যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের সামনে হাজির হয়েছেন ‘সবার আগে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষার’ শপথ নিয়ে।
Published : 20 Jan 2017, 10:17 PM
অভিষেক অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে বাণিজ্য, কর, অভিবাসন ও পররাষ্ট্রনীতি- সব ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি; পূর্বসূরি বারাক ওবামার অনেক কাজ পাল্টে দেওয়ার ঘোষণা তার আগেই ছিল।
শুক্রবার ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, ততক্ষণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, ভাংচুর আর পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের খবর আসতে শুরু করেছে।
ডান হাত উপরে তুলে, বাঁ হাত আব্রাহাম লিংকনের স্মৃতিধন্য বাইবেলে রেখে প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের কাছ থেকে শপথ পড়েন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে সূচনা হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের।
অভিষেকের পর ক্যাপিটল ভবনের ঐতিহাসিক ধাপে দাঁড়িয়ে প্রথম ভাষণে ট্রাম্প বলেন, “আজ থেকে আমাদের এই ভূমি পরিচালিত হবে নতুন দর্শন নিয়ে। আজ থেকে সবার আগে থাকবে আমেরিকার স্বার্থ, সবার আগে থাকবে আমেরিকা।”
শপথ অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের পাশে ছিলেন স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প। বেশ কয়েকজন সাবেক প্রেসিডেন্ট, ঊর্ধ্বতন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ হাজার হাজার মানুষের উপস্থিত ছিল প্রেসিডেন্টের অভিষেকে। আর টেলিভিশনের পর্দায় ওই শপথ অনুষ্ঠনে চোখ ছিল বিশ্বের অগুণতি মানুষের।
শপথ শেষের কিছুসময় পরই আসতে থাকে অভিনন্দন বার্তা। ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে পোপ ফ্রান্সিস এক বার্তায় তাকে গরিবদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে কাজ করার আহ্বান জানান। ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানায় কানাডা এবং যুক্তরাজ্যও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তিক্ত নির্বাচনী প্রচারের পর জনমতের বিভক্তির মধ্যে ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্পের অভিষেকের মধ্য দিয়ে ঘরে-বাইরে একটি নতুন ও অনিশ্চিত পথে পা রাখল যুক্তরাষ্ট্র।
এবিসি নিউজ/ওয়াশিংটন পোস্টের জনমত জরিপ মতে, মাত্র ৪০ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন ট্রাম্প। যা ট্রাম্পের আগের তিন প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনের চেয়ে অনেক কম। এ সমর্থন তিনি বাড়াতে পারবেন কিনা সময়ই তা বলে দেবে।
ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিয়ে কঠোর বক্তব্য, রাশিয়ার সঙ্গে ঊষ্ণ সম্পর্কের অভিপ্রায় এবং নেটোর সমালোচনা- সবকিছু মিলিয়ে এক নতুন ধরনের মার্কিন প্রেসিডেন্টই পাচ্ছে বিশ্ব।
বিভক্ত জাতি
ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিভক্তি সর্বকালের সবচেয়ে বেশিতে পৌঁছেছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে দেখা গেছে, ৮৬ শতাংশ মার্কিনি আগের চেয়ে এখন জাতি বেশি বিভক্ত বলে মনে করছে।
এবার মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষ দেশের রাজনৈতিক বিভক্তি তাড়াতাড়ি দূর হতে পারে বলে মনে করছে।
রাশিয়ার উল্লাস, মেক্সিকোয় অসন্তোষ
রাশিয়ায় উল্লাস করে হোয়াইট হাউজের নতুন সদস্যকে স্বাগত জানানো হয়েছে। ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আশায় আছে রাশিয়া।
মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ট্রাম্পের পোস্টার। দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ‘ট্রাম্প বার্গার’, ‘ট্রাম্প ললিপপ’।
অন্যদিকে, এর ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে মেক্সিকোয়। ট্রাম্প আমলের সূচনাকে সেখানে বিরক্তি নিয়ে প্রত্যক্ষ করছে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও।
ট্রাম্প কাজ শুরুর পরে মেক্সিকোর সঙ্গে প্রথম সংঘাতটাই বাধবে ‘মেক্সিকো প্রাচীর নির্মাণ’ নিয়ে। এ প্রাচীর ট্রাম্প বানাতে চান মেক্সিকোর অর্থায়নেই।
উদ্বিগ্ন বিশ্ব
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আরও বিচ্ছিন্ন, আরও সুরক্ষিত করা, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নেওয়া এবং চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের অঙ্গীকার করেছেন।
একইসঙ্গে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং নেটোতে তহবিল কমানোর কথা বলায় বন্ধু দেশ ব্রিটেন থেকে শুরু করে বাল্টিক দেশগুলো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী নিরাপত্তা বলয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় আছে।
অন্যদিকে, আমেরিকায়ও কি আরেক মোদী আমলের সূচনা হল কি-না তা নিয়ে উদ্বেগ আছে ভারতে। ২০১৪ সালে ডানপন্থি হিন্দু নেতা নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার সময় অনেক ভারতীয় যেমন উদ্বিগ্ন হয়েছিল, তেমনি ট্রাম্পকে নিয়েও একই উদ্বেগ বোধ করছে তারা।
বিতর্কিত রাজনৈতিক অতীত নিয়ে মোদীর ক্ষমতায় আরোহণে ভারতের বিদ্যমান রাজনৈতিক ভারসাম্য ব্যাহত হয়েছিল। নির্বাচনে তার জয় শুধু ভারতীয়দেরকেই নয়, বৈদেশিক অঙ্গনকেও অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে ফেলেছিল।
ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটও অনেকটা একই। ফলে তার আমলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নয়ন একই রকম থাকবে কি-না। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ভারতীয়রা কেমন আচরণ পাবে? এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
ট্রাম্প আমলে ফিলিপিন্সে মার্কিন সেনা উপস্থিতির অবসান ঘটবে কি না তা নিয়ে দেশটি উদ্বিগ্ন। তাছাড়া, ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রায় ২০ লাখ ফিলিপিনো এবং দেশটির অভিবাসী হতে ইচ্ছুক ফিলিপিনোরা সমস্যায় পড়তে পারে বলেও উদ্বিগ্ন ফিলিপিন্স।
ট্রাম্প আমল নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে ইউরোপেও। ট্রাম্প শপথ নেওয়ার আগেই দুটি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জার্মানির শরণার্থী আশ্রয় দেওয়া ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন। এখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউরোপীয়দের ভবিষ্যৎ এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থা নিয়ে সংঘাত কতটা এড়িয়ে চলা যাবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন জার্মানি।
ওদিকে, মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের ক্ষেত্রে ট্রাম্প ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরানোর যে পদক্ষেপ নেবেন বলেছেন তাতে আরবরা ক্ষুব্ধ হওয়ার ঝুঁকি আছে। তাছাড়া, আইএস’ কে মোকাবেলার যে অঙ্গীকার ট্রাম্প করেছেন, তা কিভাবে করবেন সে পরিকল্পনাও এখনও নেওয়া বাকী।
কাজ শুরু শিগগিরই
ট্রাম্প জলদিই সবকিছু নিয়ে কাজ শুরু করতে চান। সহযোগীরা আগেই জানিয়েছিলেন, শপথের পর ব্যাপক ক্ষমতার প্রেসিডেন্সিয়াল কলমটি ব্যবহার করতে দেরি করবেন না ট্রাম্প। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই বাস্তবায়ন করা যায় এমন বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করবেন তিনি।
এরই মধ্যে কিছু নির্বাহী আদেশে সই করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নীতিগুলোর রাশ টেনে ধরার কাজ শুরু করেছেন ট্রাম্প।
অভিবাসননীতি কঠোর করা, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা, ১২-জাতির ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব বাণিজ্য চুক্তি এবং কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে করা নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট চুক্তি থেকে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়েও ট্রাম্প দাপ্তারিক নোটিশ দেবেন।