বলিউডে পৌরাণিক কাহিনি নির্মিত হলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রথমেই যার নাম উচ্চারিত হতো তিনি ভারত ভূষণ। হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রথম ‘চকলেট হিরো’র খেতাবটা অনায়াসে দেয়া যায় তাকে। চেহারা ছিল সুন্দর, গানও জানতেন। তাই সংগীতপ্রধান চলচ্চিত্র হলেই ডাক পড়তো তার।
Published : 27 Jan 2016, 02:47 PM
ভারত ভূষণের জন্ম ১৯২০ সালের ১৪ জুন ভারতের উত্তর প্রদেশের মিরাটে। বাবা ছিলেন মিরাটের সরকারি উকিল রায়বাহাদুর মোতিলাল। অতি শৈশবে মাকে হারিয়ে তিনি বড় হন দাদির কাছে আলিগড়ে। লেখাপড়াও করেন আলিগড়ে। বড় ভাই আর চন্দ্র ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক।লাক্ষ্ণৌতে তার স্টুডিও ছিল। ভাইয়ের পথ ধরে ভারত ভূষণ চলচ্চিত্রে আসেন। বাবার প্রবল আপত্তি ছিল এতে। কিন্তু সেই আপত্তি উপেক্ষা করে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছা নিয়ে চলে আসেন কলকাতা। পরে যান মুম্বাইয়ে।
১৯৫২ সালে মুক্তি পায় বিজয় ভাট পরিচালিত সংগীতবহুল ছবি ‘বৈজু বাওরা’। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন ভারত ভূষণ। ছবির গল্প মুঘল বাদশাহ আকবরের সময়ে বিখ্যাত গায়ক তানসেনের সঙ্গে এক অখ্যাত শিল্পীর দ্বন্দ্ব নিয়ে। ঘটনাটির ঐতিহাসিক ভিত্তি তেমন নেই তবে রয়েছে কিংবদন্তি ও উপকথা। সিনেমার কাহিনিতে দেখা যায়, সভাগায়ক তানসেনের গান শুনে সম্রাট আকবর মুগ্ধ। তিনি ঘোষণা করেছেন তানসেনের শহরে তার চেয়ে ভালো যদি কেউ গাইতে না পারে তবে সেই শিল্পীর গান গাওয়ার প্রয়োজন নেই। গান গাওয়ার অপরাধে এক সংগীতশিল্পীকে নির্যাতন করা হয় এবং মৃত্যুর আগে তিনি তার স্ত্রীকে বলে যায় শিশু পুত্রকে গানের ওস্তাদ বানাতে। যেন সেই শিশু ওস্তাদ হয়ে সংগীতযুদ্ধে পরাজিত করতে পারে তানসেনকে। সেই শিশুর নাম ব্রজনাথ বা বৈজু। বালক বৈজুর প্রাণের সঙ্গী সে গাঁয়ের মেয়ে গৌরী। বৈজুর মধ্যে রয়েছে গানের সহজাত প্রতিভা। কাহিনির এক পর্যায়ে গ্রাম ছেড়ে যায় বৈজু এবং এক প্রখ্যাত গুরুর কাছে সংগীতের তালিম নেয়। তার মনে রয়েছে তানসেনকে পরাজিত করা এবং পিতার মৃত্যুর বদলা নেওয়ার প্রতিশোধ স্পৃহা। কিন্তু গুরু বলেন প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে সংগীতের সাধনা হয় না। আর শিল্পীর মনে যদি ভালোবাসার বেদনা না থাকে তাহলে বড় গায়ক হওয়া সম্ভব নয়। বৈজুকে অনুপ্রাণিত করতে মৃত্যুর অভিনয় করে গৌরী। গৌরীকে হারানোর বেদনায় পাগল বা ‘বাওরা’ হয়ে যায় বৈজু।
এক সময় গান গাইতে গাইতে দরবারে হাজির হয় সে। শুরু হয় তানসেনের সঙ্গে তার সংগীতযুদ্ধ। বৈজুর গানে পাষাণ দ্রবীভূত হয়ে যায়। প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে বৈজু। কিন্তু তানসেনকে সে ক্ষমা করে দেয়। সম্রাট আকবর তার সভায় শিল্পী হয়ে থাকতে বৈজুকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু পার্থিব সম্পদ ও খ্যাতির প্রতি নির্মোহ বৈজু বেরিয়ে পড়ে পথে।
ছবিটি সুপারডুপার হিট হয় এবং ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়। এ ছবির সংগীত পরিচালক নওশাদ এবং কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ রফি দুজনেই তাদের জীবনের সেরা কাজ উপহার দেন। সেই সঙ্গে জীবনের সেরা অভিনয় করেন ভারতভূষণ। এই একটি ছবিই তাকে পৌঁছে দেয় বলিউডের সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের কাতারে।
এরপর একের পর এক পৌরাণিক ও ইতিহাসভিত্তিক ছবিতে নায়ক হন ভারত ভূষণ। ‘আনন্দমঠ’, ‘মা’, ‘মির্জা গালিব’,‘শাবাব’, ‘শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু’, ‘বসন্ত বাহার’, ‘কবি কালিদাস’, ‘পরদেশী’, ‘রানী রূপমতি’, ‘চম্পাকলি’, ‘সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত’, ‘সোহনি-মাহিওয়াল’সহ বিভিন্ন সফল বাণিজ্যিক ছবিতে নায়ক হন ভারত ভূষণ। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পুরাণ, ইতিহাস, উপকথা, কিংবদন্তি, রূপকথাভিত্তিক ছবির তিনি ছিলেন একচেটিয়া নায়ক।
১৯৫৪ সালে ‘শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু’ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয়ের সুবাদে সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জয় করেন। সত্তরের দশকে তিনি নায়ক থেকে চরিত্রাভিনয়ে সরে যান। ‘জয় সন্তোষী মা’,‘উমরাও জান’সহ বেশ কটি ছবিতে তাকে সংগীতগুরু বা সাধক চরিত্রে দেখা যায়।
ব্যক্তিজীবনে অনেক শোক ও ভাগ্যবিপর্যয় সইতে হয়েছে ভারত ভূষণকে। মাত্র দুই বছর বয়সে মাকে হারানোর মধ্য দিয়ে যার শুরুটা ঘটে। ভারতভূষণ বিয়ে করেছিলেন মিরাটের বিখ্যাত জমিদার রায়বাহাদুর বুধ প্রকাশের কন্যা সারদাকে। এই দম্পতির দুই মেয়ে। দ্বিতীয় মেয়ে অপরাজিতাকে জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬০ সালে মৃত্যু হয় সারদার। প্রথম মেয়ে অনুরাধার পোলিও হয়। ফলে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন অনুরাধা। স্ত্রীর অকাল মৃত্যু ও বড় মেয়ের অসুস্থতা ভারত ভূষণকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ১৯৬৭ সালে তিনি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও ‘বারসাত কি রাত’ ছবির সহশিল্পী রত্নাকে বিয়ে করেন।
মুম্বাইতে একাধিক বাংলো ও গাড়ির মালিক ভারত ভূষণ এক সময় এতটাই আর্থিক সংকটে পড়েন যে, সব বিক্রি কর দিতে বাধ্য হন। তিনি প্রচুর বই কিনতেন এবং পড়তেন। আর্থিক সংকটে পড়ে সেই বইগুলোও বিক্রি করতে বাধ্য হন তিনি। ১৯৯০ সালের দিকে তিনি সব ঋণ থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হন।
১৯৯২ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার সর্বশেষ অভিনীত ছবি ‘আওয়াল নাম্বার’ ১৯৯০ সালে মুক্তি পায়।
ভারতভূষণ এখনও ‘বৈজু বাওরা’সহ অসংখ্য ছবিতে তার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।