পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ‘ষড়যন্ত্র’ যে হয়েছিল, সে বিষয়ে একমত হলেও কার কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে- তা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি দুদক ও বিশ্ব ব্যাংক পর্যবেক্ষক দলের।
Published : 06 Dec 2012, 04:01 AM
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ‘ষড়যন্ত্র’ যে হয়েছিল, সে বিষয়ে একমত বিশ্ব ব্যাংক ও পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে কার কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে- সে বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান।
বুধবার দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের পর রাতেই ঢাকা ত্যাগ করেন লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন এই পর্যবেক্ষক দলের তিন সদস্য।
তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান জানিয়েছেন, অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কয়েকজনের বিরুদ্ধে দু’এক দিনের মধ্যে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
তবে তার আগে অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন আবারো পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর বুধবারই মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কথা জানিয়েছিল দুদক।
গোলাম রহমান মঙ্গলবার বলেছিলেন, অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে ‘ঘুষ’ লেনদেনের ‘ষড়যন্ত্রের’ জন্য বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে।
বুধবার বিশ্ব ব্যাংক পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে দু দফা বৈঠকে বসেন দুদক কর্মকর্তারা। বিশ্ব ব্যাংক প্যানেলের সদস্যরা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গেও আলোচনা করেন।
বিশ্ব ব্যাংক প্যানেলের সদস্যরা দুদক ছাড়ার পর গোলাম রহমান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।
সুপারিশ অনুযায়ী চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দুই-এক দিনের মধ্যে আইনি ব্যবস্থা নেব।”
অভিযুক্তের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে না বললেও তিনি মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, এই সংখ্যা ১০ এর কম।
প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের এই পর্যন্ত যা অনুসন্ধান হয়েছে, পুরো বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনার পর কমিশন এই বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করবে।”
এ ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখানে সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। আমাদের আইনি কাঠামোর মধ্যে যদি তাদের কোনো পরামর্শ থাকে, তবে তা বিবেচনা করা হবে।”
এই প্রসঙ্গে গোলাম রহমান বলেন, এখানে অনেক বিষয় রয়েছে, যা এখন প্রকাশ করা সমীচীন হবে না।
বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা সফল কি না- জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “প্যানেল আমাদের কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করেছে। আমরা কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করেছি।”
মঙ্গলবার অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “অর্থের আদান-প্রদান হয়নি। অর্থ বিনিময়ের জন্য একটি আলোচনা হয়েছিল, যাকে আমরা ষড়যন্ত্র বলছি।”
তিনি বলেন, দুর্নীতির ‘ষড়যন্ত্র’ যে হয়েছিল, সে বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও দুদক একমত।
তবে কার কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে- সেই বিষয়ে মতৈক্য এখনো হয়নি জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “ইনক্লুশন অ্যান্ড এক্সক্লুশনের বিষয়ে আমাদের মধ্যে এখনো মতভেদ রয়েছে।”
বুধবারের বৈঠকে ওই মতভেদ দূর হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
বুধবার দুদক চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় সেগুন বাগিচার কমিশন কার্যালয় ছাড়ার সময় ওকাম্পো সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “দুদক প্রশংসনীয় কাজ করছে। আমাদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।”
“আর কিছু বলা নেই’ জানিয়ে ওকাম্পো বলেন, এখন তিনি বিমানবন্দর রওনা হচ্ছেন। তার সঙ্গে ছিলেন প্যানেলের অন্য দুই সদস্য টিমোথি টং ও রিচার্ড অল্ডারম্যান।
প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার বিষয়ে বুধবার দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের ফাঁকে ওকাম্পো ও তার প্যানেলের সদস্যরা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গেও আলোচনা করেন।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে এই প্যানেলের সদস্যদের সঙ্গে দুদকে গিয়েছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইনও।
ঘণ্টাখানেক পর তারা সবাই যান মিন্টো রোডে অর্থমন্ত্রীর বাড়িতে। সেখানে দুই ঘণ্টা আলোচনার পর পুনরায় দুদকে ফেরেন ওকাম্পোরা তিনজন, তবে ফেরেননি গোল্ডস্টেইন।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে দুদক ছাড়ার সময় গোল্ডস্টেইন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এখনো আলোচনা করছেন তারা। আলোচনা শেষ হলে কিছু বলতে পারবেন।
অর্থমন্ত্রীর বাড়িতে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেই বিষয়ে মুখ খোলেননি কেউ। ওকাম্পো সাংবাদিকদের সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।
ওই বৈঠকে থাকা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর কাছে বৈঠকের আলোচনা জানতে চাওয়া হলে ‘অর্থমন্ত্রী বলবেন’ বলে তিনিও সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান।
মুহিত নিজে ‘নো কমেন্ট’ বলে সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেছেন।
পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা সফরে আসে বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল।
তাদের ঢাকায় অবস্থানের মধ্যেই মঙ্গলবার সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক কর্মকর্তারা, প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর যাকে পদত্যাগ করতে হয়।
মঙ্গলবার সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, যিনি প্রকল্পের কাজের বিষয়ে এসএনসি লাভালিনের পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন বলে দাবি করেছেন আবুল হোসেন।
কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৯১ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করেছিল বিশ্ব ব্যাংক।
সরকার ও তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের পক্ষ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করা হলেও অনড় থাকে বিশ্ব ব্যাংক এবং তার ধারাবাহিকতায় গত জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে।
এরপর আবুল হোসেনের পদত্যাগ, প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজর মসিউর রহমান ও সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে ছুটিতে পাঠানোসহ সরকারের নানামুখী তৎপরতায় বিশ্ব ব্যাংক সিদ্ধান্ত বদলায়।
তবে দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে ওকাম্পোর নেতৃত্বে পর্যবেক্ষক দল গঠন করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করছে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন।