্করণ করতে হলো। প্রদেশগুলো থেকে অসংখ্য চিঠি এল সম্মেলনে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে।
সমাজতন্ত্রী দলের কার্যনির্বাহী পরিষদ সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে আলোচনায় বসল। দলের কয়েকজন সদস্য এতে স্পষ্টতই বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছিল যতটা গিলতে পারবেন তার চেয়ে বেশি যেন মুখে ঢুকিয়ে ফেলেছেন। বিরাট বড় সম্মেলন হতে চলেছে এটা যার আয়োজন কোনো খেলার কথা না। পয়সা কই? ও বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না বলে আশ্বস্ত করলাম। জনগণের স্বার্থে টাকা তোলা যাবে। কিন্তু সম্মেলন আয়োজনে তাড়াহুড়ো করা চলবে না। যথেষ্ট সময় ও প্রস্তুতি নিয়ে করতে হবে। সম্মেলনকে সফল করতে হবে এমনভাবে যাতে শুধু মেক্সিকো নয়, সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে শ্রমিক শ্রেণী গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটা কাজ করতে হবে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে। সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ, বৃহৎ মাত্রার প্রচারণা, সিদ্ধান্তসমূহ লেখা, এছাড়া আরো অনেককিছু। সকলে উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে, কিন্তু ঠিক কী করতে হবে কারোরই তেমন জানা নেই। সুতরাং বৈঠক শেষে দেখা গেল আমাকে পার্টির সম্পাদক ও পার্টি প্রোপাগান্ডার পরিচালক পদে বসানো হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার অপরাপর দেশ থেকে ভাতৃপ্রতীম প্রতিনিধিদের নিমন্ত্রণ করে সম্মেলনে নিয়ে আসার বাড়তি দায়িত্বটাও আমার ওপর পড়ল। সেই কুঁড়ের দলের সদস্যরা ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভাতৃপ্রতীম প্রতিনিধিদল হিসেবে যোগদানের আগ্রহ জানিয়ে রেখেছিল।
মেক্সিকোয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলন আয়োজনের এই তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে দন মানুয়েল একদিন আরেকটা কূটনৈতিক মিশনের ব্যাপারে ডেকে পাঠালেন। জানালেন, রাষ্ট্রপতি আমায় সাক্ষাৎ প্রদানে খুশি হবেন। জার্মান লিগেশনে ( German Legation ) * রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যে সাক্ষাৎ হয়েছিল সেটা ছিল অনানুষ্ঠানিক। এই সাক্ষাৎটি হবে আনুষ্ঠানিক, রাষ্ট্রপতির রাষ্ট্রীয় নিবাসে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন উপস্থিত থাকবেন এবং আমাকে দুপুরের ভোজ পর্যন্ত থাকতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দন মানুয়েলের কাছে আরো শুনলাম সমাজতন্ত্রী দলটাকে পুনর্গঠনে আমার নানাপ্রকার তৎপরতা রাষ্ট্রপতি পর্যবেক্ষণে রাখছেন এবং এর ফলাফলের ব্যাপারেও গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। বিশেষ করে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ভাতৃপ্রতীম প্রতিনিধিদের নিয়ে আসার চেষ্টা কী দাঁড়াবে সেই বিষয়ে তিনি বিশেষ আগ্রহী। তারপর তিনি এও স্বীকার করে নিলেন যে মেক্সিকোর কূটনৈতিক ও দূতাবাসগুলোর সহায়তা এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যাবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এই মোলাকাত কেঠো আনুষ্ঠানিকতায় শেষ হবে না, দন মানুয়েলের কথায় সেটা বুঝে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হলো বেশ একটা ফলদায়ক আলোচনাই হবে হয়তো।
গণপ্রজাতন্ত্রী মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতির আবাস ছিল চাপুলতেপেকের পুরাতন দুর্গে। সুশোভিত এক পার্কের মাঝখানে একটা টিলার ওপরে ছিল রাষ্ট্রপতির বাড়িটা। একটা চওড়া রাস্তা পার্ক থেকে মূল শহর পর্যন্ত চলে গেছে। নয়াবিশ্বের ওটাই শঁজেলিজে। নিত্য সেখানে সুবেশা নরনারীদের আনাগোনা চলে যেন প্রাত্যহিক ফ্যাশন প্যারেড। আঁকাবাঁকা পথটা চলে গেছে পার্কের একেবারে ভেতরে। সেখানে চাঁদোয়ায় ছাওয়া বিলাসবহুল আহারকেন্দ্রগুলোতে ফ্যাশনদুরস্ত অশ্বারোহীদের এলাহী খাবার পরিবেশন করা হতো। ভাগ্যবিড়ম্বিত রাজা ম্যাক্সমিলিয়ান ও রানী শার্লটের সময় থেকেই বিশ্বশ্রেষ্ঠ ঘোড়াগুলোর কয়েকটি এই চাপুলতেপেকের বিখ্যাত আাঁকাবাঁকা পথে কখনও মৃদুছন্দে পা ফেলেছে আবার কখনও টগবগিয়ে ছুটেছে। তাদের গর্বিত আরোহীদের তালিকায় ইউরোপের স্বনামখ্যাত প্রত্যেকের নামই পাওয়া যাবে।
মেক্সিকোর ইতিহাসে ঘোড়ার স্থান অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে অশ্ব প্রজাতি কিন্তু নয়াবিশ্বের আদিবাসিন্দা নয়। স্প্যানিয়ার্ডদের হাত ধরে প্রথম ঘোটক প্রজাতির প্রবেশ ঘটে আমেরিকা মহাদেশে। অদ্ভুতদর্শন প্রাণীপৃষ্ঠে আসীন হওয়ার সেই দৃশ্য নব্যআবিষ্কৃত মহাদেশের অধিবাসীদের পরাভূত করায় খুব যে নগণ্য ভূমিকা রেখেছিল তা নয়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন অ্যাজটেকদের কাছে ঘোড়ায় সওয়ার স্পেনবাসীদের নিশ্চয়ই নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী মনে হয়েছিল। নিশ্চয়ই তারা ভেবেছিল স্বর্গ থেকে স্বয়ং দেবতাকুল অবতরণ করেছেন। যদিও ভাবার কোনো কারণ নেই যে বেরিং প্রণালী পেরিয়ে আমেরিকার আদিবাসীরা এশিয়া থেকে এই মহাদেশে পদার্পণ করেছে, তবে মেক্সিকান ঘোড়ার আদিবাস এশিয়া তাতে সন্দেহ নেই। মুসলমানদের হাত ধরে আরবী ঘোড়া প্রথম স্পেনে পা রাখে। স্প্যানিয়ার্ড বিজেতাদের পিঠে নিয়ে সেই ঘোড়া আসে নয়াবিশ্বে। মেক্সিকোর ঘোড়া আরবী ঘোড়ার চেয়ে আকারে ছোট। তবে খুবই চিত্তাকর্ষক সন্দেহ নেই। বাস্তবিক অর্থে প্রত্যেক মেক্সিকানই পাকা ঘোড়সওয়ার। মেক্সিকো যেহেতু আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমিতে পরিণত হলো আমাকেও তাই ঘোড়ায় চড়াটা শিখে ফেলতে হলো। ঘোড়ায় চড়া ব্যাপারটা আমার বরাবরের পছন্দ ছিল আর চাইতামও ভালভাবে খেলাটা শিখতে। কিন্তু সুযোগ পাইনি তেমন। ভারত ছাড়ার আগে আগে কলকাতা ময়দানে কিছুদিন চর্চা করেছিলাম মাত্র। তখন অধিকাংশ সময় পালিয়ে থাকতে হতো আমায়। আমার আশা ছিল ভোর ভোর উঠে ময়দানে গেলে তেনাদের চোখ এড়িয়ে প্র্যাকটিস করতে পারব। ভাবনাটা ভুল ছিল। ঠিক তিন কি চার দিনের মাথায় দেখি সিআইডির স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের তখনকার প্রধান ডেনহ্যাম দিব্যি ঘোড়ায় চড়া প্র্যাকটিস করছেন। ঘোড়ায় চড়ার অনুশীলনের সেখানেই ইতি টানতে হলো। মেক্সিকোয় যখন সুযোগটা আবার এল মহাউৎসাহে নেমে পড়লাম। কিন্তু চাপুলতেপেকের ওই আঁকাবাঁকা পথে কেতাদুরস্ত ঘোড়সওয়ার, যাদের আবার বেশিরভাগই বিদেশী, এদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়া আমার পছন্দ ছিল না। ওখানে দিনকয়েক চর্চার পর যখন জিনের ওপর বসা অভ্যাস হয়ে গেল গ্রামের পথে পথে ভ্রমণকেই বেছে নিলাম। মেক্সিকোর মানুষ স্প্যানিশদের ভঙ্গীতে ঘোড়ায় চড়ে, লম্বা রেকাবে পা পুরোপুরি ছড়িয়ে দিয়ে। ইংরেজদের চেয়ে এই ভঙ্গী আমার কাছে খুবই আরামদায়ক মনে হলো। মেক্সিকান ঘোড়ার জিনও অনেক আরামদায়ক। ঘোড়সওয়ার অনেক নিরাপদে জিনে বসতে পারে। এই ব্যবস্থায় চৌকস ঘোড়সওয়ার দুই হাত পুরোপুরি আলগা করে বসতে পারে কারণ লাগামটাকে জিনের অগ্রভাগের ( pommel ) ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। সিলভার কিংএর (সাদা যে ঘোড়াটাকে নিয়মিত ভাড়া করতাম সেটার নাম) পিঠে বসে পোষা অ্যালসেশিয়ানকে পাশে নিয়ে প্রত্যেকদিন সকালে শহরের পাড়াগুলো চষে বেড়াতাম আমি। চলে যেতাম সিয়েরা নেভাদার নিচের ঢালে। সেখানকার গ্রাম্য মানুষগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল এভাবে।
যে সময়টাতে আমি মেক্সিকোতে গিয়েছিলাম তাদের পুরানো আলো ঝলমলে দিন ততদিনে অস্তমিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও চাপুলতেপেক এভিনিউয়ে তার অবশেষ রক্ষিত ছিল। প্রত্যেক বিকেলে উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত অভিজাত মহিলাদের বহন করে মোটরগাড়ির বহর ভীড় করে দাঁড়াত। মহিলাদের সঙ্গী হিসেবে দেখা যেত ঝকঝকে সামরিক পোশাকধারী পুরুষদের। মেক্সিকো সিটি সম্পর্কে কিছুমাত্র আগ্রহ আছে এমন কারো পক্ষে চাপুলতেপেক অ্যাভিনিউয়ে অলস ভ্রমণ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রপতি নিজেও ব্যতিক্রম নন। প্রতিদিন শেষ বিকেলে তাঁর কালো লিমুজিন দুর্গফটক দিয়ে বেরিয়ে শহরের দিকে চলে যেত আবার ফিরেও আসত। দুর্গফটক থেকে অ্যাভিনিউয়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে আধা ঘণ্টা লাগত। এই পুরো সময়টা রাষ্ট্রপতি মৃদুহাস্যে টুপিটি তুলে পার্কভ্রমণে আসা অগুনতি সুশোভিত নরনারীর অভিবাদনের প্রত্যুত্তর দিতেন।
টীকা
* লিগেশন অ্যাম্বাসির চেয়ে কম কূটনৈতিক মর্যাদার দূতাবাসকে বলা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত লিগেশন ধরনের দূতাবাসের ব্যবহার ছিল। দূতাবাস অর্থাৎ অ্যাম্বাসির প্রধানকে রাষ্ট্রদূত বা অ্যাম্বাসেডর এবং লিগেশনের প্রধানকে মিনিস্টার বলা হয়। যেসব প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল তাদের নিয়ে কমনওয়েলথ গঠন করা হয়। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর একটি আরেকটিতে দূতাবাস স্থাপন করলে তাকে হাইকমিশন এবং রাষ্ট্রদূতকে হাইকমিশনার বলা হয়। কমনওয়েলথের বাইরে বাকি দেশগুলোর দূতাবাসকে অ্যাম্বাসি ও রাষ্ট্রদূতকে অ্যাম্বাসেডর বলা হয়। এভাবে এক কমনওয়েলথভুক্ত দেশ কমনওয়েলথভুক্ত নয় এমন দেশে দূতাবাস স্থাপন করলে তাকে অ্যাম্বাসি এবং ওই দেশে কমনওয়েলথভুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতকে অ্যাম্বাসেডর বলা হয়। অ্যাম্বাসেডর এবং হাইকমিশনার একই কূটনৈতিক পদমর্যাদাভুক্ত।
চলবে