যারে যাবি যদি যা

ষাট দশকে তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব ও পাকিস্তানের জনপ্রিয় প্লেব্যাক গায়ক। তার ভরাট ও মাধুর্যপূর্ণ কণ্ঠস্বর শ্রোতাকে আবিষ্ট করত সহজেই।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2014, 07:13 AM
Updated : 20 April 2014, 01:44 PM

‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘ডেকো না আমারে তুমি’ বশির আহমেদের কণ্ঠের এই গানগুলো বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ল্যাসিক গানে পরিণত হয়েছে মূলত তার কণ্ঠশৈলীর জন্যই। যদিও অনেক বছর তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে দূরে ছিলেন, সংগীতভুবনেও ছিলেন অনুপস্থিত, তবু তার কণ্ঠ শ্রোতার কাছে ছিল অবিস্মরণীয়।

অসংখ্য শ্রোতানন্দিত গানের শিল্পী বশীর আহমেদের জীবনাবসান হল ২০ এপ্রিল।

বশির আহমেদের জন্ম ১৯৪০ সালে কলকাতার এক উর্দুভাষী পরিবারে। তার শৈশব এবং যৌবনের অনেকটা কেটেছে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পট পরিবর্তন তার শিল্পীজীবনকে অনেক ব্যাহত করেছে।

১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পরও তার পরিবার কলকাতাতেই থেকে যায় যদিও তার পরিবারের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা প্রতিকূল হয়ে পড়ে। তবে তিনি ছিলেন এক গানপাগল কিশোর। ১৫ বছর বয়সেই ওস্তাদ বিলায়েত হোসেনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। এরপর তিনি মুম্বাই যান এবং ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলির শিষ্য হন। বড়ে গোলাম আলি তার এই কবি ছাত্রকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। বশির আহমেদ সে সময় চমৎকার গজল গাইতেন এবং নিজে লিখতেন গানের কথা।

১৯৬০ সালে বশির আহমেদ ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় তখন চলচ্চিত্রশিল্প বিকশিত হচ্ছে। বাংলাভাষায় তো সিনেমা নির্মাণ হচ্ছেই; কিন্তু তার চেয়ে বেশি রমরমা অবস্থা উর্দু সিনেমায়। আত্মীয় ইশরাত কালকাতভি উর্দু সিনেমার জন্য গান লিখতেন। তিনি তখন ‘তালাশ’-এর জন্য গান লিখছিলেন। ‘তালাশ’-এর সংগীত পরিচালক ছিলেন রবীন ঘোষ। ইশরাতই পরিচয় করিয়ে দেন রবীন ঘোষের সঙ্গে। ‘তালাশ’ সিনেমায় তখন প্লেব্যাকের কাজ করছিলেন বিখ্যাত শিল্পী তালাত মাহমুদ। সুযোগ পেলেন বশির আহমেদও। তার কণ্ঠে মুগ্ধ রবীন ঘোষ তাকে সুযোগ দেন। ওই সিনেমায় বশির আহমেদের গাওয়া ‘কুছ আপনি কাহিয়ে, কুছ মেরি সুনিয়ে’, ‘ম্যায় রিকশাওয়ালা মাতওয়ালা’ গানদুটি শ্রোতাপ্রিয় হয়। রহমান-শবনম অভিনীত সিনেমাটি ব্যবসা সফল হয়। ফলে কপাল খুলে যায় বশির আহমেদেরও। তিনি চলচ্চিত্রে উর্দু গানের জনপ্রিয় গায়ক হয়ে ওঠেন। ষাটের দশকে প্লেব্যাকে তিনি ছিলেন প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাগানও তিনি গেয়েছিলেন এবং জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কবি ও গীতিকার। সুরকারও ছিলেন। এবং সাফল্যও পেয়েছিলেন যথেষ্ট। মাত্র এক দশকের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা পান তিনি।

১৯৬৪ সালে রবীন ঘোষের ‘কারওয়ান’ সিনেমায় বশির আহমেদের লেখা এবং গাওয়া ‘যাব তুম আকেলে হো গায়ে হাম ইয়াদ আয়েগে’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ‘সাগর’, ‘মিলান’, ‘কাংগান’, ‘দরশান’, ইত্যাদি ব্যবসা সফল সিনেমার সুবাদে তিনি সেসময় পাকিস্তানে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। তিনি তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ শুরু করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগীত পরিচালক হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে তার কদর কমে যেতে থাকে। পরবর্তীতে তিনি চলচ্চিত্রজগত থেকে সরে যান। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কার্যত তেমন কোনো কাজই করতে পারেননি সেখানে। ১৯৭৫-এ তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। কিন্তু এখানেও তেমনভাবে কাজে যোগ দেননি।

বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করতেন আর গানের শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। বিটিভির গানের অনুষ্ঠানেও নিয়মিত শিল্পী ছিলেন তিনি। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় মোটামুটি নিভৃতেই কাটিয়ে গেছেন পরবর্তী সাড়ে তিনদশক।

তার কণ্ঠে সেই অবিস্মরণীয় গানের ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি, যা কিছু বলার ছিল বলে দিয়েছি’ পংক্তির মতো তিনিও যেন কোনো নীরব অভিমানেই দূরে সরে ছিলেন খ্যাতির ভুবন থেকে।

যেমন আড়ালে ছিলেন জীবনে, তেমনি নিভৃতে চলে গেলেন মৃত্যুর দেশে। খাঁচার খোলা দরজা দিয়ে যেন নীরবে উড়ে গেল প্রাণপাখি। তবে বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে বশির আহমেদ চিরদিন বেঁচে থাকবেন তার ললিত কণ্ঠের জন্য।