হুমায়ূন আহমেদ আশির দশকের মাঝামাঝিতে আমেরিকা থেকে পি এইচ ডি সমাপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। এরইমধ্যে তার দুইটি উপন্যাস‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে। একদিন শুনলাম, তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারের জন্য প্রযোজক নওয়াজীশ আলী খানের প্রযোজনায় একটি সাপ্তাহিক নাটক রচনা করেছেন।
Published : 12 Nov 2016, 11:16 PM
হুমায়ূন আহমেদ সুলেখক বিধায় আমি নওয়াজীশ আলী খানকে বললাম পরবর্তীতে তিনি টেলিভিশন অফিসে এলে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। সেভাবেই অল্প কিছুদিনের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা হলো।
আমি তাকে বললাম, “আপনার লেখার হাত চমৎকার, আপনি যদি আমাকে একটি নাটক লিখে দেন তাহলে আমি আপনার নাটকটি প্রযোজনা করতে পারি।”
আমার কথা শুনে হুমায়ূন একেবারে সরাসরি বললেন, “আমি উপন্যাস লিখি, নাটক লিখতে পারি না।” এটুকু বলেই অবশ্য তিনি একটু ভেবে বললেন, “তবে এই মুহুর্তে আমার একটি রঙিন টেলিভিশন কেনার খুব প্রয়োজন। আপনাকে একটি নাটক দিলে, সেটি প্রচার হলে, যদি আমার রঙিন টেলিভিশন কেনার পয়সাটা জোগাড় হয়ে যায়, তবে আপনাকে একটি নাটক দিতে পারি।”
আমি বললাম “তা হবে, আপনি একটি একক নাটক আজ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে লিখে নিয়ে আসুন।” হুমায়ূন একটি নির্দিষ্ট তারিখে নাটক দেবার কথা বলে বিদায় নিলেন।
কথা মত ঠিক এক সপ্তাহ পর তিনি একটি একক নাটক নিয়ে হাজির হলেন। নাটকের নাম ‘এইসব দিনরাত্রি’। আমি তাকে বললাম, “আপনি পরশু দিন আসুন। আমি নাটকটি পড়ে আপনাকে মতামত জানাব।”
মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ,আনন্দ-বেদনা নিয়ে লেখা তার নাটকের চমৎকার গাঁথুনি, চমৎকার সংলাপ সর্বোপরি উপস্থাপনাশৈলী পড়ে আমার মনে হলো, এই নাটকটিকে ধারাবাহিক নাটকে রুপান্তরিত করা গেলে বেশ হয়।
হুমায়ূন যথা সময়ে ছ’টি নাটকের পান্ডুলিপি নিয়ে উপস্থিত হলেন। তার নাটকের প্রতিটি পান্ডুলিপি পড়ে দেখলাম। হুমায়ূন আহমেদের গল্প সামনে টেনে নিয়ে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা।
তাকে আমি বললাম, “আপনার লেখা নাটকের ধারাবাহিকচিত্র আমার পছন্দ হয়েছে। এই নাটকটি আমি ধারাবাহিক নাটক হিসেবে শুরু করব।”
নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে শুরু হলো নতুন আঙ্গিকের ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’। অল্পদিনেই নাটকটি দর্শকদের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়ে তুলল।
সেই সময় ‘এইসব দিনরাত্রি’ প্রচারের তারিখে ঢাকা ক্লাবে হাউজি খেলা হত। নাটকটির দর্শকপ্রিয়তার কারণে ক্লাব কর্তৃপক্ষ হাউজি খেলার তারিখ পরিবর্তন করেছিলেন। তখন বিটিভিতে প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ সাপ্তাহিক, ধারাবাহিক নাটকের সময়সীমা ছিল এক ঘন্টা।
এ ধারাবাহিক নাটকটি শেষ হওয়ার পরপরই তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে একটি চলচিত্র নির্মাণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এর আগে আমি কোনো সিনেমা অর্থাৎ পঁয়ত্রিশ মিলিমিটারের কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ না করলেও এবিষয়ে আমার পড়াশোনা ছিল। আমি প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করলাম।
হুমায়ূন আহমেদের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসটি আমি পড়েছিলাম। ঐ উপন্যাসটিই চলচ্চিত্রে রুপায়িত করার সিদ্ধান্ত নিলাম। মধ্যবিত্ত জীবনের চাওয়া-পাওয়া,আশা-আকাঙ্খার একটি সুন্দর নিটোল গল্প ‘শঙ্খনীল কারাগার’।
এক শুভক্ষণে ‘শঙ্খনীল কারাগার’র শুটিং শুরু হলো। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হলো আমার চলচ্চিত্র পরিচালনার অধ্যায়। লক্ষ্য করলাম, শুটিং চলাকালীন প্রায় প্রতিদিন হুমায়ূন উপস্থিত থাকেন।
তাকে সে কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, “আপনার পেছনে থেকে লক্ষ্য করি, কিভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ করা হয়।”
পরবর্তীতে ‘আগুনের পরশমনি’ চলচ্চিত্রসহ চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা হুমায়ূন আহমেদেরও হয়েছে।
ঈদের নাটকের মধ্যে তার লিখা ‘একদিন হঠাৎ’ নাটকটি এখনও দর্শকদের মনে আছে। একটি পাঁচ ছ’বছরের শিশু তার শিক্ষক হুমায়ূন ফরিদীর প্রশিক্ষণ অনুসারে ঢাকা চিড়িয়াখানায় একা একা গিয়ে আবার প্রশিক্ষণ অনুযায়ী বাড়িতে ফিরে আসে। সেই মজার গল্প এখনও দর্শকদের সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমার প্রযোজনায় নির্মিত হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি নাটক দর্শক বিপুল আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন। আমার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র হুমায়ূনের উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ সারা দেশের সিনেমাহলগুলোতে একই সঙ্গে মুক্তি পেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সেই সময় দর্শকদের আগ্রহের জন্য ঢাকার গুলিস্তান ও নাজ এবং চট্রগ্রামের আলমাস ও দিনার সিনেমা হলে চলচ্চিত্রটি একনাগারে বহুদিন দেখানো হয়েছিল।
এই সিনেমা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। সেই সঙ্গে রাশিয়ায় তাসখন্দ চলচিত্র উৎসবে ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’-এর সম্মান অর্জন করেছিল।
১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই । এই অকালপ্রয়াত গুণী ব্যক্তির আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। দোয়া করি আল্লাহ পাক যেন তাকে বেহেশত নসীব করেন।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক , বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং প্রধান উপদেষ্টা, গাজী টেলিভিশন।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে
এইসব দিনরাত্রির ছবি: হুমায়ূন আহমেদ রচিত ‘এইসব দিনরাত্রি’তে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমেদ ও ডলি জহুর।