বড় ঘাটতি, বড় স্বপ্নের বাজেট

মধ্যম আয়ের দেশের সিঁড়িতে আরোহনের স্বপ্ন নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে সমালোচকদের চোখে বড় বাধা অর্থায়ন।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2014, 06:29 PM
Updated : 5 June 2014, 06:29 PM

ছয়ের কোটা থেকে প্রবৃদ্ধিকে সাতের ঘরে নিয়ে যেতে মুহিতের বেসরকারি বিনিয়োগ পরিকল্পনাকেও যথেষ্ট মনে করছেন না অনেকে।

তাহলে বড় ঘাটতি পুষিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হবার বড় যে লক্ষ্য স্থির করেছেন দুঁদে আমলা মুহিত, তার কতটুকু পূরণযোগ্য সেটাই এখন সময়ের প্রশ্ন।

মুহিতের বাজি চাঙ্গা হতে থাকা বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং রাজনীতির হানাহানি আর রক্তপাতের পরও ৬ এর ওপর প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা।

অষ্টমবারের মত বাজেট বক্তৃতায় মুহিত বলেন, “বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার নিরিখে যে বাজেট কাঠামোটি আমরা আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি তা যেমন প্রবৃদ্ধি সহায়ক হবে; তেমনি তা মূল্যস্ফীতিকে সংযত রাখবে। জনগণ এতে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখবে।”

উচ্চ প্রবৃদ্ধি, নিম্ন মূল্যস্ফীতি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপশি পদ্মা সেতুসহ দেশব্যাপী ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাব করে জাতীয় সংসদে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।

প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। এর সিংহভাগ ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা আসবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর এর কর আদায় থেকে যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৪ হাজার ৭২০ কোটি বেশি।

এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে পাওয়া যাবে ৫ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা, আর আয়কর বহির্ভূত আয় ২৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।

নতুন কোনো কর আরোপ করা না হলেও করজাল ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করার প্রস্তাব করেছেন মুহিত।

করমুক্ত আয়ের সীমা বর্তমানের দুই লাখ ২০ হাজার টাকা রেখে ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

রাজস্ব আয় যাই হোক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ৬ হাজার ৩০ কোটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন কর্মসূচি বিশাল, প্রায় ৮৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।

মন্ত্রীর এই হিসাব বাস্তবায়নযোগ্য নয় মনে করছেন  বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় গভর্নরের দায়িত্ব পালনকারী সালেহ উদ্দিন বলেন, “আয়ের দিকটা যদি আমি দেখি,এখানে রাজস্ব আদায় করতে হবে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডকে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ডের চলতি বছর যে পারফরমেন্স দেখিয়েছে তাতে আগামী অর্থ বছরে এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় কি সম্ভব হবে?

“কী এমন হলো যে রাজস্ব বোর্ডের স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ে গেল? রাতারাতি মানুষের পরিবর্তন হয়ে যাওয়া এতোটা সহজ না। এখানে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে, তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।”

সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও একমত নন মুহিতের সঙ্গে।

বিশাল এডিপি বাস্তবায়নযোগ্য নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাও অর্জন সম্ভব হবে না। চলতি অর্থবছরের এডিপির সবটা বাস্তবায়ন হবে না, আমরা ধারণা ৫৪ হাজার কোটি টাকা এ খাতে ব্যয় করা যাবে। সেখানে ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার জন্য যে প্রশাসনিক দক্ষতা দরকার, এক বছরে তা কীভাবে অর্জন হবে?”

অর্থমন্ত্রী বলছেন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি মূলত বছরব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে।

সরকারি হিসেবে, এবার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরেও এই রাজনৈতিক হানাহানিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল রাজনৈতিক হানাহানি কমবে এবং ২০১৭ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যাবে।

এবারও তার আশা রাজনৈতিক সমস্যা কম থাকবে, প্রবৃদ্ধি উচ্চগতি পাবে।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বাজেট বিলে সই করছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

মুহিত বলেন, “চলতি অর্থবছরের প্রথমভাগে আগের বছরের ধারাবাহিকতায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চলতে থাকায় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার ফলে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। ৬ দশমিক ২ শতাংশ হবে।

“আমি অনুকূল আবহাওয়া ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করছি। এ সব অনুমান ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।”

তবে মির্জ্জা আজিজ শতভাগ নিশ্চিত যে, এই প্রবৃদ্ধি হবে না।

“সামগ্রিকভাবে বাজেটে বাস্তবতার অভাব দেখতে পাচ্ছি। কারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ধরা হয়েছে, তা অর্জন অসম্ভব। আমি ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না।”

মুহিতের বাজেট বক্তৃতার বড় অংশজুড়ে ছিল বড় বড় অবকাঠামো তৈরির কথা। বিপুল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হবার কথা।

মন্ত্রী যাকে তার স্বপ্ন বলছেন সেই পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেইনের মহাসড়ক ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছানোর কথাও আছে তার বক্তৃতায়। এই বাজেটে দুই প্রকল্পই পাচ্ছে অগ্রাধিকার। সরকারের মহা পরিকল্পনায় আরো বৃহৎ প্রকল্পের কথাও কিছুদিন ধরে সংবাদ মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। 

তবে গবেষক জায়েদ বখত মনে করছেন, বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি উত্তরণে বিস্তারিত নেই মন্ত্রীর বক্তৃতায়।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা শেষ করছেন, “অনেকেই জানেন যে, আমি কর্মব্যস্ত আশি বছর অতিক্রম করেছি। অর্জন ও ব্যর্থতার দোলাচলে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে আমি কথনও আশাবাদ ব্যক্ত করতে এবং রাখতে কার্পণ্য করিনি।

“আমি আগেও বলেছি যে, কালো মেঘের আড়ালে আমি সোনালি রেখা দেখতে পাই। বাংলাদেশের অপরিমেয় সম্ভাবনার এদেশের তরুনদের মত আমিও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এই অপরিমেয় সম্ভাবনার স্বার্থে আমরা চাই একটি অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র।

“বাংলাদেশের জনগণও প্রতিটি কঠিন সময়ে এই আদর্শে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে গেছেন এবং সাফল্য অর্জন করেছেন। এবারেও তার কোন হেরফের হবে বলে আমি মনে করি না।”

“সেই বিশ্বাসে অটুট থেকে আমি আহ্বান জানাবো আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়ন এবং মঙ্গলের স্বার্থে সব রকম সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে।”

মুহিত বলেন, “আমি স্বীকার করছি আমাদের এই কার‌্যক্রম এবং অর্থায়ন পরিকল্পনা উচ্চাভিলাসী। কিন্তু গত পাঁচ বছরে আমরা প্রমাণ করেছি উচ্চাভিলাষী কার‌্যক্রম আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি।”

“আমাদের বাস্তবায়ন দক্ষতা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। সংশোধিত বাজেটের ৯৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি আমরা।

“এ মেয়াদে আমাদের সরকারের মূল লক্ষ্য হবে রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে আমাদের যা যা করণীয় তা দ্রুত সম্পন্ন করা। আমার বিশ্বাস আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আমাদের সেই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করার উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশ হিসেবে কাজ করবে।”