দেশের বাইরে যারা একা পড়তে আসবেন তাদের সব্যসাচী হতে হবে এটা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নেয়া উচিৎ। বিদেশে উচ্চশিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি আছে। প্রস্তুতির কোথাও ত্রুটি হলে সবকিছু কেঁচেগণ্ডুষ!
Published : 28 Apr 2017, 01:25 PM
তখন উচ্চশিক্ষা আশীর্বাদ না হয়ে বিপদও হতে পারে। তাই আগে থেকেই জেনেশুনে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া ভালো। জার্মানিতে খুব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি নেই বলে এখানে অনেক দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে আসে। সেটা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ, মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়া তো আছেই।
জার্মানিতে কেবল উচ্চশিক্ষা মূল লক্ষ্য হলে শুধু ইংরেজি দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু চাকরি অসম্ভব। জার্মানিকে বলা হয় 'ল্যান্ড অব টেকনোলজি'। এখানে যাদের কম্পিউটার সায়েন্স, প্রোগ্রামিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনার বাতিক বা উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে তাদের সম্ভাবনা খুব ভালো। সেক্ষেত্রেও ভাষার দক্ষতা বি২ বা সি১ লাগে।
আমাদের পাশের দেশ ভারতে ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকেই বিদেশি ভাষা শেখানো হয়। সেখানে কম্পিউটার সায়েন্সের স্নাতকের একজন শিক্ষার্থী জার্মানি আসার পরিকল্পনা মাথায় রেখেই প্রতি সেমিস্টারে জার্মান ভাষার কিছু কোর্স-ক্রেডিট সম্পন্ন করে।
জার্মানির অনেক ছেলেমেয়েই 'আউসবিল্ডুং' (কর্মমুখী প্রশিক্ষণ) করে চাকরি করে আমরা যাকে আমাদের দেশে বলি ডিপ্লোমা। দেশে যেমন গবেষক লাগে তেমনি শ্রমিকও লাগে। শতভাগ গবেষক বা শ্রমিক দিয়ে দেশ চালানো যায় না। তাই বিদেশে ডিপ্লোমা পড়ারও সুযোগ আছে। এখানে এক বছর ফ্রিতে কোনও বাসায় বেবিসিটার বা বাচ্চা দেখাশোনা করে মেয়েদের নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ আছে। নেপালে অনেক মেয়ে ভাষা শিখে এসে এখানে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা পড়ছে।
অন্য দিকে মাস্টার্সে যারা পড়তে আসেন স্নাতক পড়া অবস্থাতেই ভাষার ক্ষেত্রে বি২ সম্পন্ন হলে জার্মানিতে খণ্ডকালীন চাকরি পেতে সুবিধা। কিছু সাবজেক্টে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেলেও ভাষা না জানলে চাকরির সম্ভাবনা জার্মানিতে একেবারেই নেই। যেমন সাংবাদিকতার কথা যদি বলি খুব ভাল সুযোগ পড়াশোনার কিন্তু সংবাদ মাধ্যম হল ভাষার খেলা সেখানে ইংরেজি দিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা গেলেও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র খুব সীমিত।
একই রকম আর্কিটেক্ট বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এর বেলায়। ইংরেজি এবং জিআরই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির সুযোগ পাওয়া গেলেও জার্মানিতে জার্মান ভাষা জানা লাগবে। আর যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে অনেক টিউশন ফি সেক্ষেত্রে স্কলারশিপ আগেই ব্যবস্থা করতে হয়। কেননা স্কলারশিপ খুব সীমিত। পাশাপাশি রেজাল্ট জিআরই বা আইইএলটিএস স্কোর মোটিভেশন সাথে স্কলারশিপ পেতে নিজেকে প্রমাণের জন্য প্রকাশনা বা পাবলিকেশন লাগবে।
জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বিনা বেতনে হলেও হলে ভাষা জানা থাকলে অনেক দ্বার উন্মোচন হয়ে যায়। আমার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের জন্য জানার ভালো জায়গা জার্মানি। পরিবেশ নিয়ে জানতে হলেও জার্মানি এখনো বিশ্বসেরা।
এখানে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারদেরও সারাদিন মেশিন নিয়ে বসে বসে শিখতে হয়। বাণিজ্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের স্নাতক পড়ার সময় বাধ্যতামূলক ইন্টার্ন করতে হয় যাতে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ এর দক্ষতা ও যোগ্যতা গড়ে ওঠে।
চাকরি বা পড়াশোনায় এখানে পৃথিবীর সব দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে তাদেরকে যুদ্ধে নামতে হয়। চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ইউরোপ এর অন্য দেশ থেকেও ছেলেমেয়েরা জার্মানিতে আসে, যাদের বেসিক আগে থেকেই অনেক ভালো থাকে ।
আবার জার্মানি থেকে অন্যদেশে যারা যান তাদেরও অন্য ভাষার পরীক্ষা দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র হলে জিআরই বা ইউরোপের ফ্রান্স বা ব্রিটেন হলে ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ লাগে কেননা এখন গ্লোবালাইজেশনের যুগ। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সবকিছুতে ভাষার আদান-প্রদান খুব জরুরি কেননা একা একটা দেশ তার নিজের ভাষা নিয়ে এগুতে পারে না।
ভাষা শেখা আমাদের মতোই সারা বিশ্বের মানুষের জন্য চালেঞ্জ। ব্রিটেনে স্কুলে শিশুদের ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষা শেখানো হয়। ভারতে বেশিরভাগ মানুষ কমপক্ষে দু-তিনটি ভাষা জানেন, কারণ দেশে একশ'টির মত ভাষা। দেশটির এক প্রদেশের মানুষ অন্য প্রদেশের মানুষের সাথে হিন্দি আর ইংরেজিতে কথা বলে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হলে তিনি যে ডরমিটরিতেই বা বাড়িতেই থাকুন না কেন রান্না, বাজার, ঘরদোর, বাথরুম, বেসিন, রান্নাঘর, ময়লার বালতি পরিষ্কার সবকিছু নিজেরই করতে হয়। আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে আমাদের দেশের মতো রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায় না যেখানে ক্লাসের ফাঁকে একটু খেয়ে নেওয়া যায়। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ভেবে নিতে হয় সকালে কী খেয়ে ক্লাসে যাবে আর সে খাওয়ারটা ঘরে আছে কিনা।
ঘুম ভেঙ্গে ওভেনে বা টোস্টারে ব্রেড ঢুকিয়ে দিয়ে সাথে সাথে নিজের তৈরি হয়ে নিতে হয়। প্রবাসে সব কিছু ঠিক সময় মতো করতে পারা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে বাস, ট্রেন সব ঘড়ি ধরে চলে, এক মিনিট এদিক ওদিক হবার উপায় নেই। আবার সারাদিনের জন্য বাইরে গেলে বা ক্লাসে থাকলে খাওয়ার, কফির মগ, পানির বোতল সব ব্যাগে ভরে নিতে হয়। কেননা চাইলেই রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে চা খেয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।
আমি যে ক্যাম্পাসে থাকি সেটা বিশাল জায়গা নিয়ে। কিন্তু এতো বড় ক্যাম্পাসে একটি মাত্র ক্যান্টিন রয়েছে। সেখানে দুপুরে খাবার এবং চা কফির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সে খাবার পয়সা দিয়ে শুধু কেনা হয়, আমি খুব ক্ষিধে নিয়েও পু্রোটা খেতে পারিনি কোনদিন এই এক বছরে।
আর ক্যাম্পাসে ওয়ান টাইম কাপ বা মগ অতিরিক্ত বর্জ্য তৈরি করে বলে একে খুব নিরুৎসাহিত করা হয়। তাই সবাই ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার আগে একটা ব্যাগপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে তাতে পানির বোতল, কফির মগ, জুস, চকোলেট এবং সাথে দুপুরের খাওয়ার ভরে নিয়ে বেরিয়ে পরে।
ক্লাস লাইব্রেরি পড়াশোনা, পার্ট-টাইম কাজ সব করে ঘরে এসে আবার চলে পরদিনের প্রস্তুতি। এখানে টানা ৪ ঘণ্টা করে ক্লাস। দিনে ৮ ঘণ্টা বা তার বেশিও ক্লাস করতে হতে পারে যদি পাশাপাশি ভাষা শেখা বা অন্য কোনও ক্লাস থাকে।
শহর-বাজার, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে কোথাও রিকশা নেই, ছেলে মেয়ে, ছোট বড় সবাই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরে আর বাস স্টপ বা ট্রেন স্টেশনের পাশে সাইকেল রাখার ভালো ব্যবস্থা থাকে সব জায়গাতেই।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ঘরগুলোতে ইচ্ছে মত ফার্নিচার, কার্পেট, সোফা, বা নানা রকম পেইন্টিংস দিয়ে সাজানোর সুযোগ আছে। কিন্তু ঘরে থাকবার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে আবার ঘর ধুয়ে মুছে রং করে দিয়ে যেতে হয়।
আমার জার্মানিতে গত অক্টোবরে এক বছর হল। ডরমিটরিতে আমার ঘরের মেয়াদ শেষ হল তখন আমাকেও ঘরে রং করে দিতে হয়েছে। বিদেশে বাসা খুঁজে পাওয়ায় এক বিপদ। আমি খুব চিন্তায় ছিলাম কীভাবে সব করবো। একা ঘরের ফার্নিচার সাততলা বা আটতলায় টেনে তোলা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।
এখানে বন্ধুরা খুব সাহায্য করে। আমার ঘরের রং করা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমাকে ওরা বার বার জিজ্ঞেস করেছে কী সাহায্য লাগবে! একজন বন্ধু তো একা একা নিচ তলা থেকে ৬ তলা পর্যন্ত একটা ছোট ফ্রিজ টেনে তুলে দিয়ে গেল।
জার্মান মেয়েরা আমাকে বাসা পেতে আপ্লিকেশন লিখতে এবং সেটি খুঁজে পেতে অনেক সাহায্য করেছে।
ছেলেমেয়েগুলোকে দেখতে খুব শুকনো কাঠি কাঠি, রোগা-পাতলা দেখা গেলেও এদের কর্মক্ষমতা যে অনেক বেশি সেটা পার্টটাইম কাজ করতে গেলেই টের পাওয়া যায়।
প্রথমদিকে খুব কষ্ট হত এখন আস্তে আস্তে শিখে নিয়েছি অনেকটা এই এক বছরে। আর এখানে সব চেয়ে বেশি স্বাধীনতা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো! সেটা দিনে, কী মাঝ রাতে! প্রকৃতির রং-রূপ ও খুব ভালো করে উপলব্ধি করা যায় অদ্ভুত এক ভাষা রয়েছে এর, যেটা শহরের কোলাহলে পাওয়া যায় না।
এতো দায়িত্ব আর ব্যস্ততা হয়ত শুনতে খুব কঠিন মনে হচ্ছে কিন্তু এগুলো আমাকে নিজের দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে। জার্মানিতে পড়তে এসে আমার মনে হয়েছে এখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। ধনী-গরীব সবাই সমান, সাদার উপরে কালো বা কালোর উপরে সাদার কোনও বৈষম্য নেই।
উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনা তা সে যে দেশেই হোক, দেশে ফিরে আসা আর ওই একই দেশে থেকে চাকরি খোঁজার জন্য দুই রকম প্রস্তুতি লাগে।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ইমেইল: [email protected]
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |