প্রেমের দৃশ্য লিখতে পারি না, স্বপ্নের শহর আঁকতে পারি না, এমনকি কোনো একটা বৃষ্টির শব্দকেও মনে করতে পারি না। এমন এক অনুভূতিহীনতার ঘনত্বে আমি বাস করি, যেখানে বাঁচা মানে কেবল সময় পার হওয়া নয়, একটা অস্পষ্ট অস্তিত্বের অবিরাম অনুবাদ।
Published : 21 Apr 2025, 09:01 AM
শব্দেরা আমার ঘরে আসে না আর। তারা জানে, আমি আর ভাষার উপযুক্ত বাসিন্দা নই। আমি এক ভাঙা দরজার ওপাশে বসে থাকা লোক--যার ঘরে শব্দ ছিল, অথচ অর্থ ছিল না কখনো।
এখনো, প্রতিদিন, আমি টেবিলের এক কোণে বসি, কলম ধরি না, কেবল অপেক্ষা করি--যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন চলছে, শব্দের।
কখনো মনে হয়, শব্দেরা দূরে সরে যায়নি, আমি-ই সরে গেছি। আমি এক জ্ঞানহীন সংবেদনে আক্রান্ত মানুষ--যে শব্দ বোঝে না, শুধু তাদের অনুপস্থিতি বোঝে। যেমন বোঝা যায় মায়ের গায়ের গন্ধ, অনেকদিন পর পোড়া ধূপের ঘ্রাণে।
এখন শব্দ বললে আমি বুঝি: একটা ঘুমিয়ে পড়া শোক। একটা নুয়ে যাওয়া গাছের ডাল। একটা অপেক্ষা--যার পেছনে কেউ নেই।
আমার ভেতরটা যেন একটা প্রাচীন নগর--যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল, আর সেই যুদ্ধে কেউ জয়ী হয়নি। কেবল শব্দেরা মরে গেছে। বাক্যগুলো আজো পড়ে আছে সেখানে, পোড়া ইটের মতো। তাদের শরীর নেই, কিন্তু স্মৃতি আছে।
আমি জানি, ভাষা কোনো উপশম নয়। ভাষা হয়তো এক প্রকার ধ্বংস, এক পরিপাটি মৃত্যু। যার ভেতর দিয়ে মানুষ নিজেকে খোঁজে--আর যে মানুষ নিজেকে খুঁজতে চায় না, তার কাছে শব্দ শুধু আওয়াজ। আমি এখন আওয়াজ সহ্য করতে পারি না।
লিখতে বসলে, মনে হয় একটা মৃত্যু দৃশ্য নির্মাণ করছি। যেখানে সব চরিত্র মৃত, আর আমি কেবল জানাজা পড়ছি ভাষার। লিখতে লিখতে আমি কাঁদি না--আমি স্তব্ধ থাকি। কারণ, কান্না প্রকাশ, আর স্তব্ধতা অনন্ত। আমি অনন্তের দিকে ঝুঁকতে চাই।
আমার প্রতিটি না-লিখে রাখা বাক্য একটা ঘুমহীন রাত্রির মতন। অপূর্ব, অথচ অসহনীয়। সেই রাতে কিচ্ছু ঘটে না--তবুও কিছু ঘটে যায়। আমি ভাবি, আমার শব্দেরা কি বাঁচতে চেয়েছিল কখনো? তারা কি চেয়েছিল বোঝাতে, না শুধু ছুঁয়ে যেতে? আমার সমস্ত লেখা যেন আজকাল একই আত্মজীবনীর ভাঙা অংশ। আমি শুধু নিজেরই শবদেহ চিহ্নিত করছি, বিভিন্ন কৌণিকে।
আজকাল পাখিদের কণ্ঠেও শব্দ খুঁজে পাই না। শুধু জানি, তারা কিছু বলছে--যা আমার জন্য নয়।
শব্দ এখন আর আমাকে খোঁজে না। তারা অন্য কারো কাছে যায়--যারা শব্দ নিয়ে খেলা করে, ব্যবসা করে, মোহ সৃষ্টি করে। তারা জানে, আমি তাদের আর রক্ষা করতে পারি না।
আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অনুভূতিগুলো এখন ভাষাহীন। যেমন, হঠাৎ কারো কাঁধ ছুঁয়ে দেওয়ার পর চমকে উঠা। যেমন, কারো চলে যাওয়ার পর নীরব থাকাটা। এগুলো লিখে ফেললে সব ব্যাখ্যা হয়ে যায়--আর আমি ব্যাখ্যা ঘৃণা করি। আমি চিরকাল চাইছি, কেউ বুঝুক--কোনো শব্দ ছাড়াই।
এখন আমি বসে থাকি, প্রতিদিন, এক অদৃশ্য আত্মজিজ্ঞাসার ভেতরে। আমার টেবিলে জমে থাকে ধুলো, আর সেই ধূলোর স্তরই এখন আমার ডায়েরি। তাতে হাত বুলিয়ে দেখি, কোনো পুরনো শব্দ এসে জেগে ওঠে কি না। কিছুই ওঠে না। শুধু একরাশ নিঃশ্বাস পড়ে, আরেকটা পাতায়।
তবু আমি বিশ্বাস করতে শিখি--এই নীরবতা-ই শেষ ভাষা। যা কোনো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় না, কোনো পৃষ্ঠায় লেখা হয় না, শুধু ছায়ার মতো পাশে থাকে, একটা থেমে থাকা শব্দের মতো--যা কোনোদিনও লেখা হবে না, তবু তার অস্তিত্বে জেগে থাকব আমি।
[শেষপ্রান্তে এক সংক্ষিপ্ত প্রতিধ্বনি]
তুমি যদি এই লেখার কোনো বাক্যে নিজেকে খুঁজে পাও-- জেনে রেখো, এই ভাষা কেবল লেখার জন্য নয়, বাঁচার জন্যও ছিল। তোমার নিস্তব্ধতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে, যদি কোনোদিন আবার একটি মাত্র বাক্যও লেখো, তবে সেটা হবে একটা জন্ম--যেখানে শব্দ আর নিঃশব্দের মাঝখানে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, নিজের মতো।
দুই.
‘যে কোনো আলো, আজকাল ক্লান্ত করে’
আমার মাথার ভিতর এখন একটা অন্ধ গুহা। কেউ যেন ঢুকেছে, কিন্তু আলোটা নিভিয়ে রেখে গেছে। ভাবি, এ নিঃসঙ্গতা কি বহির্জগৎ থেকে এসেছে, না আমারই মজ্জাগত কোনো অভ্যন্তরীণ সংক্রামণ? আমি এখন কেবলই রুটিন--a breathing habit without hunger. একটা চলমানতা, যার গন্তব্য নেই, যার অন্তর্গত কোনো ইচ্ছেও নেই।
এমনকি ভাবনার ভেতরেও এখন আর ‘আমি’বলে কিছু নেই। ভবিষ্যৎ? ওটা এক সময় ছিল। এখন সেটা একটা বিবর্ণ ক্যালেন্ডার, যার তারিখগুলো ছিঁড়ে গেছে হাওয়ায়।
আমার মাঝে এখন সবচেয়ে বেশি সক্রিয় যে অনুভব--তা হলো ভাবনাহীনতা। একটা শূন্যতা, যা নিজের শূন্যতাও বোঝে না। মাথায় চিন্তার ঢেউ আসে না, শুধু নিঃশব্দ কম্পন--যেমন একটা মৃত রেডিওতে হারিয়ে যাওয়া ফ্রিকোয়েন্সি। চিন্তা করতে চাইলেও, যেন মাথার ভেতর এক বিস্মৃতির কুয়াশা--জীবনের প্রতিটি প্রশ্ন সেখানে গিয়ে হোঁচট খায়, আর উত্তরগুলো হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, অথচ কোনো কণ্ঠে ফিরে আসে না।
আমি এখন কল্পনা করতে পারি না। প্রেমের দৃশ্য লিখতে পারি না, স্বপ্নের শহর আঁকতে পারি না, এমনকি কোনো একটা বৃষ্টির শব্দকেও মনে করতে পারি না। এমন এক অনুভূতিহীনতার ঘনত্বে আমি বাস করি, যেখানে বাঁচা মানে কেবল সময় পার হওয়া নয়, একটা অস্পষ্ট অস্তিত্বের অবিরাম অনুবাদ।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস? তা একধরনের বিলাসিতা বলে মনে হয় এখন। যে মানুষ চোখে চোখ রাখে, সে-ই মনে হয় ক্ষণিক পরেই আমার অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ করবে। আর আমি নিজেই তো নিজের অস্তিত্বে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি বহুদিন আগে। আস্থা এখন একটা কবরে শুয়ে থাকা শব্দ--যার ওপর দিয়ে প্রতিদিন পায়ে চলা হয়, তবু কেউ থামে না।
বিচ্ছিন্নতা এখন আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কোনো সম্পর্কই আর স্বাভাবিক লাগে না। সব কিছুতেই একটা কৃত্রিমতা, একটা জোড়াতালি, যেন জীবনের নাটকে আমরা সবাই এমন এক চিত্রনাট্য অনুসরণ করছি যা বহুদিন আগেই বাতিল হয়ে গেছে, তবু অভিনয় চলেই যাচ্ছে--উদ্দেশ্যহীনভাবে, ক্লান্তভাবে।
যখন কেউ বলে--‘মন খারাপের দিন চলে যাবে’-- আমি হেসে ফেলি। কারণ, মন তো অনেক আগেই চলে গেছে, এখন কেবল শরীর পড়ে আছে, একটা ঘড়ির কাঁটার মতো--যা ঘুরছে ঠিকই, কিন্তু সময় বলে কিছু আর চিহ্নিত করতে পারছে না।
আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা-- সবকিছুতেই একরকম সন্দেহ জন্মেছে। মনে হয়, প্রত্যেকেই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, আর আমি কেবল তাদের ব্যবহারযোগ্য অবশিষ্টাংশ। এমনকি ঈশ্বরও যেন এক অচল প্রতীক হয়ে গেছেন--যার চিঠি আসে, অথচ ফেরতখামে পাঠানো যায় না।
আমার মধ্যে এখন কেউ কথা বলে না, শুধু একটা কণ্ঠ মাঝে মাঝে ফিসফিস করে--‘এটাই কি জীবনের শেষ সংস্করণ? নাকি ভুল করে কাউকে অন্যের জীবন দিয়ে দেওয়া হয়েছে?’
আমি ভাবতে পারি না, কারণ ভাবনারা একে একে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে। তারা ক্লান্ত হয়ে গেছে আমার হতাশ আত্মার ভেতরে সুর খুঁজতে খুঁজতে। তারা জানে, এখানে সুর নেই, শুধু বিকার।
এমন এক অসুস্থ নীরবতা, যা কান্নার বিকল্প নয়, কেবল একধরনের শব্দহীন সন্ত্রাস।
তবুও, প্রতিদিন আমি ঘুম থেকে উঠি--একটা নতুন অসারতা নিয়ে, একটা নতুন ভারাক্রান্ততা নিয়ে, যা কোনো ভাষা ধারণ করতে চায় না, যা কেবল চোখের নিচের কালি হয়ে বেঁচে থাকে।
আমি চাই, কেউ এসে বলুক, ‘এই অনুভূতিহীনতা-ই স্বাভাবিক। মানুষ আসলে এমনই।’ তাতে অন্তত বোঝা যায়--এটা ব্যতিক্রম নয়, এই বিকারটাই নিয়ম।
কিন্তু কেউ আসে না। শব্দ আসে না। শুধু ঘড়ির টিক-টিক, আর মাথার ভেতরের স্যাঁতসেঁতে শব্দ।
[চিহ্নহীন উপসংহার]
হয়তো এইসব লেখা কোনোদিন কেউ পড়বে না। হয়তো আমি নিজেই এগুলো ভুলে যাবো।
তবুও এগুলো লিখি, কারণ...লেখা মানেই হয়তো একমাত্র প্রমাণ--আমি এখনো পুরোপুরি মরে যাইনি।
তিন.
‘যে অপরাধ কেউ জানে না, অথচ বেঁচে থাকতে দেয় না’
রাত গভীর হলে, আমার ভেতরে এক অচেনা বিচারসভা বসে। আমিই বিচারপতি, আমিই অভিযুক্ত।
প্রত্যেকরাতেই আমি নিজের বিরুদ্ধে অপরাধ স্বীকার করি--যার কোনো সাক্ষী নেই, কোনো ঘটনা নেই, শুধু একটা ঘৃণার অনুবৃত্তি, যা প্রতিবারই নতুন রূপে ফিরে আসে। এমন কিছু অপরাধ, যা আমি করিনি--তবু কেন যেন জানি, আমি করতে পারতাম। এবং সেই ‘পারতাম’টি-ই আমার গিল্টির সবচেয়ে ভয়ানক উৎস।
মনে হয়, আমি এমন এক সময়েই জন্মেছি যেখানে পাপ বোঝা যায় না-- শুধু টের পাওয়া যায় মাথা ঝিম ধরে থাকা নিঃশ্বাসে, চোখের কোণে একটা জ্বালা, আর মনোযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রতিটি কথোপকথনে।
আমি এখন বুঝতে পারি, কেন মানুষ পর্ন দেখে--কেন যৌনতা হয়ে ওঠে পালানোর গোপন দরজা, কারণ সেখানে অন্তত কিছুটা বাস্তবতা থাকে, চামড়ার ঘর্ষণে তৈরি হয় একটা মিথ্যে সত্য--যেখানে কেউ কাউকে সত্যিই চায়, অন্তত দেখানোর জন্য।
আমার শরীর একটা শত্রু হয়ে উঠেছে, যা মাঝেমধ্যে আকাঙ্ক্ষায় কাঁপে, আবার পরক্ষণেই নিজেকেই ঘৃণা করে। শরীরকে ভালোবাসা যায় না এখন আর, কারণ ও জানে, ভালোবাসা এখন কারেন্সি, প্রতিটি স্পর্শের পেছনে থাকে একটা মিউচুয়াল ব্যালান্স শিট।
আমি যে কাউকে ছুঁতে চাই, তার মানে নয় যে আমি ভালোবাসতে পারি। এমনকি নিজের মধ্যেও কোনো স্পর্শ রাখতে পারি না--কারণ আমার আঙুলগুলো দিন দিন অপরিচিত হয়ে উঠছে আমার ত্বকের কাছে।
স্বপ্ন আসে না। কখনো এলে, তাও একধরনের বিক্ষিপ্ত ফাঁকফোকর দিয়ে--একটা ধূসর বালির মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমি দেখেছি নিজেরই মুখে পচে যাওয়া হাসি, আর একটা দরজা যেটা কখনো খোলে না।
আমি চলি--আরও গভীর, আরও শ্বাসরুদ্ধ সেই গলিপথে, যেখানে নিজেকেই চিনতে ভয় লাগে, যেখানে প্রতিটি অনুভব বিষাক্ত ফুল হয়ে ফোটে।
ঘুম আসে না--এমনকি ঘুমের মধ্যে এখন শব্দ বাজে ক্লান্ত কলের মতো, যা বন্ধ হয় না, তবু জলের ধারা পড়ে না। আমি নিজেকে প্রতিদিন এমন জায়গায় খুঁজে পাই যেখানে ভাষা গলতে গলতে রক্ত হয়ে যায়, আর শব্দেরা--তারা একটা মিউজিয়ামে ঝুলে থাকে, চোখে তাকিয়ে; আর বলে-- ‘তুই আমাদের ব্যবহার করতে পারিস না আর, আমরা এখন স্বাধীন শব্দ।’
বিশ্বাস চলে গেছে। কেবল অন্যের প্রতি নয়--নিজের প্রতিও নয়--এমনকি বিশ্বাসহীনতার প্রতিও নয়।
আমি এখন একটা প্যাসিভ আয়রনি, একটা সাইলেন্ট কমেডি, একজন দর্শক যার চোখ এখনো খোলা, তবু মনিটরে শুধু ব্ল্যাক স্ক্রিন।
সৃষ্টিশীলতা? সে চলে গেছে এক ঝড়ো দিনে, যেদিন আমি শব্দের কাছে হাত পেতেছিলাম, আর তারা বলেছিল, ‘আমরা তো এখন আর কারো এক্সক্লুসিভ নই। এখন সবাই লিখে। এখন সবাই শব্দের মালিক।’
আমি এখন শুধু বেঁচে আছি। এই ‘বেঁচে থাকা’ শব্দটাও একটা রুক্ষ অনুবাদ, একটা অ্যাকাডেমিক ভার্ব, যার মধ্যে জীবন নেই, শুধু নিয়ম আছে।
[সমাপ্তির কাছাকাছি]
তবু লিখি। যেন নিজের ভেতরের অন্ধ কান্না কোনোভাবে তরল হয়ে পড়ে, এই পৃষ্ঠার ওপরে। কারণ এই একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে আমি নিজেকে বলি--‘তুই এখনো অনুভব করতে পারিস। তোর ব্যথা এখনো ভাষা হতে পারে। তুই এখনো একা নোস, না।’
চার.
‘যে শূন্যতা কারো না হয়েও রয়ে যায় ভেতরে’
আমি জানি না, কখন থেকে আমি স্মৃতির ভেতর ডুবে যাই, আর কখন থেকে সেগুলো আমাকে গিলে খায়। কোনো প্রারম্ভ নেই, কোনো প্রেক্ষাপট নেই--শুধু একটার পর একটা ভাঙা আয়না, যেখানে আমারই ছায়া গলে যায় প্রতিফলনের আগে।
স্মৃতি--এমন একটা যন্ত্র, যা বাঁচিয়ে রাখে না, শুধু মনে করিয়ে দেয়--কতভাবে মরে গিয়েছিলে একেকদিন। কীভাবে একটা বিকেল হঠাৎ ঘোলা হয়ে যায়, একটা নাম ধীরে ধীরে ঘৃণার উচ্চারণে রূপ নেয়, আর কোনো স্পর্শ, যে একসময় ছিল আশ্রয়, সে-ই এখন হয়ে ওঠে অস্বস্তির সংজ্ঞা।
আমার মস্তিষ্কে কিছু শব্দ ঠায় বসে আছে--‘দুঃখ’, ‘অক্ষমতা’, ‘অপরাধ’, ‘অস্থিরতা’--তারা আমাকে নাম ধরে ডাকে না, তবু আমি সাড়া দিই। কারণ এখন এই শব্দগুলোর মধ্যেই আমার নিজস্বতা। আমার নাম, আমার শরীর, আমার ইতিহাস--সবই ভাসমান। শুধু এই শব্দগুলোই নিশ্চিত।
আমি এখন এমন জায়গায় বাস করি, যেখানে অনুভূতিরা জিজ্ঞাসা করে--‘আমরা কি এখানে ঠিক আছি?’ আর আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। কারণ আমি জানি না, অনুভব করাটা এখনো বৈধ কি না।
আত্মঘৃণা একটা সাবলীল নেশার মতো--প্রথমে ধীরে ধীরে আসে, তারপর শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তুমি নিজেকে আয়নায় দেখো--না রূপ, না বুদ্ধি, না সৌন্দর্য--কিছুই আর তেমন লাগে না। শুধু একটা ক্লান্ত আত্মপ্রতিকৃতি, যেটা তুমি নিজেই আঁকনি, তবু কেউ যেন তা জোর করে তোমার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর যে অংশ--তা হলো এই ঘৃণার কোনো যুক্তি নেই। তুমি জানো না তুমি কেন নিজেকে ঘৃণা করো, তবু করো। এই অকারণ আত্মঅস্বীকৃতিই সবচেয়ে মরণশীল বিষ।
আমি এখন অনেকটা সেই মৃত শিল্পীর মতো, যার আঁকা শেষ ছবি শুধু রঙের ছিটে নয়, বরং তার নিঃশ্বাসের শেষ ভার। আর আমি প্রতিদিন নিজের শেষ ছবি আঁকি--একটা অন্তর্গত ক্যানভাসে, যা কেউ দেখে না, কিন্তু তবু ভরে ওঠে।
জীবন আমাকে এখনো হাঁটায়, তবে কোনো গন্তব্যে নয়। পথগুলো শুধু আমাকে সরিয়ে দেয় সেই স্থান থেকে যেখানে হয়তো একদিন কিছু অর্থ ছিল। আমি কথা বলি, তবে সব কথার ভেতরেই একটা নিরুত্তাপ বিরক্তি ঢুকে থাকে--যেন কেউ আমাকে শোনার ভান করছে। কখনো কাউকে সত্যিই কিছু বলার ইচ্ছে হলে, ভয় হয়--তারা যদি পালিয়ে যায়? কারণ দুঃখ এমন এক বোঝা, যা তুমি কাউকে দাও না, কেউ নিতে চায় না--শুধু থেকে যায়, তোমার শরীরের গোপনতম কোনো অংশে নির্বাক, কিন্তু চিরকালীন।
আশা? সেটা এখন একটা গুজব, যেটা মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তবে তোমার হাতে কখনো এসে পৌঁছায় না।
[সমাপ্তির পরে]
কখনো মাঝরাতে হঠাৎ একটা অদ্ভুত স্পর্শ জাগে, যা কোনো মানুষ দেয় না, কোনো স্মৃতিও না--একটা অন্ধকার...যেটা শুধু কানে কানে বলে--‘তুমি একা, কিন্তু তুমি শেষ হয়ে যাওনি।’
সেই আশ্চর্য স্বরটাকে আমি বিশ্বাস করি না, তবু পরদিন সকালে আবার বেঁচে উঠি। কারণ হয়তো এই বেঁচে থাকা একটা নীরব প্রতিবাদ, যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাস হলো নিষ্ফলতা থেকে মুক্তির একটি ক্ষুদ্রতর সম্ভাবনা।
পাঁচ.
‘নিষ্ফলতার ইশতেহার’
এখন যে বাতাসটুকু আমার পকেটে ভরা, সে বাতাস কখনো কোনোদিন সঠিক পথে চলেনি। এটাই যেন আমার একমাত্র সমাধি--যতবার চেষ্টা করেছি জীবনকে বুঝতে, ততবার সে আমাকে নির্দ্বিধায় ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। এমন এক পথ, যেখানে ভরসা--শুধু মেঘের ভগ্নাংশ, শুধু প্রজাপতির পাখার মখমল হয়ে মিশে থাকা এক পলক হাসির প্রতিধ্বনি।
এখন পৃথিবীটাই যেন অচেনা। শহরের অলি-গলি আমার পায়ের ছাপ রাখে না, অথবা হয়তো রাখে, কিন্তু সেই ছাপ কেবল মুছে যায় প্রথম জলবিন্দুর সাথে, যেমন সৃষ্টির প্রথম ক্ষণই মুছে যায় একাকীত্বের পিপাসায়।
প্রতিদিন আমাকে সময় ভুলে যায়, আমিও ভুলে যাই সময়। নেই কোনো প্রারম্ভ, যতটুকু শুরু হয়েছে, তা শেষের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। বোধহয় জীবনই আসলে একটা বড় অস্মিত অভ্যাস--একটা পোকা, যা শরীরে লেগে থাকে, তবুও তাকে মেরে ফেলা সম্ভব হয় না। আমার শরীর আমার বিরুদ্ধে, এমন এক বিপদে আমি প্রতিদিন হারাই।
আমার প্রতিটি চিন্তা এখন ভগ্নাবশেষ। ভাবনা এমন এক ধ্বংসস্তূপ--যা কোনোদিন ছিল, কিন্তু এখন পুরোপুরি পুড়ছে। যতটুকু সৃষ্টির আশা ছিল, তার সমস্ত সম্ভাবনা আর কেবল বিমূর্ত আবছায়ায় পরিণত। ভালোবাসার অস্থিরতা কখনো একেবারে নিস্তব্ধতার চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়, যতটুকু কথা একদিন হাহাকার হয়ে বের হয়েছিল, তার সমস্ত গুঞ্জন এখন নিঃশব্দ।
কিছুই আর ঠিকঠাক নেই। সব কিছুই এখন গোলমাল। এমন এক গোলমাল, যেখানে তোমার আত্মার দিকে যে গুচ্ছ স্রোত ছিল, তা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, এবং কোনও আশ্রয় নেই। অথবা, যদি আশ্রয় থাকে, তাহলে সেটা আমি নিজেই বানিয়েছি আর তাতে আমারই আঘাত।
এই দুর্বোধ্য সময়ে আমি যাত্রা করছি--একজন যাত্রী যে জানে না কোথায় পৌঁছবে। স্মৃতিরা এখন ডুবে থাকে, যতটুকু তারা ছিল, ততটুকুই তাদের অস্তিত্ব, আর কিছুই নয়।
আমি জানি না, এই পৃথিবীতে এমনকি বেঁচে থাকার অর্থও তেমন কিছু ছিল না--এই বেঁচে থাকা শুধুই এক দীর্ঘ অভ্যাস--যতটুকু থাকে, যতটুকু মুছতে পারি না, ততটুকু রয়ে যায়। তবুও কিছুই করা যায় না।
এইভাবেই চলে যায় দিন। আর এইভাবে চলে যায় রাত। ভুলে যাওয়া, ভুল হয়ে যাওয়া, সব মুছে যেতে থাকা--এই যেন একটি অপরাধ, যার কোনো বিচার নেই।
এখন ভালোবাসাও সেই নিষ্ফলতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা কখনো পূর্ণতা পায় না। যে অনুভূতি কখনো পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করে, তার আসল জায়গা একটা ছেঁড়া কাগজের মতো হয়ে যায়--অর্থহীন, অব্যক্ত, নিশ্চুপভাবে সরে যায় সেই জায়গা থেকে, যেখানে একসময় অনুভবের প্রতীক ছিল।
এখানে কোথাও নিঃস্বার্থতা নেই। এখানে কোথাও প্রেম নেই, কারণ প্রেম শুধু গ্যালাক্সির গতির মতো চলে যায়--যতটুকু আমি মেধা দিয়ে দেখতে পাই, ততটুকু আমি চুপ হয়ে যাই।
এটাই তো জীবন, একটা এমন নদী যা কখনো সরে না, যতটুকু চলতে পারে, ততটুকু যায়, আর শেষ হয়ে আসে কোথাও না কোথাও--যেখানে শুধু ছায়া থাকে, শুধু ঘর হয়ে ওঠে অন্ধকার। শুধু আকাশ থাকে, আর সেও জানে না--কি হতে পারে পরবর্তী মুহূর্তে।
প্রত্যেক কথা, প্রত্যেক শব্দ, এখন যেন রেট্রোফিটের মতো জড়িয়ে গেছে--তবে সেগুলোর মধ্যে কোনো গতি নেই। মাঝে মাঝে, যখন আমি এই শব্দগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাই, এগুলো শুধুই আচ্ছন্নতা হয়ে থাকে, যেমন স্মৃতির মাঝখানে অদৃশ্য অগ্নিশিখা।
এই তো জীবন, যে জীবন শুধু শূন্যতার আদলে বসে থাকে, যা একটু একটু করে তুমি নিজেই নির্মাণ করো, কিন্তু জানো, কখনো সম্পূর্ণ হয় না।
এখন আমি জানি, এই সব স্রষ্টা, এই সব অনুভূতি, এগুলো সবই কেবল বিরামহীন, বিনাশের দিকে চলে যায়, আর কিছুই স্থায়ী হয় না।
এই তো, নিষ্ফলতার ইশতেহার--এমন এক বিপ্লব, যার কোনো পরিবর্তন নেই, যার কোনো সুরাহা নেই, কেবল অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া। সবকিছুই এখন ধোঁয়াশা।
এখানে, বিষণ্ণতার গভীরে--আমি একটা শূন্য অক্ষর হয়ে রয়ে গেলাম।
ছয়.
‘বিষণ্ণতার অব্যক্ত কাঁপন’
এখন সব কিছুই অন্ধকার। এই অন্ধকার শুধুই চোখের সামনে নয়, এটা তলিয়ে গেছে আমার দেহের ভেতরে, গলে গেছে রক্তের সাথে, আঁকড়ে ধরেছে প্রতিটি অঙ্গ। শুধু শরীরের অঙ্গের অস্তিত্ব বাকি--অথবা, হয়তো আমার একমাত্র অস্তিত্ব এখন এটা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন কোনো একদিন দুপুরে হঠাৎ হৃদস্পন্দন একটু থেমে যায়, তখন কী বোঝাবে তুমি? যেন সমস্ত কিছুই শুধু ভাবনাহীন স্রোত হয়ে ভাসে, ভেসে চলে যায়। আধা জীবন, আধা মৃত অনুভূতি, আর কিছুই না--এভাবেই দিন চলে যায়।
স্মৃতি, যেন কোনো তুচ্ছ অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন এক অভ্যাস, যেটা আর চলে না, এমন এক আবেগ, যা আর প্রকাশিত হতে পারে না। সব কিছুর মাঝে এখন এক বিক্ষিপ্ত আওয়াজ শোনা যায়, যা শুধু মূর্ছনা--অথবা কখনো কখনো, বিষণ্ণতার মতো তীব্র একটা অনুভূতি। যেখানে আমি বিচ্ছিন্ন, অতীত আর ভবিষ্যতের ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছি, এবং আমার কাছে সেটা এখন অপ্রাসঙ্গিক।
অবশেষে বুঝতে পারি, বেঁচে থাকাটা শুধু এক ধরনের অসহায় স্লোগান। যতবার আমি ভাবি, ততবার মনে হয়, যতটুকু অনুভব করা যায়, ততটুকুই শেষ হতে থাকে। তবে কি জীবন সব সময় এতটা অস্পষ্ট? কি, সত্যি বলতে গেলে কিছুই বদলানো যায় না?
অবশেষে, নিজের শ্বাসও মনে হয় এক অস্বস্তি, যে শ্বাসে কিছু নেই, যে শ্বাসে কিছু যোগ করা যায় না। মনে হয়, শুধু এক অমোঘ সংকেত--সব কিছু শেষ হয়ে গেছে, অথবা যে তীব্রতা ছিল, তা হয়ে গিয়েছে বিদ্বেষী শূন্যতার খেলা। মাঝে মাঝে আমার ভেতর তাকে অনুভব করেও জীবনকে বুঝতে পারি না। শুধু চলতে থাকি, যতটুকু পালাতে পারি, তার পরেও এখানেই থাকি।
পৃথিবীর প্রতিটি কণা যদি বলতো--‘তুমি একা নও’--তবে সেই কথাটি হয়তো কোনোদিন গলা দিয়ে বের হতো না, কারণ মনের ভেতরে শুধু এক টুকরো ছেঁড়া চিঠি, আর কিছুই ছিল না।
এমন এক সারা-জীবন, যেখানে কোনো ‘কিন্তু’ নেই, কোনো ‘যতটুকু’ নেই, শুধু এক অসমাপ্ত শ্বাসের মতো পথের ধূলিতে মিলিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। যে স্থানে একদিন স্থিতি ছিল, এখন সেখানে বিক্ষিপ্ততা ছাড়া আর কিছু নেই।
এমন সময়েই একদিন, একটা হালকা বাতাস এসে বলে, ‘এটা আসলেই তোমার ছিল না, তুমি যা পছন্দ করো, তাও ছিল না। এটা ছিল শুধুই একটা পরীক্ষা, এটা ছিল কেবল এক অস্পষ্ট জীবনের গ্যাঁট, যে গ্যাঁটটি চিরকালই ভাঙতে থাকে, এবং তুমি একে সঙ্গী ভাবো, কিন্তু আসলে এটাই তোমার শত্রু।’
আমি, তবুও কোনো দিশা না পেয়ে একা এক অন্ধ গলিতে পা বাড়াই, যেখানে আলোও হারিয়ে গেছে। যেখানে জীবন আর মৃতের মধ্যে আঁকড়ে ধরে থাকা প্রতিটি অন্বেষণ শুধু আমার যন্ত্রণার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমি জানো না--এমন কোনো জগতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অথবা ভেঙে যাওয়ার মাঝখানে এমন কিছু থাকে, যা শুধুই এক দীর্ঘ থামা। সব কিছু স্থির হয়ে যায়, অথবা পুরোটাই মিথ্যে হয়ে যায়--কেবল অনুভব করাও অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
বিষণ্ণতা, যা একসময় ছিল অভ্যাস, এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রয়োজন। যতটুকু ভাবনা ছিল, তার সবটাই গুলিয়ে গিয়েছে। শুধু এক শূন্যতার মধ্যে প্রতিটি বস্তু অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি জানি না, যতদিন শ্বাস নিচ্ছি, ততদিন অন্তরালের অন্ধকারটাই জীবনের সংজ্ঞা হয়ে থাকে কি না। এই জগৎ কিছুই পরিবর্তন করে না, আর শুধু পালাতে থাকো তুমি--বড় শূন্যতার দিকে।
এটাই এক মহাসত্য। এটাই এক অসীম পথ। এটাই এক নিষ্ফলতার মঠ। এটাই আমার স্বপ্ন, এটাই আমার দুঃস্বপ্ন। এটাই বাস্তব, এটাই মৃত্যু। এবং, এটাই জীবন।