এদিকে ওই পরিবারের সদস্যদের ‘সুস্থ করতে’ এলাকাবাসী বিপুল উৎসাহে ফকির-কবিরাজ দিয়ে শেকলে বেঁধে ঝাড়ফুঁক চালাচ্ছে। তাতে একদিকে কুসংস্কার ছড়াচ্ছে, অন্যদিকে ঝুঁকি বাড়ছে ওই পরিবারের সদস্যদের।
বৃহস্পতিবার তালা উপজেলার প্রসাদপুর গ্রামে রহমত বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, এলাকাবাসী ওই পরিবারের ‘অস্বাভাবিক’ সদস্যদের জোর করে খাওয়াচ্ছে। কেবল তাই নয়, পিকআপ ভাড়া করে শেকলে বেঁধে তাদের নেওয়া হচ্ছে কথিত পীর আর ওঁঝার কাছে। রাত-দিন উৎসুক জনতার ভিড় লেগে আছে ওই বাড়িতে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফরিদ হেসেন বলছেন, কোনো কারণে মানসিক আঘাত থেকে রহমতের পরিবারের সদস্যদের আচরণে অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে বলে চিকিৎসকরা মনে করছেন। কিন্তু রহমত ও তার স্ত্রী তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের হাসপাতালে পাঠাতে রাজি নন।
মার্চের শুরু থেকে রহমতের ১৩ সদস্যের পরিবারের সদস্যদের আচরণে একে একে ‘অস্বাভাবিকতা’ ছড়িয়ে পড়ার খবরে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে ওই বাড়িতে যান। সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকেও চিকিৎসক পাঠানো হয়। কিন্তু তারা হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়ে তাদের রাজি করাতে পারেননি।
রহমতের স্ত্রী নবীজান বিবির ভাষ্য, তাদের এক মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ‘পাগল সাব্যস্ত করলে’ চলতি মাসের শুরুতে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। এর পর থেকেই ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনিদের মধ্যে ‘অস্বাভাবিকতা’ দেখা দেয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফরিদ হোসেন গত ৬ মার্চ ওই বাড়ি ঘুরে এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও ওই পরিবারের সদস্যদের সাতজনের কথাবার্তা অসংলগ্ন। কখনও কখনও মারমুখী আচরণ করছেন। পুলিশের লোক কথা বলতে গেলে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বৃহস্পতিবার রহমতের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, এলাকার লোকজনও ওই পরিবারের সদস্যদের ‘পাগল’ সাব্যস্ত করে কুসংস্কারের বশে ‘জিন ছাড়ানোর’ চেষ্টায় ব্যস্ত।
রহমতের দুই ছেলে ও এক মেয়েকে তার পাঁচ বছরের মেয়েসহ ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। আরেক ছেলেকে পায়ে শেকল পরিয়ে আটকে রাখা হয়েছে জানালার সঙ্গে।
হাসপাতালে নেওয়া না গেলেও রহমতের পরিবারের সদস্যদের ঝাড়ফুঁক দিতে নেওয়া হচ্ছে দূর-দূরান্তে।
ওই গ্রামের মাসুদ বিশ্বাস জানান, রহমতের ‘জিনে ধরা ছেলেমেয়ের’ চিকিৎসার জন্য সোমবার সন্ধ্যায় একটি পিক-আপে তুলে বেঁধে যশোরের নওয়াপাড়ার ‘পীর সাহেবের’ কাছে নিয়ে যান তারা।
“সেইখানে কোনো উপকার না পাওয়ায় মঙ্গলবার তাদের মিকশিমিল আমুরডাগা এবং ডুমুরিয়ার দুই ওঁঝার কাছে নেওয়া হয়। সেখানেও কোনো লাভ হয়নি। তাই বুধবার কেশবপুর থেকে আরও দুইজন ওঁঝাকে বাড়িতে আনা হয়েছে।”
রহমত বিশ্বাসও বলছেন, “আমার এক মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন জাদু করে জিনের মাধ্যমে পাগল করে দিছে। সে কারণে বাড়ির অন্যরাও একে একে পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
তার স্ত্রী নবীজান বেগম, বড় ছেলে হায়দার বিশ্বাস, প্রতিবেশী সুফিয়ান শেখ, রহিমা বেগম, খায়রুল বিশ্বাসও একই সুরে কথা বললেন।
তার বড় ছেলে হায়দার বলেন, ‘এলাকাবাসীর সহযোগিতায়’ বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকদের করা ‘জাদু নষ্ট করার জন্য’ পাল্টা তাবিজও করা হয়েছে।
এদিকে খলিলনগর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য লিয়াকত গাজী জানান, গত সপ্তাহে রহমতের তিন ছেলে, দুই মেয়ে এবং দুই নাতি-নাতনীর মধ্যে ‘অস্বাভাবিকতা’ দেখেছিলেন তারা। তবে পাঁচ বছরের একটি শিশু, এক তরুণী ও এক কিশোরের আচরণ গত দুদিন ধরে স্বাভাবিক বলেই তার মনে হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কুদরত-ই-খোদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো কারণে গুরুতর মানসিক আঘাত পেয়ে তারা ভারসাম্য হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় খাবার, ঘুম আর চিকিৎসা পেলে সবাই সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু জোর করে তো কাউকে চিকিৎসা দেওয়া যায় না।”
এ বিষয়ে প্রশাসনের উদ্যোগ জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউএনওকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। রহমত বিশ্বাসের মতামত নিয়ে তাদের যেকোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তা ইউএনওকে করতে বলা হয়েছে। রহমতের মতামত নিয়ে সাতক্ষীরা সদরে নিয়ে অথবা যেকোনো জায়গায় তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে বলা হয়েছে।”
আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ হেসেন বলছেন, তারা নিয়মিত রহমতের পরিবারের খোঁজখবর রাখছেন। ‘সুস্থ না হলে’ তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা তারা করবেন।