আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর সারচার্জ আরোপসহ কয়েকটি সংশোধনী এনে অর্থবিল-২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।
Published : 28 Jun 2014, 07:51 PM
শনিবার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি প্রধান এইচ এম এরশাদের উপস্থিতিতে এই বিল পাস হয়।
গত ৫ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের সঙ্গে এই অর্থবিল উত্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
শনিবার সকালে সেই বাজেটের ওপর প্রথমে বক্তৃতা দেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। তারপর রওশন এরশাদের বক্তৃতার পর বক্তব্য রাখেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
এরপর অর্থমন্ত্রী তার সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর সাতটি সুপারিশ গ্রহণ করে সরকারের আর্থিক প্রস্তাবলি কার্যকরণ এবং কতিপয় আইন সংশোধনে আনীত অর্থবিল-২০১৪ সংসদে উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
রোববার পাস হবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট। বাজেটের ওপর সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য বক্তব্য ইতোমধ্যে দিয়েছেন। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হবে।
গত ৩ জুন বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার পর ৫ জুন সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রস্তাবিত বাজেটের আয়কর, ভ্যাট এবং শুল্ক বিষয়ে সাতটি সুপারিশ করেছেন; যেগুলো আমার কাছে সুপারিশ নয়, নির্দেশ হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
“আমার বাজেট প্রস্তাব আসলে তারই (প্রধানমন্ত্রী) সম্মতি এবং সমর্থন নিয়েই উপস্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং সেখানে স্বাভাবিকভাবেই তার সুপারিশ নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করেছি।”
মোবাইল ফোন ব্যবহারে সারচার্জ
প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর সারচার্জ আরোপের কোনো প্রস্তাব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় শুল্কারোপের কয়েকটি প্রস্তাব পুনঃবিবেচনার এবং মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ওপর সারচার্জ আরোপের প্রস্তাব করেন।
মোবাইল ফোনের আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব কিছুটা বেশি হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মোবাইল ফোনের আমদানির ওপর শুল্ক কিছুটা হ্রাস করতে পারেন। মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ওপর সারচার্জ বসাতে পারেন। এ থেকে যে রাজস্ব আসবে সেটা শিক্ষা ও স্বাস্থ খাতের উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারি।”
সুনির্দিষ্ট কোনো খাতে জনগণের কাছ থেকে অর্থ তুলতে সারচার্জ আরোপ করে সরকার। এক সময় যমুনা সেতু তৈরিতে সরকার সারচার্জ আরোপ করেছিল। তখন বাস-ট্রেনের টিকিট, সিনেমার টিকিট কাটার সময় অতিরিক্ত টাকা নেয়া হত, যা যমুনা সেতুর তহবিলে যেত।
কালো টাকা সাদার সুযোগ থাকছে
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার বিপক্ষে বরাবর মত দিয়ে এসে এবারো আবাসন খাতে বিনিয়োগের শর্তে এই সুযোগ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
সমাপনী বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আবাসন খাতে প্রতি বর্গমিটারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদান করলে বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগ মেনে নেয়ার বিধানটি কর প্রদান পদ্ধতিতে সরলীকরণমাত্র।”
২০১৩-১৪ অর্থ বছরের বাজেটেও আবাসন খাতে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান ছিল। স্থবির আবাসন খাতে গতিশীলতা আনার কথা বলে সেই সুযোগ দেয়া হয়।
তার আওতায় রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল এবং দিলকুশা এলাকায় অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে জমি-বাড়ি কিনলে ২০০ বর্গমিটার পর্যন্ত (তিন কাঠা) প্রতি বর্গ মিটারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা কর দিতে হয়।
তিন কাঠার বেশি জমি বা ফ্ল্যাট কেনা বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৭ হাজার টাকা কর দিতে হয়।
ঢাকার ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তিন কাঠা জমি-বাড়ি কিনতে হলে প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৪ হাজার টাকা কর দিতে হয়। আর তিন কাঠার বেশি কিনলে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা করে কর।
শনিবার আবাসন খাতে ‘এই সুযোগটিই’ বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছেন মুহিত।
আবাসন খাতে রাখলেও সরকারি বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকছে না।
অর্থ আইন ২০১১ এ সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে বিনিয়োগকৃত অর্থ বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়ার বিধান করা হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “বাস্তবে এ বিধানের সুযোগ করদাতাগণ গ্রহণ করেননি। এই সুযোগ রাখতে চাই না বিধায় এ সংক্রান্ত বিধানটি বাতিলের প্রস্তাব করছি।”
“সেক্ষেত্রে করদাতাকে কোনো ছাড় দেয়া হয়নি। প্রচলিত হারেই তাকে জরিমানাসহ কর দিতে হয়। এ ধরনের সুযোগ কর প্রদান ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রয়োজন বিধায় এ দুটি বিধান অব্যাহত রাখা যায়।”
‘গেইন ট্যাক্স’ প্রত্যাহার
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের লাভের ওপর করারোপের (গেইন ট্যাক্স) যে প্রস্তাব করা হয়েছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে এই কর প্রত্যাহারসহ বিনিয়োগকারীদের জন্য আরো কিছু সুবিধা রাখা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুহিত বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজারের বিকাশ ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বাজার থেকে প্রাপ্ত মুনাফা সম্পূর্ণ করমুক্ত সুবিধা পুনর্বহাল রাখার সুপারিশ করেছেন।
“প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বাজার থেকে প্রাপ্ত মুনাফা সম্পূর্ণ করমুক্ত সুবিধা পুনর্বহাল রাখার জন্য সংসদকে অনুরোধ করছি।”
এছাড়া করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা বৃদ্ধি করা এবং ৩০ শতাংশ বা অধিক লভ্যাংশ প্রদানকারী লিস্টেড কোম্পানিসমূহের প্রদেয় করের ১০ শতাংশ আয়কর রেয়াত প্রদানের প্রস্তাব বিবেচনার জন্য সংসদকে অনুরোধ করছি।”
৫ জুন অর্থমন্ত্রী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছিলেন তাতে প্রথম বারের মতো গেইন ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব করা হয়।
পুঁজিবাজারে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের লাভ ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা হলে ৩ শতাংশ হারে এবং ২০ লাখের বেশি হলে ৫ শতাংশ হারে কর দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন মুহিত।
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে শুল্কছাড় প্রত্যাহার
সাবান, টুথপেস্টসহ কয়েকটি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক কমানোর যে প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে এসে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি।
একই বিবেচনায় ফ্লোট গ্লাস ও প্রসাধনী সামগ্রীর সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে পূর্বের ন্যায় ৪৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি।”
১৮০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির শুল্কছাড়
প্রস্তাবিত বাজেটে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত নতুন হাইব্রিড গাড়ি আমদানির ওপর ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
শনিবার অর্থমন্ত্রী তা সংশোধন করে ১৮০০ সিসি পর্যন্ত নতুন হাইব্রিড গাড়ির ওপর সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ এবং ১৮০১ সিসি থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত নতুন হাইব্রিড গাড়ির ওপর আরোপিত ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক নির্ধারণ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
ফ্ল্যাট বিক্রির মুনাফায় কর ছাড়
প্রস্তাবিত বাজেটে ফ্ল্যাট বা দালান বিক্রি থেকে প্রাপ্ত মুনাফার ওপর প্রতি বর্গফুটে ৯০ টাকা হারে উৎসে কর কাটার প্রস্তাব করা হয়েছিল। শনিবার তা কমিয়ে ৫৫ টাকা ৭৬ পয়সা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুহিত বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো গৃহনির্মাণে বিনিয়োগের পরিমাণ বিবেচনায় ফ্ল্যাট বা দালান বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত মুনাফার ওপর প্রতি বর্গফুট ৯০ টাকা হারে উৎসে কর কর্তনের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে প্রতি বর্গমিটারে ৬০০ টাকা (প্রতি বর্গফুট ৫৫.৭৬ টাকা) কর্তন করা হবে।”
এছাড়া ব্যক্তি ও অংশীদারী ব্যবসায়ের বিক্রয় বা মোট প্রাপ্তি ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হলে পেশাদার হিসাব বিজ্ঞানীর সনদ প্রদান বাধ্যতামূলক করার যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এছাড়া নির্মাণ খাতের মৌলিক উপাদান রড উৎপাদনের ব্যয় কমাতে বিলেট উৎপাদনে গ্রাফাইট ইলেকট্রোডের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সমাপনী বক্তৃতার উপসংহারে মুহিত বলেন, “আমি মনে করি আমি যে সংশোধনী প্রস্তাবাবলী পেশ করেছি সেগুলোসহ আমার সামগ্রিক বাজেট প্রস্তাব দেশের উন্নয়নকে গতিশীল করবে। প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে এবং সাধারণ জীবনযাত্রার মান উন্নীত করবে।
“আমরা আগামী পাঁচ অর্থবছরে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি এমন মাত্রায় নিতে সক্ষম হবে যেখানে শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি দেশের সব নাগরিক মোটামুটিভাবে উপভোগ করতে পারবে।”