মঞ্জু, মেনন, ইনুর সমালোচনায় জিয়াতনয় তারেক

সরকারের তিন মন্ত্রীর পূর্বের রাজনৈতিক ভূমিকা তুলে ধরে সরকারের সমালোচনা করলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

সৈয়দ নাহাস পাশাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2014, 09:13 AM
Updated : 2 Sept 2014, 09:13 AM

মন্ত্রীরা হলেন- জাসদ নেতা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) নেতা পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ইনু ও মেননের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন তারেক। আর একটি দৈনিকে প্রকাশিত মঞ্জুর একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন তিনি।

তারেক রহমান বলেন, তার বাবা জিয়াউর রহমানই প্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

“রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হলেও শহীদ জিয়া যুদ্ধের ডাক দিতে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে সময় নষ্ট করেননি।”

বিএনপি ও দলটির প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকার সমালোচনাকারীদের অনেকের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক অংশগ্রহণ ছিল না বলে দাবি করেন তারেক।

তিনি বলেন, “যারা এখন বিএনপি কিংবা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের অনেকেরই গৌরবজনক অংশগ্রহণ ছিল না। এদের অনেকেই ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানীদের কাছে স্বেচ্ছা সমর্পণের আগে শেখ মুজিবের দেয়া তেল নাকে দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন।

“এই তেলবাজরাই এখন নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে তেল ব্যবহার করছেন। নিজেরাই নিজেদের মতো করে তৈলাক্ত ইতিহাস রচনা করছেন। তাদের গলাবাজিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অসহায়।”

আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, “ইতিহাসের কঠিন সত্য তুলে ধরার কারণে কিছু লোক উল্টোপাল্টা বলছে।  আমি শুধু হযরত আলীর একটি বাণীর উদ্বৃতি দিবো- যুক্তিবুদ্ধিহীন মানুষই অশ্লীল কথা বলে।”

বর্তমান সরকার ও মন্ত্রীদের ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুই মন্ত্রী ইনু ও মেননের ভূমিকা তুলে ধরেন তারেক।

তিনি বলেন, “শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর হাসানুল হক ইনুর এবং কর্নেল তাহেরের ভুমিকা নিয়ে ২০০৯ সালে দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর হাসানুল হক ইনু শাহবাগে বেতার ভবনে গিয়ে অভ্যুত্থানের নায়কদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছিলেন এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছিলেন, সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহেরও ছিলেন।”

মেনন সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন, “সে সময় ১৯৭৫ সালের ২৯ আগস্ট রাশেদ খান মেননের দল,  ইউপিপি একটি  বিবৃতি প্রকাশ করে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, মুজিবের অপসারণে জনগণ উল্লসিত। তার মৃত্যু কারও মনে সামান্যতম সমবেদনা বা দুঃখ জাগায়নি, জাগাতে পারে না।”

সভায় দৈনিক সমকালে প্রকাশিত মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর একটি লেখা নিয়ে আলোচনা করেন তারেক।

তিনি বলেন, “ওই রিপোর্টে বলা হয়, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ থেকে ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের নেতা নির্বাচত হয়েছিলেন।  এই ঘটনার জের ধরে তৎকালীন ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ ছাত্রলীগের ওই হলের নেতাকর্মীদের  মারধর করে।

“এই খবর পেয়ে তিনি যান শেখ মুজিবের বাসায়। সঙ্গে ছিলেন মরহুম আব্দুর রাজ্জাক। শেখ মুজিবকে ফজলুল হক হলের ঘটনা বলার পর তখন শেখ মুজিব বললেন, লজ্জা করে না, ছাত্রলীগের ছেলে হয়ে মার খেয়ে এসেছিস, ওদের হল থেকে বের করে দে। বাকিটা আমি দেখব।

“তারপর লুঙ্গির ভাঁজ থেকে কিছু একটা বের করে শেখ মুজিব রাজ্জাক সাহেবের হাতে দিলেন, গাড়িতে ওঠার প্রস্তুতি নেয়ার সময় শেখ মুজিব কিছু একটা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর হাতে দিয়ে বললেন, 'গাড়িতে সব সময় কিছু একটা রাখিস’।”

জিয়াকে বিতর্কিত করার চেষ্টা

নিজের বাবা প্রয়াত সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানই প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বলে দাবি করেন তারেক।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কোনোভাবেই জিয়ার ভূমিকা খাটো করতে ব্যর্থ হয়ে এখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তাকে জড়ানোর চেষ্টা চলছে বলেও দাবি করেন তিনি।

তারেক বলেন, “তিনিই প্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হলেও শহীদ জিয়া যুদ্ধের ডাক দিতে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে সময় নষ্ট করেননি।

“যুদ্ধের, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কোনোভাবেই শহীদ জিয়ার ভূমিকাকে খাটো করতে ব্যর্থ হয়ে এখন তারা শহীদ জিয়াকে বিতর্কিত করতে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে শহীদ জিয়ার নাম জড়াতে চায়।”

আলোচনায় জিয়াউর রহমানকে সফল রাজনীতিক হিসেবে অভিহিত করে তার বড় ছেলে তারেক বলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে তার মতো নেতা বিরল, যিনি একাধারে প্রতিটি দায়িত্বে ছিলেন সমান জনপ্রিয়।”

বিএনপিকেও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য দল হিসেবে দাবি করেন  তারেক।

ধর্মকে ভিত্তি করে দল হতে পারে না

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে একাধিক ধর্মভিত্তিক দল থাকলেও ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে না বলে মনে করেন তারেক রহমান।

তিনি বলেন, রাজনীতিতে ধর্মের অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দল হতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে বাবা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে নেতাকর্মীদের বিষয়টি খেয়াল রাখতে বলেন তারেক।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এক কর্মশালায় জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। অবদান থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনোই রাজনীতি করা যায় না।”

বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো বারবার চেষ্টা করলেও তারা বিফল হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তারেক বলেন, “আমাদের দেশে যে সকল ধর্ম রয়েছে আমাদের অনেকে আছেন সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করার ও রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন। আমরা বারবার দেখেছি, তারা বিফল হয়েছে।”

ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি রয়েছে। তবে জোট শরিক জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে আসছেন বিএনপি নেতারা।

শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুসের সভাপতিত্বে ও কয়েস আহমেদের পরিচালনায় ওই আলোচনা সভায় বিএনপির ৫০০ শতাধিক নেতা-কর্মী-সমর্থক অংশ নেন, যার ব্যানারে প্রধান অতিথি তারেককে ‘দেশনায়ক’বলা হয়।

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা পর্বের আগে বিএনপি পরিচালনায় জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অবদান তুলে ধরে পলিসি ফোরাম নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।

সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে মুক্তির পর চিকিৎসার জন্য  যুক্তরাজ্যে যান তারেক।

২১ অগাস্টসহ বিভিন্ন মামলা মাথায় নিয়ে লন্ডনে থাকা তারেক প্রবাসে বিএনপির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। লন্ডন থেকে মালয়েশিয়া গিয়ে একটি সভায়ও যোগ দেন তিনি। গত জুলাইয়ে সস্ত্রীক সৌদি আরব গিয়ে মায়ের সঙ্গে ওমরাহও পালন করেন তিনি।

সর্বশেষ গত ২৫ অগাস্ট লন্ডনে এক সভায় বক্তব্যে শেখ মুজিব পরিবারকে ‘অভিশাপ’ এবং আওয়ামী লীগকে ‘কুলাঙ্গারের দল’বলেন তিনি।  

কয়েক মাস আগে আরেক সভায় নিজের বাবা জিয়াউর রহমানকে ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’বলে দাবি করেন তারেক। সেইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’বলেন তিনি।

এসব বক্তব্যের জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তীব্র বাক্যবাণ তারেককে লক্ষ্য করে। সেইসঙ্গে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও উঠেছে।