যে বাসা থেকে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ‘তুলে নেওয়ার’ অভিযোগ করেছে পরিবার, সেখানে খুঁজে এসে রায়হান নামে এক ব্যক্তির অবস্থান ও চলে যাওয়ার তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ।
Published : 15 Mar 2015, 07:32 PM
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলামের তদন্তের এই তথ্য রোববার বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চে উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া পাঁচটি প্রতিবেদন এদিন আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। কোথাও তার খোঁজও পাওয়া যায়নি।
তবে পুলিশ প্রতিবেদনের সেই ‘রায়হান’ আর সালাহ উদ্দিন একই ব্যক্তি কি-না সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন এই বিএনপি নেতার স্ত্রী হাসিনা আহমেদের পক্ষে শুনানি করতে আসা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।
আদালত জানিয়েছে, সোমবারও এ বিষয়ে শুনানি করা হবে।
হাসিনা আহমেদের অভিযোগ, গত ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। ‘নিখোঁজ’ হওয়ার আগে ফোন করে তাকে বিষয়টি জানানোরও চেষ্টা করেন এই বিএনপি নেতা।
স্বামীর খোঁজ চেয়ে পরদিন রাতে গুলশান থানা ও উত্তরা থানায় জিডি করতে চাইলেও পুলিশ তা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন হাসিনা।
এরপর গত বৃহস্পতিবার তিনি হাই কোর্টে গেলে আদালত একটি রুল জারি করে। সালাহ উদ্দিনকে কেন খুঁজে বের করে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হবে না- সরকারকে তা রোববারের মধ্যে জানাতে বলা হয়।
সে অনুযায়ী বিভিন্ন বাহিনীর পক্ষ থেকে রোববার অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
‘রায়হান’ বৃত্তান্ত
পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরার তিন তলা যে বাড়ি থেকে সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হয়েছিলেন বলা হচ্ছে তার মালিক মৃত ড. সিরাজ উদ দৌলা। তার মেয়ের পক্ষে রেজা নামের এক ব্যক্তি ওই বাসার দেখভাল করেন।
ওই বাড়ির নিচতলায় পশ্চিমপাশে গ্যারেজ, পূর্ব পাশ ব্যবহার করা হয় গুদাম হিসাবে। দুই দারোয়ান আশরাফুল ও আকতার নিচতলাতেই থাকেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার চারটি ফ্ল্যাটে চারটি পরিবার বসবাস করে, যার মধ্যে দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের ফ্লাটটি পুলিশের অনুসন্ধানের সময় তালাবন্ধ ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ডিএমডি হাবিব হাসনাত ও তার স্ত্রী সুমনা ওই বাসার ভাড়াটিয়া।
“জিজ্ঞাসাবাদে দারোয়ান আকতার জানায়, চারদিন আগে হাসনাত সাহেব সস্ত্রীক বাসা থেকে গিয়েছেন। যাওয়ার সময় রায়হান নামে একজন পুরুষ মেহমান রেখে যান। হাসনাত সাহেব দারোয়ানদের বলে যান, তাদের অনুপস্থিতিতে মেহমান বাসায় থাকবেন।
“আকতার আরও জানায়, বাসায় রাত ১১টা পর্যন্ত ভাড়াটিয়ারা গাড়ি নিয়ে যাওয়া আসা করে। ১০ মার্চ আনুমানিক ৯টার দিকে ৪-৫ জন মেহমান হাসনাত সাহেবের বাসায় আসেন। ওই ফ্ল্যাটের দরজা নক করার পর ভেতর থেকে দরজা খুললে তারা ভেতরে ঢোকেন।
“আনুমানিক আধা ঘণ্টা পর বাসায় আসা লোকদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে যান সেই মেহমান। ওই লোকটি সালাউদ্দিন কি-না, সেটা তারা (দারোয়ান) জানে না।”
আদালতে রিট আবেদন করার পর সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমরা শিওর, বাসার দারোয়ানকে উনারা ডিবির কার্ড দেখিয়ে বলেছে আমরা ডিবির লোক। ছয় গাড়ি লোক গিয়ে চোখ বেঁধে হাত বেঁধে তুলে তাকে (সালাহ উদ্দিন) নিয়ে যায়।”
তবে দারোয়ানের বরাত দিয়ে পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রায়হান নামের ওই ব্যক্তির কাছে যারা এসেছিলেন, তাদের পরনে কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক ছিল না। কোনো অস্ত্রও দারোয়ানরা দেখতে পাননি। বাইরে অপেক্ষমান গাড়ি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলে মনে হয়নি।
“মেহমানের হাতে হাতকড়া ছিল না। তাকে জোর করে নেওয়া হচ্ছে বলেও মনে হয়নি।”
ওই বাড়ি থেকে কাউকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধরে নিয়ে যাওয়ার তথ্যও ভাড়াটিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া যায়নি বলে আদালতকে জানিয়েছে পুলিশ।
“হাবিব হাসনাত সাহেব বাসায় মেহমান রেখে কোথায় গেছেন, তাও তারা জানেন না। তবে দুই দিন ধরে তাদের গাড়িগুলো গ্যারেজে নাই।
“খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে হাবিব হাসনাত সাহেব ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছেন। তার স্ত্রী সুমনা বাবার বাড়িতে যাননি। হাসনাত ও সুমনার সন্তানরা তাদের সঙ্গে থাকেন না। তাদের মোবাইল দুটি বন্ধ পাওয়া যায়।
“এ অবস্থায় কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, আলোচ্য বাসায় সালাহ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন বা তাকে কেউ গ্রেপ্তার বা অপহরণ করেছে”, বলা হয় প্রতিবেদনে।
আদালতে জমা হওয়া সবগুলো প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনের কোনো সন্ধান পুলিশ জানে না।
র্যাবের দেওয়া প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, হাসিনা আহমেদের স্বামী সালাহ উদ্দিন আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে গ্রহণ করা হয়নি।
র্যাব কেন নিজেদের হেফাজতের বিষয়ে তথ্য না দিয়ে পুলিশ হেফাজতের কথা বলছে- এমন প্রশ্নে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশির উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, “প্রতিবেদনের ওপরে বাংলাদেশ পুলিশ লিখে পাঠানো হয়েছে। র্যাব পুলিশেরই অংশই।”
‘তিনটি পয়েন্ট’
সব প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতের সামনে তিনটি পয়েন্ট বলেন।
এগুলো হলো- ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেন হাসিনা আহমেদ পুলিশের কাছে যাননি? জিডি করতে গিয়ে তিনি ‘লিখিত দিতে’ কেন অস্বীকার করেছেন? স্বামীর অপহরণের কথা জানাতে থানায় তিনি ‘সাংবাদিকদের নিয়ে’ গেলেন কেন?
“আমি নিজে থেকে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। পুলিশ তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে, করে যাবে। তিনটা ফ্যাক্ট আমি বললাম। আমি চাই, বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হোক। কেউ যেন এই ঘটনাকে রাজনীতির পুঁজি না করে।”
মাহবুবে আলমকে শুনানিতে সহায়তা করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশির উল্লাহ।
হাসিনার পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সঙ্গে ছিলেন এজে মোহাম্মদ আলী ও মো. বদরুদ্দোজা বাদল।
মওদুদ আহমদ বলেন, এ বিষয়ে তাদের কিছু বলার আছে। তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য সময় প্রয়োজন।
প্রতিবেদনগুলো হলফনামা আকারে জমা দিলে সোমবার বক্তব্য রাখবেন বলে জানান বদরুদ্দোজা বাদল।
হাবিব হাসনাত কোথায়?
পুলিশ ওই বাসার ভাড়াটিয়া হাবিব হাসনাতের হদিস আদালতকে দিতে না পারলেও শুনানির পর আদালত থেকে বেরিয়ে হাসিনা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এই ব্যাংক কর্মকর্তা বর্তমানে দুবাইয়ে রয়েছেন।
সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে ‘কোনো নাটক করছেন না’ মন্তব্য করে হাসিনা বলেন, “আমি সবাইকে অনুরোধ করছি, এটা অত্যন্ত মানবিক ব্যাপার। এ বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি না করে আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। হাসনাত সাহেব আমার নিকট আত্মীয়। উনি বিস্তারিত বলেছেন।”
হাসিনার ভাষ্য অনুযায়ী, সালাহ উদ্দিনকে ১০ মার্চ রাতে ‘ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার’ পর হাবিব হাসনাতের মধ্যেও গ্রেপ্তার আতঙ্ক তৈরি হয়, কেননা তিনি এই বিএনপি নেতাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওই আতঙ্ক থেকে তিনি দুবাই চলে যান। আর তার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় হাসিনা জিডিও করতে পারছিলেন না।
“পরদিন দুপুরে উনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। উনার সঙ্গে কথার বলার পর পার্টির সঙ্গে কথা বলি। নজরুল ইসলাম সাহেব বিবৃতি দেন। এরপর উনি বলেন, তুমি থানায় যাও জিডি কর।”
স্বামীর খোঁজে প্রধানমন্ত্রীকেও অনুরোধ করবেন জানিয়ে হাসিনা আহমেদ বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব, উনি যেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন।”
“আমি তার স্ত্রী, আমি জানি, আমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে। আমার স্বামীকে নিয়ে আমি নাটক করব, এটা জীবনেও হতে পারে না।”
রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিক থেকে সালাহ উদ্দিনের নামেই গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে হরতালের বার্তা দেওয়া হচ্ছিল। তবে নিজের অবস্থান প্রকাশ করছিলেন না এই রাজনীতিক।
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস ছিলেন সালাহ উদ্দিন। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে কক্সবাজারের সংসদ সদস্য হন এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার স্ত্রী হাসিনাও সংসদ সদস্য ছিলেন।