মুক্তিযুদ্ধের সময় আল বদর বাহিনীর চট্টগ্রামের ‘হেডকোয়ার্টার’ ছিল ডালিম হোটেল। সেখানে বন্দি নির্যাতনের আর্তনাদ আজও তাড়িয়ে বেড়ায় অনেককে।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায়ে আদালত বলেছে, “এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদরের সদস্যদের পরিচালনা এবং নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজেই। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই একটি ডেথ ফ্যাক্টরি ছিল।”
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য আইনি শেষ লড়াইও ব্যর্থ হয়েছে মীর কাসেমের। মঙ্গলবার তার রিভিউ (আপিলের রায় পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ হওয়ায় এখন ফাঁসি কার্যকরের আগে শুধু রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাওয়ার সুযোগই আছে তার জন্য।
রিভিউ খারিজের দিন মহামায়া ভবনে গিয়ে সুনসান নীরবতা দেখা যায়। অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন ভবনটির বাসিন্দারাও মুখ খুলতে নারাজ।
১৩৭৩ বঙ্গাব্দে চন্দ্র মোহন নাথ চট্টগ্রাম শহরের পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে ৬ শতক জমির ওপর তিন তলা ‘মহামায়া ভবন’ নির্মাণ করেন।
তার অনুপস্থিতিতে যুদ্ধের সময় এটি নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আল বদর সদস্যরা।
এখন ওই ভবনের নিচতলায় তিনটি দোকান আছে। তৃতীয় তলায় থাকেন ভাড়াটিয়ারা।
দ্বিতীয় তলায় বাস করেন চন্দ্র মোহন নাথের চার ছেলে বাবুল চন্দ্র নাথ, সুভাষ চন্দ্র নাথ, সুকুরঞ্জন নাথ ও অরুণ চন্দ্র নাথের পরিবার।
দুপুরে ‘মহামায়া ডালিম ভবন’ এ গিয়ে নিচতলার দোকান মালিক ও ভবনের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভবন মালিক চন্দ্র মোহন নাথের সন্তানদের কারও দেখাও মেলেনি। ভবনের নিচতলায় বাবুল চন্দ্র নাথের একটি মুদি দোকান থাকলেও সেটি ছিল বন্ধ।
রায় ঘোষণার পর গণজাগরণ মঞ্চের মিছিল ভবনটির সামনে গেলেও বাসিন্দারা কেউ বেরিয়ে আসেননি।
দ্বিতীয় তলার বাসিন্দারা কেউ গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
বিভীষিকাময় ডালিম হোটেল
একাত্তরের ১৯৭১ সালের জুলাই-অগাস্টে মহামায়া ভবনটি দখল করে নেন চট্টগ্রামের বদর নেতা মীর কাসেম ও তার অনুসারীরা। তখনই ‘মহামায়া ভবনের’ নাম পাল্টে রাখা হয় ‘ডালিম হোটেল’।
ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা একাত্তরে খোলা জিপ ও অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়াত।
তারা বলেন, শহরের কোথাও কোনও মুক্তিযোদ্ধা গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পেলেই মীর কাসেমের নেতৃত্বে বদর বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত।
মীর কাসেমের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সহযোগী ও স্থানীয় হিন্দুদের ধরে সেখানে নিয়ে চালানো হত অমানুষিক নির্যাতন।
চান্দগাঁও এলাকার বাড়ি থেকে একাত্তরের ৩০ নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. এমরানকে ধরে নিয়ে আসে মীর কাসেম ও পাকিস্তানি সেনারা।
ওই হোটেলে মীর কাসেম আলী এলে বদর সদস্যরা ‘ডা. খান আ গ্যায়া..., কাসেম সাব আ গ্যায়া’ বলে হাঁক পাড়ত বলে জানান তিনি।
সৈয়দ মো. এমরান বলেন, আমার বাড়ির ছয়জনসহ মোট ১৪ জনকে ধরে আনা হয়। দোতলার একটি কক্ষে চোখ বেঁধে প্রতিদিন আমার ওপর নির্যাতন চলত।
একাত্তরে মীর কাসেমের নৃশংসতার বর্ণনা দিয়ে এমরান বলেন, তার নিদের্শেই নগ্ন করে পেটানোর পর রক্তাক্ত অবস্থায় অন্ধকার কক্ষে বন্দিদের ফেলে রাখা হত। বিভিন্ন কক্ষ থেকে ভেসে আসত বন্দিদের আর্ত চিৎকার।
“দুদিন পর বাসি খাবার আর পানি চাইলে টয়লেট থেকে বদনায় করে দেওয়া পানি মিলত। অনেককে পানির পরিবর্তে প্রস্রাবও খেতে দেওয়া হয়েছে।”
একাত্তরের ৩০ নভেম্বর আন্দরকিল্লায় গোপন আস্তানা থেকে মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে ধরে নেয় বদর বাহিনী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেখানে নির্যাতনের সময় বন্দিদের আর্তনাদের শব্দ আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।”
১৯৭১ এর ২৩ নভেম্বর নগরীর কদমতলী থেকে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে ধরে নেওয়া হয় ডালিম হোটেলে।
তিনি বলেন, “ওই হোটেলের প্রতিটি কক্ষ থেকে আসত নির্যাতিতদের গোঙানি ও আর্তনাদের আওয়াজ। বদর সদস্যরা আমার ঠোঁট থেঁতলে দিয়েছিল।”
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই মীর কাসেম আলীসহ বদর সদস্যরা ডালিম হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওইদিনই মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণ ডালিম হোটেল থেকে বন্দিদের উদ্ধার করেন।
তথ্যপ্রমাণ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের দাখিল করা ‘প্রামাণ্য দলিল : মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ের তথ্য উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, “আল বদর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যেই।
“এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আল বদরের সদস্যদের পরিচালনা এবং নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজেই। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই একটি ডেথ ফ্যাক্টরি ছিল।”