পাকিস্তানের ‘অনার কিলিং’ এবং একজন কান্দিল বেলুচ

পরিবারের অমতে বিয়ে, প্রেম এমনকী ধর্মীয় অনুশাসনের বরখেলাপ করা- এমনসব ‘অপরাধে’ নিজের আপনজনদের হাতে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রাণ হারাচ্ছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি নারী। যাদের মধ্যে এক পঞ্চমাংসেরই বসবাস পাকিস্তানে।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2016, 02:12 PM
Updated : 17 July 2016, 02:12 PM

‘অনার কিলিং’- নামের বর্বোরচিত এই প্রথার বলি এবার হলেন দেশটির সাড়া জাগানো এক সোশাল মিডিয়া তারকা। কান্দিল বেলুচ নামের এই মডেল-এর হত্যাকাণ্ড আরও একবার সামনে নিয়ে এলো পাকিস্তানে ‘অনার কিলিং’ এবং নারী নিগ্রহের মতো বিতর্কীত প্রসঙ্গটিকে।

পাকিস্তানের ‘কিম কার্দাশিয়ান’ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনপ্রিয়  হয়ে ওঠা মডেল ও অভিনেত্রী কান্দিল বেলুচ শুক্রবার খুন হন তারই আপন ভাইয়ের হাতে। সম্প্রতি পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার খুনি ওয়াসিম জানিয়েছেন, পারিবারিক নাম ‘বেলুচ’-এর সম্মান রক্ষার্থেই বোনকে হত্যা করেছেন তিনি।

ওয়াসিম-এর ভাষ্যে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেকে খোলামেলাভাবে প্রদর্শন করে পারিবারিক নামের ‘সম্মানহানী’ ঘটাচ্ছিলেন তিনি; যার কারণে কান্দিলকে মেরে ফেলাটা ‘আবশ্যক’ হয়ে পড়েছিল।

কান্দিল বেলুচ তারকাখ্যাতি অর্জনের আগে পেশায় ছিলেন একজন ‘বাস হোস্টেস’। ২০১৪ সালে ‘ফেইসবুক’ নিজের একটি ‘পাউটিং’ ভিডিও আপলোড করার পর রাতারাতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি।

এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে নিজেকে আবেদনময় রূপে উপস্থাপন এবং সাহসি বক্তব্যের কারণে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে গেছেন বেলুচ। রক্ষণশীল মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে বেলুচের এইসব কার‌্যকলাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চললেও দেশটির তরুণীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। নিজের নারীবাদী বক্তব্যের কারণে অনেকের কাছে ‘সাংস্কৃতিক আইকনে’ও পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

চলতি বছরের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলার সময় পাকিস্তান ভারতকে হারাতে পারলে নগ্ন হয়ে নাচার ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।

কিন্তু গত টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে পরাস্ত হয় পাকিস্তান। তখন ইউটিউবে আরেকটি ভিডিও আপলোড করেন কান্দিল। যেখানে নগ্ন হয়ে নাচতে না পারার জন্য তাঁকে কাঁদতে দেখা যায়।

পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটার ভিরাট কোহলিকে প্রেম নিবেদন করেও আলোচনায় এসেছেন বেলুচ। ভিরাটের উদ্দেশ্যে স্নানরত অবস্থায় একটি ভিডিও আপলোড করেছিলেন তিনি, যা নিয়ে বয়ে যায় সমালোচনার ঝড়।

অতিসম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল তেহরিক-ই-ইনসাফ এর উচ্চপদস্থ এক নেতা এবং ধর্মগুরু মুফতি আবদুল কাভির সঙ্গে সেলফি তুলে আবারও বিতর্কের ঢেউ তোলেন বেলুচ। যার ফলশ্রুতিতে ওই নেতাকে যাবতীয় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পদ থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দেয়া হয়।

তবে মুফতিকে ‘ইসলামের কলঙ্ক’ বলেছেন বেলুচ। তিনি বলেন, ‘‘মুফতি কী করে নিজেকে ইসলামের অভিভাবক বলেন? উনি তো ইসলামের নামে কলঙ্ক। উনি ভক্ত-অনুরাগীদের সামনে এক রকম, আলাদা থাকলে আর এক রকম। একটি টিভি শো’য়ের প্যানেলে পরিচয় হয়েছিল আমাদের। সেখানে আমার ফোন নম্বর চেয়েছিলেন এই লোক। পরে আমাকে নানাভাবে অসম্মান করেন তিনি। তাই তার আসল চেহারাটা সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম আমি।’’

ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবে বেলুচের এসব কর্মকান্ডে মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না তার পরিবার। পারিবারিক ভাবে নিষেধ করা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কোন প্রকার ছবি কিংবা ভিডিও আপলোড না দিতে।

ফেইসবুকের মাধ্যমেই বোনকে সরাসরি হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন ওয়াসিম।

ওইসব হুমকির জবাবে বেলুচ এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, “যতোবারই আমাকে টেনে নিচে নামাও না কেন, আমিও যোদ্ধা, আবারো ফিরে আসবো ঠিকই। কান্দিল বেলুচ নির্যাতিত নারীদের কাছে একটি অনুপ্রেরণার নাম। আমি জানি এরপরও তোমরা আমাকে ঘৃণা করবে। করতে থাক, আমার কিছু যায় আসেনা তাতে।”

তবে একপর‌্যায়ে গিয়ে ঠিকই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কাবোধ করতে থাকেন বেলুচ। খুন হওয়ার তিন সপ্তাহ আগে তাই পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এফ আই এ’র পরিচালক এবং ইসলামাবাদের জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট-এর কাছে নিজের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন।

কয়েক দিন আগে থেকে চেষ্টা করছিলেন পাকিস্তান ছাড়ারও। পাকিস্তানের এফআইএ কে অবহিত করেই ঈদের ছুটি কাটাতে স্বপরিবারে করাচি থেকে পাঞ্জাব প্রদেশের মুজাফফারবাদ গ্রামে গিয়েছিলেন বেলুচ। সেখানেই পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে খুন হন তিনি।

এই হত্যাকান্ডকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান জাইদি বলেন, “ভাইয়ের হাতে খুন হলো কান্দিল বেলুচ! নৈতিকতাবাদীদের ধ্যান ধারনায় আঘাত দিয়ে সে যাই করে থাকুক না কেন, এই ধরনের হত্যা বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

‘অনার কিলিং’ নিয়ে নির্মিত ‘সেভিং ফেইস’ এবং ‘অ্যা গার্ল ইন দ্য রিভারঃ দ্য প্রাইস অব ফরগিভনেস’ নামক ডকুমেন্টারি দুইটির জন্য দুইবারের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয়ী শারমীন এ প্রসঙ্গে এক টুইটার বার্তায় বলেন, “ ‘সম্মান রক্ষার্থে হত্যা’ (অনার কিলিং) করা হয়েছে কান্দিল বেলুচ কে। একটি অনার কিলিং বিরোধী আইনের অভাবে আর কতো নারীর প্রান হারাবো আমরা?”

বিশ্বের অনেক দেশের মতোই ‘অনার কিলিং’ পাকিস্তানের একটি সামাজিক প্রথা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রথাকে সেখানে ডাকা হয় ‘কারো-কারি’ নামে।

প্রতিবছর ‘পরিবারের সম্মান রক্ষা’র নামে দেশটিতে আপনজনদের হাতেই হত্যার শিকার হন শত শত নারী। দেশটির স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের তথ্যমতে শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই ‘অনার কিলিং’ এর নামে স্বজনদের হাতে খুন হয় এক হাজারেরও বেশী নারী। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক কিংবা নিজের ইচ্ছামতো বিয়ে করার মতো কারণে খুন করা হয়েছে তাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই ঘটে এসব ঘটনা। দেশটির বিচারব্যাবস্থায় এইসব হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো হলেও এই ব্যাপারে কোন কঠোর আইন আজ পর‌্যন্ত হয়নি।

এর আগেও ২০১৪ সালে ১০০০ ও ২০১৩ সালে ৮৬৯ জন নারীকে একই কারণে হত্যা করা হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন মূল সংখ্যাটি আরো অনেক বড় কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরণের হত্যাকাণ্ডগুলোকে দূর্ঘটনা কিংবা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।