ফিনল্যান্ডের ডায়েরি: জীবনে রঙের মন্ত্র

ফিনল্যান্ডে এসে প্রথম দিকে এদেশের মানুষকে যান্ত্রিকই মনে হয়েছে। আসলেই তো যান্ত্রিক।

এহেছান লেনিন ফিনল্যান্ডের অউলু থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2017, 11:51 AM
Updated : 13 Feb 2017, 11:51 AM

এই বরফময় দেশে যেখানে একটু ধূম্রপানের ইচ্ছে জাগলেও সাড়ে তিন কেজি ওজনের জুতো-জ্যাকেট পরে বের হতে হয়, সেখানে আবার আবেগ আসবে কোত্থেকে। তার চেয়ে ঢের ভালো আমার বাংলাদেশ, আমার শহর, আমার গলির ছোট্ট টং দোকান।

সময়ের সঙ্গে সেই ধারণা বদলেছে অনেকটাই। এখন বেশ উপলব্ধি করতে পারি- ওরা আসলে বর্তমানটাকেই ভোগ করে; বর্তমান নিয়েই বাঁচে। বেশ সহজ সমীকরণ জীবনের। এই যে দিনের পর দিন মাইনাস তাপমাত্রায় বসবাস, এই যে তুষারপাতের জ্বালাতন, এসবের মাঝেও যে রঙের দেখা মিলে তা কাছে না গেলে কী জানা হতো?

এক একটা উপলক্ষকে ওরা ঘরোয়া আয়োজনে ফ্রেমবন্দি করে। সপ্তাহের শেষ দুটো দিন তো ওদের জন্য ‘ঈদ’। শুক্রবার সন্ধ্যা না গড়াতেই চোখে পড়বে গাড়িভর্তি করে বাসায় বিয়ার নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। লাল মাংস আর বিয়ারের যুগল স্বাদটা যে কেমন!

তবে শনিবার সকালের নিরবতায় ঠিক ঠাহর করতে পারি, উদযাপনের ঘুমে ঘুমিয়েছে পুরো শহর। অউলু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সুপারভাইজর মারিতা পুইক্কনেনের সঙ্গে এ বিষয়ে একদিন বেশ কথা হয়েছিল। জানিয়েছিলেন তাদের যাপিত জীবনের নানা মাত্রা। ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনীতি আর রাজনীতি নিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিটের সেই আলাপচারিতায় একটি কথা বেশ মনে ধরেছিল, ‘আজকের সূর্যটাকে আজই দেখ, কে জানে কাল সেটি উঠবে কিনা’।

আমাদের বাচ্চারা যেমন করে বড় হয়, ফিনিশ বাচ্চারাও কিন্তু ঠিক তেমনি। ওরাও রং পেন্সিলে ছবি আাঁকতে পছন্দ করে, বাবা-মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। ওদের মা-বাবারাও সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওরাও সন্তানের সঙ্গে স্মৃতিময় কথা ভেবে আবেগ ঝরায়। মেয়ের আঁকা ছবি দেখিয়ে মারিতাকে বেশ আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়তে দেখেছিলাম সেদিন। মেয়ে বড় হচ্ছে।

ফিনল্যান্ডে সাত বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের ডে-কেয়ার বাধ্যতামূলক। তারপর শুরু হবে স্কুল। এই পুরো সময়টায় বাচ্চাকে খেলাধুলার মধ্য দিয়েই শেখানো হবে একা চলার নানা মন্ত্র, নীতি-নৈতিকতা। ওদের পড়াশোনার খরচ আজীবন সরকারই বহন করবে। ভবিষ্যতের চিন্তাটাও সরকারেরই। নইলে আছে বেকার ভাতা।

ফিনিশ আইন অনুয়ায়ী, আঠারো বছরের পর আর সন্তানকে আগলে রাখার কোনো উপায় নেই। সে চাইলেই বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারবে। জীবনের গতি-প্রকৃতি কী হবে তা একান্তই তার নিজের ব্যাপার হবে তখন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়েটা নিজের পছন্দেই করে ওরা। তাতে অভিভাবকের সায় মিললে ভালো, না মিললেও ক্ষতি নেই! ষাটোর্ধ্ব নিঃসন্তান রিত্তা কেইস্কি জীবনের গল্পের কথা বলতে গিয়ে একবাক্যে বলেছিলেন, ‘স্টিল উই আর হ্যাপি, উই এনজয় এভরি মোমেন্ট’।

অধ্যাপক রিত্তা গবেষণার নৈতিক শিক্ষা পড়ান আমাদের। সহপাঠীকে বিয়ে করার এত বছর পরও রিত্তা কেইস্কিদের সন্তানহীন জীবনে সুখি হওয়ার মন্ত্রটা বর্তমানকে উপভোগ করার মাঝে কিনা তা জানি না। আসলে পশ্চিমাদের জীবন-সংসার নিয়ে আমরা যেভাবে ভাবি, ওপেন সেক্স বা নানা কথা আমরা যেভাবে শুনি, আদতে সেটি কতটুকু সত্যি তা বুঝতে সময়ের প্রয়োজন।

শেষ করবো আমার বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে। বাংলাদেশে থাকতে ঢাকায় এক রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম- কি ভাই সপ্তাহে কয়দিন রিকশা চালান? একগাল হাসি দিয়ে সে বলেছিল, “আইজ রোজগার ভালা হইছে, কাইল চালামু না।” আমি বললাম, “পরশু যদি অসুখ-বিসুখ হয়?” তার উত্তর ছিল, “হেইডা কপাল বুঝবো।”

লেখক: সাংবাদিক, ফিনল্যান্ডের অউলু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ প্রকৌশল শিক্ষার্থী।

ই-মেইল: ahasan.khairul@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com . সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!