দেবাশিস চক্রবর্তী’র মিথেন রহস্য

দেবাশিস চক্রবর্তী
Published : 9 July 2021, 09:30 AM
Updated : 9 July 2021, 09:30 AM


এমন এক লকডাউনের দিনে, কোন গল্পকার যদি জলপাই রঙা উর্দিধারিদের হুড়োহুড়ি দেখতে বাইরে ঘুরতে যায়, আর কম্পিউটারের ওয়ার্ড প্রসেসর নিজে থেকে গল্পটা লেখা জারি রাখে, তবে একটা তেলেসমাতি কাজ হয়। তাছাড়া ল্যতিন আমেরিকা যদি ঢাকায় নেমে আসে তবে সাংস্কৃতিক রাজনীতি বা রাজনীতির সংস্কৃতি নিয়ে কাদের বা রিজভির কোন মাথা ব্যাথার কারণ দেখি না। রুজি-রুটি নিয়ে দিশেহারা কোন রিক্সাওয়ালা, যার রিক্সার ডান টায়ারের বাতাস কম, তাকে তার রিক্সা সমেত যদি শান্তিনগরের আকাশে অশান্ত ভঙ্গিতে ডানা ঝাপটানো অবস্থায় কেউ দেখে ফেলে, যে কেউ কেউয়ের মধ্যে হয়তো আছেন তজবি হাতে বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে থাকা কোন সহকারী সচিব বা ক্লাস টু'তে পড়া কোন মেয়ে, যে কিনা স্কুলের সেই গাছটির কথা ভাবছিল যার ডালে নীল ফুল ফুটতো-সেই ডানা ঝাপটানো রিক্সাওয়ালা যার ডানায় হঠাৎ হলদে সূর্যের আলো ঝলকে যায়, তবে এসব দেখার পরেও এবং এত সব সাক্ষী-সবুত থাকার পরেও মনে হতে পারে এসব ডিপ ফেক কম্পিউটার সিমুলেশন। এমন কম্পিউটার সিমুলেটেড গল্প আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা বিশ্বাস করি না, কারণ যেদিন ঈশ্বর এই শহরে পায়খানা করে দিয়েছিলেন তারপরের কোন একদিন গলির মাথায় পৌঁছানোর আগেই আমার মাথায় এবং শহরের তাবত মানুষের মাথায় শয়তানের ছ্যাপ এসে পড়েছিল, তারপর থেকে আমি এবং আমরা এসব বিশ্বাস করি না। তারপর থেকে আমরা বেঁচে আছি অন্য কারও ঘোরের ভেতর। এমন ঘোরের মধ্যে নিঃশ্বাস নিতে নিতে আমরা অনেক আগেই ভুলে গেছি আকাশের দিকে তাকাতে। তাই আমরা খেয়াল করতে পারি নি যে আমাদের শহরের আকাশ জুড়ে জেঁকে বসেছে মিথেন গ্যাসের মেঘ। এই জমে থাকা থিক থিকে মিথেন গ্যাসের খবর আমরা পাই পৃথিবীর ছায়াপ্রভুদের মারফত। এই ছায়াপ্রভুরাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, যে দেখো তোমাদের শহরের আকাশ জুড়ে প্রতিদিন ঘনীভূত হচ্ছে মিথেন গ্যাস। এই স্বাদ-গন্ধহীন মিথেন ছড়িয়ে আছে শহরের সারা আকাশ জুড়ে। হঠাৎ করে সাময়িক আগমন নয় বরং স্থায়ীভাবে জেঁকে বসেছে মিথেন। কিন্তু ছায়াপ্রভুরাও এই মিথেন গ্যাসের জন্মের হদিস জানে না। আমরা কোনদিন ভেবেও দেখিনি তাই আমাদের জানার প্রশ্নই উঠছে না। নগরপাল বা নগরফুপার এই নিয়ে কোন গাত্রদাহ আমাদের চোখে পড়ে না। নগরমামা একদিন বেতার সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আকাশ তো আর শুধু অক্সিজেনের না, আকাশ মিথেনেরও, আকাশ সবার। কিন্তু উপনিবেশ আমলের উদ্বৃত্ত সম্পদ ব্যবহার করা ছায়াপ্রভুদের উদ্বৃত্ত সময় অনেক। তারা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই মিথেন নিঃসরণের রহস্য সমাধান করতে চান। তাদের মধ্যে উত্তম পুরুষেরা এই মিথেন রহস্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাদের নারীরাও সমান তালে ভাবতে থাকেন আর মহাকাশে তাদের যে যান্ত্রিকদূতগুলো ছিল তাদের নাক ঘুড়িয়ে দেন আমাদের শহরের দিকে। যান্ত্রিকদূতেদের সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে আমাদের শহরের বিশাল ভাগাড়ের গন্ধ। এই গন্ধকে তারা আঁশে-শাঁসে বিশ্লেষণ করেন। তারপর আমাদের জানান যে মিথেন গ্যাসের সরবরাহকারী হচ্ছে আমাদের ময়লার ভাগাড়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ছুটে যায় ময়লার পাহাড়ে। কিন্তু অনেকদিন পর যাওয়ার কারণেই কিনা জানি না, তবে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। কারণ এটা ময়লার পাহাড় নয় বরং টিলা। কারণ ৭০ ফুট উঁচু ৫০ একরের ময়লার ভাগাড়কে পাহাড় বলার যায় না। এরপরেই ছায়াপ্রভুদের যে পারিবারিক ব্যাঙ্ক আছে, যে ব্যাঙ্ক কিনা "বৃহৎ ব্যাঙ্ক" নামে আমাদের কাছে পরিচিত, হ্যাঁ সেই ব্যাঙ্কেরই অপেক্ষাকৃত উত্তেজিত এক কর্মকর্তা আমাদের পরিবেশ চাচাকে ফোন করে মৃদু তিরস্কার করেন এবং তার হাতের কাছে থাকা কিছু তথ্য জানিয়ে এর জবাব চান। সেই বৃহৎ ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা জানান যে, এই মিথেন গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড নামের সুপরিচিত গ্যাসের তুলনায় পরিবেশের জন্য অন্তত ৮০ গুণ বেশি ক্ষতিকর। আর আমাদের ময়লার ৭০ ফুট উঁচু আর ৫০ একর বিস্তৃত ভাগাড় থেকে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪ হাজার কেজি মিথেন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতি ঘণ্টায় ৯০ হাজার গাড়ি চললে পরে এর সমপরিমাণ দূষণ করতে পারে। কিন্তু বৃহৎ ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা এসব তথ্য পরিবেশন করেই থামেন না। বরং তিনি নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। যে প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যে আমাদের পরিবেশ দোকানিদের ২২১ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের পরিবেশ চাচা ধৈর্যশীল পুরুষ। তার এবং তার পূর্ববর্তী তিন ধৈর্যশীল পুরুষের নির্দেশনাতেই গত দশ বছরে ২২১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। অধস্তন ২৯৬ খেলোয়াড়কে খুশি করবার জন্য দফায় দফায় বিদেশ সফরে পাঠিয়েছেন যাতে তারা ছায়াপ্রভুদের শহরগুলো দেখতে পারেন, তাদের খাবার চেখে, পানীয় পান, স্পর্শযোগ্য নারীর চামড়া স্পর্শ এবং নরম বিছানায় শীতল আবহাওয়ায় নিরাপদ তন্দ্রা উপভোগ করতে পারেন। তাছাড়া প্রকল্পের প্রয়োজনে উন্নত গাড়িও কিনতে হয়েছিল ১০টি আর পাশাপাশি গড়তে হয়েছে একটা শক্তপোক্ত ভবন। আর এই ঋণের টাকা খরচ করেই যে সারা শহরজুড়ে একের পর এক ফুট-ওভার ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে তাও মনে করিয়ে দিতে ভুলেন না। তাই বোঝাই যাচ্ছে এমন ধৈর্যশীল এবং স্থিতিস্থাপক চরিত্রের পুরুষকে বিদেশী ভাষায় একটু কড়া মেজাজে কিছু বলে কেউ টসকাতে পারবে না। আমাদের পরিবেশ চাচা বরং নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের ঋণের অর্থ কম ছিল বলে উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি আরও যোগ করেন যে এই ঋণের অর্থ কম ছিল বলেই আমাদের গণিত খেলোয়াড়েরা অঙ্ক কষে শুধু মাত্র বায়ু দূষণের কয়েকটি উৎস খুঁজে করতে পেরেছেন। আরেকটু অর্থ বরাদ্দ পেলে বরং আরও কিছু করে দেখানো সম্ভব হতো।

এতে কিছুটা কাজ হয়। বৃহৎ ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা কিছুটা নমনীয় হন। তিনি আমাদের পরিবেশ চাচাকে আশ্বস্ত করেন যে শীঘ্রই তারা নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের জন্য আরও বড় অঙ্কের ঋণের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তিনি পই পই করে বলে দেন যে ময়লার ভাগাড় মিথেনের বড় উৎস তবে তা দিয়েই আমাদের শহরের আকাশের বিস্তৃত এবং স্থায়ী মিথেন নিঃসরণের ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না-অর্থাৎ পরিস্থিতি এখনো রহস্যাবৃত। তবে সুখের বিষয় ছায়াপ্রভুদের প্রধান পুরুষেরা আমাদের শহরের আকাশের দিকে নজর বিদ্ধ করে রেখেছেন। তারা হেস্ত নেস্ত একটা করবেন অবশ্যই।

আমাদের শহরের আকাশে এত মিথেন গ্যাস ছোটাছুটি করছে তবে তার রহস্য ছায়াপ্রভুরা ভেদ করতে পারছেন না? এমনটা বিশ্বাস করতে আমাদের মধ্যে অনেক ক্রীতদাসেরই কষ্ট হয়। আমাদের এই সন্দেহ যে একেবারেই অমুলুক ছিল না তার প্রমাণ যে কেউ পেতে পারতেন যদি তারা এই গ্রহের এক বিশাল ধনকুবেরের দিকে একটু খেয়াল করতেন। আমাদের এই বিশেষ ধনকুবের আর বাকি সব কুবেরের থেকে একটু আলাদা, একটু খেয়ালি-দরদি-মরমি ভীষণ রকমের দানবীর। দান খয়রাতের জন্য কতশত মুক্তমনার প্রাণের পুরুষ হয়ে হৃদয়ের মণিকোঠায় বসে আছেন। তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের আকাশে আজ কালো মিথেনের মেঘ জমে আছে। এখন মেঘ আসলেই জমে আছে কিনা, আর জমে থাকলে তা মিথেনেরই কিনা তা আমরা কেউই আসলে নিশ্চিত নই। তবে ধরে নিচ্ছি জমে আছে। কারণ স্ত্রীর সাথে তাঁর বনিবনা হচ্ছে না। এমন বনিবনা না হওয়ার সময় কোন ব্যাটারই বা মেজাজ ফুরফুরা থাকে? তাজ্জবের বিষয় এই যে এমন গুমোট পরিবেশই কিনা তিনি আমাদের শহর নিয়ে ভাবছেন। এবং তাঁর কম্পিউটারের চেয়ে প্রখর মস্তিষ্কের জোরে মিথেন রহস্যের একটা মানস সমাধানে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু আমরা সত্যযুগে বেঁচে নাই। তাই আমাদের একমাত্র রক্ষাকর্তা ধনকুবের বাবাজির মনের খবর পড়তে পারছি না। হতে পারে সমাধানটা লুকিয়ে আছে আমাদের শহরের প্রত্যেকটা ইমারতের সেপ্টিক ট্যাঙ্কে। এমনটা হতেই পারে যে দুর্বল পয়ঃনিষ্কাসন ব্যবস্থা আর অল্প একটু এলাকায় কোটি কোটি মানুষের পায়খানা জমে জমে প্রতিদিন জন্ম দিচ্ছে মিথেনের মেঘ। এমন সব চিন্তা আমাদের শরীর অবশ করে দিতে পারত কিন্তু আমরা ছুটে যাই মরমি সাধকের কাছে। তিনি স্মিত হেসে বলেন-
আমার মনে যখন বসন্ত আসবে তখন সারা বিশ্বে বসন্ত আসবে- আমার মন যখন পুষ্পিত হবে সারা বিশ্ব পুষ্পিত হবে। এই শুনে আমরা ধন্ধে পড়ে যাই। আমাদের মনে এমন কী আছে যে আমাদের শহরের আকাশে এত মিথেন জড়ো হয়েছে? আমাদের মনের কুয়াশা কাটেনা। তবে আমাদের মধ্যে কারও কারও মনে সন্দেহ হয় যে আমাদের আকাশে মিথেনের মেঘ কারণ এই শহরে একদিন ঈশ্বর পায়খানা করে দিয়েছেন। ঈশ্বর পায়খানা করেদিয়েছেন, কারণ হিসাবে আমাদের সঙ্গত কারণেই ঈষৎ বিরক্ত এক ওস্তাদের কয়েকটা লাইন দেগে দিতে পারি এইভাবে, "বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ধনার্জন করে না, স্রেফ লুটতরাজ করে। ফলে এখানে নতুন মিলিয়নার বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ; আর টাকা পাচারের পরিমাণ কল্পনাতীত রকমের বেশি। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিদেশনির্ভর, আর মধ্যবিত্তের প্রত্যেকেই সম্ভাব্য ইমিগ্র্যান্ট।"