অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও ছাত্রলীগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স বাতিলের দাবিতে ধর্মঘটী শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্র হাতে চড়াও হয়ে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ ও পুলিশ।

এস এম নাদিম মাহমুদ, রাবি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Feb 2014, 05:01 AM
Updated : 3 Feb 2014, 05:04 PM

ছাত্রলীগকর্মীদের মারধর এবং পুলিশের রাবার বুলেট ও কাঁদুনে গ্যাসে আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী।

রোববার সকাল থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলার সময় ছাত্রলীগকর্মীদের ছোট আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়তেও দেখা যায়।

এ সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় পুলিশের রোষের শিকার হন সাংবাদিকরা।

ছাত্রলীগের ওই হামলার পর ‘বর্ধিত ফি ও সান্ধ্য কোর্স বিরোধী শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে আন্দোলনকারীরা ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলে উত্তেজনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

রাতে সিন্ডিকেটের ওই সিদ্ধান্তের পর আন্দোলকারীদের মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ খোমেনী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আন্দোলন পুনরায় শুরু করবেন তারা।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান, আইন ও কলা অনুষদের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্স চালু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ফি দুই থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

এর প্রতিবাদে গত ১৬ জানুয়ারি থেকে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। দাবি পূরণ না হওয়ায় বৃহস্পতিবার তা ধর্মঘটে গড়ায়।

শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজান উদ্দিন বর্ধিত ফি স্থগিতের ঘোষণা দিলেও তা প্রত্যাহার এবং সেই সঙ্গে সান্ধ্য কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।

রোববার প্রশাসন বর্ধিত ফি প্রত্যাহার করলেও সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সোমবার সকাল ৮টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দেয়।

বিক্ষোভ দিয়ে সকাল শুরু

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কয়েক হাজার শিক্ষার্থী সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সব অ্যাকাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে খন্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে জড়ো হতে থাকে।

সকাল ৯টার দিকে পুলিশ হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবন ও তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের তালা ভেঙে দেয়। তারা রবীন্দ্র কলা ভবন ও শহীদুল্লাহ কলা ভবনের তালা ভাঙার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা।

এক পর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়ে তাদের মাইক কেড়ে নেয়। এরপর প্রক্টর তারিকুল হাসান মিলন এসে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করলে শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের কাছে জড়ো হয়।

এর পরপরই ওই ভবনের পাশে দুটি হাতবোমা বিস্ফোরিত হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।

ছাত্রলীগের হামলা

বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান রানার নেতৃত্বে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা একটি মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এলে পরপর কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

এর পরপরই আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হতে দেখা যায় সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের। প্রশাসন ভবনের পূর্ব পাশ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর তারা ধেয়ে গেলে পশ্চিম দিক থেকে পুলিশও চড়াও হয়।

এক পর্যায়ে আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা ছুটোছুটি শুরু করলে পুলিশের সামনেই তাদের পেটাতে দেখা যায় ছাত্রলীগকর্মীদের।

এরপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে ঘুরতে থাকে। এ সময় আন্দোলনে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীতে তারা মারধর করে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। 

এ সময় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যায়। ছাত্রলীগের মারধরের সময় পুলিশ পুরোপুরি নিরব ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। 

বেলা ১টার দিকে বিভিন্ন  হল থেকে শিক্ষার্থীরা আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে এবারো টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর সিরাজুল ইসলামকেও এসব ঘটনার সময় পুলিশের সঙ্গে দেখা যায়।

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, তাদের আন্দোলন নস্যাত করতে ‘পুলিশের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগকর্মীরা তাদের ওপর এই হামলা চালিয়েছে।

অস্ত্র হাতে যারা

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় পিস্তল হাতে দেখা যায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান ইমন,আল-গালিব ও ফয়সাল আহম্মেদ রুনু,যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবর রহমান পলাশ, নাসিম আহম্মেদ সেতু, পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মুস্তাকিন বিল্লাহ ও সাবেক নেতা সুদীপ্ত সালাম।

এদের মধ্যে অনেককে এর আগে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষে অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল। ওই সময়ও অস্ত্র হাতে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল।

রোষের মুখে সাংবাদিকরা

সাধারণ ছাত্রদের মারধর করা হলেও পুলিশ নীরব কেন জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের পূর্ব জোনের উপকমিশনার প্রলয় চিচিম।

এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য এগিয়ে এসে দুই সাংবাদিককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এবং লাঠিপেটা শুরু করেন। এতে পাঁচ সাংবাদিক আহত হন। রাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি শাকির আহমেদ ও সহ-সভাপতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক এস এম নাদিম মাহমুদের বুকেও শটগান ঠেকান পুলিশ সদস্যরা।

প্রলয় চিচিম পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশেই আমরা অ্যাকশনে গেছি।”

আহত হয়েছেন নিউ এইজ এর রাবি প্রতিনিধি নাজিম মৃধা, শীর্ষ নিউজের জাকির হোসেন তমাল, মানবকণ্ঠের বুলবুল আহমেদ ফাহিম, ফ্লাশ নিউজের জীবন, এবিনিউজের জহিরুল হক মুন।

এছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে আহত হন দৈনিক সোনার দেশের আলোকচিত্র সাংবাদিক রুমি, গুলবার আলী জুয়েল। এর প্রতিবাদে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত তিন সহকারী প্রক্টর ও পুলিশ উপকমিশনার প্রলয় চিচিমকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।

আহত যারা

হাতবোমার স্পিল্টার, গুলি ও রাবার বুলেটে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন অমিত গোস্বামী, তারিন আক্তার, স্বপন, রাজিব, তাওহিদ হোসেন, বিলকিস নাহার, আতিক আহম্মেদ, শোভন আহম্মেদ, সালমা আক্তার, মায়া, আশুরা, রবিউল ইসলাম, পরাগ হোসেন, আশিকুর রহমান আশিক, রাখি আক্তার, সাজু সর্দার, আবদুর রশিদ, যুথি আক্তার। তাদেরকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

হামলার প্রতিক্রিয়া

তাপস পাল নামের এক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনারা বলেন, ‘আমরা সবাই ছাত্রলীগ, নেতা মোদের শেখ মুজিব’, আপনারা কি জানেন শেখ মুজিব তার ছাত্রত্ব হারিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য আন্দোলন করার কারণে? আর আপনারা নিজেদের আন্দোলনটাও বোঝেন না।”

ছাত্রলীগের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আঁতাত হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “প্রশাসনের সাথে হাত মিলিয়ে আপনারা যে নিজেদের ক্ষতি করলেন এটা কি একবারও উপলব্ধি করেন না আপনারা?”

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম ও ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান বকশী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা সমর্থন দিয়ে হামলা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নায্য দাবি আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে, আমরা তাদেরকে ধিক্কার জানাই।”

ছাত্রলীগ বর্ধিত ফি ও সান্ধ্য কোর্স বাতিলের দাবিতে মিছিল-সমাবেশ করেছিল ইতোপূর্বে। তিন দিন আগে তারা এই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে স্মারকলিপিও দিয়েছিল।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই পরিবারের বাবা। তিনি কিভাবে তার সন্তানদেরকে ওই সব গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে মার খাওয়াতে পারেন, তা আজ গোটা জাতি দেখল,” বলেন সুফিয়ান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “যেভাবে আজ হামলা হলো- সেটা নজিরবিহীন। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি আমাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে।”

ছাত্রলীগের বক্তব্য

হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী এই হামলায় জড়িত নয়। ইসলামী ছাত্রশিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে।”

ছাত্রলীগের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রচার সম্পাদক জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, “আমাদের কোনো নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেনি। সেই ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ওপর হামলার তো প্রশ্নই আসে না।”

হামলাকারীদের ছবি গণমাধ্যমে আসার কথাও বলেন তিনি।

হামলাকারীদের ছবি প্রকাশের কথা তুলে ধরলে মিজান বলেন, “ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী এই ঘটনায় জড়িত থাকে, সেই ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

ছাত্রলীগকর্মীদের দিকে ইট ছোড়া হয়েছিল দাবি করে মিজান বলেন, “কেউ যখন আপনাকে আঘাত করবে আপনি কি নিশ্চুপ থাকবেন? আমাদের নেতা-কর্মীরাও তাই আমাদের ওপর হামলা এড়াতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে মাত্র।”