সত্যজিৎ-এর সেলুলয়েডে রবি ঠাকুর

দেড়শো বছরেরও আগে জন্ম নেয়া কবিগুরুর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো সম্পূর্ণতার স্বাদ। তারই পরবর্তী প্রজন্মের সুযোগ্য প্রতিনিধি সত্যজিৎ রায়। বিনোদনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতিকে পৃথিবীময় সমাদৃত করে তোলার মহান দায়িত্বে ব্রতী হয়েছিলেন তিনি। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মর্যাদা নোবেল পুরস্কারে যেমন ভূষিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, তেমনি চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্মান অস্কার অর্জন করেছেন সত্যজিৎ।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2016, 07:25 AM
Updated : 9 May 2016, 09:05 AM

রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুপ্রেরণায় উপমহাদেশের অনেক নির্মাতাই ছবি বানাতে চাইলেও সত্যজিৎ-এর সৃষ্টিতেই তিনি পেয়েছেন পূর্ণতা। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে সত্যজিৎ-এর সেলুলয়েডে রাবিন্দ্রীক সাহিত্য নিয়েই এবারের আয়োজন।

শান্তিনিকেতন থেকে শুরু

কলকাতার বিখ্যাত রায় চৌধুরী পরিবারের উত্তরসুরী সত্যজিৎ-এর আগ্রহ সাহিত্য এবং চারুকলার প্রতি থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে তরুণ সত্যজিৎ তার পড়াশোনার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অর্থনীতিকে।

কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী আর সুকুমার রায়ের রক্ত যার শরীরে বইছে, সেই সত্যজিত চারুকলা থেকে দূরে থাকবেন কী করে? শান্তিনিকেতন সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ না করলেও, মায়ের পিড়াপিড়ি আর রবিঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধাবশত ১৯৪০ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যান তিনি। তখনকার বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখার্জিদের সান্নিধ্যে এসে প্রাচ্যকলা সম্পর্কে আরো বেশি করে জানার সুযোগ ঘটে তার। ভারতের প্রাচীনতম শিল্পের নিদর্শন অজন্তা-ইলোরা ঘুরে ভারতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি সম্বন্ধে আরো বেশি শ্রদ্ধা জন্মে তার।

শান্তিনিকেতনে পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হওয়ার আগেই জীবিকার তাগিদে কলকাতায় ফিরে আসেন সত্যজিৎ। কলকাতায় প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে জীবিকা নির্বাহের সময়েই তার পরিচয় ঘটে বিশ্ব চলচ্চিত্রের রূপালী মায়ার সঙ্গে। লন্ডন ভ্রমণকালে ইটালিয়ান ধ্রুপদ চলচ্চিত্র ‘বাইসাইকেল থিফ’ দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। পরবর্তীতে বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোয়ার সান্নিধ্যে এসে তার সেই আকাঙ্খা আরো তীব্র হয়।     

সেই ধারাবাহিকতায় বাংলা ছবির ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে ১৯৫৫ সালে অমরত্বের পথে যাত্রা শুরু হয় সত্যজিৎ-এর। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধ্রুপদ উপন্যাস থেকে ‘অপু ত্রয়ী’ তৈরির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের ভাষায় বাংলার আবহমান জীবনযাত্রাকে বিশ্ববাসীর সামনে মূর্ত করে তোলেন তিনি।

নির্মাতা সত্যজিৎ-এর খ্যাতি যখন দুনিয়া জোড়া, ঠিক সে সময়ই ভারত সরকারের কাছ থেকে ডাক এলো রবিঠাকুরকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের। ১৯৬১ সালে কবিগুরুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত অনুরোধে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ৫৪ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন তিনি।

প্রামাণ্যচিত্রটি সত্যজিৎ রায়কে তৈরি করতে দেয়া নিয়ে ভারতের আমলা মহলের অনেকেই অনেক রকমের কথা বলেছিলেন। প্রামাণ্যচিত্রটিতে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত ইতিহাস কতোখানি উঠে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই।

সেসময় সন্দেহবাদীদের মুখ বন্ধ করেছিলেন স্বয়ং জওহরলাল নেহেরু। সত্যজিতের শৈল্পিক চেতনার প্রতি অগাধ আস্থা রেখে তিনি বলেছিলেন, “ঐতিহাসিক দরকার নেই আমাদের। আমাদের দরকার একজন শিল্পীর। সত্যজিৎ রায় তেমনি একজন শিল্পী। আমার মনে হয় না কোনো ঐতিহাসিকের এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত।”

নেহেরুর আস্থার প্রতিদান দারুণভাবেই দিয়েছিলেন সত্যজিত। রবিঠাকুরকে নিয়ে তার অসাধারণ গবেষণা তথ্যচিত্রটিতে ভিন্ন এক মাত্রা যুক্ত করে, যা পরবর্তীতে উপমহাদেশের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে দাঁড়ায়।

যখন ১৯৬১ সালের ৫ মে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ প্রামাণ্যচিত্রটি মুক্তি পায় তখন সত্যজিত এটি নিয়ে বললেন, “তিনটি কাহিনীচিত্র নির্মাণের সমান কাজ করতে হয়েছে আমাকে এ ছবির জন্য। এই জীবনীমূলক ছবিটি নির্মাণে রবীন্দ্রনাথকে একজন মানুষ এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখানোই আমার লক্ষ্য ছিলো।”

রাষ্ট্রপতি সম্মাননা পাওয়া এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়েই রবীন্দ্রসাহিত্যের দারুণ ভক্ত বনে যান সত্যজিত, যা তার পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোকে অসামান্যভাবে প্রভাবিত করে।

সত্যজিত-এর ‘চারকন্যা’

সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ভারতীয় নারীদের অনুভূতিকে সবচেয়ে সফলভাবে চিত্রায়িত করতে পারা প্রথম বাঙালি নির্মাতা তিনি। আর এক্ষেত্রে অবশ্যই সামনের সারিতে রয়েছে ‘চারুলতা’ এবং ‘তিন কন্যা’। রবি ঠাকুরের গল্প গুচ্ছের চারটি ছোটগল্প থেকে নির্মিত এই ছবিগুলো একজন শিল্পী হিসেবে সত্যজিতের অবস্থান ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

১৯৬১ সালেই রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোটগল্প ‘সমাপ্তি’, ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘মণিহার’ নিয়ে সত্যজিৎ তৈরি করেন ‘তিন কন্যা’। এরমধ্যে ‘সমাপ্তি’ পায় ভারতীয় রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক এবং ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘মণিহার’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কৃত হয় মেলবোর্ন ও বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।

মধ্যবিত্ত এক পোস্টমাস্টার এবং বার বছরের কিশোরী রতনের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের এক অপূর্ব ছবি ‘পোস্টমাস্টার’। সত্যজিত তার অসাধারণ পরিচালনা, সূক্ষ ক্যামেরার কাজ আর যথাযথ সংগীতের মাধ্যমে দুটি মানব হৃদয়ের ভালোবাসার অনুভূতির সঙ্গে বাস্তবতার রূঢ়তার সংঘাতকে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

‘পোস্টমাস্টার’-এর ট্র্যাজেডির একেবারেই বিপরীতধর্মী ছবি ‘সমাপ্তি’। কিশোরী বধু মৃন্ময়ীর গয়না গায়েই বাসর ঘর থেকে গাছ বেয়ে পালিয়ে যাওয়া, পোষা কাঠবিড়ালি চড়কির সঙ্গে তার উচ্ছল চপলতা- এর সবই যেন বাংলার কিশোরী বধূদের আবহমান ছেলেমানুষীকে বর্ণময় করে তুলেছে।

অন্যদিকে, ‘মণিহার’ ছবির পুরোটাই এক রহস্যের জালে ঘেরা। এক বিচিত্র নারী মনস্তত্ত্ব উদঘাটনের এই ছবিটিকে আবার ভূতের ছবির তকমাও পুরোপুরিভাবে দেয়া যায় না। ছবির শেষাংশে সোনার কঙ্কণ পরা কঙ্কালের হাতের নাটকীয় আবির্ভাব হঠাৎ ত্রাসের সঞ্চার করে ঠিকই, কিন্তু রহস্যের অবগুন্ঠন উন্মোচন হয় না পুরোপুরি।

১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় ‘চারুলতা’। রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত এই কাহিনীচিত্রটিকে অনেকেই মনে করেন সত্যজিতের সবচেয়ে ত্রুটিহীন ছবিগুলোর একটি। অনেকের দৃষ্টিতে, ছবিটিতে চারুলতা নামের এক নিঃসঙ্গ গৃহবধূর বেদনা এবং পরবর্তীতে তার দেবরের প্রতি ভালোবাসার অন্তর্দহন সত্যজিত যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা ছাড়িয়ে গেছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সুনিপুণ কাব্যময়তাকেও। 

দেশের বাইরে ছবিটি নিয়ে উচ্ছ্বসের কমতি না থাকলেও, নিজ দেশে ‘চারুলতা’র চিত্রনাট্য নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন সত্যজিৎ। বেশকিছু চিত্র সমালোচক ছবিটিকে ‘নষ্টনীড়’-এর মূলানুগ না হওয়ার অভিযোগ তোলেন। সত্যজিৎ কিন্তু এসব সমালোচনার কড়া জবাবই দিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “যখন কোনো কেতাবি পন্ডিত ‘নষ্টনীড়’ গল্পের উপসংহার ও ‘চারুলতা’ ছবির উপসংহারের মাত্রাগত তফাত খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন স্বভাবতই আমাদের বলতে হয়, This is surely the result of lopsided film education, lack of connoisseurship, and applies only to a country which took one of the greatest invention of west with the most far reaching artistic potential and promptly cut is down to size.”

‘চারুলতা’ নিয়ে দেশি সমালোচকদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও, বিশ্বজুড়েই তা ভেসেছে প্রশংসার বন্যায়।

“সত্যজিত রায়ের এই ছবির কাহিনী এমনই সমৃদ্ধ যে, মনে হয় এ যেন ভেলভেটে মোড়া টানাগাড়ি যার ভেতরের লণ্ঠনটি গ্রীষ্মের বাতাসে দুলে উঠছে আর গাড়িটি অদ্ভুত এক আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে। ১৮৭০-এর বাংলাদেশের সময়-স্বাদ এ ছবির সর্বাঙ্গে।” নিউইয়র্কার পত্রিকায় এভাবেই ছবিটি নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন সেসময়কার প্রখ্যাত চিত্র সমালোচক পেনেলোপে গিলিয়ট।  

১৯৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথের আলোচিত উপন্যাস ‘ঘরে বাইরে’র চিত্রায়নের মাধ্যমে শেষ হয় সত্যজিতের রবীন্দ্র পর্ব। ছবিটি প্রথমবার তৈরি করার সময় সত্যজিত হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। একারণে দ্বিতীয় দফায় পুত্র সন্দীপ রায়ের সহায়তা নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেন তিনি। ছবিটিতে প্রথমবারের মতো একটি চুম্বন দৃশ্যের সংযোজন করা হয়। ছবিটিতে সত্যজিতের অসুস্থতাজনিত ভুলের ছাপ থাকলেও, ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র এবং দামাস্কাস চলচ্চিত্র উৎসবে এটি পুরস্কৃত হয়।

সত্যজিতের সংগীতে রবীন্দ্রনাথ

সত্যজিত রায় কেবল অমিত ক্ষমতাধর চিত্রনির্মাতাই ছিলেন না, ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভাবান সঙ্গীতপরিচালকও। তার নির্মিত ৩৭টি চলচ্চিত্রের প্রতিটিতেই সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি নিজেই। সংগীতের ক্ষেত্রে নিজের মৌলিকতা সত্ত্বেও, বারবার তিনি প্রভাবিত হয়েছেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের মায়াময় মূর্ছনায়। 

‘পোস্টমাস্টার’ ছবিটিও এই রবীন্দ্র প্রভাবের ব্যতিক্রম নয়। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র রতনকে তুলে ধরতে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে সারিন্দা এবং দোতারার মতো আটপৌরে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ আবহের গানকে বেহালায় তুলে সেই অনাড়ম্বর সুরবিহার দিয়েই বালিকা রতনের ছবি এঁকেছেন তিনি।

অন্যদিকে, ‘চারুলতা’ ছবিতে চারুর একাকীত্বকে সোচ্চার করে তুলতে সংলাপের চেয়ে গানের সুরকেই আশ্রয় করে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানটির সুরের আদলকে যন্ত্রসঙ্গীতে প্রয়োগ করে চারুর মানসিকতাকে দর্শকদের কাছে আরো ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছেন তিনি। ছবির একটি দৃশ্যে সংলাপের ব্যবহার এড়িয়ে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটির সফল প্রয়োগ পুরো দৃশ্যটিকে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ করে তুলেছে।

শুধু রবীন্দ্রসাহিত্য নির্ভর সিনেমাতেই নয়, সত্যজিৎ তার আরো অনেক ছবিতেই রবীন্দ্রসংগীতের সফল ব্যবহার করেছেন। ‘মহানগর’, ‘জন অরণ্য’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘আগন্তুক’, ‘গণশত্রু’ এবং ‘কাঞ্চনজংঘা’র মতো তার বিখ্যাত সব ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের অনন্য সব দৃশ্যায়ন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং চলচ্চিত্ররত্ন সত্যজিৎ রায় অনেক বেশি ঋদ্ধ করে গিয়েছেন আমাদের সংস্কৃতিকে। বাঙালি হিসেবে তাদের অমর কীর্তি এখনও বিষ্ময় জাগায় বিশ্ববাসীর চোখে। সত্যজিত রায়ের জন্মের ৯৫ বছর এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও, এই দুই মহামানব চিরকালই বেঁচে থাকবেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।