একাত্তরে ডালিম হোটেল ছিল ‘মৃত্যুপুরী’

যুদ্ধাপরাধে মৃত‌্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অপহরণের পর চট্টগ্রামের যে ভবনে রেখে নির্যাতন চালানো হত, তা আদালতের বিচারে চিহ্নিত হয়েছে ‘মৃত্যুপুরী’ হিসেবে।

মিন্টু চৌধুরীও কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2014, 03:49 PM
Updated : 3 Sept 2016, 06:29 PM

মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের আলবদর প্রধান মীর কাসেমের নেতৃত্বে আন্দরকিল্লার ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে তার নাম পাল্টে ‘ডালিম হোটেল’ রাখা হয়। তার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সহযোগী ও হিন্দুদের ধরে সেখানে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হত।

আসামিপক্ষের দাখিল করা ‘প্রামাণ্য দলিল: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ের তথ্য উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, “আলবদর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যেই।

“এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদরের সদস্যদের পরিচালনা এবং নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজেই। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই ‘ডেথ-ফ্যাক্টরি’ ছিল।”

সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে ধরে এনে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হতো এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হত বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে মামলায় নির্যাতিত অনেকের সাক্ষ্যে উঠেছে।

ডালিম হোটেলে নিয়ে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার ঘটনায় ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছিল।

রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তাকে ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দিলেও জসিম হত্যার ঘটনার ১১ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট।

২০১৬ সালের ৮ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া ওই রায় কাসেম পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও ৩০ অগাস্ট তা খারিজ হয়ে যায়। সব বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ৩ সেপ্টেম্বর শনিবার রাতে এই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর করা হয়।

মীর কাসেম ও তার সহযোগীদের নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে ৪৩ বছর পরও ভয়ে শিউরে উঠেছেন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সৈয়দ মো. এমরানসহ অনেকে।

বদর নেতা মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা একাত্তরে খোলা জিপ ও অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়াতেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন তারা।

দুজনই বলেন, শহরের কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পেলেই মীর কাসেমের নেতৃত্বে বদর বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত।

একাত্তরে যুদ্ধ শুরুর কিছু পরেই জুলাই-অগাস্ট মাসে বদর বাহিনী গঠনের পর পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে অবস্থিত মহামায়া ভবন দখল করে মীর কাসেম ও তার অনুসারীরা।

১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর নগরের কদমতলী এলাকায় কারফিউ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে আটক করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩০ নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. এমরানকে গ্রেপ্তার করা হয় চান্দগাঁও এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে। একইদিন আন্দরকিল্লায় গোপন আস্তানায় বদর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসির উদ্দিন চৌধুরী।

তারা জানান, মীর কাসেমের উপস্থিতিতেই বদর বাহিনীর সদস্যরা চোখ-মুখ-হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটাত, লোহার চেয়ারে বসিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাওয়া হত। নির্যাতনের পর বন্দিরা পানি খেতে চাইলে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হত।

জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী

জাহাঙ্গীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন সময়ে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে নিয়ে গিয়ে নানাভাবে পেটানো হত। প্রায় সব কক্ষ থেকেই দিনের বিভিন্ন সময়ে গোঙানি ও আর্তনাদের আওয়াজ পাওয়া যেত।”

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিন ১৬ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত তারা সেখানে বন্দি ছিলেন বলে জানিয়েছেন এখনও সেই নির্যাতনের চিহ্ন শরীরে বয়ে বেড়ানো এই মুক্তিযোদ্ধারা।

রায়ে বলা হয়, “এইখানে অবৈধভাবে ধরে এনে আটকে রাখা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে তাদের ওপর অত্যন্ত অমানুষিক উপায়ে নিয়মিতভাবে চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হত। অভিযুক্ত মীর কাসেম আলী এই বর্বর ব্যবস্থাটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন।”

একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘ চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন মীর কাসেম। সেই সূত্রে চট্টগ্রামের বদরপ্রধান হিসেবে তার নেতৃত্বেই চলত নির্যাতন। একাত্তরের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক করা হয় তাকে, যা দৃশ্যত তার সক্রিয়তার ওপর স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্থার প্রকাশ।

একাত্তরে ডালিম হোটেলকে ‘জল্লাদখানা’ হিসেবে চিনত চট্টগ্রামের মানুষ। ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল।

নগরীর গুডস হিলসহ আরও কয়েকটি জায়গায় রাজাকার, আল শামস বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র থাকলেও একাত্তরে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডের ডালিম হোটেলই। 

রায়ে বলা হয়, “কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম, টুনটু সেন ও রঞ্জিত দাসকে হত্যাসহ এখানে (ডালিম হোটেলে) পরিচালিত সব ধরনের অপরাধেই তার (মীর কাসেম) প্রত্যক্ষ মদদ ও উৎসাহ ছিল। নিহত বন্দিদের লাশও খুঁজে পায়নি তাদের স্বজনরা।”

রায়ের পর মীর কাসেম আলী

মীর কাসেমের নির্দেশেই মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেককেই অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই চামড়ার গুদাম এলাকায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সৈয়দ মো. এমরান জানান, তিনতলা ভবনের ডালিম হোটেলে বিভিন্ন কক্ষে দুই শতাধিক লোককে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি যে কক্ষে আটক ছিলেন সেখানে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করার কথা শোনেন অন্য বন্দিদের কাছ থেকে।

ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যেও এ কথা বলেছিলেন এমরান, যে হত্যাকাণ্ডের জন্য মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।

ডালিম হোটেলের অন্য কক্ষগুলোতে আরও চার-পাঁচজন বন্দিকে হত্যার পর কর্ণফুলী নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার কথাও শুনেছিলেন বলে এমরান জানান।

রায়ে আরও বলা হয়, ডালিম হোটেলে ঘটে যাওয়া সব ধরনের অপরাধের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন মীর কাসেম। এসব অপরাধে তার ‘কর্তৃত্বপূর্ণ’ অংশগ্রহণও প্রমাণিত। ফলে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪ (২) ধারা অনুযায়ী ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে’র দায়ে দোষী।

মীর কাসেমের তখনকার অবস্থান জানিয়ে নির্যাতিতরা বলেন, তিনি যখন ডালিম হোটেলে ঢুকতেন, তখন পাহারায় থাকা বদর সদস্যরা বলে উঠতেন ‘কাসেম সাব আ গ্যায়া, কমান্ডার সাব আ গ্যায়া’।

বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য না পেলে মীর কাসেমের নির্দেশে নির্যাতনের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যেত বলেও নির্যাতিতরা জানান।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুর দিকে মীর কাসেম ডালিম হোটেলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় বলে বন্দিদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়। ১৪ ডিসেম্বর বদর সদস্যরা ডালিম হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে স্থানীয় লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধারা ডালিম হোটেলের দরজা ভেঙে বন্দিদের উদ্ধার করে।