'দর্শকের জন্যই সিনেমা'

সম্প্রতি আন্তজর্াতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতীয় নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। এক সন্ধ্যায় তিনি কিছুটা সময় দেন গ্লিটজকে। কথা হয়, উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের বিবতর্ন থেকে শুরু করে হিন্দি সিনেমার বদলে যাওয়া দৃশ্যপট নিয়ে।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2014, 08:26 AM
Updated : 12 Dec 2014, 08:53 AM

গ্লিটজ: মূলধারার হিন্দি সিনেমা এখন প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সবখানেই। সত্তরের দশকে বিকল্প ধারার পত্তনের পর হিন্দি সিনেমা অনেকদূর এগিয়েছে। হিন্দি সিনেমার ভাষাও এখন বদলে গেছে অনেকটাই। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

শ্যাম বেনেগাল: শুরু থেকেই বলি তাহলে। ভারতীয় সিনেমাকে পূর্ণাঙ্গভাবে যদি দেখ, তাহলে দেখবে, এটি একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্যই অনুসরণ করে এসেছে সবসময়। আর এই ঐতিহ্য এসেছে আমাদের মঞ্চ নাটক থেকে। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, জনপ্রিয় ধারার মঞ্চ নাটকও এসেছে আমাদের প্রাচীন নাটমণ্ডল থেকে, যেখানে ধ্রুপদ আর লোক - সংস্কৃতির এই দুই ধারাই বিদ্যমান ছিল।

এখন এই ঐতিহ্যের অনুসরণেই একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আমাদের সিনেমার গল্প বলা হয়। অন্যদিকে আবার (নাটকীয় কারণেই হোক অথবা নান্দনিক কিংবা মনস্তাত্বিক কারণেই হোক), মাঝে মাঝে সিনেমা এমন কিছু উপাদান দিয়ে সাজানো হয়, যাতে করে দর্শক নিছক বিনোদনের জন্যই সিনেমা দেখতে পারে। আর তাই সিনেমার গল্পে গান আর নাচ যোগ করা শুরু হল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়া বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলে যেহেতু এ ধরনের সিনেমা বানানো হয় না, সে কারণেই এই নির্দিষ্ট কাঠামোটি সিনেমা নির্মাণের একটি অনুপম ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। আর এটাই হল, আমাদের মূলধারার সিনেমা।

এখন, এর মধ্যে কোন বিষয়টার কারণে কিছু মানুষ (সৃজনশীল চিন্তাভাবনার মানুষ) এই ধারা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারল না? কারণ, ধীরে ধীরে এটিই হয়ে গেল একটা প্রোক্রাস্টিয়ান বেডের মতো। মধ্যযুগে মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এক ধরনের বিছানা বানানো হত। বিছানার আকারের থেকে যদি কেউ বেশি লম্বা হয়ে যেত, তাহলে তার হাত পা কেটে ফেলা হত। আর কেউ যদি হতো খাটো, তাহলে তাকে টেনে হিঁচড়ে লম্বা বানানো হত। মূলধারার সিনেমার ব্যাপারটাও অনেকটা সে রকম ছিল। যেভাবেই কেউ সিনেমা বানাতে চান না কেন, তাকে ঐ নির্দিষ্ট ছকে বাধা কাঠামো অনুসরণ করেই সিনেমা বানাতে হত।

এখন এখানে বেশ কিছু বাধা কাজ করতো নির্মাতাদের জন্য। প্রথমত, যে ধরনের সিনেমা দেখতে দর্শক অভ্যস্ত, সে ধরনের সিনেমা বানানোই সবচেয়ে সহজ। এরপরও যদি কেউ নিজের মতো করে সিনেমা বানাতে চাইতো এবং সেটার জন্য দর্শকও যোগাড় করে ফেলতো, তারপরও হলে গিয়ে সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে দর্শকদের সেই আগের ধারার সিনেমা দেখারই প্রত্যাশা থাকতো।

এখন, এই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সিনেমা বানানোর প্রথম ধাপটা ভারতে সবার আগে শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে। এর আগেও অবশ্য, ত্রিশের দশকে, সেই থিয়েটারের আমলেই অন্যান্য কোম্পানিগুলোর পাশপাশি ব্রিটেন ফেরত পিসি বরুয়া, জার্মানি ফেরত হিমাংশু রায়ের মতো মানুষ ছিলেন। তারা গতানুগতিক সিনেমাগুলোর বাইরে গিয়ে ‘বোম্বে টকিজ’-এর মতো কিছুটা ভিন্নধর্মী সিনেমা বানাচ্ছিলেন। তাদের হাত ধরে সিনেমায় নতুন নতুন ধারণার জন্ম হচ্ছিল। কিন্তু তারাও ‍খুব বেশিদূর যেতে পারেননি। ধীরে ধীরে মূলস্রোতের সঙ্গে মিশে গেলেন তারাও।  

আর তাই সত্যিকারের বিপ্লবটা শুরু হল পঞ্চাশের দশকেই। তখনই আমাদের মাঝে এলেন এমন একদল মানুষ, যাদের এর আগে সিনেমার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই ছিলনা। যেমন ধরা যাক, সত্যজিৎ রায়ের কথা। নির্মাতা হওয়ার আগে তিনি ছিলেন বাণিজ্যিক ধারার চারুশিল্পী। আরও ছিলেন মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকেরা। ঋত্বিক এসেছিলেন মঞ্চ নাটক থেকে, মৃণাল কাজ করতেন মিশ্র ধারার শিল্পে। তো, এই যে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা মানুষ এমন এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করলেন, যেখানে তারা নিজেস্ব ভাষাতেই সিনেমা তৈরি করতে শুরু করলেন। তাদের হাত ধরেই এখানে সিনেমাকে একটি স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে দেখা শুরু হল। এটিই পরবর্তীতে সিনেমা নির্মাণের বিকল্প ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল।

বাংলার পরপরই আদুর গোপালা কৃষ্ণণদের মতো নির্মাতাদের হাত ধরে কেরালাতেও ভিন্নধর্মী সিনেমা বানানো শুরু হল। একই সময়ে এটা শুরু হল কর্নাটকেও। সেখানে গিরিশ কারনাড়রা সিনেমা বানাতে শুরু করলেন। তো, সব মিলিয়ে এই ধারা পরিণত হল এক ধরনের আন্দোলনে। যেটা কিনা সবার শেষে এসে পৌঁছালো হিন্দি সিনেমায়।

এখন, হিন্দি সিনেমাই আসলে ভারতের মুলধারার সিনেমা। তাই, বাংলা, ওড়িয়া কিংবা মালায়ালামের থেকে এই ক্ষেত্রে নতুন কোনো বিপ্লব শুরু করাটা অনেক বেশি কঠিন ছিল। আর এই ভাষাতেই সিনেমা বানাতে শুরু করি আমি।

হিন্দিতে, আমার মতো আরও কিছু মানুষ ছিল (এম এম সাত্তু এবং আরও অনেকে) যারা ওই সময়টাতে নিজেস্ব ঘরানায় সিনেমা বানাতে শুরু করে। এখন, এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় দর্শকদের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন চলে এসেছিল। আমরা যে ধরনের সিনেমার কথা বলছি, সে ধরনের সিনেমা কিন্তু দর্শকদের সমর্থন ছাড়া বানানো সম্ভব ছিল না। কারণ, দর্শক না থাকলে তো সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই।

তো, আমি যখন সিনেমা বানাতে শুরু করেছিলাম, আমি দর্শকদের সমর্থন পেয়েছিলাম। তাই, তখন থেকে এখনও পর্যন্ত আমি সিনেমা বানানো চালিয়ে যেতে পেরেছি। ৪১ বছর ধরে সিনেমা বানিয়ে আসছি আমি। এখন আর আমার সিনেমা বানাতে গেলে অর্থ সংস্থান নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।

তবে শুরুর দিকে সিনেমার বাজেট নিয়ে আমাকে সমস্যায় পড়তে হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী আমার সিনেমা কতটুকু বাজেটের মধ্যে তৈরি করতে হবে- সেটার একটা বোঝাপড়া তৈরি হলো। আর সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে এই ধরনের বোঝাপড়াটা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বোঝাপড়ার মানে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থই কেবল একটা সিনেমার পেছনে খরচ করা যেতে পারে। এর বেশি খরচ করলে দর্শকের কাছ থেকে সেই পরিমাণ অর্থ তুমি উঠিয়ে আনতে পারবে না। ফলে তোমার সিনেমা চলবে না। আর সেকারণেই এই বোঝাপড়ার ভারসাম্য থাকাটা জরুরি।

আর তাই একেবারে সৃজনশীল সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রেও দর্শকের অর্থনৈতিক সামর্থর ব্যাপারে সজাগ থাকতে হয়। আবার চিন্তাভাবনার দিক থেকে থাকতে হবে পুরোপুরি স্বাধীন। আর সে ধরনের সিনেমা বানানোটাই আমার কাম্য।

গ্লিটজ:
আপনি তো একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সহযোগিতা পেয়েছেন আপনার সিনেমার পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে....

শ্যাম বেনেগাল: দেখ, এটা নির্ভর করে তুমি কোথা থেকে এসেছো সেটার ওপর। সেভাবে বলতে গেলে, আমি নিজেও এসেছি গ্রাম থেকেই। আর তাই, একেবারে তৃণমূল পযর্ায়ের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আমার জীবনে ছিল অনেক বড় একটা প্রভাবক। আর আমি এমন একটা সময়ে বেড়ে উঠছিলাম, যখন ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাইরেও ঘটে যাচ্ছিল বড় বড় সব পালাবদল। যখন আমি কিশোর ছিলাম, আমার শহর হায়দ্রাবাদেই ‘কমিউনিস্ট’ ভাবধারার মধ্য দিয়ে তেলেঙ্গানা আন্দোলন পুনর্জীবন পায়। আদর্শের দিক থেকে এটা ছিল পুরোপুরি সামন্ততন্ত্রবিরোধী এবং কমিউনিস্ট।

গ্লিটজ: এই সব উপাদানই বারবার উঠে এসেছে আপনার ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’ সিনেমায়....

শ্যাম বেনেগাল: অবশ্যই! সেটা তো আসবেই। কারণ, এইসব ধ্যান ধারণায় প্রভাবিত হয়েই তো আমি বেড়ে উঠেছি। যখন সমাজ বদলাতে থাকে, চিন্তাভাবনাগুলোও সেই অনুযায়ীই গড়ে ওঠে, তখন সেভাবেই তুমি তোমার সিনেমা বানাবে- এটাই হয়।

এরপরও কিন্তু তুমি বদলাবে। তুমি আগের ধ্যান ধারনা ধরে রাখতে পারবে না। কারণ পুরো পৃথিবীই বদলাচ্ছে। তুমি নিজে বদলাচ্ছ, তোমার সম্পর্কগুলো বদলাচ্ছে, আর এর মধ্যেই অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে।

সিনেমার বর্তমান চিত্রের কথাই ধরো। পুরো দৃশ্যপটটাই কিন্তু পাল্টে গেছে, কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। এখনকার সিনেমায় কিন্তু আর কোনো সামন্ত চরিত্র দেখা যায় না, কারণ আমাদের সমাজেই সামন্তবাদ আর নেই। এখন আমাদের সমাজব্যবস্থা অনেক বেশি পুঁজিবাদী। এমনকী, আমরা যে ধারণাটাকে পুঁজিবাদী হিসেবে জানতাম- সেটাও বদলে গেছে অনেকখানি। আর তাই সমাজ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও আগের থেকে বদলে গেছে কিছুটা।

যেমন ধরো, সামাজিক সমস্যার বিষয়টা। সমাজে আগে যে ধরণের সমস্যা নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম, সেগুলোও এখন বদলে গেছে। এই যেমন, সমাজে নারীদের স্থান আর সংখ্যালঘু সমস্যার বিষয়টা। ভারতে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো মুসলমানরা। তারা সবসময়ই অন্যদের থেকে ভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এসেছে। এখন, তাদের সমস্যাগুলোকে তুমি কিভাবে বুঝবে?

সুতরাং, যখন আমি ‘মাম্মো’ কিংবা ‘সারদারি বেগম’-এর মতো সিনেমা বানালাম সংখ্যালঘুদের সমস্যা প্রেক্ষাপটে রেখে, আমাকে কিন্তু তাদের মতো করেই তাদের বাস্তবতাকে বুঝতে হয়েছিল। আমার জন্য বিষয়টা অনেক সহজও ছিল অবশ্য। যাদের এরকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং সংখ্যালঘু হিসেবেই আসলে সারাজীবন যাদের বাঁচতে হয়- তাদের অবস্থা বোঝা আমার জন্য খুব একটা কঠিন কিছু না। কারণ, আমি নিজে এমন একটা সম্প্রদায় থেকে এসেছি, পুরো পৃথিবীতে যে সম্প্রদায়ের মোটে ৪০ হাজার মানুষ জীবিত আছে। আর তাই সংখ্যালঘু হওয়া ব্যাপারটি আসলে আমার জন্য নতুন কোনো ধারণা নয়। আমার বেড়ে ওঠাই এর মধ্য দিয়ে। এসব ব্যাপারও আমার চিন্তাভাবনাকে অনেক প্রভাবিত করেছে।

গ্লিটজ: আপনি অনেক আগে যে জিনিসটা শুরু করেছিলেন তা হলো সিনেমায় শক্তিশালী নারী চরিত্র তুলে ধরা। আপনার সিনেমাগুলো ছিল নারীকেন্দ্রীক এবং নারী চরিত্রনির্ভর। আবার এখন সিনেমায় শক্তিশালী নারী চরিত্রের আবির্ভাব শুরু হয়েছে। আশি, নব্বই কিংবা এ শতাব্দীর শুরুতেও মূলধারার সিনেমায় নারীদের আবেদনময়ী করে উপস্থাপনের দিকেই সবার মনোযোগ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ‘কাহানি’, চলতি বছরের ‘হাইওয়ে’ কিংবা ‘কুইন’- এই নারীপ্রধান সিনেমাগুলো বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক বার্তাও বহন করেছে ...

শ্যাম বেনেগাল:
দেখ, এটা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না, আমাদের দর্শক এই ধরনের সিনেমায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে, যে ধরনের সিনেমা আমরা আগে তৈরি করেছিলাম। যদিও, মূলধারার সিনেমার দর্শকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কম বেশি আগের মতোই রয়ে গেছে, তারপরও এই বলয়ের বাইরে দর্শকদের আরেকটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন অনেক মানুষ আছেন যারা বোঝেন, এমন ধরনের সিনেমাও হয় যেগুলো খুবই বিনোদনমূলক, উপভোগ্য আবার যেগুলো তাদের অন্যরকম এক অভিজ্ঞতাও দেবে।

আর সেকারণেই, আজ তরুণ নির্মাতারা ‘কাহানি’র মতো সিনেমা বানাতে পারছেন। আমরা যখন এরকম সিনেমা বানাচ্ছিলাম, তখন কিন্তু এই ক্ষেত্রটা ছিলনা। আমাদের সেটা বানিয়ে নিতে হয়েছে।

গ্লিটজ: আপনি সেই ক্ষেত্রে অগ্রণী...

শ্যাম বেনেগাল: আমি আসলে সেই অগ্রণী প্রজন্মের একজন। যাই হোক, এখনকার নির্মাতাদের জন্য আসলে বিষয়টা সহজ। আর তাছাড়া, এখন ইমতিয়াজ আলির মতো নির্মাতা আছেন, যিনি খুব সংবেদনশীলভাবে এই বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি বানাতে পারেন। দিবাকর ব্যানার্জির মতো নির্মাতা আছে; তিনি অসাধারণ সব সিনেমা বানান। এদের মতো দারুণ নির্মাতারা যখন দৃশ্যপটে হাজির হন, তখন আসলে পুরো ক্ষেত্রটাই বেড়ে ওঠে। তাদের জন্যই আসলে এখন এরকম দারুণ ব্যাপারগুলো ঘটছে।

ভারতীয় চলচ্চিত্র, এমনকী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চলচ্চিত্রের জন্যই এটা খুবই শুভ লক্ষণ। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশেও একই রকমের ঘটনা ঘটছে।

গ্লিটজ: কেবল আর একটি প্রশ্ন আছে। যতদূর জানি, আপিনি সিনেমা বানানো শুরু করেছিলেন একদম কিশোর বয়সে। ১২ বছর বয়সে আপনার বাবার দেওয়া একটি ক্যামেরা দিয়ে সিনেমা বানানো শুরু করেন আপনি। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য, বিজ্ঞাপন চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে। যে উৎসবে অংশ নিতে আপনি এসেছেন, সেটি স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং মুক্ত চলচ্চিত্রের উৎসব। বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের মধ্যে অনেকেই স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং প্রামাণ্যচিত্র দিয়েই সিনেমাকে বোঝার প্রয়াসের সূচনা করছে। আপনার কি মনে হয়, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এই চেষ্টার গুরুত্ব অনেক?

শ্যাম বেনেগাল: হ্যাঁ, আমি সেটা মনে করি। তবে এটাও জানি, এই ক্ষেত্রের অনেক বড় একটা সুবিধার পাশাপাশি বড় একটা অসুবিধাও আছে।

সুবিধাটা হল, স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানাতে অনেক কম অর্থের প্রয়োজন। আর তাই, অর্থ সংক্রান্ত ঝুঁকিটাও কম। যদিও পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়ে যে আর্থিক লাভ হয়, সেটা কখনোই পাওয়া যাবে না। বড় পরিসরে সিনেমা বানাতে গেলে তাই তোমাকে এরপর টাকার জন্য এর ওর কাছে হাত পাততে হবে, ধার করতে হবে নয়তো চুরি করতে হবে! তবে, ছোট পরিসরে, তুমি যা চাইছো, ঠিক তেমন করেই তোমার সিনেমা বানাতে পারবে।

অসুবিধাটা হল, তোমার সিনেমার জন্য দর্শক জোগাড় করাটা। তোমার বানানো সিনেমা দর্শক দেখবে কী না এটা তো তাদের ব্যাপার। স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্মাতাদের সঙ্গে দর্শকের সম্পর্ক তো তুমি আগে থেকে অনুমান করতে পারবে না। ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো তুমি দর্শক পাবে, ক্ষেত্রবিশেষে পাবে না।

এখানে আবার টেলিভিশন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশে যেমন এনডিটিভি একটা ছোট ভুমিকা পালন করছে প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের সুযোগ করে দিয়ে। তারা এই প্রামাণ্যচিত্রগুলো দেখাচ্ছেও বেশ ভাল একটা সময়ে। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, এমন সময়ে না; তারা প্রামাণ্যচিত্র দেখাচ্ছে পিক আওয়ারেই। এর মাধ্যমেও কিন্তু এক ধরনের দর্শক তৈরি হচ্ছে।

এখন এখানেও কিন্তু সুযোগটা অনেক কম, যেহেতু আমরা বলতে পারছি না আসলে ঠিক কী পরিমাণ দর্শক এখান থেকে আমরা পাচ্ছি। কিন্তু তারপরেও, সুযোগ তো একটা তৈরি হচ্ছে। আর সেটা কিন্তু আমাদের স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্মাতাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

মোদ্দা কথা, যখন তুমি স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানাচ্ছো, তখন তোমার সৃজনশীলতার স্বাধীনতা অনেক, চাপও অনেক কম। কিন্তু এই ধরনের সিনেমা দিয়ে দর্শক টানা আর সিনেমা তৈরির যাত্রা অব্যাহত রাখা অনেক কঠিন।

আর তাই যেভাবেই দেখো না কেন, সমস্যা থাকবেই। এটা গ্রিক পূরাণের সেই সিসিফাসের গল্পের মতো। যে বড় একটা পাথরকে ঠেলতে ঠেলতে পাহাড়ে তুলে পরের দিনই আবিষ্কার করতো, পথরটা আবার আগের যায়গাতেই ফিরে এসেছে। বিষয়টা এরকমই। জীবনটাই আসলে এরকম। এরমধ্যে দিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। আর আমরা, চলচ্চিত্র নির্মাতারা এসবের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকি সিনেমা বানিয়ে!