চুয়াডাঙ্গায় একটি বাউল উৎসবের আয়োজক জাকারিয়া সরদারকে হত্যার পর বন্ধ হয়ে যায় দুদিনের সেই উৎসব।
Published : 12 Dec 2015, 07:52 PM
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সদর উপজেলার আলোকদিয়া ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া গ্রামের এই হত্যার ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
গ্রামের যে মাঠে জাকারিয়াকে হত্যা করা হয়, তার মাত্র পাঁচশ গজ দূরেই গুচ্ছগ্রামের ফকির বাগানে চলা ওই উৎসব শুক্রবার দুপুরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম জানান, গাঙপাড়ার বাড়ি থেকে বাউল উৎসবে যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে ১০-১২ জনের একটি দল জাকারিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ওই গাড়ির চালক রাশেদুল ইসলাম।
তবে তার কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করার মতো কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
গত দুই বছরে পীর, ফকির ও বাউলসহ সুফিবাদী ধারার বেশ কয়েকজন মানুষকে হত্যার ঘটনার ধারাবাহিকতায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটল।
এসব হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এগুলোর সঙ্গে জাকারিয়া হত্যার ধরনের মিল থাকলেও পুলিশ এখনো কাউকে দায়ী করেনি; শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রেপ্তারও হয়নি কেউ।
জাকারিয়ার পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়রা জানান, জাকারিয়ার বাবা ফজলু শাহ চুয়াডাঙ্গায় ফকির হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রতিবছর গ্রামে বাউল উৎসবের (বাউল সম্প্রদায় যাকে বলে ‘সাধুসঙ্গ’) আয়োজন করতেন। তার মৃত্যুর পর গুচ্ছগ্রামের ফকির বাগানে তাকে কবর দেওয়া হয়। সেখানকার ‘মাজার চত্বরে’ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে ছেলেও সাধুসঙ্গের আয়োজন করে আসছিলেন। বৃহস্পতিবার ফজলু শাহর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতেও সাধুসঙ্গের আয়োজন করা হয়।
“দেড় কিলোমিটার দূরের উৎসবস্থলের কিছুটা দূরে ১০-১২ জনের একটি দল গাড়ি থামিয়ে রাশেদুলকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়।তার কাছ থেকে খবর পেয়ে উৎসব থেকে বাউলরা এসে রাস্তার পাশে জাকারিয়ার লাশ পড়ে থাকতে দেখে।”
রাতেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাশেদুলকে থানায় নিয়ে আসা হয় বলে জানান তিনি।
পুলিশ কর্মকর্তা সাইফুল বলেন, “রাশেদুল বলেছে, হামলাকারীদের কাউকে সে চিনতে পারেনি। হত্যারহস্য উদঘাটনে অগ্রগতি হওয়ার মতো কোনো তথ্যও তিনি দিতে পারেননি।”
মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের দরবেশপুর গ্রামের বাসিন্দা রাশেদুল (৩০) জাকারিয়ার পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাকেও তারা সন্দেহ করছে না বলে জানান তিনি।
শুক্রবার ময়না তদন্ত শেষে জাকারিয়া সরদারের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়ছে। রাতেই আকন্দবাড়িয়া কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
এই হত্যার ঘটনায় শনিবার রাতে মামলা হতে পারে বলে জানান তিনি।
শনিবার বিকেলে আকন্দবাড়িয়া গ্রামের লোকজন জানান, পেশায় পান ব্যবসায়ী জাকারিয়ার সঙ্গে কোনো বিষয়ে কারো বিরোধ ছিল না।
জাকারিয়ার স্ত্রী সালমা খাতুন জানান, তার স্বামীকে হত্যা করতে পারে- এমন কোনো শত্রু ছিল না।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ কোনোদিন আমার স্বামীকে হুমকিও দেয়নি।প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের ওই আখড়ায় তিনি রাতে বা দিনে বহুবার গিয়েছেন কখনো কোনো অসুবিধা হয়নি।”
ওই গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বলেন, “জাকারিয়ার বাবা গ্রামে ভালমানুষ হিসেবে পরিচিত। তার ছেলে জাকারিয়ারও গ্রামে বেশ সুনাম।”
‘মতার্দশগত বিরোধ’ থেকে জেএমবি সদস্যরা আগের যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে পুলিশ বলছে, তার শুরু ২০১৩ সালে।
ওই বছর ডিসেম্বরে ঢাকার গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ ছয়জনকে গলাকেটে হত্যা করা হয়।
এর প্রায় দুবছর পর গত ৫ অক্টোবর পীর হিসেবে পরিচিত পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে বাড্ডায় নিজের বাড়ির খানকা শরিফে একইভাবে হত্যা করা হয়।
এর মধ্যেই সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে ন্যাংটামামুর মাজারের কথিত ফকির রহমত ও মাজারের খাদেম কাদেরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
আর গত নভেম্বরে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় রংপুরের কাউনিয়ার এক মাজারের খাদেম রহমত আলীকে।
এই দুই ঘটনায়ও আটক জেএমবি সদস্যরা হামলার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ফকিরতন্ত্রে বিশ্বাসী ও বাউল উৎসবের আয়োজক জাকারিয়া হত্যার পেছনেও একই শক্তি জড়িত কি না সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছে না পুলিশ।
আলোকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আক্তারুল ইসলাম মুকুল বলেন, নিহত জাকারিয়া ভাল মানুষ ছিল। তার জানাজায় যতো মানুষ উপস্থিত হয়েছে তা এর আগে আকন্দবাড়িয়া গ্রামে আর দেখা যায়নি।
“অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, কারা কেন তাকে হত্যা করলো? এর উত্তর কেউই দিতে পারেনি।”
চুয়াডাঙ্গা জেলা বাউল কল্যাণ সংস্থা সভাপতি মহিউদ্দিন বলেন, জাকারিয়া হত্যার প্রতিবাদে রোববার সকাল ১০টায় শহীদ হাসান চত্বরে মানববন্ধন হবে। পরে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।